Pages

Saturday, 13 September 2025

বিহার: ইন্ডিয়া জোটের পরীক্ষা

এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক 

কল্যাণ সেনগুপ্ত



বিহার নির্বাচন ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। ইতিমধ্যে রাহুল, তেজস্বী ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে এবং ইন্ডিয়া জোটের আরও বহু নেতার যোগদানে বিহারের একটা বড় অংশে (ভোট চুরি বন্ধে) যাত্রা বেশ খানিকটা সাড়া ফেলেছে। তবে এর ফলেই জয় নিশ্চিত, বলা সম্ভব নয়। ভোটের দিন বুথ লেভেলে কী ঘটে এবং প্রকৃত ভোটারদের সবার নাম শেষ পর্যন্ত তালিকায় স্থান পায় কিনা ও ভোট প্রদানপর্ব শান্তিপূর্ণ রূপে সাঙ্গ হয় কিনা, এসবের উপরেই নির্ভর করছে ভোটের ফলাফল। ভোটের নোটিস জারি হবার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারই সর্বশক্তিমান। তাঁর কথাই আইন এবং তাহাই চূড়ান্ত। এখন সবার কাছেই এটা পরিষ্কার যে, বিজেপিকে জেতাতে তিনি কোনও কিছুরই তোয়াক্কা করবেন না। এমনই এক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ভরসা শুধুমাত্র সাধারণ মানুষের রাস্তায় নেমে ঐক্যবদ্ধ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে এবং তা একমাত্র সম্ভব যদি ইন্ডিয়া জোট তথা সমস্ত বিরোধী পক্ষ ঐক্যবদ্ধ থাকে।

বিহার নির্বাচনকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে সর্বাধিক জরুরি বিষয় হচ্ছে, প্রকৃত ভোটারদের নাম যেন কোনওভাবেই বাদ না যায়, সেটি নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তারা কী রায় দেয় বা নির্বাচন কমিশন শেষ পর্যন্ত তা কতখানি মানে, সবটাই এখন ভবিষ্যতের গর্ভে। কারণ, নির্বাচন কমিশন যতখানি আগ্রাসী ভূমিকা পালনে ব্যগ্র, তা সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করার সাহসী মনোভাব দেখাতে কি সক্ষম হবে সর্বোচ্চ আদালত? বিষয়টি যথেষ্ট আশঙ্কার। তবে, দ্বাদশ নথি হিসেবে আধার কার্ডকে গণ্য করার সুপ্রিম নির্দেশ নির্বাচন কমিশন শেষমেশ মানতে বাধ্য হয়েছে। তবুও, যদি প্রতিকূল পরিস্থিতির উদয় হয়, তা বদল ঘটাতে পারে একমাত্র গণ জাগরণ এবং তা অবশ্যই হতে হবে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। এর সামান্য বিচ্যুতি হলেই দমন পীড়ন নামিয়ে আনবে সুযোগের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে থাকা হিংস্র শাসক। অবশ্য শান্তিপূর্ণ অহিংস আন্দোলনকেও কীভাবে ঝামেলায় জড়ানো যায় তার সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা দেখলাম, বিহারের 'ভোটার অধিকার যাত্রা' অভিযানের পথে নেতাবিহীন ফাঁকা মঞ্চের সুযোগ নিয়ে মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি কর্মীর কংগ্রেসি ভেক ধরে মোদীর মায়ের নামে গালি দিয়ে হাঙ্গামা বাঁধাবার সুচতুর প্রয়াসে। অতএব, সাধু সাবধান।

বর্তমান কঠিন পরিস্থিতিতে মোদিরাজকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারলে দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্র শুধু নয়, এ যাবৎ টিকে থাকা যেটুকু বা যা কিছু শুভ অবশিষ্ট আছে, সবই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশেষত বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যে যে ভাবে বাংলা ভাষী, অর্থাৎ, বাংলায় কথা বলার অপরাধে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, অত্যাচার করছে, থানায় বা অন্য কোথাও আটকে রাখা হচ্ছে, তা অতীতে কখনই হয়নি। সেখানকার পুলিশ কোনওরকম প্রমাণপত্র যেমন, আধার বা ভোটার কার্ড কিছুই মানছে না, সব নকল বলে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে। এমনই গা-জোয়ারি বেআইনি কার্যকলাপ ও চরম হেনস্থা করা হচ্ছে ভিন্ন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া গরিব খেটে খাওয়া বাঙালি, বিশেষত মুসলমানদের। বহু মুসলমানকে পুশ ব্যাক করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে। কাউকে কাউকে জেভিসি মেশিনের সাহায্যে সীমান্তের কাঁটাতারের উপর দিয়ে ওপারে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, মাঝসমুদ্রে নিয়ে গিয়েও ফেলে দিচ্ছে। এই সমস্ত ঘটনাই হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের নানাবিধ অত্যাচারের কথা মনে করিয়ে দেয়। ভাষণ দিয়ে, সাধারণভাবে প্রচার করে সোজা রাস্তায় বাংলা জয় সম্ভব নয় বুঝে এখন ভয় দেখিয়ে চূড়ান্ত আতঙ্কিত করে বাঙালিকে পদানত করার চেষ্টা চলছে। বাংলার মানুষ অবশ্য সে সব বুঝে নেবেন ঠিকই, কিন্তু তা হয়তো অনেকটা কঠিন হয়ে যাবে যদি বিজেপি বিহারে জিতে যায়। ফলে, বাংলাকে বিজেপির হাত থেকে রক্ষা পেতে হলে বিহারে বিজেপির পরাজয়কে নিশ্চিত করতেই হবে। সে কারণেই বিজেপির বিরুদ্ধে ইন্ডিয়া জোটের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ জরুরি।

খুব শিগগিরই হয়তো বিহারে নির্বাচনী বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। ফলে, এখনই সব দলকে ভোট প্রক্রিয়ার ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এখন আর সময় নেই ইন্ডিয়া জোটের সাংগঠনিক বৈঠক করার। সুতরাং, ইন্ডিয়া জোট শরিকদের মধ্যে নির্বিঘ্নে আসন বণ্টন এখন সর্বাধিক জরুরি। এই পর্বটি বেশ কঠিন ও গোলমেলে। কিন্তু তবুও প্রত্যেককেই খানিক ত্যাগ স্বীকার করে বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান আবশ্যিক। এরপরেই জরুরি হচ্ছে ভোটার তালিকায় প্রকৃত ভোটারদের নাম রক্ষার লড়াই। সেটির সুষ্ঠু সমাধান হলে তখন নামতে হবে বুথ রক্ষার লড়াইয়ে এবং পরবর্তী দায়িত্ব হবে গৃহীত মতদান পূর্ণ ইভিএম সমূহের সংরক্ষণ কেন্দ্রে পাহারাদারি। অতঃপর ভোট গণনা কেন্দ্রে সঠিক রূপে গণনা প্রক্রিয়া সম্পন্ন ও ফল ঘোষণা এবং জয়ের শংসাপত্র গ্রহণ। উপরোক্ত প্রতিটি পর্বে কমিশনের তরফে গড়বড়ির আশঙ্কা পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান এবং এর তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী আছে অনেকেই। বিহারে ২০২০ সালের নির্বাচনেও বিজেপি জেতেনি এমন বেশ কয়েকটি আসনে জয়ী প্রার্থীকে বহুক্ষণ বসিয়ে রেখে শেষমেশ বলা হয়, তুমি হেরে গেছ। এভাবে গা জোয়াড়ি করে জেতা প্রার্থীকে পরাজিত ও হারা প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। এটা  করা সম্ভব হয়েছে কারণ, সেবার বিরোধী পক্ষ যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ ও এ বিষয়ে আদৌ সজাগ ছিল না। এবার কিন্তু ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে, বিরোধীরা এখন ঐক্যবদ্ধ ও সজাগ।

বিহারের নির্বাচন বর্তমানে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে এসে উপস্থিত। সামনে হয় গভীর অন্ধকার খাদ, নয়তো এক আলোকিত মুক্তির পথ। ফলে, এসপার-ওসপারের লড়াইয়ে নামা ছাড়া উপায় নেই। মনে রাখা জরুরি, কোনওক্রমেও বিজেপি বিহারে জয় হাসিল করতে সক্ষম হলে দমন পীড়ন চালিয়ে যে কোনও প্রকারেই হোক তারা বাংলার দখল নেবেই। সে কারণেই বিহারের প্রচারে বিরোধী নেতাদের ঐক্যবদ্ধ চেহারা তুলে ধরাটা অতীব জরুরি। পাটনার গান্ধী ময়দানে ইন্ডিয়া জোটের সাম্প্রতিক মহাসমাবেশ এক ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে।

দেশকে রক্ষা করতে হলে মোদি শাসনের কালা অধ্যায়ের অবসান চাই দ্রুত। এ বিষয়ে কোনওরকম গাফিলতি দেশের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। বিপদ বুঝলে তারা যে কোনও সময় যে কোনও ভয়ঙ্কর পথ অবলম্বন করতে পারে, এমনকি প্রয়োজনে জরুরি অবস্থা জারি করে সমস্ত বিরোধীপক্ষের নেতাদের জেলে পুরলে তখন পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র সব ধ্বংস হয়ে যাবে। 

মাথায় রাখতে হবে, শক্তিশালী ইন্ডিয়া জোট ভিন্ন আর এই মুহূর্তে অন্য কোনও উপায়ই নেই। ফলে, সব কিছু ধ্বংস হওয়ার আগেই সমস্ত বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, পুনর্গঠিত করতে হবে ইন্ডিয়া জোটকে সাংগঠনিক রূপে এবং বিস্তৃত ও আলোচিত এক প্রকৃত জনমুখি কর্মসূচির প্রস্তাবকে গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ রূপায়ণের লক্ষ্যে এগোতে হবে। ইতিমধ্যেই বিরোধী পক্ষ সুযোগ হারিয়ে নিজেদের ভুলে হরিয়ানা, দিল্লি ও মহারাষ্ট্র হাতছাড়া করেছে। তাই, মনে রাখতে হবে, 'বেটার লেট দ্যান নেভার'। 

এ বিষয়ে ইন্ডিয়া জোটের প্রধান স্তম্ভ ও জাতীয় বড় দল কংগ্রেসের দায়দায়িত্ব অনেক বেশি। এই দলের সামান্য বিচ্যুতি আমাদের ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে। সে কারণেই মনে রাখা জরুরি যে, আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাসের কাছে এ বিষয়ে দায়বদ্ধ।


1 comment:

  1. বাহঃ, বেশ স্পষ্ট ভাবে ই লেখক বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন এবং সাধারণ মানুষের আশু কর্তব্যটিও বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, এই লেখাটি আরো অনেক মানুষের পড়া উচিত , ছড়ি য়ে দেওয়া উচিত

    ReplyDelete