Pages

Sunday, 7 July 2024

গণপিটুনি থেকে দাঙ্গা

প্রত্যকের পিঠে-বুকে ছুরি গাঁথা

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়



শরীরটা ভালো নেই। মনে হচ্ছে আমার ঘ্রাণশক্তির সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সকালে উঠে আমি খবরের কাগজ খুলি, কিন্তু বেশ কিছুদিন হল কাগজ খুললেই খালি মড়া পোড়ানোর গন্ধ নাকে আসছে। মাংস পুড়ে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমনটা। তারপর সারাদিন চতুর্দিকে ওই গন্ধটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ভয় করছে। তাই কয়েকদিন হল আমি আর সংবাদপত্র খুলছি না। কেউ কি বলতে পারেন, এর মধ্যে গণপিটুনিতে মৃতের সংখ্যা কতটা বাড়ল?

সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষের হৃদয় বোধহয় আজ সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে মানুষ কেবল মরছে আর মারছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা, 

        'ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে

        মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো ।

        অন্ধ ছেলে, বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায়

        পাথর কেটে পথ বানানো, তাই হয়েছে ব্যর্থ ।

        মাথায় ক্যারা, ওদের ফেরা যতোই থাক রপ্ত

        নিজের গলা দুহাতে টিপে বরণ করা মৃত্যু

        ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে

        মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।

        পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত

        মানুষ বড় সস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।'

মানুষের জীবন বড় সস্তাই তো, নইলে কীভাবে সম্ভব সকাতর চিৎকারের কানফাটা ধ্বনিকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত পিটিয়ে চলা, যেন প্রাণের অন্তিম বায়ু নির্গত হলেই এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি আলিঙ্গন করবে জনসমূহকে; তারই অপেক্ষায় এই বিভীষণ নির্মমতা চালিয়ে যাওয়া। ভিড় দ্বারা সংগঠিত এই হিংসার বিবিধ রূপ আছে – কখনও তা র‍্যাগিং, কখনওবা গণপিটুনি, আবার কখনও গণধর্ষণ। এই ধরনের হিংসা আমাদের সমাজে নতুন নয়, বহু পুরনো। কিন্তু সমাজ যত উন্নত হয়েছে ততই তো কথা ছিল এইসব হাড় হিম করা ঘটনাগুলির সংখ্যা হ্রাসের, কিন্তু কবির কথাই ঠিক – ‘কেউ কথা রাখেনি’। আদর্শের দ্বারা চালিত হয়ে যখন হিংসার পথ গ্রহণ করা হয় তখন তাকে বলে বিপ্লব, উঁচুতলার কর্তৃপক্ষের নির্দেশে যখন হিংসার ঘটনা ঘটে তখন তাকে বলে যুদ্ধ কিংবা যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা আর শূন্যতার দরুণ হিংসা সংগঠিত হয় তখন তা হয় গণপ্রহার। ভিড় তখন উন্মত্ত, ক্ষিপ্র ও অনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ভিড়ের এরকম আচরণের কারণ কী?

১৮৪১ সালে ফ্রান্সে জন্ম হয় গুস্তাভ লে বনের। ১৮৬৬ সালে তিনি ডাক্তারি পাশ করলেও আদতে ছিলেন একজন পলিম্যাথ। নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ওষুধ এবং পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি তাঁর আগ্রহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৯৫ সালে তিনি একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন যা তাঁকে আজও প্রাসঙ্গিক রেখেছে। বইটির নাম, 'দ্য ক্রাউড: আ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড'। বইটা এতটাই মৌলিক যে সিগমুন্ড ফ্রয়েড বারংবার এর উল্লেখ করেছেন, ব্যবহার করেছেন। ফ্রয়েডের বই 'গ্রুপ সাইকোলজি অ্যান্ড দ্য অ্যানালাইসিস অফ দ্য ইগো' গুস্তাভের বইয়ের দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত। গণ-আচরণে মনস্তত্ত্বগত ক্রিয়াকলাপ বিষয়ে বইটির আলোচনা। 

গুস্তাভ তাঁর গ্রন্থে ‘ভিড়’-এর সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ভিড় হল আবেগ, ভয়, ভালবাসা বা ঘৃণার মতো অনুভূতি দ্বারা একত্রিত হওয়া মানুষের একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক গোষ্ঠী’। এই লোকেরা তাদের বিচক্ষণতা ও বিচারের অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, বৌদ্ধিকভাবে নিকৃষ্ট হয়ে ওঠে এবং ধ্বংসাত্মক ও বীরত্বপূর্ণ উভয় কাজেই সম্ভাব্য ভাবে সক্ষম হয়। ভিড়ের ইতিবাচক দিক হল প্রতিবাদসভা। আবার এরই নেতিবাচক দিকটি হল আদর্শ ভুলে ক্রোধের সামনে আত্মসমর্পণ করে ভাঙচুর চালানো। গুস্তাভ লিখেছেন, 'An individual in a crowd is a grain of sand amid other grains of sand, which the wind stirs up at will.'।

ভিড় কিছু স্বতন্ত্র মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যেমন গোষ্ঠীর মধ্যে অজ্ঞাত-পরিচয় থেকে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস, অতিসংবেদনশীলতার সংক্রমণ এবং অযৌক্তিক আচরণ। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যক্তিদের চরম মনোভাব গ্রহণ এবং অপ্রত্যাশিত কাজ করতে পরিচালিত করে। কেননা নিজের পরিচয় গোপন থাকবে এরকম একটা বোধ বহু মানুষকে নিয়ে চলে যায় একটি আদিমতম পর্যায়ে যেখানে সে বর্বর, হিংস্র। আবার এই অতিসংবেদনশীলতা ভিড়ের মধ্যকার মানুষকে এমন বিভোর করে যে সে তখন কেবলমাত্র আদিম-প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়; মানুষ যেহেতু একটি সর্বভূক জন্তু, ফলে সে তখন সেই পশুত্ব-স্পৃহাটিকে উপভোগ করে যাকে একলা অবস্থায় শিক্ষা ও আইনি শাস্তির ভীতি অবদমিত রেখেছিল। গুস্তাভের মতে, এইখানেই ডারউইনকে ব্যর্থ ঘোষণা করে 'ভিড়' পিছন দিকে হাঁটা শুরু করে। আর এটাই ধীরে-ধীরে সমস্ত মানুষকে গ্রাস করে রচনা করে একটি উন্মত্ত ভিড়। ভিড়ের মধ্যে আরও তীব্রতর হয় অযৌক্তিকতার প্রভাব, তখন একটাই আওয়াজ যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খায়, ‘দুনিয়া রসাতলে যাক আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব’। প্রত্যেকটি একক ব্যক্তির চেতনা তখন সমগ্রের চেতনার রূপ পায়, এবং সেই ভিড় তখন যা-খুশি করতে পারে। গণপিটুনি তো তার সামান্যতম ক্রিয়া, আর ভয়াবহ ক্রিয়া হল দাঙ্গা। 

এছাড়াও গুস্তাভ ভিড়ের মানুষদের ছয়টি প্রত্যক্ষ মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও বলেছিলেন – 

এক) আবেগপ্রবণতা, খিটখিটে এবং সহজেই পরিবর্তনযোগ্য, অর্থাৎ, সেই সব ব্যক্তি যাঁরা দ্রুত রেগে যান এবং ঘন-ঘন আবেগ পরিবর্তন করেন; 

দুই) অন্যের পরামর্শ দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হওয়া, অর্থাৎ, যাঁরা বন্ধু বা মিডিয়া থেকে বিবেচনাহীন ভাবে যে-কোনও ধারণা গ্রহণ করেন; 

তিন) বিষয়ের সরলীকরণ ও অতিরঞ্জিত অনুভূতি; 

চার) আধিপত্যবাদী ও অসহিষ্ণু, অর্থাৎ, যে-সব ব্যক্তি অন্যের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিন্তু বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারে না; 

পাঁচ) নৈতিকতার মেরুকরণ যা উচ্চ ও নিম্ন যে-কোনও নৈতিক মানদণ্ডে যেতে সক্ষম এবং 

ছয়) যুক্তিতে অক্ষম, কিন্তু প্রবল চাক্ষুষ কল্পনাশক্তি। 

আছে পাঁচটি পরোক্ষ কারণও, যেমন - জাতিচিন্তা, গোঁড়া ঐতিহ্যবোধ, সমকালীনতাকে গ্রহণ করার অক্ষমতা, রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার স্তরে অবস্থান এবং শিক্ষা, যেগুলি ভিড়ের মনস্তত্ত্বগত দিকগুলিকে প্রভাবিত করে। নজরটান হল, কথাগুলি ১৮৯৫ সালে বলা। আজ তার কি ব্যতিক্রম দেখতে পাই? 

ফ্রয়েডও সমস্বরে বলেছেন যে, ভিড়ের অংশ হিসাবে ব্যক্তি অসীম শক্তির অনুভূতি অর্জন করে যা তাকে আবেগতাড়িত করে, অন্যথায় তাকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে দমন করতে হয়ে থাকে। ক্ষমতার এই অনুভূতিগুলি ব্যক্তিকে কেবল ভিড়ের অংশ হিসাবে কাজ করতে দেয় তাইই নয়, সুরক্ষার অনুভূতিও দেয়। ফ্রয়েড দুই ধরনের ভিড়ের কথা বলেন - একটি হল স্বল্পকালীন ধরনের, যা ক্ষণস্থায়ী তড়িৎ দ্বারা চিহ্নিত হয়, যেমন কোনও প্রবণতা, অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখলেই 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দেওয়া, অথবা নেতানেত্রীদের দেখলে 'চোর-চোর' বলে চেঁচানো কিংবা অবাঙালি দেখলে 'জয় বাংলা' বলে চিৎকার করা। আরেকটি হল স্থায়ী ধারার যা অত্যন্ত সংগঠিত প্রকৃতির, যেমন, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সামরিক বাহিনী কিংবা কোনও রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত দলীয় কর্মী। ফ্রয়েড অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, 'A primary mass is a number of individuals who have put one and the same object in place of their ego ideal and consequently identify with each other.'। 

আজ ধর্মের শৃঙ্খলা মানুষের মধ্যে অনেকটা নরম হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে রকেটের গতিতে। ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে – ধর্ম মানুষকে পাপের ভয় দেখিয়ে নৈতিকতার পথে চলতে বাধ্য করে। সেদিনই একজন সুহৃদ বলছিলেন জেলেদের গল্প। তিনি বললেন, ধর্ম যখন প্রবল ছিল তখন মানুষ প্রকৃতিকে সম্মান করত। এক হাতের কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ মাছ ধরত না, অবিরাম গাছ কেটে ফেলত না, ভিক্ষা দেওয়াকে কর্তব্য মনে করত ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান এসে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে এমনভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে যে তাদের আর পাপের ভয় নেই। ফলে, নৈতিকতাও আর থাকছে না। নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন মানুষ পশুবৎ বৈ আর কী! পাড়ার নেতা বিবেকহীন মাস্তানি চালাচ্ছে আর মানুষ বাধ্য হয়ে সহ্যও করছে, মন্ত্রীরা চুরি করছে কিন্তু আইন তাদের প্রায় কিছুই করতে পারছে না, সমস্ত নিয়ম-শৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখালেও আর বলার কেউ নেই, বড়লোকরা ক্রমশ বড়লোক হচ্ছে আর আমমানুষ ট্যাক্স দিতে একটু ভুল করলে নোটিশ খাচ্ছে ইত্যাদি ঘটনা মানুষকে অসহায় করেছে, ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসহীন করছে। তার উপরে আছে একটা নতুন যুগের পদধ্বনি যেখানে ডিজিটাল সমাজ ও তৎপ্রসূত রাজনৈতিক অর্থনীতি মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। সে পুরনো মূল্যবোধের কিছুই আর খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে, সে অস্তিত্ব সংকটের মুখে আরও হিংস্র হয়ে উঠছে এবং অসহায় ও দুর্বল মানুষের উপরে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে – কখনও ফেসবুকে কখনও রাস্তায় কখনও মেসবাড়িতে। তাহলে কি মুক্তির উপায় নেই?

আছে। পুঁজিবাদ মানুষের সামনে উন্মুক্ত করেছে অসীম অতৃপ্তি। বিনোদন আর বিলাসিতার অপরিসীম আকাশ। ভোগের অপরিমেয় লালসা মানুষকে লকলকে লালাঝরা জিভ দিয়ে অবিরাম চেটে চলেছে। শাস্ত্র বলে, ত্যাগের দ্বারা ভোগ কর। ঈশ উপনিষদের প্রথম মন্ত্রই হল, 'ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌।।' অর্থাৎ, '‘আমি-আমার’ জ্ঞান বর্জন করে, লোভকে সংযত করে, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করতে হবে, অপরের ধনে লোভের দৃষ্টি দিলে হবে না।' 

চরম ধনী থেকে অতি গরিব যদি এই অনুভূতির দ্বারা নিজেদের মনের সৃজন করতে পারে তাহলেই এই দুনিয়ায় একটা সুখ ফিরবে। সুখী মানুষ সর্বদাই ক্ষমাশীল। আর লোভী ও ঈর্ষা দ্বারা আবিষ্ট মানুষ হিংস্র, জিঘাংসা দ্বারা চালিত। কিন্তু এই পথই যে সহজ। ত্যাগের পথ কঠিন। ফলে, আমার নাকে ওই গন্ধটা বোধহয় থেকেই যাবে। একইসঙ্গে যে-মানুষগুলি এভাবে হিংসার পথ গ্রহণ করে, আমি দেখতে পাই তাদের প্রত্যেকের পিঠে-বুকে ছুরি গাঁথা – হতাশার, ক্লান্তির, লোভের ও ক্রোধের।


1 comment:

  1. ভালো লেখা, সুচিন্তিত মতামত। নিজেকে পরখ করে নেওয়ার মত যেমন তেমনি গোষ্ঠিবদ্ধ হিংস্রতা অনুধাবন করা যায়। বহুল প্রচার পাক।
    অসিত রায়

    ReplyDelete