Pages

Friday, 2 August 2024

যমালয়ে রেল দফতর!

'কোন ল্যাজে মারি তায়'

মালবিকা মিত্র



সবাই জানত, সংখ্যালঘু সরকার জোট সরকার, ডাইনে আনতে বাঁয়ে কুলায় না। বাজেট তো যেন শরিকি বাজেট। মন্ত্রিসভা, স্পিকার, স্পেশাল প্যাকেজ, এসব নিয়েই বুঝি টানাটানি শুরু হবে। বাঙালরা বলে আড়াই হাতি গামছা আব্রু ঢাকে তো ইজ্জত ঢাকে না। কিন্তু সরকার বেশ স্বস্তিতেই মন্ত্রিসভা করল, স্পিকার করল, বাজেটও করল, হাবেভাবেও যেন 'চারশো পার সরকার'। কিন্তু ওই যে কথায় বলে, উপরওয়ালার মার দুনিয়ার বার। যখন যা দেয় ছপ্পড় ভরকে দেয়-- আশীর্বাদও, অভিশাপও। 

কথাটা কেন উঠল বলি। নির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন শুরু হল নিট-ইউজি পরীক্ষা দুর্নীতি দিয়ে। এই সরকারের যাত্রার একেবারে গোড়ায় গলদ। আরেকটু ঠিক শব্দ চয়ন করলে বলতে হয় 'বিসমিল্লাহ গলদ'। কিন্তু  কথায় বলে, কুকুরের পেটে নাকি ঘি সয় না, তাই বিসমিল্লাহ শব্দটা সবার কানে ঠিকঠাক ধরা পড়ে না। অতএব, ওই শব্দটা বাদ রাখলাম । শুধু তো নিট-ইউজি নয়, এক্সিট পোলকে কেন্দ্র করে শেয়ার বাজারের উত্থান-পতন এবং স্বয়ং মোদীজী ও অমিত শাহজীর শেয়ার নিয়ে দেশের জনগণকে পরামর্শ দান। সে এক বিরাট স্ক্যাম। অর্থাৎ, একটা নয়, দু' দুটো ঘোটালা নিয়ে এ সরকারের যাত্রা শুরু। তারপর এই সরকারের বয়স সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই শুরু হল একের পর এক রেল দুর্ঘটনার সিরিজ। লোকে বলছে, দফতরটাই 'রেল দুর্ঘটনা দফতর' হয়ে গেছে। কেউ বলছে সিরিয়াল কিলার। 

অশ্বিনী বৈষ্ণবের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই। এখানে ওখানে নতুন গাড়ির উদ্বোধন আছে, মোদিজীর স্তুতি করা আছে নিয়মিতভাবে। সংসদে বন্দেভারত, বুলেট ট্রেন, আরও অতিরিক্ত গতির গল্প শোনাচ্ছেন। কিন্তু মানুষের চরম দুর্গতি সম্পর্কে মন্ত্রী অবশ্য বলেছেন 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা' নিয়ে বিরোধীরা অহেতুক জলঘোলা করছেন। বেশ গলার জোরেই সংসদে কথাটা বলেছেন। আর তার সঙ্গে নিজেই জলটা ঘোলা করার জন্য বলেছেন, ১২ লক্ষ রেল কর্মচারী অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। তাদের কোথায় হাততালি দেবেন, থালি বাজাবেন, তা না, নিন্দা করছেন। প্রতিদিন দু' কোটি মানুষ রেলযাত্রা করে, সেই যাত্রীদের কথা ভাবুন, তাদেরকে এভাবে দুর্ঘটনার ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত করবেন না। কী অসাধারণ যুক্তির বিন্যাস!! 

বিরোধীরা তো ঠিক এই কথাটাই বলছেন যে, প্রতিদিন দু' কোটি মানুষের রেলযাত্রাকে সুরক্ষিত করুন। তাদের ও তাদের পরিবারবর্গের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানো বন্ধ করুন। বিরোধীরা এই কথাই বলছেন যে, রেল কর্মচারীদের অসহায় অবস্থা। যাত্রী সুরক্ষা, নিরাপত্তার বন্দোবস্তগুলো নেই। অথচ, তাঁরাই মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভের সামনে পড়ছেন। লক্ষ লক্ষ শূন্য পদ। এক একজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত ডিউটি দিতে হচ্ছে। এর ফলে মানসিক ভাবে রেল কর্মীরা প্রচণ্ড চাপের মধ্যে আছেন। একজন রেলের ড্রাইভারকে বলেছিলাম, প্রায়ই আপনাদের গাড়ি স্টেশন ছেড়ে অনেকটা এগিয়ে যায়। তারপর সেই গাড়িকে আবার পিছিয়ে আনতে হয়। এরকম হলে তো বড় দুর্ঘটনা এড়াতে পারবেন না। সেই ড্রাইভার উত্তরে বলেছিলেন, আমাদের পরপর কিছু নিয়ম আছে-- কখন ফার্স্ট ব্রেক টিপবেন, কখন সেকেন্ড ব্রেক এবং কখন ফাইনাল ব্রেক। এখন ধরুন, ফাইনাল ব্রেকটা যখন দিলাম সেটা কাজ করল না, তখন আমাকে আল্টিমেট যে ব্রেক, এয়ার ব্রেক দিতে হবে। সেটা দিতে গেলে মাঝে দু-এক সেকেন্ডের সময় লাগবে। সেই সময়ে ট্রেনটা তো গতিশীল, কিছুটা এগিয়ে যাবে। অর্থাৎ, একটা ব্রেক কাজ না করা এবং নিশ্চিত ব্রেকের সাহায্য নেওয়া-- এই দুইয়ের মাঝে যে সময়, সেই সময়ে গাড়িটা বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। এটা প্ল্যাটফর্মে গাড়ি দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে যেমন সমস্যা, একইরকম কোনও বিপদের সম্মুখীন হয়েও ঘটতে পারে, অর্থাৎ, গাড়ি দাঁড়ালো না। তখন ব্রেকটা কাজ করল না। 

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ব্রেক কাজ করে না। ড্রাইভার বলেছিলেন, চাকার সঙ্গে ব্রেকের ঘর্ষণ এবং এই ঘর্ষণজনিত ক্ষয়কে নিয়মিত চেক করতে হয়। ব্রেক পাল্টাতে হয়। লক্ষ করলেই দেখা যায়, ব্রেক আর চাকার ঘর্ষণে অনেক আগুনের ফুলকি ছুটতে থাকে। এটা যদি অনেকদিন ধরে হয় তাহলে তো ব্রেক আর চাকার মধ্যে সমন্বয় ঘটবে না। এ জন্যই গাড়ির নিয়মিত চেকআপ প্রয়োজন। গাড়িগুলোকে দুটি বা তিনটি ট্রিপের পর বিশ্রাম দিতে হয়। কিন্তু সে কাজটা হয় না। কারণ, তার জন্য চাই অনেক বেশি সংখ্যক কোচ। তবেই তো কোচগুলি বিশ্রাম পাবে। এতে নিরাপত্তা আছে, কিন্তু লোক-দেখানো নাম কেনা চটকদারি নেই। চটকদারি আছে নিত্যনতুন আরও দ্রুতগতি আরও আধুনিক মডেল গাড়ি কেনায়। দ্রুতগতির গাড়ি কেনা মানে বিদেশ থেকে নতুন মডেলের কোচ আনা। সরকারি ক্রয় মানেই তো ভিন্নতর গল্প। তার ওপর এই দ্রুত গতির গাড়ি চালাতে গেলে তার যাত্রাপথটাকে সবসময়ই ক্লিয়ার ও বাধাহীন রাখতে হবে। ফলে, কোনও গাড়িকে কোথাও সরিয়ে বন্দেভারতকে আগে জায়গা দিতে হবে। কর্তার গাড়ি যাবার জন্য যেমন অন্যান্য সব গাড়িকে রেড সিগন্যাল দেওয়া হয় রাস্তায়, অনেকটা সেই রকম। এভাবেই রেল যাত্রায় সমস্যার পাহাড়। কেবলই আধুনিক প্রযুক্তির আমদানি, দু' বছর আগের চালু করা কলাকৌশল বাতিল করা। নিত্যদিন শুনতে পাই গাড়ির সিগন্যাল, পয়েন্ট, এসব আধুনিক করার জন্য কত কত গাড়ি বাতিল করা হয়। অবশ্যই দুরন্ত বা বন্দেভারত বাতিল হয় না, বাতিল হয় সাধারণের ব্যবহার্য ট্রেন। 

রেলমন্ত্রী অশ্বিনী কত সহজে বলতে পারলেন 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা'। তাঁর মন্ত্রীত্বের ৬-৭ সপ্তাহে চারটি দুর্ঘটনা ঘটে গেল। এগুলি তাঁর কাছে 'ছোটখাটো ঘটনা'। আসলে সমস্যা হল, রেলমন্ত্রী তো আর রেলে চাপেন না, তিনি বিমানে যাতায়াত করেন। এখানেই যত গোলমাল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান না। শিক্ষামন্ত্রীর পরিবার সরকারি স্কুল-কলেজে পাঠ নেয় না। শুধু তো মন্ত্রীরা নন, সেপাই, সান্ত্রী, আমলা কেউ এগুলির ভোক্তা নন। এগুলোর ভোক্তারা হলেন, বেলা বারোটার বাজারে পোকায় কাটা বেগুন আর পচা আলু যারা কিনতে যান বা সে সামর্থ্যও যাদের নেই, তাঁরা। অতএব, বলাই বাহুল্য, এগুলো খুবই 'ছোটখাটো কিছু ঘটনা'। 

রেলমন্ত্রী বললেন, আগের সরকার দুর্ঘটনা প্রতিরোধ বা যাত্রী সুরক্ষায় কোনও ব্যবস্থা করেনি। আসলে, নিরন্তর মোদি বন্দনা ও মোদী ভজনা করে অশ্বিনী বৈষ্ণব ভুলেই গেছেন নিজেকে। আগের সরকারের রেলমন্ত্রীও যে ছিলেন তিনিই! বিগত ১০ বছর ধরে সরকারে বিজেপি, বরং এ বছর এনডিএ। অশ্বিনী বৈষ্ণব ঠিক কী বলতে চাইছেন? দোষটা এনডিএ সরকারের নয়, দোষটা পূর্ববর্তী বিজেপি বা মোদি সরকারের? 

অতি সম্প্রতি প্রবল বর্ষণে দিল্লিতে ৯৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে নবনির্মিত সংসদ ভবনের ছাদ থেকে সেন্ট্রাল লবিতে জল চুঁইয়ে পড়েছে। জাত বানিয়া যাকে বলে আর কি! কোথাও পয়সা খাওয়া ছাড়ে না। মন্দিরেও খায় সংসদ ভবনেও খায়। 'না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা'। এ সরকারের তৃতীয় দফায় একেই সরকার খোঁড়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলছে, তায় একদিকে নতুন নির্মাণ থেকে জল চুঁয়ে পড়ে, অন্যদিকে শিক্ষা দফতরের স্ক্যাম, রেল দুর্ঘটনা দফতর সৃষ্ট লাগাতার আতঙ্ক, এগজিট পোল স্ক্যাম-- সবে মিলে এ যাত্রা বড়ই কঠিন ও সঙ্গীন। 

এই সমস্যার মধ্যেই বিরাজ করছে আমাদের হুকোমুখো হ্যাংলা। যার মুখে কোনও হাসি নাই। নাই তার কারণ, একটার পর একটা সংকট ও উভয় সংকট তার সামনে এখন সটান হাজির। 'আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি...'। অথবা,

'বসে যদি ডাইনে,  লেখে মোর আইনে—

           এই ল্যাজে মাছি মারি ত্রস্ত;

বামে যদি বসে তাও,        নহি আমি পিছপাও,

           এই ল্যাজে আছে তার অস্ত্র।

যদি দেখি কোনো পাজি বসে ঠিক মাঝামাঝি

           কি যে করি ভেবে নাহি পাই রে—

ভেবে দেখি একি দায়        কোন্ ল্যাজে মারি তায়

            দুটি বৈ ল্যাজ মোর নাই রে।'


2 comments:

  1. অসাধারণ।‌

    ReplyDelete
  2. খাসা ! সুকুমার রায়ের এই ছড়া এতো সুপ্রযুক্ত হবে ভাবি নি আগে !

    ReplyDelete