Pages

Wednesday, 27 November 2024

প্রসাধনী অস্ত্রোপচার?

‘বাম বিকল্প’ কেন এখনও দূরে

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১০-১৫ বছর ধরে এ রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরে তিন-চারটি শব্দ বা শব্দবন্ধ বার বার করে শোনা যায়: রক্তক্ষরণ, ঘুরে দাঁড়ানো, বাম বিকল্প, পাকা চুল, তরুণ নেতৃত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব শব্দগুচ্ছ কেন্দ্রিক বিবিধ আলোচনা চলতেই থাকে, প্রকৃতির নিয়মে বছরও ঘুরে যায়, কিন্তু উচ্চারণ ও চর্চায় ইতি পড়ে না। এ কি নিছকই মুদ্রাদোষ, নাকি গোড়ায় গলদ?

বঙ্গে এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ দলটি নির্বাচনের হিসেবে শূন্যের গেরোয় আটকা পড়েছে! কেউ বলছেন ‘আর্যভট্টের দশা’। চরম আশাবাদীরা বলেন, হবে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে। দিন যায়, রাত যায়, এক ধ্রুবক রাশির মতো ‘০’ লেপ্টে থাকে। অতএব, বিষয়টি রীতিমতো কৌতূহলোদ্দীপক এবং অভিনব।

কে না জানে, সংসদীয় গণতন্ত্রে কোনও এক সময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের রাজ্যপাট যায়, বিরোধী আসনে তাদের অধিষ্ঠান হয়, কিন্তু একেবারে শূন্য হয়ে যায় কী? যায়; যখন সমকালীন রাজনীতিতে তাদের প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকলাপের মেয়াদ ক্রমেই বিলীন ও অবসাদগ্রস্ত হতে থাকে। এক সময়ে ‘স্বতন্ত্র পার্টি’ নামে একটি দল এ দেশে বেশ সচল ছিল, রাজাগোপালাচারী, মিনু মাসানি প্রমুখেরা গড়ে তোলেন, আজ সে দলের আর অস্তিত্বই নেই; অথবা ‘মুসলিম লিগ’। কিন্তু তা বলে সিপিএম বা তাদের সহযোগী দলগুলির কি এ রাজ্যে এরকমই করুণ অবস্থা যে তাদের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে? না, তেমনটা বলা অসমীচীন। কারণ, নির্বাচনী রাজনীতিতে তাদের ভোটের অঙ্ক ক্রমেই তলানিতে এসে ঠেকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা মোটেই ফুরিয়ে যায়নি। ‘বাম’ আদর্শ বলে যে নীতিসমূহ এখনও জনমানসে উজ্জ্বল, তার প্রাসঙ্গিকতা বা কার্যকারিতা ফুরোয় তো নিই, বরং তার আরও ব্যাপ্তি ও বহর বেড়েছে। যা ঘটেছে তা হল, হাইজ্যাক। বাম দলগুলির রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কার্যকলাপ বাকী দলগুলির (মূলত শাসক ও প্রধান বিরোধী দল) কাছে গচ্ছিত পড়েছে। অর্থাৎ, তাদের কিছু রসদ (ভাবনা, ইস্যু, কর্মসূচি, প্রোগ্রাম) যেমন গেছে ওদের কাছে, ওদেরও কিছু এসেছে তাদের কাছে। এই লেনদেনের সমীকরণেই আসল গেরো লুকিয়ে!

ফলে, মানুষের কাছে শুধুমাত্র গিয়ে, ভাষণ দিয়ে অথবা তরুণ বয়সীদের নেতৃত্বে এনে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় খিল্লি আর হৈচৈ করে প্রসাধনী অস্ত্রোপচারে রক্তক্ষরণ যে বন্ধ হবে না, তা বলাই বাহুল্য। কারণ, সমস্যাটা মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের নয়, সমস্যাটা অন্তর্বস্তুতেই; অর্থাৎ, কী বিষয় নিয়ে মানুষের কাছে যাওয়া হচ্ছে, সেই বিষয়ের সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যাপন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কোনও সম্পর্ক আছে কিনা, দেশকাল, রাজনীতি, অর্থনীতির বাস্তবতা সেই সব বিষয় থেকে সমাধানের কোনও আশু পথ পাচ্ছে কিনা— এইগুলিই মুখ্য বিচার্য বা গ্রহণযোগ্যতার চাবিকাঠি। এই সময়ে এ রাজ্যের বামেদের গোড়াতেই গলদ এইখানে যে, তারা শত কসরত করে যে বিষয়গুলিকে মানুষের কাছে উপস্থিত করছে তার কোনও গ্রহণযোগ্যতাই তৈরি হচ্ছে না। অস্যার্থে, তারা মানুষের কাছে হাজির হতে পারছে না তা নয়, তারা মানুষকে যে কথাগুলি বলছে, তার মধ্যেই একটা ভ্রান্তি ও দূরত্ব থেকে যাচ্ছে!

১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে বাম দলগুলি যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলে, তার তীব্র অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের এক কটূ প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন বিরোধী দল নেতা জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ভাড়া তো মাত্র এক পয়সা বেড়েছে— কিন্তু প্রশ্নটা সেখানে নয়, প্রশ্নটা কার পকেটের পয়সা কার পকেটে যাচ্ছে (তখনও ট্রাম কোম্পানি ব্রিটিশ মালিকানাধীন একটি বেসরকারি সংস্থা)। সে সময়ের এই শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিটাই আজ বামেরা খুইয়েছে। এখনও তারা সিঙ্গুরে টাটা’র ন্যানো প্রকল্প নিয়ে হা-হুতাশ করে, বিশ্বাস করে যে উন্নততর প্রযুক্তির এই আধুনিক সময়েও বৃহৎ শিল্প হলেই যথেষ্ট কর্মসংস্থান হবে, এমনকি উর্বর কৃষি অঞ্চলেও, যেখানে ইতিমধ্যেই হাজারও মানুষ কৃষিকর্মে নিয়োজিত (সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুর মামলায় প্রশ্ন তুলেছিল, ১৯,০০০ কৃষিজীবীকে উৎখাত করে ১২০০ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্মসৃষ্টি কি আদপে কর্মসংস্থানের প্রসার না হরণ?)। অর্থাৎ, কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্প স্থাপনের যে স্বপ্ন শিল্পপতি বা কর্পোরেট হাউজ দেখে এবং তাকেই ‘উন্নয়নের’ সোপান হিসেবে মনে করে, সেই পথকে সাবেক বামেরাও শিরোধার্য করেছে। সে আতান্তর থেকে তারা আজও বেরতে পারেনি।

ফলে, লগ্নি ও কর্মসংস্থানের আন্তঃসম্পর্ক ও সমবৃদ্ধির তত্ত্ব ও তথ্য আজ যে আধুনিক প্রযুক্তি-যুগে, বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই আগ্রাসী সময়ে একেবারেই অচল, সে পাঠ তাদের এখনও মেলেনি। আর সেই সূত্রেই তারা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না যে, আধুনিক কালে নিয়মিত চাকরির তেমন কোনও সুযোগও নেই, কারণ, কাজের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে। কাজের যে সুযোগ মিলছে তা অনিয়মিত, স্বল্পস্থায়ী ও বহু ক্ষেত্রে পার্টনার মডেলে। তাহলে মানুষের দিন চলবে কেমনে? এই প্রশ্নের মোকাবিলায় বামেদের কাছে গত একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে যে উত্তরটি মজুত আছে তা হল: বিপ্লব। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চালকেরা এর মধ্যেই বুঝে ফেলেছেন কালের অন্তর্নিহিত গতি: যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে জগতের ভার চলে যায়, মনুষ্য-শ্রমকে প্রতিস্থাপিত করে ফেলে humanoid robot, ফলত সমাজে আরও বেশি উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হয়, তাহলে সেই উদ্বৃত্তের একটা অংশ প্রত্যক নাগরিকের হাতে তুলেই দেওয়া যেতে পারে। একেই কেউ কেউ বলেন ‘Universal Basic Income’ বা ‘Citizens’ Dividend’, যার আংশিক রূপ আজ আমরা দেশ জুড়ে দেখছি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, লাডলি বহিন, মাইয়া সম্মান, কৃষক বন্ধু প্রকল্প ইত্যাদির মাধ্যমে যেখানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নাগরিকদের কাছে নগদ হস্তান্তরের নীতি রাজনৈতিক অর্থনীতির এক প্রধান প্রবাহ হয়ে উঠেছে। অথচ, এই নগদ হস্তান্তরকে সাবেক বামেরা ‘ভিক্ষাবৃত্তি’, ‘ডোলের রাজনীতি’, ‘পাইয়ে দেওয়া’ ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দিয়ে কালের নিদানকেই বুঝতে অস্বীকার করেছে। তাদের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি লুপ্ত হওয়ায় তারা ধরতেই পারেনি যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও শ্রমজীবী মানুষেরা সাধারণ ভাবে স্বল্প বা প্রায় বিনা মজুরিতেই কাজ করে থাকেন। সেই বিচারে এই অর্থ প্রাপ্তি তাদের ন্যায্য হক (citizens’ dividend)। বরং বামেদের উচিত ছিল, নগদ হস্তান্তরের এই প্রবণতাকে universal basic income প্রবর্তনের অভিমুখে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলা এবং মজুরি দাসত্ব থেকে মুক্তির আন্দোলনে শ্রমজীবী মানুষকে সামিল করা। সেটা না করার অর্থ, বাম রসদকে হাইজ্যাক হতে দেওয়া!

এ ব্যতীত, বিচিত্র হলেও সত্য যে, এ রাজ্যে সাবেক বামেদের এক বড় অংশ হিন্দুত্ববাদী প্রচারে প্রভাবিত হয়ে মুসলমান বিদ্বেষকেই জাতীয় মুক্তির পথ ধরে নিয়ে দলে দলে বিজেপির ভোট বাক্সে সমবেত হয়ে পড়ল। কেউ কেউ বলেন, এর মধ্যে আসলে লুকিয়ে ছিল তীব্র মমতা-বিদ্বেষ। কিন্তু খানিক গভীরে গিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এই উগ্র হিন্দুবাদের প্রতি তাদের আকর্ষণ কর্পোরেট পুঁজির প্রতি আস্থার মনোভাব এবং পুঁজি-লগ্নির পথ ধরে অর্থনৈতিক বিকাশের ভাবনার মধ্যেই সুপ্ত। বিশেষ করে সাবেক বাম নেতৃত্বে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য থাকায় তারা খুব সহজেই কর্পোরেট পুঁজির প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়ে এবং ততদিনে কেন্দ্রে বিজেপিও এই পুঁজির সহজাত তল্পিবাহক হয়ে ওঠায় তারা বিজেপির সঙ্গে মানসিক ভাবে যে আত্মীয়তাবোধ অনুভব করে সেখানে হিন্দুত্ববাদী বয়ান ও মুসলমান বিদ্বেষ এবং মমতা-অসূয়া পরস্পরের সঙ্গে মিলেমিশে এক নতুন রাজনৈতিক দিগন্ত নির্মাণ করে। এই পরিসর থেকে বেরিয়ে আসাটা সাবেক বামেদের পক্ষে দুরূহ, যদি না তারা নিজেদের ঝুঁটি ধরে নাড়া দেয়! সে ক্ষেত্রে তাদের বহু আচরণ ও কার্যক্রম তৃণমূল দলের মতো দেখাতে পারে, এই আশঙ্কাও প্রবল। অর্থাৎ, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে স্বাগত জানালে অথবা তীব্র ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করলে, নিন্দুকেরা তাদের ‘চটিচাটা’ বলে দেগে দিতে পারে (যেমন তারা নিজেরা অন্যদের প্রতি হামেশাই করে থাকে)। এই ঝুঁকি নিতে পারার রাজনৈতিক সাহস তাদের এখনও হয়নি। ফলে, কর্মসংস্থানের গালগল্পে ভরা বৃহৎ পুঁজি অনুসৃত ‘শিল্প গড়ে ওঠা’র একমাত্রিক আবর্তেই তারা এখনও বদ্ধ।

তাই, স্থিতাবস্থা বজায় রয়। প্রসাধনী অস্ত্রোপচারের গুরুত্ব বাড়ে। ডিজিটাল কুশীলব ভাড়া করার তোড়জোড় চলে, কিন্তু content বা অন্তর্বস্তুতে পরিবর্তন কই? বিজেপির প্রচারগুলিকে একপ্রকার ছড়িয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যকে ক্রমেই বিসর্জন দেওয়া চলতে থাকে! বিদেশি রাষ্ট্র বাংলাদেশে চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করলে তাদের কর্মী ও সমর্থকেরা উঠেপড়ে যে ভাবে বিজেপির প্রচারগুলিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে তার এক কণা রা’ও কাড়তে দেখি না উত্তরপ্রদেশের সম্বলে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে। এইভাবেই কি পোক্ত হচ্ছে নিজেদের কবরখানা আর উর্বর হচ্ছে বিদ্বেষ বিষ? পশ্চিমবঙ্গ ক্রমেই আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যাচ্ছে দুটি বৃহৎ রাজনৈতিক পরিসরে। ‘বাম বিকল্প’ কি আপাতত এক মরীচিকা?

      

Friday, 22 November 2024

জালিয়াত আদানি?

এবার খোদ মার্কিন আদালত!

পার্থ হালদার



ইতিমধ্যেই খবর ছড়িয়ে পড়েছে। এতদিন ভারতের বাণিজ্য জগতে আদানির তুমুল উপস্থিতি দেখেছি, এখন দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সুদূর আমেরিকাতেও আদানি-সরগরম টের পাওয়া যাচ্ছে। ভাবলাম, টিনটিনের স্রষ্টা যদি বেঁচে থাকতেন, টিনটিনের দ্বিতীয় খণ্ড তিনি হয়তো লিখতে শুরু করতেন আমেরিকায় আদানি রহস্যের ওপর।

গতকাল বাজার খুলতেই যা ঘটবার তাই ঘটল, আদানির কোম্পানিগুলির পতন প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে গেল। তার জেরে নিফটি পতন প্রায় ২০০ পয়েন্টেরও বেশি ও অন্যান্য ছোটখাটো শেয়ার প্রায় ধরাশায়ী। কারণ, এবার আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ জানিয়েছে খোদ মার্কিন প্রশাসন। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে গৌতম আদানির ভাইপো এবং আরও কিছু নাম। অভিযোগ, সোলার ইলেকট্রিসিটি চুক্তি আদায়ের জন্য আদানির তরফে বিভিন্ন সরকারি কর্তাব্যক্তিদের ২৬৫ মিলিয়ন ডলার (ভারতীয় মুদ্রায় ২০০০ কোটি টাকার বেশি) ঘুষ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা FBI তদন্ত করে প্রামাণ্য তথ্য পেয়েছে। 

এ সম্পর্কে বিরোধী দল নেতা রাহুল গান্ধী শুধুমাত্র তাঁর নিজ শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেননি, আদানির গ্রেফতার ও ভারতীয় তদন্ত সংস্থাদের দিয়ে তদন্ত করারও দাবি জানিয়েছেন। তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীরও বিরুদ্ধে। মোদী ও আদানির যূথবদ্ধতায় 'মোদানি জোট' যে ভারতবর্ষের কাছে ভয়ঙ্করতম এক বিপদ হয়ে উঠেছে, সে ব্যাপারেও তিনি দেশের মানুষকে সাবধান হতে বলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এ দেশে আর্থিক দুনীতির জন্য যদি বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতারা জেলে যেতে পারেন তাহলে দেশে-বিদেশে এত বড় আর্থিক দুর্নীতির কারিগর কীভাবে এখনও দেশের মাটিতে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন! এ প্রসঙ্গে রাহুল সেবি চেয়ারম্যান মাধবী পুরী বুচ'এর পূর্ববর্তী অভিযোগের প্রসঙ্গও টেনে আনেন।

গৌতম আদানি করেছেন'টা কী যে তার উপর এইভাবে মার্কিন প্রশাসন ও আদালত খড়্গহস্ত? সংক্ষেপে তা এইরকম:

১) নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ সংস্থা Azure Power এবং Adani Green Power ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা Solar Energy Corporation of India (SECI)'র সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলিকে একটি অনৈতিক চুক্তি করতে প্ররোচিত ও বাধ্য করে। এই প্ররোচনা ও বাধ্যতা আদায় করা হয় বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের বিপুল উৎকোচ জুগিয়ে যার পরিমাণ ২০০০ কোটি টাকার বেশি;

২) কারণ, এই চুক্তি বাস্তবায়িত হলে Azure Power ও Adani Green Power'এর নিজেদের উৎপাদিত সৌরশক্তি থেকে SECI'কে যথাক্রমে ৪ ও ৮ গিগাওয়াট শক্তি বিক্রি করার কথা যা আবার SECI'র থেকে রাজ্য সরকারের বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কিনবে। কিন্তু এই সৌরশক্তির মূল্য এতটাই বেশি যে সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি ওই দামে এই শক্তি কিনতে রাজী হচ্ছিল না। অতএব, আদানি গোষ্ঠী এবার টাকার থলি নিয়ে নেমে পড়ল এবং বিদ্যুৎ সংস্থাগুলির আমলাদের ঘুষ দিয়ে তাদের বাধ্য করল SECI'র সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি কিনতে;

৩) ফলে, যদি উক্ত দুই গোষ্ঠী (Azure ও আদানি) SECI'কে নিজেদের নির্ধারিত উচ্চমূল্যে সৌরশক্তি নিয়মিত বেচতে পারে এবং তা সরকারি বিদ্যুৎ সংস্থাগুলি কেনে, তাহলে আগামী ২০ বছরে এই বেচাকেনায় তাদের মুনাফা হতে পারে ২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

অর্থাৎ, এ এমন এক মুনাফাবাজি যেখানে সরকারি সংস্থাগুলিকে বাধ্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেশি অর্থ দিয়ে দুই কর্পোরেট বাণিজ্যপতির সৌরশক্তির বাণিজ্যকে পুষ্ট করতে। আর এ তো হামেশাই হচ্ছে! বিশেষত যখন বারবার আদানির বিরুদ্ধে প্রায় সর্বত্র এই অভিযোগ আসছে, তখনও তার পরম মিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রমুগ্ধ মৌনতা অবলম্বন করে তাকে পারাপার হতে সাহায্য করছেন।

কিন্তু, মার্কিন দেশের প্রশাসন ও আদালতের এ নিয়ে মাথাব্যথা কেন? কারণ, এইসব তঞ্চকতা করে ও উৎকোচ দিয়ে মুনাফা হাতাবার যে জালিয়াতি, তাতে জড়িয়ে পড়েছে ওই দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের বিপুল অর্থ (আগেই বলেছি, Azure Power নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিবদ্ধ একটি সংস্থা)। উপরন্তু, আদানিদের ৪টি সংস্থা মার্কিন দেশ থেকে ১.৩৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ তুলেছে এই সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্য ও বয়ান দিয়ে এবং সরকারি আমলাদের উৎকোচ প্রদানের কথা স্বীকারই করেনি। অর্থাৎ, মার্কিন দেশের বিপুল বিনিয়োগকে এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। ফলে, US Securities Exchange Commission (SEC) এই জালিয়াতির জন্য উক্ত দুই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে Foreign Corruption Prevention Act (FCPA)'এর আওতায় আদালতে অভিযোগ দায়ের করেছে। আমেরিকার Dept of Justice উত্থাপিত সমস্ত অভিযোগ খতিয়ে দেখে উল্লিখিত দুই সংস্থার বিরুদ্ধে পাঁচটি তির বিঁধেছে: ১) FCPA উল্লঙ্ঘনের ষড়যন্ত্র ২) বন্ড জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৩) ডিজিটাল জালিয়াতি ষড়যন্ত্র ৪) ২০২১ সালের বন্ড জালিয়াতি ও ৫) বিচারকে বাধা দেওয়ার ষড়যন্ত্র।

২০২৩'এ হিন্ডেনবার্গ উত্থাপিত অভিযোগগুলির সঙ্গে এবারের অভিযোগগুলির মূল তফাত হল, হিন্ডেনবার্গ ছিল একটি বেসরকারি ব্যবসায়িক সংস্থা কিন্তু এবারে অভিযোগ এসেছে সরাসরি মার্কিন প্রশাসন ও আদালতের তরফ থেকে যেখানে নির্দিষ্ট ভাবে আইনকে লঙ্ঘন করার মামলা দায়ের হয়েছে। শুধু তাই নয়, গৌতম আদানি ও সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা পর্যন্ত জারি হয়েছে। এবার সময় এসেছে অতীত এবং আজকের এই ঘটনাকে একত্রিত করে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ করার। কেবলমাত্র ধর্মীয় ভেদাভেদের উপর ভিত্তি করে একচেটিয়া পুঁজিবাদ মানে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের শিকড় ধীরে ধীরে মজবুত হচ্ছে কিনা তা বোঝার আছে। কারণ, এই একচেটিয়া পুঁজিবাদই আগামী দিনে জন্ম দেবে নব্য ফ্যাসিবাদের। প্রতিযোগিতার যোগ্যতা যদি ঘুষের টাকার কাছে নতি স্বীকার করতে শুরু করে তাহলে আমরা একচেটিয়া পুঁজি ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না। তাছাড়া এই মুহূর্তে ভারতীয় গণতন্ত্রকে রক্ষা করার যে কটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে যাবে। 

আদানি গোষ্ঠী যে কোনও ভাবেই হোক, হিন্ডনবার্গ ও অন্যান্যদের অভিযোগের আবহেই নিজেদের কর্মকাণ্ড এখনও বহাল রেখেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয়টি হল, হিন্ডেনবার্গ কাণ্ডের পর থেকে তাদের 'আদানি এন্টারপ্রাইজ'এর শেয়ারের দাম কিন্তু সর্বোচ্চ দামের থেকে অনেক নিচে এবং ক্রমাগত নিম্নগামীই হতে থেকেছে। শেয়ার বাজার বড় বিচিত্র জায়গা, যদি কোনও সংস্থাকে বাজার নিজেই শাস্তি দিতে এগিয়ে আসে, তা বড় নির্মম। তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সুদিনের আশায়  রইলাম।

সুখবর হল, আদানির জালিয়াতি সামনে আসার পরেই কেনিয়ার রাষ্ট্রপতি তাঁর দেশের সঙ্গে আদানি গোষ্ঠীর বিমানবন্দর ও শক্তি ক্ষেত্রে মোট যে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প ছিল তা সপাটে বাতিল করেছেন। আজ সপ্তাহের শেষ কর্মদিনের অন্তে দেখার আছে, আদানির শেয়ার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়; কিন্তু ইতিমধ্যে তদন্তে যে জালিয়াতি উদ্ঘাটিত হয়েছে ও এর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা এখন সবিশেষ কৌতূহলের বিষয়! 


Sunday, 17 November 2024

প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা

কেউ শব্দ কোরো না

অমৃতা ঘোষাল


(২২ ডিসেম্বর ১৯৩৮ - ১২ নভেম্বর ২০২৪)

সাজানো বাগানে বেশ কিছু রঙিন আর সাদা-কালো ছবির মতো ফুল ছিল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মতো! আর গভীরভাবে দেখলেই দ্রষ্টার বুকের মধ্যে স্বর্গসুখকে ছাপিয়ে প্রকট হবে গুলজার এক নরক। বাস্তববাদী নাট্যকার যে অপার নাট্যজগতে প্রজাপতির ন্যায় এক ত্বষ্টা, তার সার্থক উপমা মনোজ মিত্র। 

ব্রিটিশ-ভারতের খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার ধূলিহর গ্রামে জন্ম নেওয়া মনোজ শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশভাগের ফলাফল। খুলনা তাঁর জন্মভূমি হলেও আর ভারতভূমি হিসেবে রইল না! কাঁচা বয়সেই সৃজনশীল রচনায় দক্ষ মনোজকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল ভারত-পাকিস্তানের স্বাধিকারপ্রমত্ত রাজনীতি। গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে নাটকের অভিনয় দিয়েই তাঁর নাট্যজগতে পদার্পণ, বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের ঊষালগ্ন থেকেই 'imitation of an action'-কে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের হাস্যকৌতুক 'রোগের চিকিৎসা'-র অভিনয়ে, হাঁস-চুরি-করা বালকটির ভূমিকায় তিনি এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন। কোনও অনুকৃতি নয়! জামার ভেতর গোটা হাঁস লুকিয়ে শিশু-মনোজ স্টেজে এসে অভিনয় করল। তবে হাঁসের আঁচড়ে-কামড়ে পেট-বুক রক্তাক্ত হয়ে তাঁর সহ্যসীমাও সহজেই অতিক্রান্ত হয়েছিল। দর্শক অনুভব করেছিল, নাটককে সাধারণ দর্শকের বিশ্বাসযোগ্য তথা 'universalized' করে তোলার জন্য তাঁর প্রতিটি সত্তা চূড়ান্তভাবে উন্মুখ। সেই যন্ত্রণায় মাখা কৌতুক-স্মৃতি সম্ভবত তাঁর জীবনের শেষ সাক্ষাৎকারেও আমরা খুঁজে পাব। 

দেশভাগের প্রভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্তর-মর্যাদার বহু  মানুষ। মাতৃভূমি ছেড়ে ১৯৫০ সাল নাগাদ তিনি চলে আসেন এই বাংলায়। বেলেঘাটার ভাড়াবাড়ি, বসিরহাটের বাড়ি পেরিয়ে তরুণ মনোজ মিত্র থাকতে শুরু করলেন বেলগাছিয়ার বাড়িতে। এরপর স্কটিশচার্চ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন ১৯৫৪ সালে। আর তখন থেকেই একটা নাটক রচনার প্রতিবেশ নিজের চারিপাশে আবিষ্কার করে ফেলেন। পার্থপ্রতিম চৌধুরী, অতনু সর্বাধিকারী আর দীপার  (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী) মতো বন্ধুদের সান্নিধ্যে থিয়েটারের সঙ্গে একেবারে গভীর সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। সেই পার্থর অফুরান উৎসাহেই ১৯৫৬ সালে গড়ে ওঠে নাটকের দল 'সুন্দরম'। চলচ্চিত্র-সংরূপের সঙ্গে জড়িয়ে নাটকের এক অভিনব দিশা সন্ধান করেছিল সেই দল। তাই 'পথের পাঁচালী'র নাট্যরূপ মঞ্চে উপস্থাপিত করার পরিকল্পনা করেছিল সেই দল, যদিও মনোজ প্রাধান্য দিতে চেয়েছিলেন সমকালীন বাস্তবতার জ্বলন্ত পাবককেই। সম্ভবত প্রদর্শনধর্মী  উন্মাদনা আর যুগীয় প্রবণতার কিছুটা বিপরীতে হাঁটতেন তিনি। 

দর্শন নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়াকালীন ১৯৫৯ সালে লিখলেন প্রথম নাটক 'মৃত্যুর চোখে জল'। ২১ বছরের যুবার কলমে সেই একাঙ্কের পরতে পরতে দীপ্ত হয়ে উঠল এক বার্ধক্য-আক্রান্ত প্লট। শৈশব থেকেই বৃদ্ধ পিতামহকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লক্ষ করা মনোজ উপলব্ধি করেছিলেন জীবনসায়াহ্ন-জনিত ক্রাইসিস। অথচ তাঁর সেই ঠাকুরদা অন্নদাচরণ মিত্র কিন্তু ছিলেন থিয়েটার-বিরোধী। তবে  অন্নদাচরণের কর্তৃত্বে তাঁদের গ্রামের বাড়িতেই থিয়েটারের উপকরণ-সরঞ্জাম রাখা হত। মাত্র একুশ বছর বয়সেই তিনি অভিনয় করলেন 'মৃত্যুর চোখে জল'-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধটির ভূমিকায়। আর্টিস্ট অনন্ত দাসের অসামান্য সাজানো, গলায় বার্ধক্যের ভঙ্গিমা, হাঁটার কায়দায় অবসন্ন ভাব কিংবা বয়সজনিত জরা-- এ সমস্ত কিছুকে আয়ত্ত করে সদ্য যুবক মনোজ একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন দর্শককে।  ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ অবধি 'সুন্দরম'-এ কাটিয়ে শ্যামল ঘোষের দল 'গন্ধর্ব'-এর সঙ্গে কিছুটা যুক্ত হলেন। সেই দলের নাট্যপত্রিকায় ছাপা হল তাঁর 'মোরগের ডাক' ও 'নীলকণ্ঠের বিষ'।

১৯৬০-এ রানীগঞ্জ কলেজ, ১৯৬৪'তে ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র কলেজ আর ১৯৬৫'তে নিউ আলিপুর কলেজে দর্শন বিষয়ে অধ্যাপনাও করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক বিভাগেই অধ্যাপনার কাজে যোগ দেন। রানীগঞ্জ থেকে কলকাতায় ফেরার পর মহানগর দায়িত্ব নিয়েই তাঁর প্যাশনের স্রোতকে সঠিক খাতে বইয়ে দিল। শুরু করেছিলেন যে গবেষণার কাজ, তা-ও বন্ধ হয়ে গেল। শ্যামল ঘোষের নতুন দল 'গন্ধর্ব' কিংবা পার্থর 'সুন্দরম'-এ তিনি আর ফিরলেন না। কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন এক ক্ষণস্থায়ী দল 'ঋতায়ন'। সেই দলও ভেঙে যাওয়ার পর তাঁর লেখা নাটক 'চাক ভাঙা মধু' বেশ সাড়া ফেলে দেয়। সেই নাটকের পরিকল্পনা-রিহার্সাল আরম্ভ হওয়ার পর নতুন গড়ে ওঠা দলটির সামগ্রিক ছন্দে কিছু খুঁত ফুটে ওঠে। অন্যদিকে 'সুন্দরম' দলের দেহেও তখন কিছুটা অকাল-ভাঙন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত 'এক্ষণ' পত্রিকায় এবার  প্রকাশিত হল তাঁর 'চাক ভাঙা মধু', আর বিভাস চক্রবর্তীর 'থিয়েটার ওয়ার্কশপ'-এর উদ্যোগে তা মঞ্চে অভিনীত হল। 

রানীগঞ্জ কলেজে হিন্দি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক নারায়ণ পাণ্ডের লোকসাহিত্য বিষয়ক গবেষণার আঁচ পেয়েছিলেন তিনি। সেই গবেষণার উত্তাপ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন 'সাজানো বাগান' নাটকের রসদ। ১৯৭৭-এ 'সুন্দরম'-কে উপহার দিলেন 'সাজানো বাগান'-এর মতো মাস্টারপিস। ১৯৮০'তে সেই প্লটের ওপর ভিত্তি করে তপন সিংহ পরিচালিত চলচ্চিত্র 'বাঞ্ছারামের বাগান'এ রুপোলি পর্দায় প্রথম দেখা গেল নাট্যকার মনোজ মিত্রকে। প্রায় ষাটটির মতো বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জায়গা করে নিতে একটুও ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত থেকে হরনাথ চক্রবর্তী কিংবা সত্যজিৎ রায় থেকে অঞ্জন চৌধুরী-- সর্বত্রই তাঁর সাবলীল কিন্তু নজরকাড়া উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। নিন্দুকেরা আড়ালে তাঁকে বলতে লাগলেন উৎপল দত্তের কপি, সমালোচকেরা বললেন, উত্তরসাধক। বাদল সরকার আর রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত'র মতো শিল্পীদের নৈকট্য ও সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মনোজ লিখেছিলেন 'নরক গুলজার' (১৯৭৪)। রাজনীতি ও অর্থনীতির স্যাটায়ারে ভরা এই নাটকে দর্শক প্রত্যক্ষ করল, কল্পতরু থলিতে স্বর্গরূপসী রম্ভাকে চেয়ে হাত ঢোকালে অনিবার্যভাবেই বেরয় মর্তমান কলা। সেখানে আবার প্রজাস্রষ্টা ব্রহ্মাকে উৎকোচ গ্রহণের সমর্থক হিসেবে দেখিয়ে, সমাজের ভয়াবহ অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রকট করালেন মনোজ। 

শেষ জীবনে স্ত্রী আরতি মিত্রকে নিয়ে সল্টলেকে বাস করতেন। তাঁর দুই অনুজ অমর ও উদয়নও তাঁদের সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন যথাক্রমে বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও ইতিহাস-গবেষক রূপে। এই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে মনোজ মিত্রের একমাত্র কন্যা ময়ূরী মিত্র জানান পিতার হৃৎযন্ত্র বিকল হওয়ার কথা। সেই সঙ্গে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিস, কিডনির সমস্যা, সিওপিডি আর ডিমেনশিয়ার মতো ব্যাধি তাঁকে ক্রমশ গ্রাস করছিল। ৮৫ বছর বয়সে বটবৃক্ষর মতো এই শিল্পীর জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরপ্রস্থান ঘটে, রয়ে যায় অসীম প্রত্যয়ে ভরা প্লট-চরিত্র-সংলাপের শিকড়-ঝুরি। তাঁর মৃত্যুর পর সম্ভবত শুভানুধ্যায়ী আর নিন্দুকদের মুখে একসঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে 'নরক গুলজার' নাটকের সেই অমোঘ পঙক্তি--

'কথা বোলো না কেউ শব্দ কোরো না 

ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন 

গোলযোগ সইতে পারেন না।'

সহৃদয় সামাজিকের নয়ন সমুখে অভিনেতা কিংবা শিল্পবেত্তা মনোজ আর কোনও দিনও অবতীর্ণ হবেন না। অপেক্ষা ফুরলো, নটে গাছটি মুড়োলো।


Friday, 15 November 2024

বুলডোজার শাসন নিষিদ্ধ

নিকৃষ্টতম শাসনের ইতি

বর্ণালী মুখোপাধ্যায়



বুলডোজার শাসনকে নিষিদ্ধ করে সর্বোচ্চ আদালত আপাতত আমাদের স্বস্তি দিয়েছে; বিশেষত বিরোধী দলের সদস্য, সমর্থক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষকে। বেআইনি দখল করা জমিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে যদি বুলডোজার ব্যবহার করতে হয় তবে আগে থেকে পোর্টালে সেই নোটিশ আপলোড করতে হবে, নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তাছাড়া প্রক্রিয়া না মেনে বুলডোজার চালালে সরকারি আধিকারিককে আদালত অবমাননার দায়ে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হতে পারে। নোটিশ পেয়ে পনেরো দিনের মধ্যে প্রশাসনের তরফে হিয়ারিং হবে। সেই হিয়ারিংয়ে যদি শেষ পর্যন্ত সেই বাড়ি বা দোকান ভাঙ্গা স্থির হয় তার পরে আরও ১৫ দিন সময় দেওয়া হবে যাতে সেই ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।

দলিত বনাম মুসলিম সমীকরণে এই বুলডোজার সন্ত্রাস ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা যারা করেন তাদের খোঁজ নিতে অনুরোধ করব। আদিবাসী, দলিত, তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষকে আর এসএস এবং বিজেপি এটাই ফিসফিসিয়ে বোঝায় যে মুসলিমদের জমি-দোকান-ব্যবসা-পুকুর-ক্ষেত দখল করে তাদের দেওয়া হবে। ফলে, তদন্ত করলে হয়তো দেখা যাবে, ৬৭,০০০ একর বুলডোজারের ব্যবহারে পাওয়া জমির একাংশ আদিবাসী, দলিত বিজেপি সদস্যদের দেওয়া হবে এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সেই আশ্বাস কতটা বাস্তবে কার্যকর হবে সেটা অবশ্যই বিচার্য নয়। মেরুকরণই লক্ষ্য। 

আমাদের দেশে শহর, আধা-শহরের বাড়িঘরের মধ্যে একটা বড় অংশেরই সব কাগজপত্র ঠিক নেই। সরকার, পৌরসভা সেটা জানে। কিন্তু সব বাড়ির সব কাগজ ঘাঁটতে বসলে লোম বাছতে কম্বল উজাড় হবে, সেটাও জানে প্রশাসন। ফলে, যে সরকার বা মুখ্যমন্ত্রী অথবা প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ জমি পুনরুদ্ধার করতে নামে, বুঝতে হবে তা আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষের উপর সন্ত্রাস চালিয়ে ধর্মীয় মেরুকরণ করার ছল মাত্র। সেখানে বিন্দুমাত্র দখলদারি বন্ধ করার উদ্দেশ্য নেই। মুসলিম বস্তি উজাড় করে সেখানে তাদের পোষ্যদের বেআইনি ভাবেই ব্যবসা করার আশ্বাস দেওয়া হয়। বেআইনি দখল তুলতে হলে বিজেপির দলীয় অফিসগুলো আগে ভাঙতে হবে, এমনটা বলেছিলেন আপ দলের এক নেতা। কৃষক আন্দোলনের নেতা টিকায়েত বলেছিলেন যে বুলডোজার নিয়ে এমন আক্রমণ হলে ট্র্যাক্টর দিয়ে প্রতিরোধ করা হবে। 

বুলডোজারের ব্যবহারে এক নির্লজ্জ মুসলিম আক্রমণের নজির গড়ে তুলেছিল বিজেপি। একজন গরু খেয়েছে বলে অভিযোগ এল, তাকে মৃত বা অর্ধমৃত করা তো হলই, উপরন্তু তার বাড়িও ভেঙে দেওয়া হল। পরে প্রশাসন একটা ব্যাক ডেটেড নোটিশ দেখিয়ে বলল যে ওই বাড়ি নাকি বেআইনি ছিল! এখন আদালতে সে যাবে, হয়তো জিতেও যাবে, কিন্তু সর্বনাশ যা হওয়ার তা তো হয়েই গেল! আবার এমন উদাহরণও আছে যে একটা গোটা বস্তি উদ্বাস্তু কলোনি। কিন্তু তার মধ্যে একজন বিরোধী দলের সমর্থকের বাড়ি ভাঙা হল দখলিকৃত অভিযোগ এনে, অথচ সেই সংজ্ঞায় গোটা বস্তিটা বেআইনি!

মাফিয়া গোষ্ঠীদের মধ্যেও অলিখিত আইন আছে যে শত্রু গ্যাং'এর পরিবারদের বিরক্ত করা হবে না, খুন করা তো দূরের কথা। সেরকম কোনও অঘটন হলে সেটাকে যুদ্ধ বলে ধরা হয়। আদিত্যনাথ যোগী যে নিকৃষ্টতম মাফিয়া বস সেটা তার বুলডোজার শাসন থেকেই প্রমাণিত। সমগোত্রীয় নরেন্দ্র মোদিও ভোটের প্রচারে বুলডোজার ব্যবহার করতে স্পষ্ট ভাষায় বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীদের উৎসাহ দিয়েছিলেন। তাই মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ডের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরাও পিছিয়ে নেই। রাজস্থানের কংগ্রেস সরকারও মোদী, যোগী অনুপ্রাণিত ছিল এমন অভিযোগ আছে। 

রাজনীতি মানেই বিপদ। সরকারি দল করলে লাভ আর বিরোধী দল করলে 'হাজতবাস, আহত, নিহত হতে পারি' এটা জেনেই মানুষ রাজনীতি করতে আসে। কিন্তু বিরোধী জনের পরিবারও ছাদহীন হবে এই আশঙ্কা থাকলে, মেহনতি জনতার ক্ষেত্রে না হলেও, আমাদের মতো শহুরে আরবান নকশাল, আন্দোলনজীবীদের সংখ্যা যে অনেক কমে যেত তা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়।


Tuesday, 12 November 2024

'পিপাসা, হায় না মিটিল'

প্রলম্বিত এক ছায়াপথ 

প্রবুদ্ধ বাগচী



আরও পাঁচটা না-পাওয়ার মতোই ঋত্বিকের ছবিকে তাঁর প্রকৃত চেহারায় খুঁজে পেতে আমাদের অনেকদিন লেগে গিয়েছে। আমরা মানে, যারা আশির দশকে বেড়ে উঠেছিলাম কলকাতার আবহাওয়া থেকে বেশ কিছুটা দূরত্বে। ১৯৮৭'র শহরে ‘নন্দন’ নামের এক অত্যাশ্চর্য প্রেক্ষাগৃহের স্থাপনার পর সেখানে ওই বছরের নভেম্বর মাসে সরকারি উদ্যোগে করা হয়েছিল ‘ঋত্বিক ঘটক রেট্রোস্পেক্টিভ’। মাত্র পাঁচ টাকার টিকিট কেটে সেবার দুটো ছবি দেখি। ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ও 'কোমল গান্ধার'। নন্দনের বিশাল স্ক্রিনে নীলকণ্ঠ বাগচীর পাশ-করা মুখের ফ্রেমে এসে দাঁড়ায় বঙ্গবালা, আর গোটা প্রেক্ষাগৃহে বিদ্যুতের শকের মতো বেজে ওঠে ‘কেন চেয়ে আছো গো মা’— এই দৃশ্য আসলে একটা জন্মান্তর। আমাদের ভিন্ন জন্ম হয়। আগামী সময়ে আমরা কেবল তার মধ্যেই বেড়ে উঠব অবিরাম। 

প্রায় একইরকম গায়ে-কাঁটা-দেওয়া 'কোমল গান্ধার'এর সেই লংশট— ট্রলির ওপর ক্যামেরা চলতে চলতে আচমকা লাইন থেমে যায় দুটো অনিবার্য বাফারে। এপার বাংলা ওপার বাংলা, মধ্যিখানে চর— চর নয় চরাচর। একটা প্রজন্মের বিধিলিপি লেখা হয়ে গেল ওই শটে। তুলনায় তাঁর ‘মেঘে ঢাকা তারা’ হিট ছবি। আটের দশকে নিঃসঙ্গ দূরদর্শন-জমানায় সেই ছবি প্রায়ই দেখানো হত রবিবার। সে ছবিতে নীতার জীবন নিংড়ে-নেওয়া বাঁচতে চাওয়ার আর্তি বাড়ির মা-মাসিমাদের কাছেও এক প্রবল শোকের ভ্রূণায়ন বলে চিহ্নিত হয়েছিল। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’ গানটির অমন সুতীব্র অভিঘাত ও ব্যঞ্জনা ছিল প্রায় অলৌকিক। আর এই সূচিমুখ তীব্রতার মধ্যেই আমরা খেয়াল করতে ভুলে যেতাম আজাদগড় কলোনির পরিবার-বঞ্চিত এক রিফিউজি যুবতী কোথাও যেন মিশে যায় কুমারসম্ভবের পার্বতীর অনুষঙ্গে, ভুলে যেতাম বাগেশ্রীর ওই স্বরলিপির মধ্যে কীভাবে আছড়ে পড়ছে চাবুকের আওয়াজ! গান না আর্তনাদ ? 

এত দূর মুগ্ধতার আগে কিন্তু আমরা সত্যজিৎ মৃণালের ছবি কিছু কিছু দেখে ফেলেছি। তাই এটা বলার কথা যে, আসক্ত মুগ্ধতা থেকে ঋত্বিকের পরের ছবিগুলি খুঁজে পেতে দেখতে গিয়ে তেমন বড় কিছু লাভ করেছি এটা বলা ঠিক হবে না। বাংলার দিকপাল তিন চলচ্চিত্র পরিচালকের মধ্যে ঋত্বিক সব থেকে ছোট, তাঁর তৈরি করা ছবির পরিমাণও কম। অনেকে মনে করেন, সুযোগ পেলে তিনি অন্যদের থেকে নিজেকে আরও ভাল ছবি করার কাজে নিয়োজিত করে মহত্তর হতে পারতেন। এই আপ্তবাক্যে আমাদের তেমন আস্থা নেই। এটা ঠিক, তাঁর প্রথম ছবি ‘নাগরিক’ কার্যত ‘পথের পাঁচালী’র আগে রিলিজ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ‘নাগরিক’ বা ‘কোমল গান্ধার’ সময়ান্তরে দেখে তাঁর নির্মাণের মধ্যে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা নাকি ‘পথের পাঁচালী’কে অবান্তর করে দিতে পারে। তবে তাঁর শতবর্ষের সীমানায় এসে তাঁকে কোনও ‘বনাম’ এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াটা সমুচিত নয় বলেই আমাদের ধারণা। বাংলার প্রবাদ হল, ‘অতি বড় সুন্দরী না পায় বর/ অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর’— ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রে এই ধারণাটা কিছুটা ব্যবহার করা চলে। হ্যাঁ কিছুটা, অবশ্যই পুরোটা নয়। সিনেমা ব্যাপারটাই তো এরকম, তার জন্য পুঁজি, লোকলস্কর, প্রযুক্তি লাগে, লাগে তৈরি হওয়া চলচ্চিত্রের বিপণন। মুঠো মুঠো সদিচ্ছা আর বিপুল মেধা ও জ্ঞান থাকলেই যে তাতে সিদ্ধিলাভ ঘটবে এমন মোটেও নয়। যদিও প্রখর পাণ্ডিত্য ও ফিল্ম-বিষয়ক ভাবনায় ঋত্বিক নিজে সত্যিই একজন পথিকৃৎ। পুনার ফিল্ম ইন্সটিটিউটে তাঁর কিছু কৃতবিদ্য প্রাক্তন ছাত্ররা বলেছেন, লিখেছেন সেই ঋত্বিক-সংসর্গের কথা। জীবনের শেষ দিন অবধি ঋত্বিককে কাছ থেকে পেয়েছেন নবারুণ ভট্টাচার্য, তিনিও বলেছেন এই বিরল ব্যক্তিত্বের নানা কথা। প্রতিটিই প্রণিধানযোগ্য। 

ইতিহাসে ও বাজারে নানারকম মতামত ঘুরে বেড়ায়। তার একটা হল, বিশ্রুত প্রতিভাধরদের নাকি একটু এলোমেলো বিশৃঙ্খল না হলে চলে না। ঠিক ভোট  দিয়ে এই বক্তব্যের সার নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। তবে দুনিয়ার সব প্রতিভাকেই যে নৈরাজ্যের উপাসক হতে হবে এটা কোনও নেসেসারি ও সাফিসিয়েন্ট শর্ত নয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তার প্রোজ্জ্বল উদাহরণ, যিনি এমনকি অন্যের কাছে নিজের লেখা চিঠি অবধি কপি করে রেখে দিতেন। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কতদূর সুশৃঙ্খলভাবে নিজের কাজগুলো করে নেওয়া সম্ভব এর অভিধান তিনি নিজেই রচনা করে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে করেই এই ডিসিপ্লিনের নিরিখে  ঋত্বিক-সমকালীন সত্যজিতের কথা তুলছি না, কারণ, তাতে আবার ওই ‘বনাম’ এর বদনাম হবে। কিন্তু সিনেমা এমনই একটা মাধ্যম যা তার স্রষ্টার কাছ থেকে দাবি করে নিখুঁত নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলা, কারণ, আদপে সিনেমাটা তৈরি হয় একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া মেনে যার মধ্যে ছেলেমানুষির জায়গা থাকে না। তাঁর একটি সাক্ষাৎকারে ঋত্বিক বলেছিলেন, যদি তিনি সিনেমার থেকেও জোরালো কোনও মাধ্যম কোনওদিন পান, সিনেমার মুখে লাথি মেরে তিনি সেখানেই চলে যাবেন। 

প্রথম জীবনে তিনি নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। এর পরেও সিনেমা নামক মাধ্যমটিকে তিনি খুব সিরিয়াস ভাবে নিতে পেরেছিলেন কি না, এ নিয়ে আজ একটা প্রশ্ন তোলাই যায়। কারণ, সিনেমায় নিজের মতো করে কিছু করে দেখাতে গেলে গোড়ার দিকে তাঁর অবস্থানটা পোক্ত করার কাজটা নিজেকেই করতে হয়। সবাইকেই তা করতে হয়েছে। সম্ভবত এই প্রয়াসটায় তাঁর কিছু ঘাটতি ছিল। আজ এ কথা বলা কতদূর সঙ্গত জানি না, তবু বিনীতভাবেই সপ্রশ্ন হই, নিজেকে ‘জিনিয়াস’ ভাবা এবং কেবল সেই গুণেই প্রযোজকরা আগ বাড়িয়ে এসে কাজ দেবেন, এমন একটা গোপন অহং কি ছেয়েছিল তাঁকে? আবাল্য ছটফটে ঋত্বিক ওরফে ভবা'র প্রতিভার মূল্যায়ন করতে গেলে এই কথাগুলো ওঠে। 

আরেকটা কথা ঝুঁকি নিয়েও বলা দরকার। ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের যে বিরাট সাংস্কৃতিক ছায়া একটা সময় প্রগতি শিল্পের মূল ধারা হয়ে উঠেছিল, ঋত্বিক মূলত তারই সন্তান। বাম রাজনীতি নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা, তার সঙ্গে তাঁর বিতর্ক, নানা ভাবনার দোলাচল তাঁকে সারা জীবন ব্যস্ত রেখেছে। জীবনের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’তে নীলকণ্ঠ বাগচীর চরিত্রে রূপদান বেশ অনেকটাই তাঁর রাজনৈতিক দোলাচলের আত্মকাহিনি। এই যাত্রাও কিন্তু কিছুটা ‘ছটফটে’ চরিত্রের। কোথাও থিতু নন। ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পাকা চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ জীবনে কার্যত পথের ভিখারি ঋত্বিক। নবারুণ ভট্টাচার্য একদিন দেখলেন ভবানীপুরের এক ফুটপাথে ছিন্ন পোশাকে শুয়ে রয়েছেন তিনি। পর্যুদস্ত। চরম অ্যালকোহলিক। অসম্ভব মেধা, বিপুল জ্ঞান, সংগীতের রসপিপাসু, ফিল্মের ব্যাকরণকে ফালা ফালা করার পোটেন্সি সব একাকার হয়ে গেল হাহাকারে: 'আমি পুড়ছি! ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে!' 

বহরমপুরের কলেজ জীবনে তিনি আরএসপি দলের ঘনিষ্ঠ, পরে কলকাতায় পড়তে এসে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সখ্য, সস্তা ষোলো মিলিমিটার ক্যামেরা জোগাড় করে ‘তেভাগার লড়াই’কে নথিবদ্ধ করার তাগিদে বন্ধু সলিল চৌধুরীর সঙ্গে পথে বেরনো। তথাকথিত ‘রণদিভে লাইন’কে তিনি মানছেন না তার ছাপ পড়ল পঞ্চাশের দশকে পার্টির মধ্যে তাঁর তোলা বিতর্কে। বিস্তর লেখাপড়া করা ঋত্বিককে জ্যোতি বসু সমর্থন করতেন কিন্তু স্বভাবে কিছুটা ‘কুচুটে’ ও শিক্ষিত পার্টি সদস্যদের প্রতি বিদ্বিষ্ট প্রমোদ দাশগুপ্ত কলকাঠি নেড়ে ‘অন কালচারাল ফ্রন্ট’এর প্রস্তাবক ভবা'কে বহিষ্কার করে দেন। ষাটের মধ্যপর্বে নকশাল রাজনীতি তাঁকে কিছুটা টানল তবু ঠিক স্বস্তি দিল না। নকশাল খতমের গুলি বিনিময়ের মধ্যেই নিহত হলেন নীলকণ্ঠ বাগচী ওরফে ঋত্বিক। 

কিন্তু এই প্রজ্বলনের তো একটা পরিণতি চাই। আলো। শক্তি। গতি। কেবলমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশের চরম ট্র্যাজেডি যে পার্টিশন, তাকে কেন্দ্রে রেখে অথবা তারই অবশেসনের কাছে নিজেকে সমর্পণ করেই কি একজন ফিল্মমেকার পুরো জীবন বেঁচে থাকতে পারেন? ঠিক, বাঙালির জীবনকে নতুন এক ছাঁদে ঢালাই করে নিয়েছে দেশভাগ। শিয়ালদহ রেল স্টেশনের বীভৎসা, বনগাঁ সীমান্ত, যাদবপুর, দমদম, হাবরা, কুপার্স ক্যাম্প, আজাদগড়, বিজয়গড়। একেকটি জনবসতির সঙ্গে একটি ধ্বস্ত জাতির শোক ক্রোধ প্রতিরোধ ক্লেদ যন্ত্রণা সব একাকার। কিন্তু তার পরের অন্তত সিকি শতাব্দী তিনি বেঁচে ছিলেন। এর প্রতিস্পর্ধী যে নানান রঙের মানচিত্র তৈরি হয়েছিল এই বাংলায় সেখানে কি কিছুই খুঁজে পেলেন না তিনি? চলচ্চিত্র পরিচালককে ফিল্মের বিষয় নিয়ে পরামর্শ দেওয়া লেখককে লেখার বিষয় বাতলে দেওয়ার মতোই অশ্লীল ঠিকই, কিন্তু আমরা বলছি একটা প্রত্যাশার কথা। তাঁর কাছে আসলে অপার প্রত্যাশা ছিল আমাদের। তিনি তাঁর মতো করেই না হয় গড়ে পিটে নিতেন তাঁর বাস্তবকে; আমরা জানি সেইটুকুতেই তিনি তাঁর ফাল্গুনী রচনা করে তাক লাগিয়ে দিতেন আমাদের। ‘পিপাসা, হায় না মিটিল’। ১৯৭৬'এর এক ফাল্গুনী ভোরে পিজি হাসপাতালের ক্লিন্ন বিছানায় ‘জীবনের ক্লান্তি ক্ষুধা আকাঙ্ক্ষার বেদনার’ ঋণ চুকিয়ে যেদিন তিনি চলে যাচ্ছেন, সেদিন তাঁর গুটিকয় সুহৃদ ব্যতিরেকে স্তব্ধ হয়েছিল একটা জাতি, রাজধানী-ভরা নাগরিক সমাজ। পড়ে-আসা বেলার দিকে যেভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদা বক। ছটফটে জীবন। প্রলম্বিত এক ছায়াপথ। 

[তথ্যসূত্র: সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় (সাক্ষাৎকার), বসু আচার্য (ফেসবুক পোস্ট)]

Sunday, 3 November 2024

ভেতরের মানুষটা কেমন!

এই পথে আলো জ্বেলে

মালবিকা মিত্র



আরজি কর হাসপাতালে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি ছাত্রীর ধর্ষণ ও মৃত্যু নিয়ে সারা বাংলা এমনকি বাংলার বাইরে মানুষ প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। এই প্রতিবাদের 

১) একটা বড় অংশ সরকারের বিরুদ্ধে;

২) একটি অংশ নির্দিষ্টভাবে ওই ঘটনার বিরুদ্ধে ও হাসপাতালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার দাবিতে ও 

৩) আরেকটি অংশ সমগ্র নারী জাতির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও চিন্তান্বিত। 

কিন্তু এই তৃতীয় ধারাটি আন্দোলনের মূলধারা থেকে ক্রমশ বিলীয়মান। তাই একটু বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কারণ, এই তৃতীয় ধারা ধর্ষণ সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সোচ্চার; লিঙ্গ বৈষম্য বিলোপের দাবি করে, সাধারণভাবে সর্বত্র নারী নিগ্রহ ও তার বিরুদ্ধে নারীর নিরাপত্তার পক্ষে সোচ্চার। রাত দখল আন্দোলন তো শুধু ধর্ষিতা ও খুন হওয়া ডাক্তার ছাত্রীর জন্য নয়, মেয়েদের রাত দখল। কেন মেয়েরা একা রাত্রে বেরতে পারবে না, কেন মেয়ের জন্য বাড়ির মানুষকে দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে 'এখনও কেন ফিরল না', কেন একটি মেয়েকে ভাবতে হবে, থাক আমি বার্থডে পার্টিতে যাব না, ফিরতে রাত হয়ে যাবে। এই লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে মেয়েদের রাত দখল আন্দোলন। এটাই আন্দোলনের লক্ষ্য, তিলোত্তমা উপলক্ষ মাত্র। আমি এই তৃতীয় পক্ষে অঙ্গীভূত হতে চাইলেও শেষ অবধি পারলাম না। আর সেটাই আমার মানসিক যন্ত্রণা। এমন একটি প্রতিবাদে কোথাও সামিল হতে পারলাম না। এই যন্ত্রণা প্রকাশের ভাষা নেই। 

'স্বাধীন স্বতন্ত্র' (বে)নামে একটি সংগঠন নিচের এই আবেদনটি প্রকাশ করেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আগে সরকারের রোষানল থেকে আত্মরক্ষার জন্য এরকম বেনামে আত্মগোপন করতে হত। এখন উপর্যুপরি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যাখ্যান আসার ফলে জনগণের থেকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে নানাবিধ বেনামে:

#রাজপথে_নির্যাতিতার_পোশাক_প্রদর্শনী 

''রাত' মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয়। আজ প্রায় আড়াই মাস কেটে গেলেও সরকার নারীদের দাবি নিয়ে একটি কথাও বলেনি;

আমরা যারা যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছি, ধর্ষিত হয়েছি বা ইভ-টিজ হয়েছি, তারা তাদের এলাকায় সেই বয়সের পোশাক টাঙিয়ে দিই, যে বয়সে আমরা নির্যাতিত হয়েছিলাম;

নবজাতক শিশু, কিশোরী, যুবতী, গর্ভবতী এবং প্রৌঢ়া সকলেই আমরা এই নির্যাতন এবং ধর্ষণের স্বীকার হয়েছি বারংবার; 

সরকারকে বুঝিয়ে দিই, বাংলার ৫ কোটি মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে নির্যাতিত হয়নি। যাদের বয়স ৪ থেকে ৯০, যারা স্কুল ছাত্রী থেকে বৃদ্ধা; 

প্রতিশ্রুতি নয় সমাধান চাই।'

অর্থাৎ বলা হচ্ছে, সকল নারীই ধর্ষিতা! প্রকারান্তরে সকল পুরুষই ধর্ষক! 

সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে, All men are potential rapist-- এই কথার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে potential  শব্দটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যার অর্থ, All men have the potential to rape.। মানুষ তো মূলগত ভাবে এক জৈব সত্তা। তাই তার মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ, যৌন চিন্তা, চেতনা কাজ করে থাকে। ধর্ষণ করার সামর্থ্য আছে। কিন্তু একই সাথে আবার মানুষ এক সামাজিক জীব। ফলে, তার একটা সামাজিক সত্তা আছে। সেই সামাজিক সত্তার মধ্যে সে মা কাকিমা দিদি বোন স্ত্রী ইত্যাকার নানা সম্পর্কে আবদ্ধ। নানাবিধ সামাজিক উচিত-অনুচিত, শোভন-অশোভন, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বোধ, রেওয়াজ, রীতি বিদ্যমান, সর্বোপরি একটা লজ্জা, ভয় কাজ করে। এই সামাজিক রেওয়াজ ও রীতিগুলি তাকে, তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রবৃত্তি থেকে বিরত করে। নানাবিধ সম্পর্কগুলি তার জৈব সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর ফলে মূলগতভাবে মানুষ অ্যানিমেল হলেও অ্যানিম্যালিটি তার মধ্যে প্রাধান্য পায় না। কিন্তু সুপ্ত থাকে। মান্না দে'র গানে এই প্রবৃত্তির একটা নমনীয় রূপ বর্ণিত আছে:

'ও কেন এত সুন্দরী হল...

অমনি করে ফিরে তাকালে, 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই .... 

ও কেন তখন হঠাৎ এমন এলোচুলে বাইরে এল... 

দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই 

আমি তো মানুষ।' 

কিন্তু এই মুগ্ধতা, প্রবৃত্তি এসব ছাড়াও একটা বাড়তি জিনিস, একটা নিয়ন্ত্রক, একটা সেন্সর কাজ করে। বিকৃত মানসিকতা বলতে বোঝায়, ওই সেন্সরটি যখন ঠিকমতো কাজ করে না। অধিক মাত্রায় উত্তেজক পানীয় সেবন করলে সেন্সরটি, মানে পাহারাদারটি ঝিমিয়ে পড়ে, ঠিকমতো কাজ করে না। আবার নিয়মিতভাবে উত্তেজক সেবন করার ফলে ধীরে ধীরে অকেজো, অচল হয়ে যায়, পাহারাদার সর্বদাই ঝিমোতে থাকে। এইভাবেই সেন্সরটি অচল ও বিকৃত হয়ে যায়। বেশ মনে আছে, শেষ দফার বামফ্রন্টের শাসনে অর্থমন্ত্রী দেদার দেশি-বিদেশি মদের দোকানের লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এমনকি চাঁপদানিতে একটি নার্সারি স্কুলের পাশের প্লটে এফ এল অন শপ লাইসেন্স দিয়েছিলেন। এখন সেগুলোই বটবৃক্ষের ছায়া বিস্তার করেছে। যে কোনও স্পট থেকে মাত্র এক কিলোমিটারের মধ্যে দেশি-বিদেশি মদের দোকান পাওয়া যাবে। মদ্যপান করে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ থাকলেও, হাইওয়ের পাশেই দু' হাত অন্তর হাজার হাজার লাইসেন্স প্রাপ্ত পানশালা দেখতে পাবেন। 

শুধু তো উত্তেজক পানীয় না, পরিবার বা পরিবেশে যদি ছোটবেলা থেকে কেউ সুন্দর সম্পর্ক না দেখে, তার কাছে উচিত অনুচিত বোধ তৈরি হয় না। শৈশব থেকেই যদি কেউ বাড়িতে যৌনাঙ্গ ও যৌন সম্পর্ক বিষয়ক আকছার কুকথা সর্বক্ষণ শুনতে থাকে, তখন তার বাচনের মধ্যে খিস্তি খেউড় অন্যায় বা অস্বাভাবিক বোধ হয় না। প্রসঙ্গত বলি, আমার প্রতিবেশী আমারই এক ছাত্রী তখন সম্ভবত ক্লাস টু'তে পড়ে। সে তার খাতার এক পৃষ্ঠায় অত্যন্ত কুরুচিকর গালিগালাজ লিখে ভর্তি করেছিল। আমি সেগুলো উচ্চারণ করতে পারব না, এমনকি আমার উপস্থিতিতে সেগুলো খুলে দেখাতে পারব না বলে পড়ানোর শেষে ছাত্রীর মাকে বলেছিলাম, 'বৌদি, মনে হয় মান্তুর কিছু সমস্যা হচ্ছে। একটু নজর দিয়ে খাতাটা দেখবেন। খুব খারাপ কথা লিখেছে, আপনি দেখলেই হবে। মারধর বকাবকি করবেন না।' পরদিন ওই ছাত্রীর পিসি হাসতে হাসতে আমাকে জানালো, 'ওইগুলি কোনও খারাপ কথা না। এইগুলি তো দাদা'রা হামেশাই কয়। তবে দিদিমণি, এইডা কিন্তু মানতেই হইব, বানান দ্যাহেন, একখানও ভুল লেখে নাই।' আর বৌদি জানালেন, 'বিয়ের পর প্রথম প্রথম এ বাড়ির কথাবার্তা শুনলে আমি লজ্জায় মুখ ঢাকতাম। মনে হত কান থেকে বুঝি রক্ত বেরিয়ে আসছে। এখন সবই সয়ে গেছে।' পরিবার পরিবেশে যা শুনছে, যা দেখছে, সেগুলোই মুখে বলছে ও কাজে করে দেখাচ্ছে।

অবাধ্য দুর্বিনীত কোনও পড়ুয়ার অভিভাবককে ডেকে পাঠিয়েছি। দুদিন পর হাজির হল সেই ছাত্রের দিদিমা। তিনি জানালেন, 'আমি বুড়ো মানুষ, আমাকে দয়া করে ডেকে পাঠাবেন না। যা করার আপনারাই করবেন।' শুনলাম, ওই শিশুর মা বিবাহ-অতিরিক্ত একটি সম্পর্কের কারণে সন্তানকে দু' বছর বয়সে ফেলে রেখে অন্যত্র গমন করেছেন। নিশ্চয়ই আমার নারীবাদ এই স্বাধীনতা অনুমোদন করে। তার বাবা এই সন্তানের কারণে আর বিয়ে করেননি। কিন্তু একটু দূরে চাকরি করেন, ফিরতে রাত হয়। জামাই খুব ভালোমানুষ। এ ধরনের সিঙ্গল পেরেন্ট চাইল্ড বা নো পেরেন্ট চাইল্ড'এর সংখ্যা ইদানীং সংখ্যায় বাড়ছে। এদের চোখে নারী-পুরুষের সম্পর্কগুলি কোন মানদন্ডে দেখা হয় ভাবুন তো। মোবাইল ও নেট দুনিয়ার দৌলতে স্মার্টফোনে নাবালক ভাই বোন ব্লু ফিল্ম দেখছে। আবার সেই ব্লু ফিল্মকে নিজেরা অনুশীলন করছে। তারপর বাড়িতে জানাজানি হবে সেই ভয়ে নাবালক ভাই নাবালক বোনের গলায় ছুরি চালাচ্ছে। 

আসলে আমি বলতে চাইছি, ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি। একটি মানসিক বিকৃতি। সেই বিকৃতির হাত ধরে এসেছে ধর্ষণ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি নাগরিকের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারেন না, নাইট ক্লাব থাকবে না, আপনি গণতান্ত্রিক সমাজে বলতে পারবেন না, রাত্রে হোটেল বারে মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, এটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের প্রশ্ন। সেই কারণেই আপনি বলতে পারেন না, মেয়েদের নাইট ডিউটি দেওয়া যাবে না। সেই কারণেই আমরা বলতে পারি না, 'মেয়ে মানুষ' লেট নাইট পার্টি করে বাড়ি ফিরবে না। এটা সমানাধিকারের প্রশ্ন, আমি এই অধিকারের প্রশ্নে একমত। 

কিন্তু স্মরণে রাখবেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রেই এই সমানাধিকারের মধ্যেও কিছু বিশেষ অধিকার রাখতে হয়। ধরুন, কর্মস্থলে মেটারনিটি লিভ তো রাখতে হয়, সমাজের স্বার্থে। বাসে লেডিজ সিট, ট্রেনে সংরক্ষিত লেডিজ কম্পার্টমেন্ট, এসবের তো প্রয়োজন আছে। অফিসে, সিনেমা হলে, শপিং মলে পৃথক লেডিজ টয়লেট প্রয়োজন হয় না? এগুলোকে অস্বীকার করব কীভাবে? আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন নারীর অধিকারের প্রশ্নে খুবই যুক্তিপূর্ণ ও বাস্তব সম্মত। তাঁর অধিকার চিন্তায় একটা পরিমিতি বোধ লক্ষ করা যায়। তিনি লিখেছিলেন, 'মেয়েদের শরীরের এবং মনের প্রকৃতি পুরুষের হইতে স্বতন্ত্র বলিয়াই তাহাদের ব্যবহারের ক্ষেত্র স্বভাবতই স্বতন্ত্র হইয়াছে। আজকাল বিদ্রোহের ঝোঁকে একদল মেয়ে এই গোড়াকার কথাটাকেই অস্বীকার করিতেছেন।'

ধরা যাক একজন নারী নাইট ক্লাব বা বারে সিংগার অথবা ড্যান্সার। তিনি ডিউটি শেষে আকন্ঠ মদ্যপান করে রাত্রি দুটোয় বাড়ি ফিরছেন। এ পর্যন্ত কিছু সমস্যা নেই। কিন্তু সেই নারীর নিজস্ব কোনও বাহন নেই, এখানেই সমস্যা শুরু। তিনি লিফট চাইলেন অন্যের গাড়িতে, পেলেন। সেই গাড়িতে চার যুবক তারাও মদ্যপ। আকন্ঠ মদ্যপান করে আছে। এবার বলুন, ওই নারী গাড়িতে ওঠার পর কি তাঁকে মাতৃজ্ঞানে ও ভগ্নীজ্ঞানে তাঁর ঠিকানায় সুযোগ-সন্ধানী মাতালরা পৌঁছে দেবে? এখানেই এসে পড়ে সূচনায় উল্লিখিত মন্তব্যটি -- 'All men have the potential to rape.'। কিন্তু তার মানেই সবাই রেপিস্ট নয়। কিন্তু বিশেষ বিশেষ কতকগুলো শর্ত যখন তার হিতাহিত জ্ঞান, কাণ্ডজ্ঞান, উচিত অনুচিত বোধ নষ্ট করে দেয়, তখন সে একজন রেপিস্ট হতে পারে। নানান কারণে এই সেন্সরটি বিকল হতে পারে। তার কয়েকটি উল্লেখ করেছি মাত্র। এই ঘৃণ্য সামাজিক অপরাধটি যে সমস্ত কারণ থেকে উদ্ভূত তার অধিকাংশই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, নিয়ন্ত্রণে থাকে না। কিন্তু কিছু বিষয় আছে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। 

আমি যেন কোনওমতেই প্ররোচনার কারণ না হই। কদিন আগেই মমতাশঙ্কর এরকম একটি কথা বলার কারণে যথেষ্ট ট্রোলড ও সমালোচিত হয়েছেন। এমনকি কেউ কেউ পাল্টা উস্কানিমূলক মন্তব্য ও ছবি ছেপেছেন। সেটা যার যার ভিন্ন রুচি। ভগবান বুদ্ধ গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকবেন, তার চারপাশে যতই তাকে প্ররোচনা দেওয়া হোক, এটা একটা আইডিয়াল কনসেপ্ট। ঠিক তেমনি, কেন রাত্রি দুটোয় একজন মেয়ে রাস্তায় নিরাপদ থাকবে না? রাত্রি দুটোয় শুধু তো একজন মেয়ে নয়, আমরা কেউই নিরাপদ নই। ছেলে হলে তার সর্বস্ব ছিনতাই হতে পারে। বাধা দিলে প্রাণটিও। আর মেয়ে হলে যথাসর্বস্ব, প্রাণ ও সেই সাথে তার আব্রু ইমান। রাস্তার কুকুরও বেশি রাতে আপনাকে রাস্তায় অনুমতি দেয় না। আপনি বলবেন, রাতে কেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ পেট্রোলিং থাকবে না? গাড়ি থামিয়ে কেন চেক করা হবে না, মদ্যপ কিনা, গাড়িতে কারা যাচ্ছে, ভেতরে কী হচ্ছে, এটা নজরদারি করা দরকার। না, সেটাও হবে না। নীতি পুলিশি? ব্যক্তিগত পরিসরে নাক গলানো? তদুপরি এত রাস্তা, এত অলিগলি, এত এত গাড়ি, পেট্রোলিং করে এই নজরদারি সম্ভব? তার চেয়ে ভালো হয় না যে, রাত্রি দশটা বা এগারোটার পর বার বন্ধ হয়ে যাবে, নাইট ক্লাব বন্ধ হবে। জানি, এই প্রস্তাবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, নাগরিক অধিকার হৈ হৈ করে উঠবে। 

বাস্তবিক, আমরা কেউ কি নিরাপদ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নদীপ, সে কি সুরক্ষিত ছিল? সেটা ছিল ২০২৩'এর ৯ অগস্ট। তার ওপর যা হয়েছে, তাকে নগ্ন করে তাকে দিয়ে যা যা বলানো ও করানো হয়েছে, এমন কি প্রতিষ্ঠা দিবসের নামে পিতা-মাতার দৈহিক মিলনের দিনটি পর্যন্ত তাকে দিয়ে উচ্চারণ করানো হয়েছে। এটা কি যৌনপীড়ন নয়? শোনা যায় এই সমস্ত পীড়নে সিনিয়র দাদাদের সাথে সিনিয়র দিদিরাও থাকে, মজা উপভোগ করে।  আর অনিতা দেওয়ান'এর ধর্ষণের কথাটা উচ্চারিত হয় একটি বিশেষ কারণে; ওই ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন, এ তো হতেই পারে। 

অথচ কেতুগ্রামে একটি বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। সংবাদপত্রেই পড়েছি, ডাকাতরা সেই বাড়ির সর্বস্ব টাকা পয়সা গয়না লুঠ করে। তখন বাড়ির মেয়েটি ডাকাত সর্দারের পায়ে ধরে বলে, জেঠু, আমার বিয়ের জন্য সংগ্রহ করা এইটুকুই ছিল শেষ সম্বল। এগুলো তুমি নিয়ে গেলে আমার আর বিয়ে হবে না। তোমরা বরং আমাকেও মেরে রেখে যাও। সংবাদে প্রকাশ, এরপর ডাকাত সর্দার সমস্ত সোনা দানা অর্থ ফেরত দিয়েছিল। বাড়ির সবাইকে ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি কিছু অতিরিক্ত টাকা-পয়সাও তাদের দিয়ে গিয়েছিল। কথা দিয়েছিল বিয়ের দিন আশীর্বাদ করতে আসবে। বোঝা যায়, অনেক ক্ষেত্রেই সেন্সর নষ্ট হয়ে যায়নি। লুঠপাটের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রাপ্তি ধর্ষণের সুযোগ তারা কিন্তু নেয়নি। 

আমার মনে হয়, সমস্যাটা নারীর অধিকার, পুরুষতন্ত্র এসব নয়। সমস্যাটা হল ভেতরের মানুষটা, তাকে তো আগে মানুষ হতে হবে, তারপর সে নারী বা পুরুষ, চোর বা পুলিশ, সাধু অথবা ডাকাত ইত্যাদি। এনআরএস মেডিকেল কলেজে ছাত্ররা যখন আধপাগল কোরপান শাহকে ধরে হোস্টেলে এনে গণ পিটুনি দিয়ে হত্যা করে, তখন তাদের পরিচয় ডাক্তার নয়, অমানুষ। তিলোত্তমার ধর্ষক তেমনি সিভিক পুলিশ নয়, একজন অমানুষ।

কী চোখে দেখি, প্রশ্নটা এইখানে। খুব তৃপ্তির সঙ্গে স্মরণ করছি, বছর দশ আগের একটি ঘটনা। এপিডিআর'এর এক সভায় আমার এক দাদা স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীকে বলেছিলাম, 'কত দিন পরে দেখা। তোমাকে দেখতে খুব ভালো লাগছে।' সেই দাদা শুনে মুচকি হাসল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য এক মানবাধিকার কর্মী দাদাকে বলল, 'তুমি কেমন আশ্চর্য মানুষ গো! মালবিকার মতো একজন ভদ্রমহিলা তোমাকে সুন্দর বলছে, আর তুমি একটুও কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে রামগরুড়ের ছানা?' সেই দাদা বলেছিল, 'আমি মালবিকাকে একজন মেয়ে হিসেবে দেখি না, দেখি বোন হিসেবে। আর ও আমাকে পুরুষ হিসেবে নয়, দাদা হিসেবেই দেখে।' এই কমপ্লিমেন্ট আমি কোনওদিন ভুলব না। আর দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা যদি সামাজিক সমস্যা হয়, তাহলে আপনি নিশ্চিত জানবেন, দাদা কাকা দাদু এদের কাছে যেমন চার বছরের শিশুকন্যাটি নিরাপদ নয়, ইচ্ছাকৃত ভাবেই তাদের এখানে সেখানে স্পর্শ করা হয়, ঠিক তেমনি দিদি মা কাকিমা ঠাকুমার হাতেও চার বছরের শিশু পুত্রটিও খুব নিরাপদ নয়। শ্রীকৃষ্ণ বিষয়ক একটি টিভি সিরিয়ালের একটি এপিসোড একদিন হঠাৎই চোখে পড়ে যায়। দেখি, খুব ছোটবেলায় কৃষ্ণকে মানে গোপালকে নিয়ে পাড়ার কাকিমা পিসিমা দিদি মামীমা'দের অদ্ভুত ধরনের আদর করার হিড়িক ও চোখে পড়ার মতো কিছু কার্যকলাপ। দেখে বুঝেছিলাম, শৈশবে যার এই ধরনের অভিজ্ঞতা, সে তো পুকুর পাড়ে অন্যদের বস্ত্রহরণ করবেই। পাড়ায় বা কোনও কলেজে একটু গোবেচারা শান্তশিষ্ট ছেলেকে নিয়ে মেয়েরা কেমন আলোচনা ও খোরাক তৈরি করে সে অভিজ্ঞতাও অনেকের আছে। আসলে ওই যে একটা ম্যাচো ফিগার, উন্মুক্ত সারা গায়ে লিপস্টিকের দাগ, চুম্বনের লক্ষণ বহন-- এসব তো বিপরীতমুখী ধর্ষণের ভাষ্য নির্মাণের চেষ্টা। আজকাল সিনেমায় যেমন অপ্রয়োজনে, জোর করে গালাগালি খিস্তি সংলাপের মধ্যে ব্যবহার করা হয়। আবার মহিলা চরিত্রকে দিয়ে সেগুলো বেশি উচ্চারণ করানো যেন একটা দ্বিগুণ সার্থকতা। 

কিন্তু এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ধর্ষণের রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা আমার চোখে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, এই রাজনীতি ও রাজনৈতিক দর্শন নারী ধর্ষণকে একটা বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। ধর্ষণকারীকে বীর নায়ক সাজানো হয়। সেই ধর্ষক নায়ককে গলায় মালা পরানো, তাকে মিষ্টি মুখ করানো, বরণ করা হয়। ভি ডি সাভারকার লিখেছেন, আমরা গর্বের সঙ্গে ছত্রপতি শিবাজী এবং  চিমজি আপ্পার উল্লেখ করি যে, তারা যুদ্ধ জয়লাভের পরেও সসম্মানে কল্যাণের মুসলমান শাসনকর্তার গৃহবধূ এবং বেসিনের পর্তুগীজ শাসনকর্তার স্ত্রীকে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। সাভারকার বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করছেন, শিবাজী মহারাজ বা চিমজী আপ্পা কি করে ভুলে গেলেন, গজনির মাহমুদ, মোহাম্মদ ঘোরি, আলাউদ্দিন খিলজী এই সমস্ত মুসলমান শাসকদের কথা, যারা হাজার হাজার হিন্দু নারীর উপর শারীরিক অত্যাচার ও পীড়ন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। তাঁর বক্তব্যে উহ্য এই অভিযোগ যে, কেন শিবাজী বা চিমজি মুসলিম নারীদের ধর্ষণ না করে ছেড়ে দিলেন।

বিজেপি, আরএসএস'এর রাজনৈতিক কর্মসূচি, দৃষ্টিভঙ্গি ও দর্শনে বিধর্মীর ওপর, বিশেষভাবে মুসলিম মহিলার উপর ধর্ষণ ও হত্যা একটি স্বীকৃত ঘোষিত নীতি। এই কারণেই গুজরাত দাঙ্গায় বিলকিস বানো'র পরিবারের সকলের হত্যাকারী ও ধর্ষক দশজন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী গুজরাত সরকারের নির্দেশে মুক্তি লাভ করে। পার্টি তখন তাদের মিষ্টিমুখ করিয়ে, ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করে নেয়। একইভাবে সাংসদ ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে দেশের অলিম্পিক পদকজয়ী সোনার মেয়েরা যখন শ্লীলতাহানির অভিযোগ করে, তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিজভূষণ প্রধানমন্ত্রীর পাশে সংসদে উপবিষ্ট থাকেন। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটির ছাত্রী গণধর্ষিতা হলে ধর্ষণকারী ছাত্রদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, অভিযুক্ত ছাত্রদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে। তারপর যদি বা দু' মাস পর তাদের গ্রেফতার করা হল, সাত মাসের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয়ে গেল। কারণ, ওই অভিযুক্তরা বিজেপির আইটি সেলের নেতা। একই কথা বলা চলে মণিপুরের ক্ষেত্রে। সেই রাজ্যে এক বছরের বেশি সময় ধরে চলেছে জাতি দাঙ্গা। ৩৭টির বেশি ধর্ষণের ঘটনা এফআইআর হয়েছে। এফআইআর না হওয়া ঘটনার সংখ্যা অজস্র। মহিলাদের সেখানে নগ্ন করে প্রকাশ্যে প্যারেড করানো হয়েছে, সে সব ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। 

এই পরিস্থিতিতে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী সুরক্ষা এই সমস্ত প্রশ্নে আমার কাছে প্রধান হল, 

১) উল্লিখিত রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি। এটা শুধুমাত্র নারী ধর্ষণ ও নারী পীড়ন ঘটায় না, ঘটনাকে দার্শনিক বৈধতা দেয়। অতএব, তা সবচেয়ে বেশি বিপদজনক। একে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করা প্রয়োজন। এটা প্রতিহত না হলে সামাজিক আন্দোলন এগোতে পারবে না;

২) নারী সুরক্ষা ও নিরাপত্তার যাবতীয় বন্দোবস্ত ও সেই সংক্রান্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিশ্চয়ই সমর্থনযোগ্য ও আশু প্রয়োজন;

৩) নারী সম্পর্কে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন ঘটানো। অর্থাৎ, গোড়া থেকে সমস্যায় নাড়া দেওয়া চাই। এর জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী জীবন দর্শন, মনোভাব, সংস্কৃতি গড়ে তোলা দরকার। ওটা সরকারের কাছে জবাব চাওয়ার বিষয় নয়।

'কে তুমি নন্দিনী আগে তো দেখিনি' যদি বিনোদন হয়, তাহলে আঁচল ধরে টান পড়বে, অর্থবান সুপুত্তুর টেনে গাড়িতে তুলবে, ফার্ম হাউসেও নিয়ে যাবে। একদম গোড়াতেই এর বিনাশ দরকার। হুগলি ডিএম'স রিক্রিয়েশন ক্লাবের বাৎসরিক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত ছিল 'জীবনে কি পাব না, ভুলেছি সে ভাবনা'। সেটা ২০০৪-০৫ সালের কথা। সঙ্গে অবশ্য নাটক ছিল 'ফেরারী ফৌজ'। ক্যাবারে  থাকবে, বার থাকবে, দ্রোহের নাটক থাকবে আর মাতাল লিঙ্গ সাম্যে আস্থাবান হবে, এটা অতি কাল্পনিক। তবুও আমি মানুষের সুবুদ্ধির উপরেই আজও আস্থাবান। ১৪০ কোটির দেশে অন্তত একজন তো বলেছিল, মালবিকাকে আমি মহিলা হিসেবে দেখি না, ও আমার বোন। এইটুকুই আমার কাছে আশাব্যঞ্জক। এই পথেই তাই ক্রমমুক্তির আশ্বাস।