Pages

Friday, 22 November 2024

জালিয়াত আদানি?

এবার খোদ মার্কিন আদালত!

পার্থ হালদার



ইতিমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিন ভারতের বাণিজ্য জগতে আদানির তুমুল উপস্থিতি দেখেছি, এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সুদূর আমেরিকাতেও আদানি-সরগরম টের পাওয়া যাচ্ছে। ভাবলাম, টিনটিনের স্রষ্টা যদি বেঁচে থাকতেন, টিনটিনের দ্বিতীয় খণ্ড তিনি হয়তো লিখতে শুরু করতেন আমেরিকায় আদানি রহস্যের ওপর।

গতকাল বাজার খুলতেই যা ঘটবার তাই ঘটল, আদানির কোম্পানিগুলির পতন প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তার জেরে নিফটি পতন প্রায় ২০০ পয়েন্টেরও বেশি ও অন্যান্য ছোটখাটো শেয়ার প্রায় ধরাশায়ী। কারণ, এবার আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ জানিয়েছে খোদ মার্কিন প্রশাসন। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে গৌতম আদানির ভাইপো এবং আরও কিছু নাম। অভিযোগ, সোলার ইলেকট্রিসিটি চুক্তি আদায়ের জন্য আদানির তরফে বিভিন্ন সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ২৬৫ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২০০০ কোটি টাকার বেশি) ঘুষ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা FBI তদন্ত করে প্রামাণ্য তথ্য পেয়েছে। 

এ সম্পর্কে বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধী শুধুমাত্র তাঁর নিজ শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেননি, আদানির গ্রেফতার ও ভারতীয় তদন্ত সংস্থাদের দিয়ে তদন্ত করারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও বিরুদ্ধে। মোদী ও আদানির যূথবদ্ধতায় 'মোদানি জোট' যে ভারতবর্ষের কাছে ভয়ঙ্করতম এক বিপদ হয়ে উঠেছে, সে ব্যাপারেও তিনি দেশের মানুষকে সাবধান হতে বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এ দেশে আর্থিক দুনীতির জন্য যদি বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতারা জেলে যেতে পারেন তাহলে দেশে-বিদেশে এত বড় আর্থিক দুর্নীতির কারিগর কীভাবে এখনও দেশের মাটিতে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! এ প্রসঙ্গে রাহুল সেবি চেয়ারম্যান মাধবী পুরী বুচ'এর পূর্ববর্তী অভিযোগের প্রসঙ্গও টেনে আনেন।

গৌতম আদানি করেছেন'টা কী যে তার উপর এইভাবে মার্কিন প্রশাসন ও আদালত খড়্গহস্ত? সংক্ষেপে তা এইরকম:

১) নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ সংস্থা Azure Power এবং Adani Green Power ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা Solar Energy Corporation of India (SECI)'র সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে একটি অনৈতিক চুক্তি করতে প্ররোচিত ও বাধ্য করে। এই প্ররোচনা ও বাধ্যতা আদায় করা হয় বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের বিপুল উৎকোচ জুগিয়ে যার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি;

২) কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে Azure Power ও Adani Green Power'এর নিজেদের উৎপাদিত সৌরশক্তি থেকে SECI'কে যথাক্রমে ৪ ও ৮ গিগাওয়াট শক্তি বিক্রি করার কথা যা আবার SECI'র থেকে রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কিনবে। কিন্তু এই সৌরশক্তির মূল্য এতটাই বেশি যে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি ওই দামে এই শক্তি কিনতে রাজী হচ্ছিল না। অতএব, আদানি গোষ্ঠী এবার টাকার থলি নিয়ে নেমে পড়ল এবং বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের ঘুষ দিয়ে তাদের বাধ্য করল SECI'র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি কিনতে;

৩) ফলে, যদি উক্ত দুই গোষ্ঠী (Azure ও আদানি) SECI'কে নিজেদের নির্ধারিত উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি নিয়মিত বেচতে পারে এবং তা সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কেনে, তাহলে আগামী ২০ বছরে এই বেচাকেনায় তাদের মুনাফা হতে পারে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

অর্থাৎ, এ এমন এক মুনাফাবাজি যেখানে সরকারি সংস্থাগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেশি অর্থ দিয়ে দুই কর্পোরেট বাণিজ্যপতির সৌরশক্তির বাণিজ্যকে পুষ্ট করতে। আর এ তো হামেশাই হচ্ছে! বিশেষত যখন বারবার আদানির বিরুদ্ধে প্রায় সর্বত্র এই অভিযোগ আসছে, তখনও তার পরম মিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রমুগ্ধ মৌনতা অবলম্বন করে তাকে পারাপার হতে সাহায্য করছেন।

কিন্তু, মার্কিন দেশের প্রশাসন ও আদালতের এ নিয়ে মাথাব্যথা কেন? কারণ, এইসব তঞ্চকতা করে ও উৎকোচ দিয়ে মুনাফা হাতাবার যে জালিয়াতি, তাতে জড়িয়ে পড়েছে ওই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের বিপুল অর্থ (আগেই বলেছি, Azure Power নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ একটি সংস্থা)। উপরন্তু, আদানিদের ৪টি সংস্থা মার্কিন দেশ থেকে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ তুলেছে এই সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য ও বয়ান দিয়ে এবং সরকারি আমলাদের উৎকোচ প্রদানের কথা স্বীকারই করেনি। অর্থাৎ, মার্কিন দেশের বিপুল বিনিয়োগকে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে, US Securities Exchange Commission (SEC) এই জালিয়াতির জন্য উক্ত দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে Foreign Corruption Prevention Act (FCPA)'এর আওতায় আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে। আমেরিকার Dept of Justice উত্থাপিত সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখে উল্লিখিত দুই সংস্থার বিরুদ্ধে পাঁচটি তির বিঁধেছে: ১) FCPA উল্লঙ্ঘনের ষড়যন্ত্র ২) বন্ড জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৩) ডিজিটাল জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৪) ২০২১ সালের বন্ড জালিয়াতি ও ৫) বিচারকে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র।

২০২৩'এ হিন্ডেনবার্গ উত্থাপিত অভিযোগগুলির সঙ্গে এবারের অভিযোগগুলির মূল তফাত হল, হিন্ডেনবার্গ ছিল একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক সংস্থা কিন্তু এবারে অভিযোগ এসেছে সরাসরি মার্কিন প্রশাসন ও আদালতের তরফ থেকে যেখানে নির্দিষ্ট ভাবে আইনকে লঙ্ঘন করার মামলা দায়ের হয়েছে। শুধু তাই নয়, গৌতম আদানি ও সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি হয়েছে। এবার সময় এসেছে অতীত এবং আজকের এই ঘটনাকে একত্রিত করে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করার। কেবলমাত্র ধর্মীয় ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে একচেটিয়া পুঁজিবাদ মানে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের শিকড় ধীরে ধীরে মজবুত হচ্ছে কিনা তা বোঝার আছে। কারণ, এই একচেটিয়া পুঁজিবাদই আগামী দিনে জন্ম দেবে নব্য ফ্যাসিবাদের। প্রতিযোগিতার যোগ্যতা যদি ঘুষের টাকার কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে তাহলে আমরা একচেটিয়া পুঁজি ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। তাছাড়া এই মুহূর্তে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার যে কটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যাবে। 

আদানি গোষ্ঠী যে কোনও ভাবেই হোক, হিন্ডনবার্গ ও অন্যান্যদের অভিযোগের আবহেই নিজেদের কর্মকাণ্ড এখনও বহাল রেখেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়টি হল, হিন্ডেনবার্গ কাণ্ডের পর থেকে তাদের 'আদানি এন্টারপ্রাইজ'এর শেয়ারের দাম কিন্তু সর্বোচ্চ দামের থেকে অনেক নিচে এবং ক্রমাগত নিম্নগামীই হতে থেকেছে। শেয়ার বাজার বড় বিচিত্র জায়গা, যদি কোনও সংস্থাকে বাজার নিজেই শাস্তি দিতে এগিয়ে আসে, তা বড় নির্মম। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সুদিনের আশায়  রইলাম।

সুখবর হল, আদানির জালিয়াতি সামনে আসার পরেই কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি তাঁর দেশের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর বিমানবন্দর ও শক্তি ক্ষেত্রে মোট যে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ছিল তা সপাটে বাতিল করেছেন। আজ সপ্তাহের শেষ কর্মদিনের অন্তে দেখার আছে, আদানির শেয়ার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু ইতিমধ্যে তদন্তে যে জালিয়াতি উদ্ঘাটিত হয়েছে ও এর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন সবিশেষ কৌতূহলের বিষয়! 


2 comments:

  1. লেখাটা খুবই তথ্যভিত্তিক আর ভালো, যদিও SEBI-angle টা misssing। সেটা Sucheta Dalal এখানে বিশদ আলোচনা করেছেন। যদিও ইংরিজিতে। https://youtu.be/6NMzAjLgf-A?feature=shared

    ReplyDelete
  2. আমি একটুও আশাবাদী নই। IPL নিয়ে ললিত মোদী scam এর কি পরিণতি হয়েছে - কেউ যদি একটু জানাতে পারেন। অনেক গুলো বছর পেরিয়ে গেছে। উনি বিদেশে বসে বগল বাজাচ্ছেন।

    ReplyDelete