Pages

Wednesday, 9 April 2025

জাল ওষুধের কারবার (২)

সরকারের সঙ্গে অশুভ আঁতাত

প্রদীপ রায়



দ্বিতীয় কিস্তি

স্বাস্থ্য মন্ত্রকের অধীনে গঠিত 'সেন্ট্রাল ড্রাগস স্ট্যান্ডার্ড কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন' জাতীয় স্তরে ওষুধ শিল্পের নিয়ন্ত্রক। রাজ্য স্তরে এই নিয়ন্ত্রক সংস্থার নাম 'রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল'। উভয়ের কাজ নতুন দোকানের লাইসেন্স দেওয়া, লাইসেন্স পুনর্নবীকরণ করা, ওষুধের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠানো যেখানে ওষুধের কার্যকারিতা ও গুণমান বিচার করা হয়। এছাড়াও, আইন মোতাবেক ওষুধের বিপণন হচ্ছে কিনা, তা দেখা। উভয়েই পরীক্ষার জন্য ওষুধ পাঠায় যথাক্রমে সেন্ট্রাল ড্রাগ ল্যাবরেটরি ও রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। সিডিএসসিও'র পূর্বাঞ্চলের শাখা অফিস কলকাতায়, যার অধীনে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও রয়েছে বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, সিকিম ও আন্দামান নিকোবর। বর্তমানে এই অফিসে চারজন পরিদর্শক রয়েছেন যাদের নজরদারির এলাকা উপরোক্ত সব রাজ্যে। আবার রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল'এর পরিদর্শকের ৫২টি পদ খালি, দীর্ঘদিন কোনও পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা নেই। ২০১৮'র পর কোনও নতুন নিয়োগও হয়নি। উপরন্তু, পরীক্ষাগারের চেহারাটা ভয়াবহ। উন্নত প্রযুক্তির অভাবে মান্ধাতা আমলের যন্ত্রপাতি দিয়েই ওষুধের গুণমান পরীক্ষা করতে হয়। টেকনিশিয়ানের সংখ্যা মাত্র ১২। ফলে, পরীক্ষার ফল আসতে অনেক সময় লাগে। দেরিতে রিপোর্ট আসার দরুণ জাল ওষুধের কারবারীরা তথ্য লোপাটের সুযোগ পায়। জেলার প্রান্তিক এলাকায় যে ওষুধ বিক্রি হয় তার ওপর নজরদারি সম্ভবপর নয়, ফলে, জাল ওষুধের রমরমাও ওই এলাকাগুলিতে। কেন্দ্র বা রাজ্য স্তরের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সমূহের পরিকাঠামোর কঙ্কালসার চেহারাই জাল ওষুধ কারবারীদের ব্যবসার পুঁজি।  

ওষুধ কোম্পানির স্বার্থ ও রোগীর স্বার্থের সংঘাত বহু আলোচিত একটি সমস্যা, যেখানে রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হয় নাগরিকদের কাছে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার তাগিদে। এই সমস্যাকে মান্যতা দিতে ১৯৭০ সালে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের অধীনে চালু হয়েছিল ড্রাগ প্রাইস কন্ট্রোল অর্ডার (ডিপিসিও)। কিন্তু অস্বচ্ছতা ও দিকনির্দেশের অভাবে 'ডিপিসিও ১৯৭০' কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। এরপর হাতি কমিটির সুপারিশ মাথায় রেখে 'ডিপিসিও ১৯৭৯' চালু হয়। ৩৭৪টি আকরিক ওষুধ দ্বারা নির্মিত দেশের ৯০ শতাংশ ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ওষুধগুলিকে চারটি ভাগে ভাগ করে প্রতিটি ভাগের ওষুধের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়া হয়-- 

প্রথম ভাগ: জীবনদায়ী ওষুধ। দাম নির্ধারণ হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ৪০ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে; 

দ্বিতীয় ভাগ: অত্যাবশ্যক ওষুধ। দাম নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ৫৫ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে;

তৃতীয় ভাগ: স্বল্প প্রয়োজনীয় ওষুধ। দাম নির্ধারণ করা হয় উৎপাদন মূল্যের ওপর ১০০ শতাংশ মুনাফার হার যুক্ত করে;

চতুর্থ ভাগ: মূল্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এর জন্য নির্দিষ্ট ফর্মূলা তৈরি হয়। এই আদেশের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয় আদালতে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলির তরফে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। এমনকি জীবনদায়ী ওষুধের উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশীয় ওষুধ কোম্পানিগুলি ছিল দুর্বল ও অসংগঠিত। 

এরপর চালু হয় 'ডিপিসিও ১৯৮৭', যেখানে ৩৭৪টি আকরিক ওষুধের পরিবর্তে ১৪২টি আকরিক ওষুধকে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয়। ফলে, পূর্বের ৯০ শতাংশের পরিবর্তে ৭০ শতাংশ ওষুধ মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে। চারটি বিভাগের পরিবর্তে দুটি বিভাগে ওষুধ নিয়ে এসে ওষুধের দামের মুনাফার হার স্থির হয় যথাক্রমে ৭৫ ও ১০০ শতাংশ হারে। 

বাজার অর্থনীতিকে মূলমন্ত্র করে গত শতাব্দীর নয়ের দশকে শুরু হয়েছিল আর্থিক সংস্কার। পেটেন্ট আইনের পরিবর্তন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগদান, ওষুধ নীতির পরিবর্তন সবই ঘটতে থাকে বাজার অর্থনীতির চাহিদা পূরণে। এরপর তৈরি হয় 'ডিপিসিও ১৯৯৫'। এতে মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে আসা হয় ১৪২টির পরিবর্তে ৭৪টি আকরিক ওষুধকে এবং তার দ্বারা নির্মিত ওষুধগুলিকেও। ফলে, মূল্য নিয়ন্ত্রণের আওতাভুক্ত হয় দেশের ৩০ শতাংশ ওষুধ। ওষুধের বাজারে প্রতিযোগিতার দোহাই দিয়ে বেশির ভাগ ওষুধের মুল্যকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে আসা হয়। ওষুধের মূল্যের বিনিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতি শুরু হল জোরকদমে। 

এরপর জারি হয় 'ডিপিসিও ২০১৩'। এই আদেশের বৈশিষ্ট্য হল, ৩৪৮টি মৌল বা আকরিক ওষুধ ও তার দ্বারা প্রস্তুত ৬৫০টি ব্র্যান্ডকে অত্যাবশ্যক জাতীয় তালিকাভুক্ত (ন্যাশনাল লিস্ট অফ এসেন্সিয়াল মেডিসিন বা এনএলইএম) করা। সিদ্ধান্ত হল, এই তালিকাভুক্ত ওষুধ ও তার নির্দিষ্ট  মাত্রার (ডোজেজ ফর্ম) ওষুধের দাম নির্ধারিত হবে এই ওষুধে যে ব্র্যান্ডগুলো ১ শতাংশ বা তার অধিক বাজার দখল করেছে তাদের সাধারণ গড় মূল্য ধরে। অপর একটি শর্তে বলা হয়, সরকারি অনুমতি ব্যতিরেকেই উৎপাদক সংস্থাগুলো পাইকারি দরের সূচককে ভিত্তি করে প্রতি বছর নিয়ন্ত্রিত ওষুধের সর্বোচ্চ দর পুনর্নির্মাণ করতে পারবে। বর্তমানে তা স্থির হয়েছে ১০ শতাংশে এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও ১.৭৪ শতাংশ। ফলে, ওষুধের মূল্য নির্ধারণ নীতির ক্রমবিবর্তন শুরু হয়। উৎপাদন-ব্যয় ভিত্তিক দাম নির্ধারণের বদলে বাজারের শক্তিকে ভিত্তি করে নতুন নীতি চালু হয়। বলা হয়, বাজার সর্বশক্তিমান এবং বাজারই পারে ক্রেতা ও বিক্রেতার উভয়ের স্বার্থকে সুরক্ষিত রাখতে। নিম্নোক্ত উদাহরণে ব্যাপারটা বোঝা যাবে, যদিও তুলনাটা 'ডিপিসিও ১৯৯৫' এবং 'ডিপিসিও ২০১৩'কে ধরে। 


বর্তমানে এই ওষুধগুলোর দাম অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

যে পণ্য নির্বাচনে ক্রেতার অধিকার সামান্যই এবং যে বাজার ক্রেতার অগম্য, তথ্যের অসমতার দরুণ সেখানে বাজারের শক্তি ক্রেতার স্বার্থ কতটা সুরক্ষিত করে তা সহজেই অনুমেয়। এতদসত্ত্বেও গত কয়েক বছরে বহু প্রচলিত ৪১টি ফর্মূলার ওষুধের দাম তিন দফায় প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ওষুধ কোম্পানির মালিকদের দাবি, আকরিক ওষুধের দাম বেড়েছে তাই ওষুধের দাম বাড়ানোয় সরকারি হস্তক্ষেপ চলবে না। অথচ, এই মালিকরাই কোম্পানির কর্মচারীদের মজুরি বৃদ্ধির প্রশমনে মহার্ঘ্য ভাতা বা উপযুক্ত বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেন না।

বর্তমান বাজারে মোট বিক্রিত ওষুধের মূল্যের বিচারে মাত্র ১৪ শতাংশ বা আয়তনের বিচারে ২৫ শতাংশ ওষুধের দামে নিয়ন্ত্রণ কার্যকরী। অর্থাৎ, চালু ওষুধের এক বিশাল অংশই বিনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর মুনাফা জোগানের উৎস হিসাবে বিদ্যমান। এর সঙ্গে ১৮-২৮ শতাংশ জিএসটি ওষুধ বিশেষের ওপর যুক্ত হওয়ায় ওষুধ আরও মহার্ঘ্য হয়েছে। 

এমন একটা শক্তিশালী শিল্পকে ঘিরে চলেছে বিস্তর অনৈতিক কর্মকাণ্ড। একদিকে শিল্প মালিকদের সঙ্গে সরকারের অশুভ আঁতাত, যা নগ্ন হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত নির্বাচনী ফান্ডে শাসক দলকে দেওয়া অঢেল টাকার বন্ড কেনায়। প্রতিদানে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য নিয়ন্ত্রণের বিধিনিষেধ শিথিল হয়েছে। অপরদিকে নজরদারির অভাবে এই শিল্পকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক বিশাল ব্যবসার কারবার। জাল বা নকল অথবা নিম্নমানের ওষুধ চিহ্নিত করা চিকিৎসক বা ক্রেতা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কোনও তাৎক্ষণিক দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। 

সরকারের দ্বারা ওষুধ নামক পণ্যটিকে যদি অন্যান্য পণ্যের চাইতে আলাদা ভাবে দেখার প্রয়োজনীয়তা না অনুভূত হয়, তবে এই দুষ্টচক্র চলতেই থাকবে, যার মূল্য জীবনের বিনিময়ে নাগরিককে দিতে হবে।

শেষ...

প্রথম কিস্তির লিঙ্কhttps://www.ekakmatra.in/ekak-matra-spurious-drug-1/


No comments:

Post a Comment