Pages

Thursday, 3 April 2025

'পরিপূরক শুল্কের' গুঁতোয়

ভারত কি শুধু দেখবে?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল ২০২৫’কে ‘মুক্তির দিন’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। অস্যার্থ, ওইদিন তিনি মার্কিন জনগণকে বিশ্বের অর্থনৈতিক জাঁতাকল থেকে মুক্তি দেবেন। ‘আমেরিকাকে আবার সেরা বানানো’র অভিলাষে তিনি ওইদিন নিজ দেশে বিদেশি আমদানির ওপর এমন শুল্ক চাপাবেন যে বাকী দেশ সব হাহাকার রবে পিষ্ট হবে এবং ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে তাঁর চরণতলে আছাড়িবিছাড়ি খাবে! বিশেষ করে চীন, কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ভারতকে (প্রিয় বন্ধুবর মোদীজীর কথা ভুলে মেরে) এমন শিক্ষা দেবেন যে এরপর আর আমেরিকাকে তার চলার পথে কেউ রুখতে পারবে না।

ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প যে ভাবে গ্রিনল্যান্ড ও কানাডা’কে নিজের দেশে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের তামাম আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে প্যারিস চুক্তি থেকে সটান পিঠটান দিয়েছিলেন, ধরে ধরে ‘বেআইনি’ অভিবাসীদের প্লেনে তুলে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন (ভারতীয়দের হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে), সরকারি কর্মচারীদের লাটে ছাঁটাই করছিলেন, এমনকী বিচারকদের ‘মার্কিনী স্বার্থ’ বিষয়ে সবক শেখাচ্ছিলেন, এলন মাস্কের বাচ্চা ছেলে নাক খুঁটে তাঁর টেবিলে হাত রাখলে সেই ১৫০ বছরের পুরনো রাষ্ট্রপতির টেবিলটাকে পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন, সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত এলন মাস্ক’এর টেসলা গাড়ি এক পিস কিনে বন্ধুকৃত্য অবধি করেছিলেন, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে এমন এক ‘ম্যানিয়াক’ লোককে আমেরিকার মানুষজন এমনি এমনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত করেননি (অনেকটা ঠিক হিটলারের নির্বাচনের মতো)। আমেরিকার অর্থনীতি যে ধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, ভেতরটা একেবারে ছিবড়ে, দেশে হু হু করে বাড়ছে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, বিশ্ব জুড়ে জোগান-শৃঙ্খলে আমেরিকান ব্র্যান্ড বলে আর কিছুই নাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নবরঙে আমেরিকা ক্রমশই পিছিয়ে পড়ছে, তখন খুব স্বাভাবিক যে অতি-জাতীয়তার শীৎকারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হওয়া ছাড়া তাদের আর তেমন কিছু করারও ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এই একই ঘটনা জার্মানিতেও ঘটেছিল ‘ভার্সাই চুক্তি’ পরবর্তী হিটলারের অভ্যুদয়ে। বাকীটা ইতিহাস। তবে, ইতিহাসের নাকি পুনরাবৃত্তি হয় না বলে বলা হয়ে থাকে, তথাপি যদি হয়, তাহলে তা কেমনতর সে বিষয়েও মহাজনেদের মতামত সুবিদিত।

তবুও, ২ এপ্রিল ট্রাম্প সাহেব সত্যি সত্যিই ‘reciprocal tariff’ বা ‘পরিপূরক শুল্ক’ সম্পর্কে বেশ এক বড় ঘোষণা দিলেন! হোয়াইট হাউজের রোজ গার্ডেনে সাংবাদিকদের সামনে হাতে একটি বোর্ড তুলে ধরে সেখান থেকে পড়ে পড়ে তিনি কয়েকটি দেশের নাম করে তাদের ওপর চাপানো শুল্কের হার বেশ সদর্পে ঘোষণা করলেন। যেমন, প্রথমেই বললেন চীনের নাম এবং তাদের ওপর শুল্ক চাপানোর হার ৩৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি শুল্ক চাপানো হল কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের ওপর যথাক্রমে ৪৯, ৪৬ ও ৩৬ শতাংশ হারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ইংল্যান্ড’ও বাদ যায়নি, তাদের ওপর চাপানো হার যথাক্রমে ২০ ও ১০ শতাংশ। আর ভারত? ভারতের ওপর মোদীজীর অতি প্রিয় বন্ধু ট্রাম্পের শুল্ক হার চাপলো ২৬ শতাংশ। এবং এই প্রতিটি শুল্কই নাকি ‘ডিসকাউন্ট’এ দেওয়া, আসল হার আরও বেশি (উনি সে সব কমিয়ে দিয়েছেন)। ভারতের কথা বলতে গিয়ে তিনি অবলীলায় বললেন, ‘very tough, very tough’। অর্থাৎ, তিনি বোঝালেন যে, তাদের দেশের পণ্য যদি অন্য দেশে উচ্চ শুল্ক হারের কোপে পড়ে দুর্মূল্য হয়, তাহলে তিনিও সে দেশের পণ্যকে উচ্চ শুল্ক হারের গুঁতো দিয়েই সবক শেখাবেন। একদা মুক্ত বাণিজ্য ও বিশ্বায়নের ধ্বজা ওড়ানো দেশ আমেরিকা কি সত্যিই কোনও বিপদে পড়ল যে উলটো পথে হেঁটে এখন দুয়ার আঁটা ছাড়া তার সামনে আর কোনও উপায় নেই?

বলাই বাহুল্য, এই নতুন ‘পরিপূরক শুল্ক’র দাপটে প্রায় প্রতিটি দেশই যারপরনাই ক্ষুব্ধ ও তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক ভাবে ট্রাম্পের অত্যন্ত কাছের জন, ইতালির চরম দক্ষিণপন্থী প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি পর্যন্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ওপর চাপিয়ে দেওয়া শুল্ক হারের কড়া ভাষায় নিন্দা করেছেন। চীনের বিদেশ মন্ত্রক তো তীব্র ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেছে যে, মার্কিন দেশের এই শুল্ক নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য রীতিকে লঙ্ঘন করছে এবং চীন নিজেদের অধিকার ও স্বার্থরক্ষায় এর বিরুদ্ধে পালটা ব্যবস্থা নিয়ে শেষ পর্যন্ত এই বাণিজ্য যুদ্ধে লড়ে যাবে। পাশাপাশি, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে জাপান, ইউকে থেকে অস্ট্রেলিয়া— প্রায় প্রত্যেকটি দেশই এই নীতির নিন্দা করেছে। অথচ, একমাত্র ভারতই এখনও পর্যন্ত গলা তুলে তেমন উচ্চবাচ্য কিছু বলেনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী আমতা আমতা করে জানিয়েছেন যে বিষয়টি ভেবে দেখার মতো(!)। অবশ্য, এর প্রকোপে ভারতীয় শেয়ার বাজার আজ (৩ এপ্রিল ২০২৫) দিনের শুরুতেই ভালই গোত্তা খেয়েছে এবং দিনের শেষে এসে সেনসেক্স’এর পতন ৩২২ পয়েন্ট। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ শুল্ক হার ভারতীয় শিল্পের এক বড় অংশকে বেশ বিপদে ফেলে দিয়েছে। ভারত এখন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এলন মাস্ক’এর টেসলা গাড়ির ওপর ১১০ শতাংশের শুল্ক প্রত্যাহার করে তুষ্টিকরণের রাজনীতি করবে, নাকি, অন্যান্য দেশগুলির মতো চোখে চোখ রেখে আমেরিকার রক্ষণশীল অর্থনীতির সমালোচনা করার হিম্মত দেখাবে, তা ‘ডোলান’ ট্রাম্পের বিশ্বস্ত বন্ধু মোদীজীই জানেন।

তবে এ কথা অনস্বীকার্য, ট্রাম্পের নয়া শুল্ক নীতি বিশ্বের অর্থনৈতিক শৃঙ্খলে এক আমূল পরিবর্তন আনবে এবং আমেরিকার পক্ষে তা অশনি সংকেত। আজ কোনও পণ্যের ওপরেই কোনও দেশের একচেটিয়া অধিকার আর মান্যতা পায় না, কারণ, বিশ্বায়নের ফলে যে অর্থনৈতিক জোগান-শৃঙ্খল তৈরি হয়েছে, সেখানে একেকটি দেশে একেকরকম পণ্যাংশ নির্মিত হয়ে আরেক দেশে গিয়ে assembled হয়। ফলে, কোনও পণ্যেরই আজ সে অর্থে নিজ দেশ নেই, কোনও পণ্যকেই বলা যাবে না যে তা অমুক দেশের। নিজে একজন সফল ব্যবসায়ী হয়ে ট্রাম্প কি আজকের অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের এই খবরটুকু রাখেন না? তা বিশ্বাস করা কঠিন। আসলে, বিশ্ব বাজারে আমেরিকা আজ ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তাঁর নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সঙ্গীন। প্রযুক্তি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সঙ্গী করে অর্থনৈতিক বিজয় রথে চীন আজ অনেকটাই এগিয়ে গেছে। পাশাপাশি, আজকের বিশ্ব বাজারেও চীন নানান উপায়ে নিজেদের উপস্থিতিকে আরও গ্রহণীয়, লাভজনক ও সর্বজনীন করে তুলেছে। ইতিমধ্যেই ভিয়েতনাম ও চীনে প্রচুর পরিমাণে রফতানিমূলক ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্র গড়ে ওঠায় তারা বিশ্বকে বহুল পরিমাণে সস্তায় পণ্যের জোগান দিতে পারছে, যেখানে আমেরিকার পক্ষে নতুন করে সেই জায়গায় পৌঁছনো আর সম্ভব নয়; কারণ, তাদের দেশের বড় বড় কোম্পানিগুলিও উক্ত দেশগুলিতে (এমনকি তাইওয়ান’এও) ম্যানুফ্যাকচারিং হাবকে রফতানি করে নিজ দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং অর্থনীতির সক্ষমতাকে ইতিমধ্যেই খুইয়ে বসে আছে। অথচ ট্রাম্পের মনে হয়েছে, এখন পথ বিদেশের পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক চাপিয়ে তাদের দুর্মূল্য করে তুলে নিজের দেশের উৎপন্ন পণ্যগুলিকে আপেক্ষিক সস্তা দরে ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন করে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব গড়ে তোলা ও আমেরিকাবাসীকে কাজ দেওয়া। কিন্তু পুঁজিবাদের আবহে এর ফলে যে মুদ্রাস্ফীতি ও অকর্মণ্যতা চেপে বসবে সে কথা তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা এইভাবেই ভেবে থাকেন এবং শুরুতে জনতার বেশ বাহবাও পান, তারপর আমরা জানি, সে সব কল্পকথা কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতের মোট রফতানির ১৮ শতাংশ আমেরিকার সঙ্গে। ২৬ শতাংশ শুল্ক চেপে বসায় এই রফতানি নিশ্চিত ভাবে ধাক্কা খাবে। বিশেষ করে, আইটি, ওষুধ, পোশাক, গাড়ি ও অলঙ্কার— এইসব শিল্প  বেশ কঠিন সমস্যার মুখোমুখি হবে বলে অনুমান। তবে বিশ্বায়নের আবহে আমেরিকা যদি সত্যি সত্যিই মুক্ত বাণিজ্য ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিকে অস্বীকার করে, তার বিপ্রতীপে আজ অনেকগুলি দেশ এক জায়গায় এসে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে পড়ছে যে নতুন কোনও অর্থনৈতিক অক্ষরেখা গড়ে ওঠাটা অবান্তর কিছু নয় আর। হয়তো দেখা যাবে, ডলারের সে জোরও আর আগামী দিনে থাকবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, ভারত এই জায়মান গতিশীলতাকে কতটা বুঝতে ও ধারণ করতে সক্ষম। কারণ, আমাদের বর্তমান শাসকও তো সমান ভাবেই উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী, যাদের বরং ট্রাম্পের অমূলক চিন্তার সঙ্গে ভালো মেলে।

           

1 comment:

  1. পড়ে ভালো লাগলো, ধন্যবাদ

    ReplyDelete