Pages

Wednesday, 31 July 2024

'এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশে...'

কেন এই জলঘোলা?

সজল রায়চৌধুরী



প্রস্তাবটা এসেছে অদ্ভুত ভাবে। সুকান্ত মজুমদার, নিশিকান্ত দুবে, অনন্ত মহারাজ, গৌরী শঙ্কর ঘোষ যেন নিজের নিজের দায়িত্বে উত্তরবঙ্গ ও মালদা-মুর্শিদাবাদের চিকেন নেক'কে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র রাজ্য বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করার প্রস্তাব দিয়েছেন। শমীক ভট্টাচার্য সহ আরও কেউ কেউ প্রতিবাদ করে বলেছেন যে এটা বিজেপির লাইন নয়। কেউ যদি মনে করেন, বিজেপির নেতারা নিজেদের চরম হতাশা ও বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকেই এইসব উল্টোপাল্টা দাবি করছেন, তাহলে ভুল করবেন। শেক্সপিয়ারের ভাষায় বলতে হয়, দেখতে পাচ্ছেন না 'though this be madness, there is method in't.' (Hamlet)। বিজেপির নেতাদের বাংলা ভাঙার খুঁটিনাটি বক্তব্য ও তার খণ্ডনের পাগলামির মধ্যে একটা পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে। যেটা পরিকল্পিত। পশ্চিমবঙ্গকে টুকরো টুকরো করার ভাবনাটা ভাসিয়ে দিয়ে বাজার যাচিয়ে দেখা যাক। কোনও ফল না হলে 'আমাদের লাইন নয়' বলে মুখ মুছে পিছিয়ে আসা যাবে। 

ভোটে খারাপ ফল হ‌ওয়ার আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির শিরঃপীড়ার কারণ। এখন তো পশ্চিমবঙ্গের নাম শুনলেই তাদের 'মনে জাগে শিরোহীনের স্কন্ধ'। তাদের হাতে মোটে একটাই তাস-- বিভাজন; ধর্ম, ভাষা ও জাতিসত্তা ভিত্তিক বিভাজন। এই বিভাজনকে উসকে দিয়ে হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের পতাকার নিচে অতি কেন্দ্রীভূত প্রশাসন গড়ে তোলা। উদ্দেশ্যটা এত স্পষ্ট যে তা নিয়ে বেশি কিছু বলার নেই। কিন্তু এর ফলাফল হয়েছে উল্টো। ভোটের সময় পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল, কংগ্রেস ও সিপিএম একে অপরের বিরুদ্ধে লড়লেও বিজেপির ভাঙার গান শুনে প্রত্যেকে প্রতিবাদ করেছে।

খানিক ইতিহাসে যাওয়া যাক। প্রধানত বাঙালি অধ্যুষিত যে ভূখণ্ডকে আমরা বাংলা বা বঙ্গভূমি বলি, প্রশাসনিক ভূ-ভাগ হিসেবে তা পাঠান সুলতানদের আমলেই প্রথম উল্লিখিত হয়। গৌড়বঙ্গের কথা তার আগেও শোনা যায়। মোগল আমলে সুবে বাংলার মধ্যে বিহারের কিছুটা এবং উড়িষ্যার অংশ ছিল। চণ্ডীমঙ্গলে দেখি,

'ধন্য রাজা মানসিংহ বিষ্ণুপদাম্বুজ-ভৃঙ্গ

গৌড়-বঙ্গ-উৎকল-অধিপ।।'

সে সময় বাঙালি ছাড়াও কোল, মুন্ডা, খেরোয়াল, আদিবাসী, অস্ত্রাল, ভোটচিনি ইত্যাদি মূলবাসীরা ছিল। বাংলা কখনই শুধুমাত্র বাঙালির বাসভূমি ছিল না। ইংরেজ আমলে ভারতে ছিল বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, বোম্বাই প্রেসিডেন্সি ও মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি। ১৯১১ পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ইংরেজি শিক্ষার দৌলতে 'ভদ্রবিত্ত' বাঙালি ঔপনিবেশিক প্রশাসন ও শিক্ষালয়ের প্রধান শক্তি হিসেবে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। পাঞ্জাব থেকে অসম, ডাক্তার, অধ্যাপক, স্কুল-মাস্টার, পোস্ট-মাস্টার, স্টেশন-মাস্টার অনেকেই বাঙালি। আদালত বোঝাই বাঙালি উকিল ব্যারিস্টার। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সিতে তামিল ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে মারাঠি, গুজরাটি ও পার্সিদের প্রাধান্য। ভারতে  জাতিগুলোর অসম বিকাশ বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিসত্তাগুলোর ধাপকাটা সিঁড়ি বা hierarchy গড়ে তুলল। অনেক ক্ষেত্রে সনাতন জাতপাতের সিঁড়ির সঙ্গে এটা প্রায় সমানুপাতিক।

বাঙালির এই আধিপত্য জায়মান অন্য জাতির উত্থানের পথে প্রায়ই প্রতিবন্ধকতার কাজ করেছে। এই সংঘাত বিশেষ ভাবে ওড়িয়া ও অসমীয়াদের ক্ষেত্রে প্রবল হয়। (দ্রঃ-- ফকিরমোহন সেনাপতি ও লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার আত্মজীবনী)। ১৯০৫ সালে তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশ ভেঙে পূর্ববঙ্গ‌ ও অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ করা হয়। বলা হয়, প্রশাসনিক কারণেই এই বঙ্গভঙ্গ। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য‌ই এর পেছনে কাজ করেছিল। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনার পুনরাবৃত্তি করছি না।

১৯২০ সালে কংগ্রেসের কাজকর্ম নিজ নিজ ভাষায় চালানোর জন্য কংগ্রেসকে কুড়িটা প্রদেশে ভাগ করা হয়। প্রশাসনিক প্রদেশ যেমন‌ই হোক কংগ্রেস এই প্রথম ভাষাভিত্তিক প্রদেশের পথে এগোয়। অবদমিত জাতিসত্তার আন্দোলন তীব্র হয়। সাইমন কমিশনের কাছে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রদেশ দাবি করে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। বাংলা থেকে ওড়িশা ও বিহার আলাদা হয়। এই বঙ্গভঙ্গ অবশ্য সঠিক ছিল। ১৯৪৭ সালে ৬০০'র মতো দেশীয় রাজ্য সহ বিভক্ত ভারত স্বাধীন হয়। কিন্তু, এবার যে বাংলা ভাগ, তা অতীব শোচনীয়। 

ভারতে ১৯৫২ সালে মাদ্রাজ থেকে তেলুগু ভাষী অঞ্চলকে আলাদা রাজ্যে পরিণত করার দাবিতে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা রামুলু অনশন করে প্রাণত্যাগ করেন। পৃথক অন্ধ্র রাজ্য গঠিত হয়। ১৯৫৫ সালে ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশন গঠিত হয়। যে রাজ্যগুলি গঠিত হয় সেগুলিও বিভিন্ন সময়ে পুনর্গঠিত হয়। মোটামুটিভাবে বলা যায়, প্রায় সর্বত্রই ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য পুনর্গঠিত হয়েছে। অতএব, বিজেপির কোনও কোনও নেতার পশ্চিমবঙ্গ ভাগের এই আওয়াজ ভারতে রাজ্য পুনর্গঠনের মূল নীতির বিরোধী। মালদহ, মুর্শিদাবাদ বাংলাভাষী। সুতরাং, বাংলা থেকে আলাদা করার কোনও কারণ নেই। উত্তরবঙ্গে যেমন বিভিন্ন পাহাড়ি জনজাতি অবদমিত অবস্থায় আছে, তেমন বহু জনজাতির ভাষা ও সংস্কৃতি এবং জল, জঙ্গল, জমি থেকে তারা ২০০ বছর ধরে সব অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে হতে বিলুপ্তির পথে। কেন্দ্রকামী বিজেপি তাদের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি দিতেই পারে না।

বাঙালির কাছে এখন একদিকে যেমন বিজেপির খপ্পর থেকে নিজেদের ভূখণ্ডকে মুক্ত রাখতে হবে, অন্যদিকে ওই আদিবাসী 'মানহারা' মানবগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, মর্যাদা ও অধিকার বাংলায় অক্ষুন্ন রেখে যেতে হবে। অবাঙালি-বিরোধী কোনও বিদ্বেষমূলক স্লোগান নয়। হাতে হাত রেখে সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।


Saturday, 27 July 2024

কোন বইটা পড়ি?

আপন আলো

শ্রেয়া ঘোষ



বাংলার লেখকদের মোটামুটি দুটি শ্রেণি বিভাগ  আছে-- নামী লেখক ও অনামী লেখক। ফলত, বাংলা ভাষায় যে সব লেখাপত্র হচ্ছে তারও শ্রেণি বিভাগ অনুরূপ; অর্থাৎ, সে লেখা নামী লেখকের কলম জাত না অনামী লেখকের! তার মানে, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতার গুণগত মানের থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে লেখকের আভিজাত্য। এর ফলে আতান্তরে পড়েছি আমরা, যারা জাত ধর্ম বিচার না করে শুধু সৎ, উচ্চমানের ও চিত্তাকর্ষক সাহিত্যের সন্ধানী।  

বাংলায় প্রকাশিত বইপত্রকেও দু' ভাগে ভাগ করে ফেলা যায়। প্রথমত, কোনও পত্রিকা বা কাগজে ইতিমধ্যে প্রকাশিত লেখা গ্রন্থাকারে মুদ্রিত বা অপ্রকাশিত লেখার সরাসরি বই হিসেবে আত্মপ্রকাশ। এবার, পত্রিকাগুলিও অভিজাত ও অনভিজাত এই দু' ভাগে  বিভক্ত। কুলীন পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যায় ঠাঁই পাওয়া উপন্যাস বা ধারাবাহিক প্রকাশের অব্যবহিত পরেই-- পুজো থেকে বইমেলা-- এই মাস তিনেকের মধ্যেই বই হয়ে স্টলে স্টলে আসে। অপরদিকে অনামী পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা কফিনবন্দী মৃতদেহ সদৃশ-- না, অতিরিক্ত সম্মান দেওয়া হয়ে গেল বোধহয়-- বরং হিমঘরে বস্তাবন্দী পচা-ধসা আলুর সঙ্গে তুলনা করাই সঠিক হবে।

নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ছোটবেলা থেকে আমাদের বই পড়ার অভ্যেস তৈরি হয়েছে একটা ধারাবাহিকতা মেনে। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র পেরিয়ে সতীনাথ, জরাসন্ধ, বুদ্ধদেব বসু, আশাপূর্ণা, লীলা মজুমদার, জ্যোতিরিন্দ্র, নরেন্দ্র মিত্র। ক্রমশ সমরেশ বসু, বিমল কর, সুনীল, শীর্ষেন্দু, কবিতা সিংহ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দিব্যেন্দু পালিত, রমাপদ চৌধুরী, মতি নন্দী, নবনীতা দেবসেন, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, বাণী বসু। বিশুদ্ধ পারিবারিক তথাকথিত মূলধারা বা বাণিজ্যিক লেখা অথবা ভিন্ন ধারার সাহিত্য সবই বুভুক্ষুর মতো খেয়ে পরিপাক করার সুস্থ অভ্যেস ছোট থেকেই তৈরি হয়েছে। বছর চল্লিশেক আগে আমাদের কম বয়সে ঝড়ের মতো এলেন সমরেশ মজুমদার, আবুল বাশার, জয় গোস্বামী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, জয়া মিত্র। ক্রমশ আত্মপ্রকাশিত তিলোত্তমা মজুমদার, বিপুল দাশ। প্রথম রচনা থেকেই চমকে দিয়েছেন, সাগ্রহে অপেক্ষা করেছি পরের লেখাটির জন্য। শুরু থেকে এঁদের প্রতিটি প্রকাশিত লেখা পড়ে গিয়েছি। বই নির্বাচনের দায়িত্ব কালক্রমে অভিভাবকদের থেকে নিজের হাতে নিয়ে জীবনানন্দ, সন্দীপন, কমল চক্রবর্তী, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, নবারুণ, সুবিমল মিশ্র সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজস্ব রুচি তৈরি করে ফেলেছি।

অত্যন্ত দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে যে রুচি তৈরি হয়েছে, তা সাম্প্রতিক কালে বিপুল ধাক্কা খাচ্ছে। মনে পড়ে সেই সব লেখকদের কথা যাঁরা নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন শুরুর লেখাটি থেকেই । বিদ্যুৎ চমকের মতো ঝলসে দেওয়া লেখা সব। এখন কোথায় সেরকম লেখা? তথাকথিত নামী ও অভিজাত পত্রিকার লেখাগুলি শুধুই হতাশ করে। স্পষ্টত কোনও অনুশীলন বা প্রস্তুতি ছাড়াই একেকটি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন লেখক। লেখা শেষ করেই পাঠিয়ে দিচ্ছেন প্রকাশের জন্য আর তা মনোনীতও হয়ে যাচ্ছে সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সাময়িক পত্রিকায় বা দৈনিক কাগজের রবিবারের পাতায়। এ হেন পরিস্থিতিতে এই সব লেখকদের আর কোনও চেষ্টাই থাকে না নিজেদের লেখার মান উন্নত করার। এই কারণেই বাংলা সাহিত্যের মান গুণোত্তর প্রগতিতে নিম্নগামী। 

বহুল প্রচারিত ও বিজ্ঞাপিত এই সব লেখা ক্রমাগত পড়তে পড়তে পাঠকের রুচিরও অবনমন হচ্ছে। লেখকরা নিজের লেখার মান উন্নত না করে পাঠককে ভয়ঙ্কর রকম নির্বোধ ভাবছেন। অধিকাংশ লেখাপত্র ছোটগল্প বা উপন্যাসের ন্যূনতম শর্তটুকুও পূরণ করছে না। অকিঞ্চিৎকর ও গতানুগতিক বিষয়-ভাবনা, নিম্নমানের ভাষা আর দুর্বল নির্মাণ ও উপস্থাপনার ফলে আজকের গল্প, উপন্যাসগুলি সাহিত্য পদবাচ্যই হয়ে উঠছে না। বারে বারে ঘুরে ফিরে আসছে সাদামাটা প্লট আর গতানুগতিক বিন্যাস। যেমন,

১) স্কুলের পুনর্মিলন উৎসবে প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিত্ত প্রাক্তনীদের ভীড়ে অভাবী বা সামাজিক আভিজাত্যে তুলনায় খানিক নিচুতলার ছাত্রের অস্বস্তি বা অপমান;

২) খুন বা সেরকম কোনও অপরাধ ঘটানো ব্যক্তি নিজের শরীর থেকে নির্গত দুর্গন্ধে মানসিক স্থিতি হারিয়ে মনোবিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন;

৩) পৌরাণিক ঘটনার আদলে বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্করহিত কোনও কাহিনি;

৪) ভয়ঙ্কর সব হাসির গল্প। হাসির গল্পের ইলাস্ট্রেশনে চরিত্রদের চেহারা কখনও স্বাভাবিক হবে না আর নামকরণও একঘেয়ে প্যাটার্নে। কতদিন, কতদিন ধরে এই বৃত্তে পাক খাব আমরা পাঠকরা? পরিণত সাহিত্য ক্রমশ দুর্লভ।

প্রতিভার দেউলিয়াপনা? 

গত দশ বছরে বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনও লেখক এলেন না যিনি প্রতিভার এই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে লিখছেন, এই ঘটনাটি কিন্তু খুবই অস্বাভাবিক। ফলে, স্বাভাবিক যে কথা মনে আসে তা হল, ভালো লেখা রচিত হচ্ছে কিন্তু তা বৃহত্তর পাঠকের সামনে আসছে না। ঘন অন্ধকারে সহস্র ভোল্টের স্পার্ক ঝলসাচ্ছে কদাচিৎ কিন্তু সে ঝলকানি অতি দুর্লভ। একজন লেখকের পক্ষে একটি মাত্র ভালো উপন্যাস বা গল্প লিখে হারিয়ে যাওয়া তো সম্ভব নয়। তাহলে? 'দেশ' পত্রিকাতেই বহু বছর আগে একবার প্রচ্ছদ কাহিনি হয়েছিল মধ্যমেধার জয়জয়কার। মেধাবী লেখাগুলির হারিয়ে যাওয়ার পিছনে কি এটাই কারণ? 

নিজস্ব অভিজ্ঞতায় দীর্ঘ সময় ধরে পরিচিত বৃত্তে শুনেছি/ পড়েছি  কোনও কবি বা লেখকের একের পর অসাধারণ কবিতা বা কাহিনি। কোনও নামী পত্রিকায় সেগুলি মুদ্রিত হতে দেখিনি। কদাচিৎ হয়তো ছাপা হয়েছে একখানি লেখা যেটি নিতান্তই সাধারণ। তার মানে কি অভিজ্ঞ সম্পাদক পাঠকের রুচি বা মেধা  সম্বন্ধে একটা  ধারণা তৈরি করে নিয়েছেন আর সেই অনুসারে জনপ্রিয়তার স্বার্থে লেখার মানের সঙ্গে আপস করছেন? অথচ অতীতে বাংলা সাহিত্যে প্রাতঃস্মরণীয় সম্পাদকেরা পাঠকের রুচি নির্মাণে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়  ভূমিকা নিয়ে, ক্রমাগত স্রোতের প্রতিকূলে গিয়ে সৎ সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছেন। 

আমি জানি না কী কারণে আধুনিক সাহিত্যের সেরা সম্ভারে ক্রমাগত পৌরাণিক আখ্যান! জানি না কেন সাম্প্রতিক সাহিত্যে প্রেত পিশাচের বাড়বাড়ন্ত। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায় লেখা পাঠানোর নিয়মাবলীতে সাতটি শর্ত থাকত। তার মধ্যে অন্যতম ছিল, 'নবীনরা যদৃচ্ছা পাগলামিও পাঠাতে পারেন কিন্তু বানান ও ব্যাকরণ ভুল থাকলে পড়ে দেখা হবে না।' আজ সত্যি বাংলা সাহিত্য অভিভাবকহীন। তাই, 'কুলীন' গোত্রীয় পত্রিকার বার্ষিক গল্প সংখ্যায় একই ব্যক্তির সম্পর্কে 'করত', 'পেত' ইত্যাদি হীনতর ক্রিয়া পদের পাশে নির্দ্বিধায় সর্বনাম 'তিনি'র সহাবস্থান। অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার-- 'অথচ এই ট্র্যাডিশন ফলো করতে গিয়ে'-- এই ধারা অনুসরণ করতে গিয়ে কি এতটাই অপ্রচলিত বাক্যাংশ? গল্পের মুখ্য চরিত্র, পৌরাণিক কাহিনির ইন্দ্রদ্যুম্ন দিব্যি য-ফলা উড়িয়ে 'ইন্দ্রদুম্ন' হয়ে বিরাজমান। প্রাজ্ঞ সাহিত্যিকের গল্পের চরিত্র অক্লেশে বলে দেন– 'অতিরিক্ত মেধার কারণেই কি না কে জানে এক মেয়ের চেহারা রসকষহীন রুঠা'। একই নির্মিতিতে একের পর এক গল্প লিখে চলেছেন তো চলেছেন নামী গল্পকার, আর সম্পাদকও প্রকাশ করে চলেছেন ক্লান্তিহীন। পাঠকও অক্লান্তভাবে সে গল্প পড়ে চলেছেন তো চলেছেন। এ কি প্রতিভার দেউলিয়াপনা নাকি আকাশছোঁয়া আত্মম্ভরিতা-- পাঠকরা এর বেশি কিছুর যোগ্য নয়।

নোংরা প্লাস্টিকের মতো

লেখা ছাপা না হোক, নবীন লেখকরা সাহিত্য সভাগুলিতে ডাক পেলেই যেন হাতে চাঁদ পেয়ে যান। বিশেষত যে সভাগুলিতে ঘটে নক্ষত্রের সমাবেশ। বিখ্যাত সাহিত্যিকদের কথা শোনা আর নিজের লেখা তাঁদের শোনানো-- দুটো বিষয় নিয়েই অসম্ভব প্রাণিত থাকেন। প্রথম পর্ব অর্থাৎ শ্রোতার ভূমিকা তাঁরা যথাযথ পালন করেন। কিন্তু নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই নিজের বক্তব্যের মাধ্যমে সম্ভাবনাময় নবীনদের প্রতি যথাযথ উপদেশ দেবার পরই তাঁদের অন্যত্র অধিকতর প্রয়োজনীয় কাজের তাগিদে বিদায় নিতে হয়। তাঁদের বিদায় সম্বর্ধনা নিয়ে উদ্যোক্তারা অতি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাকি সভা ভাঙা হাটের মতো এলোমেলো হয়ে যায়। সম্প্রতি অপূর্ব একটি ছোট গল্প পড়লাম এই বিষয়ে-- পূর্ণ প্রস্তুতি আর উদ্দীপনা নিয়ে নতুন লেখা গল্প পড়তে সভায় গিয়েছিল যে তরুণ, বিশিষ্ট সাহিত্যিককে গল্প শুনিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে, শেষ অবধি সে গল্প শোনানোর সময়টুকু আর পায় না। সভা ভেঙে যায়। কিন্তু সে গল্প যার নাম 'জগদীশ ও শ্রীদেবী', তার শ্রোতা সে খুঁজে পায় ওই দমচাপা সভাঘরের বাইরে।

শেষ অবধি আশাটুকু কিন্তু রয়ে যায় বুকে আমাদের, আমরা যারা বাংলা সাহিত্যে বাঁচি। সকাল থেকে রাত অবধি দৈনন্দিনের ব্যস্ততায়, সময়ের সঙ্গে রেস লাগিয়ে হারতে হারতেও, বেদম হয়েও ফিনিশিং লাইন ছুঁয়ে ফেলি। সেই মুহূর্তে কেন্নোর মতো গুটিয়ে এতটুকু হয়ে অস্তিত্বহীন হয়ে যায় যত অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য-- 

-- গল্প  না দিয়ে একটা অণুগল্প দিতে পারেন, এই ধরুন দুশো শব্দের মধ্যে; 

-- পাঠিয়ে দেবেন দশটা গল্প, আমাদের নির্বাচকমণ্ডলী যদি প্রকাশের উপযুক্ত মনে করেন... 

-- মোটামুটি কত ফর্মা হবে? তিরিশ মতো লাগবে ধরে রাখুন। বুঝতেই তো পারছেন, এ সব বই তো কাটবে না। 

শেষ বিকেলে ঘনিয়ে আসা ঝড়ের দাপটে উড়ে যাওয়া নোংরা প্লাস্টিকের মতো টুকরো টুকরো শব্দগুলো ছিটকে যায়। আর সেই সময়ে কী করি আমি? নিজের ঘরে, নিজের বইয়ের তাকের সামনে দাঁড়াই। কোন বইটা টেনে নিই সে কথা কেউ জানবে না। মোবাইলে পাইকারাকে অর্ডার দিয়ে কোন বইটার দাম GPay'তে পাঠাব সেটা নির্বাচন করব শুধুই আমি।


Tuesday, 23 July 2024

বাজেট নিয়ে অযথা হৈচৈ

সরকারের দিন গিয়াছে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

বাজেট নিয়ে বেশ কিছু বছর লেখালিখি-বলাবলি বন্ধ করেছি। কারণ, বাজেটে কিছু যায় আসে না। এবারও কিছু লেখার কথা নয়! বরং কেন এইসব আলোচনা অযথা এবং এবারেও যে তাই, সেইসব কথাই ঈষৎ বলার চেষ্টা করব। 

গতকাল (২২ জুলাই) সংসদে যে অর্থনৈতিক সমীক্ষা (২০২৩-২৪) পেশ করা হল (প্রতি বছরই বাজেটের আগের দিন তা হয়), তার আলোচনা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই সমীক্ষার সঙ্গে বাজেটের কোনও সম্পর্ক নেই, যে সম্পর্ক থাকাটা বাঞ্ছনীয়, সেইজন্যই তা বাজেট-বক্তৃতার আগের দিন সংসদে পেশ হয়। সে সম্পর্ক নেই বলেই বাজেট নিছকই গেরস্তের আয়-ব্যয়ের আনুমানিক হদিশের মতো নিতান্তই এক বাঁদিক ও ডানদিকের অঙ্কের হিসেব মেলানোর ব্যর্থ প্রয়াস। গেরস্তের হিসেব যেমন মাসের শেষে মেলে না, তেমনই সরকারের হিসেবও বছর শেষে উলটপুরাণ!

কিন্তু এবারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা তিন-চারটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পেড়েছে:

কথা ১) দেশের বেকারত্বের সমাধানের প্রশ্নটি এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে- সে চ্যালেঞ্জ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এই প্রথম বেশ জোরের সঙ্গে সমীক্ষায় স্বীকার করা হল যে, ‘The biggest disruption for the future of work is the accelerated growth in AI, which is poised to revolutionise the global economy, India would not remain immune to this transformation.’। অতএব, সমীক্ষার মতে, এই সম্ভাব্য ব্যাপক অভিঘাতকে সামলানোর জন্য সরকার ও কর্পোরেট দুনিয়াকে ভাবতে হবে;

কথা ২) ক্রমবর্ধমান শ্রমবাহিনীর বোঝা সামলাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত অ-কৃষি ক্ষেত্রে প্রতি বছর গড়ে ৭৮.৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান করতে হবে;

কথা ৩) ২০২৯-৩০ সালে দেশে ২.৩৫ কোটি গিগ শ্রমিক তৈরি হবে যা মোট শ্রমবাহিনীর ৪.১ শতাংশে দাঁড়াবে। এই বিপুল শ্রমবাহিনীর জন্য যথাযথ সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজন;

কথা ৪) সিংহভাগ কর্মসংস্থান যেহেতু বেসরকারি ও কর্পোরেট ক্ষেত্রেই হয় এবং কর্পোরেট দুনিয়াও গত ১৫ বছরে আজ সব থেকে বেশি মুনাফা করেছে (২০১৯-২০’এর তুলনায় এই মুনাফা ২০২২-২৩’এ চার গুন বৃদ্ধি পেয়েছে), তাই পুঁজি ও শ্রমের মধ্যে যথাযথ বিভাজন ও নিয়োজন তাদেরই দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমীক্ষার মতে, যদিও এ কথা সর্বজনবিদিত যে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি কর্পোরেটদের এক অসীম মুগ্ধতা রয়েছে, কিন্তু তা বলে কর্মসংস্থানের প্রশ্নকে তারা এড়িয়ে যেতে পারে না, কারণ, এর সঙ্গে সামাজিক সুস্থিরতার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক রয়েছে।

এত স্পষ্ট করে আজকের বাস্তবতাকে অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তুলে ধরা গেলেও এবারের বাজেটে তার কোনও প্রতিফলন নেই। কারণ, সমস্যাটাকে সরকার বড়জোর চিহ্নিত করতে পেরেছে, তার সমাধানের যাদুকাঠি তার হাতে আর নেই। অর্থনীতির ভার চলে গেছে এক নৈর্ব্যক্তিক নিয়ন্তার হাতে, যার দুটি হাতের একটি ধরে রেখেছে সর্বৈব প্রযুক্তি-নির্ভর এক দানব কর্পোরেট দুনিয়া ও অপরটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সরকারের দিন গিয়াছে।

সরকার আপাতত যেটা করতে পারে তা হল, জনকল্যাণ। কর্মসংস্থানের ক্ষমতা তার নেই। অল্পবিস্তর স্থায়ী-অস্থায়ী সরকারি চাকরি তৈরি করা যেতে পারে, তাতে চিঁড়ে ভিজবে না। ফলে, এবারের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ল্যাজেগোবরে হলেন। তিনি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তিনটি প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছেন: ১) স্কিম এ – নতুন নিযুক্ত কর্মচারীর প্রথম মাসের মাইনে (১৫,০০০ টাকার উর্ধ্বে নয়) সরকারের তরফ থেকে নিয়োগকর্তাকে দিয়ে দেওয়া হবে; ২) স্কিম বি – ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মনিয়োজনে ইপিএফও মাধ্যমে অর্থ সহায়তা ও ৩) স্কিম সি – মালিকদের সহায়তা (এই স্কিমটি এখনও স্পষ্ট নয়)। বোঝাই যাচ্ছে, এইগুলি সব তালেগোলে মার্কা উদ্ভট স্কিম। নতুন নিয়োজিত প্রার্থীকে এক মাসের মাইনে সরকার দিয়ে দিলে বাকী মাসগুলি মালিকপক্ষ কেন সেই কর্মচারীকে মাইনে দিয়ে যাবে যদি না তাকে ৬ মাস পরে তাদের কোনও কাজে লাগে? অনেকটা ‘উজলা গ্যাস’ স্কিমের মতো, প্রথমবার ফ্রি সিলিন্ডার সহ গ্যাস ওভেন পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু পরের বার সিলিন্ডার কেনার টাকা কে জোগাবে সেইসব গরিব পরিবারে তার কোনও উত্তর নেই! সেই সঙ্গে বাজেটে আগামী পাঁচ বছরে ৫০০টি কোম্পানিতে ১ কোটি ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১ বছরের এই ইন্টার্নশিপে সরকার ৫০০০ টাকা করে ইন্টার্নদের মাসিক স্টাইপেন্ড দেবে। তারপর? এ তো অনেকটা ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পের মতো!

বাজেট পড়া যত এগিয়েছে, সেনসেক্স ও নিফটি’র সূচক তত নিম্নগামী হয়েছে। আপাত ভাবে মনে হবে, কর্পোরেট দুনিয়াও তেমন কিছু এ বাজেট থেকে পায়নি। কিছু পাওয়ারও নেই। নতুন এয়ারপোর্ট নির্মাণের ঘোষণা আছে। নির্মাণের পর লাভজনক হলে সেই এয়ারপোর্টগুলি প্রিয় কর্পোরেটরা হয়তো পেয়ে যাবে। এর জন্য বাজেটে লেখাপড়ার কোনও দরকার পড়ে না! দুই বেয়াদপ শরিককে তুষ্ট করতে অন্ধ্রপ্রদেশ ও বিহারকে ঢেলে সরকারি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই রাজনৈতিক সিদ্ধিপূরণ শাসকের দিক থেকে ‘কাজের কাজ’ বটে! বাজেটে এইসবই হতে পারে! যেমন, এই অস্থির ও অনিশ্চিত অর্থনৈতিক সময়ে জনকল্যাণের পরিধি ও বরাদ্দ বাড়িয়ে বাজেটে এক নতুন দ্বার খুলে দেওয়া যেতে পারত, কিন্তু সে সব কাজে শাসকের মন নেই। তারা সরকারি অর্থে সম্পদ তৈরি করে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার স্কিম বানাতে ওস্তাদ। অথচ, ২০২৩-২৪ সালের বৃটেনের বাজেটের দিকে যদি একবার তাকান- ৩৪১ বিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দ করা হয়েছে জনকল্যাণের খাতে, যা বাজেটে মোট অর্থ বরাদ্দের ২৯ শতাংশ; স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে দেওয়া হয়েছে যথাক্রমে ২৪৫ বিলিয়ন পাউন্ড (২০ শতাংশ) ও ১৩১ বিলিয়ন পাউন্ড (১১ শতাংশ)।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হচ্ছে কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার; একপ্রকার অনন্যোপায় হয়ে কর্পোরেটপতিদের কাছে আবেদন জানানো হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কিছুটা পাশে সরিয়ে সংবেদনশীল ভাবে কর্মসংস্থানের বিষয়টিকে দেখতে। অথচ, বাজেটে এর বটিকা হিসেবে উপযুক্ত জনকল্যাণের কোনও প্রকল্পের হদিশ নেই; গোঁজামিল দেওয়া কর্মসংস্থানের কিছু উদ্ভট পদক্ষেপের প্রস্তাব আছে মাত্র। কেন? ভাবনায় উঁকি দিলেও তার প্রয়োগে সাহসের অভাব? কারণ, বিভাজনের রাজনীতিই যাদের ক্ষমতা-সাফল্যের অন্যতম মাপকাঠি, তারা কী উপায়ে সর্বজনীন জনকল্যাণের রাজনীতির বাহক হতে পারে? জনকল্যাণ প্রকল্পের সুফলগুলি যে বিভাজন-রেখার পরোয়া করে না! ধর্ম বা জাতপাতের রঙ দেখে না! মনে পড়ছে, ২০১৬ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি মহাশয় তাঁর অংশের একটি পরিচ্ছেদে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ প্রণয়নের কথা লিখেছিলেন। কিন্তু তিনিও বাজেটে সে কথা উত্থাপন করেননি। পরে আর সে কথা শোনাও যায়নি।

তাই, বাজেট যদি ‘প্রত্যক্ষ জনকল্যাণে’ অর্থ বরাদ্দ না করতে পারে, তাহলে তা অর্থহীন এক প্রলাপ মাত্র। সামান্য এ-ধার ও-ধারে কর বাড়া-কমা’র জন্য বাজেটের দরকার নেই, তা বছরভরই চলতে পারে। বলাই বাহুল্য, বাজেট এখন গেরস্তের হিসেব রাখার খাতার মতো; যার তেমন বিশেষ কোনও কার্যকারিতা নেই।

 

Friday, 19 July 2024

কুর্নিশ তোমার ছাত্রদের

ভালো থেকো বাংলা

শ্রীপর্ণা চক্রবর্তী



'বাংলার ধনুকের ছিলায় ছিলায় যত টান 

তীরের ফলায় তবু বিষ নয় লালনের গান।' 

পুলিশের সামনেও হয়তো সেই ভরসাতেই ছেলেটি দাঁড়িয়ে রইল প্রথম গুলিটা এসে লাগার পরও, দু' বাহু প্রসারিত করে দ্বিতীয় গুলিটাকে সে জাপ্টে নিল চেনা বলিউডি কায়দায়, তারপর ধীরে ধীরে জমিনে লুটিয়ে পড়ল। নাহ, সামাজিক মাধ্যমে ঘুরে চলা দৃশ্যটা কোনও সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র থেকে তুলে আনা নয়, দৃশ্যটা বড়ই টাটকা এবং বাস্তব। স্থান রংপুর, বাংলাদেশ-- চলমান আন্দোলনের প্রথম শহীদ আবু সাঈদ। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় তাকে রাষ্ট্রযন্ত্র খুন করল। আবু সাঈদের পরে সে তালিকায় যুক্ত হয়ে চলেছে আরও নাম-- আসিফ, রাফি, ওয়াসিম, আদনান, সাব্বির... 

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাবির একদল ছাত্র প্রথম সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সেই সময়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৫৬ শতাংশ পদ সংরক্ষিত ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বজনদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, বিভিন্ন জেলার জন্য ১০ শতাংশ, জনজাতিদের জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ। তাদের এই সাহসী উদ্যোগ দ্রুতই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশের ছাত্ররা এক কাতারে এসে দাঁড়ায়, দাবি করে ন্যায়বিচারের। 'মেধার ভিত্তিতে চাকরি চাই, বৈষম্যের অবসান চাই'— রাজপথ থেকে সামাজিক মাধ্যম স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হতে থাকে। আন্দোলন ক্রমে ব্যাপক আকার নিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনজাতি এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য থাকা সংরক্ষণ বজায় রেখে বাকি সবরকমের সংরক্ষণ বাতিলের নির্দেশ দিতে কার্যত বাধ্য হন এবং তখনকার মতো আন্দোলন স্থগিত হয়। বলা যেতে পারে, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ছিল আন্দোলনের সফলতার প্রাথমিক স্বীকৃতি। 

কিন্তু পরবর্তীতে ২০২১-এ সাত জন মুক্তিযোদ্ধার স্বজনের পক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে এই নির্দেশনামার বিপক্ষে আপিলের প্রেক্ষিতে গত ৫ জুন পূর্বের সংরক্ষণ পদ্ধতির পুনর্বহালের পক্ষে রায় ঘোষণা হয়। এর পরই ছাত্র আন্দোলন পুনরায় শুরু হয় এবং তা দ্রুত ব্যাপক আকার ধারণ করে প্রায় সারা দেশের ছাত্র যুবদের স্বতঃস্ফূর্ততায়। যদিও পূর্ব সিদ্ধান্ত বহাল রাখার জন্য সরকার ইতিমধ্যেই উচ্চ আদালতে আবেদন করেছে। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ গত ১০ জুলাই এক মাসের স্থগিতাদেশ দিয়ে বলেছে, হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর বিষয়টি পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে শীর্ষ আদালত।

যে প্রশ্ন ঘুরে ফিরে আসছে তা হল, আদালতের স্থগিতাদেশ এবং বর্তমান সরকারের নীতি সবই যখন ছাত্র যুবদের মূল দাবির বিরুদ্ধে নয় তবে আন্দোলন এই ভয়াবহতা ধারণ করল কীভাবে? যখন ছাত্র লীগ, যুব লীগ ও আওয়ামী লীগের কর্মীদের আক্রমণে আহত শতাধিক শিক্ষার্থী, দেশের সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ, সড়ক বন্ধ, আন্তর্জালিক পরিষেবা নিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যাহত, নিরস্ত্র ছাত্রের মৃত্যুর সংখ্যাটা কোথায় গিয়ে থামবে তার উত্তরও অজানা, তখন রাষ্ট্রের ভূমিকা কী? এভাবে অস্ত্র দিয়ে ছাত্র আন্দোলন দমন কতটা প্রয়োজনীয় ছিল? 

আন্দাজ করা যেতে পারে, এক অনপনেয় হতাশা সে দেশের ছাত্র-যুব সমাজকে গ্রাস করেছে। পরিসংখ্যানের হিসেবে, ১৮-২৪ বছর বয়সীর মধ্যে ১৮.৮৭ শতাংশ বা প্রতি ৫ জনে ১ জন কোনওরকম শিক্ষাক্ষেত্র বা কর্মক্ষেত্রের আওতায় নেই। আনুমানিক ৩.২ কোটি শিক্ষিত বেকার। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে প্রতি ৩ জনে ১ জন মুক্তিযোদ্ধার স্বজন অর্থাৎ সংরক্ষিত আসনের আওতায়। বিশেষ করে যখন মেধা ও প্রাপ্যতার প্রশ্ন ওঠে, তখন এই পদ্ধতি অসাম্য ও বৈষম্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। এর সাথে যোগ হয় সাম্প্রতিক কালের দুর্নীতিতে ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা। এছাড়াও সরকারি দাবি অনুযায়ী, এই আন্দোলনে জামাত এবং অন্যান্য বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির ইন্ধন রয়েছে। তারা এই আন্দোলনকে ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে। যদিও রাজনৈতিক ময়দানে তা অত্যন্ত 'স্বাভাবিক পদক্ষেপ'।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইদানিংকালে বারবার চোখে পড়েছে প্রতিস্পর্ধী অবস্থান গ্রহণের মূল্য কিভাবে দিতে হয়। কন্নড় সাহিত্যিক এম এম কালবুর্গি, সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে ও নরেন্দ্র দাভোলকরের হত্যাকাণ্ড যদি না আমরা ইতিমধ্যেই বিস্মৃত হয়ে থাকি। আর তাই বিরুদ্ধ স্বরকে 'দেশদ্রোহীর' তকমা লাগিয়ে দেওয়া হোক কিংবা ভারত বন্ধু হাসিনার আন্দোলনকারীদের 'রাজাকার' হিসেবে চিহ্নিত করা-- সবই যেন সর্বাধিপত্যকামী শাসন প্রতিষ্ঠার ভাষা। অর্থাৎ, বিরোধীর কথা বলার পরিসরটিকেই না রাখা, এই তাদের একমাত্র পন্থা। দেখলে অবাক লাগে না-- পশ্চিমবাংলার মানুষ মৌলবাদী-একনায়কতন্ত্রী দল আর আপাত ভাবে কম একনায়কতন্ত্রী দলের মধ্যে দ্বিতীয় জনকে বেছে নেয় মন্দের ভালো হিসেবে। কিন্তু সংশয় হয়, ভারতীয় আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদের ফলে যে পরিমাণ ঘৃণা বর্তমানে বাংলাদেশের জনগণের মনে ভারত তথা ভারতীয়দের প্রতি দানা বাঁধছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে সে দেশে সম্পূর্ণভাবে মৌলবাদ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। 

কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ রাষ্ট্র মেরামতের যে স্বপ্ন দেখতে পারে, দেখাতে পারে, আমরা কি তা দেখতে ভুলে গিয়েছি? তা গত শতাব্দীর শেষের দিকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন (১৯৮০-১৯৯০) কিংবা সাম্প্রতিক কালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন (২০১৮) এবং সব শেষে সংরক্ষণ সংস্কার আন্দোলন (২০২৪)-- সব কটি ক্ষেত্রেই ছাত্রসমাজই মুখ্য পরিচালক থেকেছে। তারা হারিয়ে যায়নি, আপস করেনি, বিফল হয়নি। 

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৩/ ১৯৮৪ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ছাত্র সংগ্রাম বা গণতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয় এবং সেই লাগাতার আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর। উল্লেখ্য, সে সময়ে ২৪টি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে তৈরি হওয়া 'সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য' গঠনের আগে জোটে থাকা মূল দুটি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল ও বাংলাদেশ ছাত্র লীগ আলাদাভাবে বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। এরপরই এরশাদ সরকারের পতন এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার স্থাপন। 

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে বাস ধাক্কায় দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ঢাকার বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে ও দ্রুত সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরা পথে নেমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ শুরু করে, চালকদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি আটকায়। দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোড়ন তোলে এই আন্দোলন এবং সরকারকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করে। আন্দোলনের চাপে সরকার দ্রুত সড়ক নিরাপত্তা আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা পাশ করায়। আগেই বলা হয়েছে, চলমান আন্দোলনটির সূত্রপাতও সেই ২০১৮ সালে। এই ছাত্র আন্দোলনগুলো পর পর লক্ষ করলে বোঝা যায়, তাদের একতা এবং আন্দোলনের মাঝপথে খেই হারিয়ে না ফেলা-- এ দুটো পন্থা আন্দোলনে সফল হতে তাদের বড় সহায়ক থেকেছে।

আমাদের দেশে সিএএ বিরোধী আন্দোলনে এ দেশের ছাত্র-যুবদের সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলেও কোনওভাবেই তা ছাত্র আন্দোলন বা নিদেনপক্ষে ছাত্রসমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠদের আন্দোলন, এমনটা বলা যায় না। এ দেশ শেষ কবে কোনও সামাজিক বিষয়ে ছাত্র আন্দোলন দেখেছে তা সহজে মনে পড়ে না। শুধু দেশের কিছু তথাকথিত 'এলিট' শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আন্দোলনই আবর্তিত হতে থেকেছে সামাজিক মাধ্যমের পাতায় পাতায়। যেহেতু ভারতের বর্তমান ছাত্র আন্দোলনগুলো মূলত বামপন্থী রাজনীতির দ্বারা জোরালো ভাবে প্রভাবিত, তাই যা কিছু অনুজ্জ্বল তা কোনওদিনই সেভাবে আন্দোলনের বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারেনি। সেই কারণেই হয়তো আইআইটি খড়্গপুরে মারা যাওয়া ফাইজান আহমেদের জন্য এ দেশে কলরব ওঠে না। এর সঙ্গে আছে ঐক্যবদ্ধ না হওয়ার তীব্র চেষ্টা যা কখনও সরাসরি দলীয় রাজনীতির (যা সবসময়ই মানুষের থেকে বড় হয়ে দাঁড়ায়) বেশে, কখনও নীতি আদর্শের নামে, আর্থ-সামাজিক শ্রেণির পার্থক্যে, ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের গেরোয় আটকে পড়ে। তাই, ক্ষমতাতন্ত্রের সাফল্য আসতে দেরি হয় না, একনায়কের জয়ও আসে সহজে। 

এরই পাশাপাশি বলতে হয়, এই উপমহাদেশের সংরক্ষণের কথাও। খুব সম্ভবত ১৮৮২'তে উইলিয়াম হান্টার এবং জ্যোতিরাও ফুলের উদ্যোগে প্রথম সংরক্ষণের পরিকল্পনা হয়, যার পেছনে ছিল জাতপ্রথা, অস্পৃশ্যতার মতো নিকৃষ্ট সামাজিক ব্যাধি। তবে বর্তমানে যে সংরক্ষণ ব্যবস্থা ভারতে চালু রয়েছে তার প্রতিষ্ঠা ১৯৩৩'এ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামসে ম্যাকডোনাল্ডের ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’ এর হাত ধরে। গান্ধী এবং আম্বেদকরের ‘পুনা চুক্তি’ স্বাক্ষরও এ ক্ষেত্রে বহু আলোচিত। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই ভারতীয় সংবিধান অনুসারে (অনু: ১৫, ১৬) জাতের ভিত্তিতে বৈষম্য নিষিদ্ধ হয়, তবে সেই তালিকায় ছিল শুধুমাত্র তফসিলি জাতি ও জনজাতি। ১৯৯১ সালে তালিকায় যুক্ত হয় অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (অনুচ্ছেদ: ৩৪০)। অতএব বলা চলে, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংরক্ষণের বয়স কমপক্ষে সাত দশক উত্তীর্ণ।

অথচ, বৈষম্য আদৌ মোছা গেল কিনা, এ প্রশ্ন আমাদের মাথায় আসে না। আলোচনা পর্যালোচনা চলতে থাকে, সংরক্ষিত সমাজের সবচেয়ে ওপরতলার একদল আজন্ম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার পর তার পরবর্তী প্রজন্মও সেই সুবিধা ভোগ করতে থাকে। শ্রেণির বাকি অংশের কাছে সে সুযোগ আজও পৌঁছতে পারে না, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সে কথা ভুলেও তোলেন না, পাছে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয় সে ভয়ে। সাধারণ জনগণ-- অসংরক্ষিত আসনের জনগণ-- কাগজে-কলমে সংরক্ষণের অধিকারী অথচ সুবিধা-বঞ্চিত জনগণ প্রশ্ন করে না, কারণ, তারা প্রশ্ন করার জায়গাতেই কখনও পৌঁছতে পারে না। বৈষম্য জিইয়ে রাখাই যেন নেতাদের সুযোগ করে দেয় বৈষম্য দূরীকরণের পক্ষে রাজনীতি করার; সংরক্ষণ ব্যবস্থার তাই অবসান হয় না। নির্বাচন ব্যবস্থাটিও ক্রমে শুধুই জাত-ধর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। 

প্রতিবেশী দেশের ছাত্রদের সমাজের প্রতি এই দায় থেকে আমরা কতটা শিখব তা ভবিষ্যৎ বলবে। জানা নেই এ মৃত্যু মিছিল কবে থামবে, রাষ্ট্র কবে শিখবে অস্ত্র দিয়ে জোর দেখিয়ে সাময়িক আগুন নিভলেও তা সুদূরপ্রসারী হয় না। সুমনের গান ধার করে আবার বলি, 'স্মৃতিতে এখনও শুনি বঙ্গবন্ধুর আহ্বান, পূবের আকাশ ছোঁয় শান্তিতে ভোরের আজান'। এই বিশ্বাসটুকু অটুট থাকুক। ভালো থেকো বাংলা, কুর্নিশ তোমার ছাত্রদের।


Saturday, 13 July 2024

বুড়িগঙ্গায় প্রাণ!

দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ চলছে

বিবর্তন ভট্টাচার্য



প্রথম পর্যায়ে ৩.৪ কিমি দীর্ঘ বুড়িগঙ্গা সংস্কারের কাজে (চিঁড়েকল থেকে নতুন পাড়া ক্লাব পর্যন্ত) যে‌ সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছিলাম, তাতে আমাদের মনে হয়েছে, 'নদী সংস্কার হচ্ছে' এই বিষয়টি বেশ মাখো মাখো শোনালেও আগে দরকার নদীর খাত‌ থেকে বেআইনি দখলদারি উচ্ছেদ। পাটকাঠির গাদা, গোয়ালঘর, শৌচাগার, ধানের গোলা, ক্লাবঘর, কালীমন্দির, বাঁশের সাঁকো (এপার থেকে ওপারে যাওয়ার) এইসব উচ্ছেদের পর তবে বুড়িগঙ্গা আজ প্রবহমান। ঠিক এই কারণেই, শান্তিপুরে সুরধ্বনি নদীর সংস্কারে অর্থ অনুমোদিত হয়ে কাজ শুরু হলেও সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা পশ্চাদপসরণ করেছেন নদীখাত থেকে দখলদারি তুলতে না পেরে।

কার্যত, ১৩ জুন  ২০২৪ সকালবেলা বুড়িগঙ্গায় ১০০ জন মানুষ নেমে কচুরিপানা অপসারণের কাজ শুরু করেন। এর আগে ২৫ মে গঙ্গাপ্রসাদপুরে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষক ও মৎস্যজীবীদের যৌথ এই সভা ছাড়াও ৯ কিমি পথ টোটোতে করে প্রচার চালানো হয়। সভায় উপস্থিত ২০০ জন কৃষক ও মৎস্যজীবীরা সিদ্ধান্ত নেন, কোথায় কাটা মাটি রাখা হবে। এও ঠিক হয়, বুড়িগঙ্গার অধিকার বিন্যস্ত থাকবে, কৃষকদের পাট পচানোর জন্য দু' মাস এবং বাকী সময়‌ মৎস্যজীবীদের জন্য বন্টিত করে।‌‌ মশারি জাল ব্যবহার করা যাবে না। চওড়া এবং গভীর করে বুড়িগঙ্গা সংস্কার করতে হবে। বুড়িগঙ্গায় জলসরবরাহকারী নয়নজুলিগুলো‌ ভালো করে পরিষ্কার করে দিতে হবে। পাট পচানোর পর পাটকাঠি বুড়িগঙ্গা থেকে তুলে পরিষ্কার রাখতে ‌ হবে। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো সবাইকে মেনে চলতে হবে। একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষণীয় যে, কোনও রাজনৈতিক দল এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনি।

এবারে দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ নতুন পাড়া ক্লাব থেকে হেড়ের খালের ব্রিজ হয়ে জকপুর পর্যন্ত। Work Order অনুযায়ী, ৫,৬০০ মিটার দৈর্ঘ্যের সংস্কার চাকদহ পৌরসভা ও চান্দুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েত-১ (থানা চাকদহ) ৩০ শতাংশ কম রেটে ৬০ লক্ষ টাকায় সম্পন্ন হবে ও ১২০ দিনের মধ্যে কাজ শেষ করবে। এলাকার মানুষ আনন্দে আত্মহারা। এত দুর্নীতি, এত চুরি-চামারি, তার মধ্যে এই নদী আন্দোলন গণ-আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।  কাটমানি ছাড়া কোথাও কাজ হয় বলে মনে হয় না। কিন্তু, বুড়িগঙ্গা সংস্কার আন্দোলনের কর্মীরা এজেন্সিকে চা খাওয়াচ্ছে অথচ এজেন্সি তাদের কিছু খাওয়াতে পারছে না।

এর মধ্যে হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বুড়িগঙ্গায় প্রাণ সঞ্চার বিষয়টিকে শিক্ষা জগতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সচেষ্ট হয়েছেন। একটা স্লাইড ডকুমেন্ট ও রাইট আপ তৈরি করা হয়েছে যা ভারতের বিভিন্ন আইআইটি ও বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখানো হবে। গবেষকের বক্তব্য, বিশ্বে একমাত্র হাডসন রিভার ( Hudson)'এ- যেটি নিউ ইয়র্কে প্রবাহিত- ১৯৬০-৭০'এ সংস্কারের কাজ হয়েছিল। মাটির কাছের মানুষদের নিয়ে এইরকম হেজে যাওয়া, মজে যাওয়া নদী যদি প্রাণ ফিরে পায় তা অভূতপূর্ব এক ঘটনা বৈকি; কারণ, ভারত‌ ও পশ্চিমবঙ্গের কোথাও এমনতর ঘটনা আগে দেখা যায়নি। সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই ধরনের নদী সংস্কারের এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। আগামী ২০ জুলাই স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ে মৎস্যজীবী, কৃষক ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে এই ডকুমেন্টটি প্রদর্শিত হবে।  

পাশাপাশি, নদীর খাতে পাটচাষ তোলা সম্পর্কে কৃষকদের যথাযথ বোঝানো মৎস্যজীবীদের নিত্যদিনের কাজ। নিজেদের জীবন-জীবিকার কাজ বজায় রেখে প্রতিদিন পালা করে এই কাজের তত্ত্বাবধান করে চলেছেন মৎস্যজীবীরা। বুড়িগঙ্গা সংস্কার হলেই এই বর্ষায় মাছ ছাড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মৎস্য দফতর। ইতিমধ্যে শোল, ল্যাঠা, কালবাউস, মৃগেল, শিঙ্গি, মাগুর মাছ পাওয়া যাচ্ছে।

প্রতিদিন ৬টি জেসিবি ১০ ঘন্টা করে নিয়মিত কাজ করে চলেছে। এই বর্ষায় প্রচুর জল প্রবেশ করবে বুড়িগঙ্গায়। বুড়িগঙ্গায় জোয়ার-ভাটার জল প্রবাহিত হবে। চাকদহের নিকাশির জল ১৫ এমএলডি করে ফেলা হবে বুড়িগঙ্গায়। গত বছরেই মহালয়ায় এই বুড়িগঙ্গায় পিতৃতর্পণ করেছেন‌ এলাকার বহু মানুষ।

বলাগড়ের মৃতপ্রায় নৌ-শিল্প আবার প্রাণ ফিরে পাবে। নতুন মাটিতে নতুন ফসল-- এবার শীতেই এই সুবিধা পাবেন কৃষকরা।

এ বিষয়ে যারা আরও জানতে চান, বিশেষত কীভাবে বুড়িগঙ্গার প্রথম পর্যায়ের কাজ গত বছরে সম্পন্ন হয়েছে, তাঁরা এই ভিডিওটি দেখতে পারেন:

https://www.youtube.com/watch?v=QB_RYyOnoCU&t=7s


Sunday, 7 July 2024

গণপিটুনি থেকে দাঙ্গা

প্রত্যকের পিঠে-বুকে ছুরি গাঁথা

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়



শরীরটা ভালো নেই। মনে হচ্ছে আমার ঘ্রাণশক্তির সঙ্গে কিছু একটা হয়েছে। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো সকালে উঠে আমি খবরের কাগজ খুলি, কিন্তু বেশ কিছুদিন হল কাগজ খুললেই খালি মড়া পোড়ানোর গন্ধ নাকে আসছে। মাংস পুড়ে গেলে যেমন হয় ঠিক তেমনটা। তারপর সারাদিন চতুর্দিকে ওই গন্ধটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার ভয় করছে। তাই কয়েকদিন হল আমি আর সংবাদপত্র খুলছি না। কেউ কি বলতে পারেন, এর মধ্যে গণপিটুনিতে মৃতের সংখ্যা কতটা বাড়ল?

সভ্যতার অগ্রগতিতে মানুষের হৃদয় বোধহয় আজ সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গিয়েছে। চতুর্দিকে মানুষ কেবল মরছে আর মারছে। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা, 

        'ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে

        মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো ।

        অন্ধ ছেলে, বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায়

        পাথর কেটে পথ বানানো, তাই হয়েছে ব্যর্থ ।

        মাথায় ক্যারা, ওদের ফেরা যতোই থাক রপ্ত

        নিজের গলা দুহাতে টিপে বরণ করা মৃত্যু

        ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে

        মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।

        পথের হদিস পথই জানে, মনের কথা মত্ত

        মানুষ বড় সস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো।'

মানুষের জীবন বড় সস্তাই তো, নইলে কীভাবে সম্ভব সকাতর চিৎকারের কানফাটা ধ্বনিকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত পিটিয়ে চলা, যেন প্রাণের অন্তিম বায়ু নির্গত হলেই এক স্বর্গীয় সুখানুভূতি আলিঙ্গন করবে জনসমূহকে; তারই অপেক্ষায় এই বিভীষণ নির্মমতা চালিয়ে যাওয়া। ভিড় দ্বারা সংগঠিত এই হিংসার বিবিধ রূপ আছে – কখনও তা র‍্যাগিং, কখনওবা গণপিটুনি, আবার কখনও গণধর্ষণ। এই ধরনের হিংসা আমাদের সমাজে নতুন নয়, বহু পুরনো। কিন্তু সমাজ যত উন্নত হয়েছে ততই তো কথা ছিল এইসব হাড় হিম করা ঘটনাগুলির সংখ্যা হ্রাসের, কিন্তু কবির কথাই ঠিক – ‘কেউ কথা রাখেনি’। আদর্শের দ্বারা চালিত হয়ে যখন হিংসার পথ গ্রহণ করা হয় তখন তাকে বলে বিপ্লব, উঁচুতলার কর্তৃপক্ষের নির্দেশে যখন হিংসার ঘটনা ঘটে তখন তাকে বলে যুদ্ধ কিংবা যখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা আর শূন্যতার দরুণ হিংসা সংগঠিত হয় তখন তা হয় গণপ্রহার। ভিড় তখন উন্মত্ত, ক্ষিপ্র ও অনিয়ন্ত্রিত। কিন্তু ভিড়ের এরকম আচরণের কারণ কী?

১৮৪১ সালে ফ্রান্সে জন্ম হয় গুস্তাভ লে বনের। ১৮৬৬ সালে তিনি ডাক্তারি পাশ করলেও আদতে ছিলেন একজন পলিম্যাথ। নৃবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ওষুধ এবং পদার্থবিজ্ঞান ইত্যাদি তাঁর আগ্রহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৯৫ সালে তিনি একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন যা তাঁকে আজও প্রাসঙ্গিক রেখেছে। বইটির নাম, 'দ্য ক্রাউড: আ স্টাডি অফ দ্য পপুলার মাইন্ড'। বইটা এতটাই মৌলিক যে সিগমুন্ড ফ্রয়েড বারংবার এর উল্লেখ করেছেন, ব্যবহার করেছেন। ফ্রয়েডের বই 'গ্রুপ সাইকোলজি অ্যান্ড দ্য অ্যানালাইসিস অফ দ্য ইগো' গুস্তাভের বইয়ের দ্বারা তীব্রভাবে প্রভাবিত। গণ-আচরণে মনস্তত্ত্বগত ক্রিয়াকলাপ বিষয়ে বইটির আলোচনা। 

গুস্তাভ তাঁর গ্রন্থে ‘ভিড়’-এর সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ভিড় হল আবেগ, ভয়, ভালবাসা বা ঘৃণার মতো অনুভূতি দ্বারা একত্রিত হওয়া মানুষের একটি ‘মনস্তাত্ত্বিক গোষ্ঠী’। এই লোকেরা তাদের বিচক্ষণতা ও বিচারের অনুভূতি হারিয়ে ফেলে, বৌদ্ধিকভাবে নিকৃষ্ট হয়ে ওঠে এবং ধ্বংসাত্মক ও বীরত্বপূর্ণ উভয় কাজেই সম্ভাব্য ভাবে সক্ষম হয়। ভিড়ের ইতিবাচক দিক হল প্রতিবাদসভা। আবার এরই নেতিবাচক দিকটি হল আদর্শ ভুলে ক্রোধের সামনে আত্মসমর্পণ করে ভাঙচুর চালানো। গুস্তাভ লিখেছেন, 'An individual in a crowd is a grain of sand amid other grains of sand, which the wind stirs up at will.'।

ভিড় কিছু স্বতন্ত্র মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে, যেমন গোষ্ঠীর মধ্যে অজ্ঞাত-পরিচয় থেকে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস, অতিসংবেদনশীলতার সংক্রমণ এবং অযৌক্তিক আচরণ। এই বৈশিষ্ট্যগুলি ব্যক্তিদের চরম মনোভাব গ্রহণ এবং অপ্রত্যাশিত কাজ করতে পরিচালিত করে। কেননা নিজের পরিচয় গোপন থাকবে এরকম একটা বোধ বহু মানুষকে নিয়ে চলে যায় একটি আদিমতম পর্যায়ে যেখানে সে বর্বর, হিংস্র। আবার এই অতিসংবেদনশীলতা ভিড়ের মধ্যকার মানুষকে এমন বিভোর করে যে সে তখন কেবলমাত্র আদিম-প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয়; মানুষ যেহেতু একটি সর্বভূক জন্তু, ফলে সে তখন সেই পশুত্ব-স্পৃহাটিকে উপভোগ করে যাকে একলা অবস্থায় শিক্ষা ও আইনি শাস্তির ভীতি অবদমিত রেখেছিল। গুস্তাভের মতে, এইখানেই ডারউইনকে ব্যর্থ ঘোষণা করে 'ভিড়' পিছন দিকে হাঁটা শুরু করে। আর এটাই ধীরে-ধীরে সমস্ত মানুষকে গ্রাস করে রচনা করে একটি উন্মত্ত ভিড়। ভিড়ের মধ্যে আরও তীব্রতর হয় অযৌক্তিকতার প্রভাব, তখন একটাই আওয়াজ যেন মাথার চারপাশে ঘুরপাক খায়, ‘দুনিয়া রসাতলে যাক আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়ব’। প্রত্যেকটি একক ব্যক্তির চেতনা তখন সমগ্রের চেতনার রূপ পায়, এবং সেই ভিড় তখন যা-খুশি করতে পারে। গণপিটুনি তো তার সামান্যতম ক্রিয়া, আর ভয়াবহ ক্রিয়া হল দাঙ্গা। 

এছাড়াও গুস্তাভ ভিড়ের মানুষদের ছয়টি প্রত্যক্ষ মনস্তাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যও বলেছিলেন – 

এক) আবেগপ্রবণতা, খিটখিটে এবং সহজেই পরিবর্তনযোগ্য, অর্থাৎ, সেই সব ব্যক্তি যাঁরা দ্রুত রেগে যান এবং ঘন-ঘন আবেগ পরিবর্তন করেন; 

দুই) অন্যের পরামর্শ দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হওয়া, অর্থাৎ, যাঁরা বন্ধু বা মিডিয়া থেকে বিবেচনাহীন ভাবে যে-কোনও ধারণা গ্রহণ করেন; 

তিন) বিষয়ের সরলীকরণ ও অতিরঞ্জিত অনুভূতি; 

চার) আধিপত্যবাদী ও অসহিষ্ণু, অর্থাৎ, যে-সব ব্যক্তি অন্যের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় কিন্তু বিরুদ্ধ মত সহ্য করতে পারে না; 

পাঁচ) নৈতিকতার মেরুকরণ যা উচ্চ ও নিম্ন যে-কোনও নৈতিক মানদণ্ডে যেতে সক্ষম এবং 

ছয়) যুক্তিতে অক্ষম, কিন্তু প্রবল চাক্ষুষ কল্পনাশক্তি। 

আছে পাঁচটি পরোক্ষ কারণও, যেমন - জাতিচিন্তা, গোঁড়া ঐতিহ্যবোধ, সমকালীনতাকে গ্রহণ করার অক্ষমতা, রাজনীতি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার স্তরে অবস্থান এবং শিক্ষা, যেগুলি ভিড়ের মনস্তত্ত্বগত দিকগুলিকে প্রভাবিত করে। নজরটান হল, কথাগুলি ১৮৯৫ সালে বলা। আজ তার কি ব্যতিক্রম দেখতে পাই? 

ফ্রয়েডও সমস্বরে বলেছেন যে, ভিড়ের অংশ হিসাবে ব্যক্তি অসীম শক্তির অনুভূতি অর্জন করে যা তাকে আবেগতাড়িত করে, অন্যথায় তাকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে দমন করতে হয়ে থাকে। ক্ষমতার এই অনুভূতিগুলি ব্যক্তিকে কেবল ভিড়ের অংশ হিসাবে কাজ করতে দেয় তাইই নয়, সুরক্ষার অনুভূতিও দেয়। ফ্রয়েড দুই ধরনের ভিড়ের কথা বলেন - একটি হল স্বল্পকালীন ধরনের, যা ক্ষণস্থায়ী তড়িৎ দ্বারা চিহ্নিত হয়, যেমন কোনও প্রবণতা, অর্থাৎ, মুখ্যমন্ত্রীকে দেখলেই 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনি দেওয়া, অথবা নেতানেত্রীদের দেখলে 'চোর-চোর' বলে চেঁচানো কিংবা অবাঙালি দেখলে 'জয় বাংলা' বলে চিৎকার করা। আরেকটি হল স্থায়ী ধারার যা অত্যন্ত সংগঠিত প্রকৃতির, যেমন, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী বা সামরিক বাহিনী কিংবা কোনও রাজনৈতিক আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত দলীয় কর্মী। ফ্রয়েড অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, 'A primary mass is a number of individuals who have put one and the same object in place of their ego ideal and consequently identify with each other.'। 

আজ ধর্মের শৃঙ্খলা মানুষের মধ্যে অনেকটা নরম হয়েছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ হয়েছে রকেটের গতিতে। ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে – ধর্ম মানুষকে পাপের ভয় দেখিয়ে নৈতিকতার পথে চলতে বাধ্য করে। সেদিনই একজন সুহৃদ বলছিলেন জেলেদের গল্প। তিনি বললেন, ধর্ম যখন প্রবল ছিল তখন মানুষ প্রকৃতিকে সম্মান করত। এক হাতের কম দৈর্ঘ্যের ইলিশ মাছ ধরত না, অবিরাম গাছ কেটে ফেলত না, ভিক্ষা দেওয়াকে কর্তব্য মনে করত ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান এসে গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদকে এমনভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে যে তাদের আর পাপের ভয় নেই। ফলে, নৈতিকতাও আর থাকছে না। নৈতিকতা ও মূল্যবোধহীন মানুষ পশুবৎ বৈ আর কী! পাড়ার নেতা বিবেকহীন মাস্তানি চালাচ্ছে আর মানুষ বাধ্য হয়ে সহ্যও করছে, মন্ত্রীরা চুরি করছে কিন্তু আইন তাদের প্রায় কিছুই করতে পারছে না, সমস্ত নিয়ম-শৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখালেও আর বলার কেউ নেই, বড়লোকরা ক্রমশ বড়লোক হচ্ছে আর আমমানুষ ট্যাক্স দিতে একটু ভুল করলে নোটিশ খাচ্ছে ইত্যাদি ঘটনা মানুষকে অসহায় করেছে, ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাসহীন করছে। তার উপরে আছে একটা নতুন যুগের পদধ্বনি যেখানে ডিজিটাল সমাজ ও তৎপ্রসূত রাজনৈতিক অর্থনীতি মানুষকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। সে পুরনো মূল্যবোধের কিছুই আর খুঁজে পাচ্ছে না। ফলে, সে অস্তিত্ব সংকটের মুখে আরও হিংস্র হয়ে উঠছে এবং অসহায় ও দুর্বল মানুষের উপরে সুযোগ পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে – কখনও ফেসবুকে কখনও রাস্তায় কখনও মেসবাড়িতে। তাহলে কি মুক্তির উপায় নেই?

আছে। পুঁজিবাদ মানুষের সামনে উন্মুক্ত করেছে অসীম অতৃপ্তি। বিনোদন আর বিলাসিতার অপরিসীম আকাশ। ভোগের অপরিমেয় লালসা মানুষকে লকলকে লালাঝরা জিভ দিয়ে অবিরাম চেটে চলেছে। শাস্ত্র বলে, ত্যাগের দ্বারা ভোগ কর। ঈশ উপনিষদের প্রথম মন্ত্রই হল, 'ঈশাবাস্যমিদং সর্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথা মা গৃধঃ কস্য স্বিদ্ধনম্‌।।' অর্থাৎ, '‘আমি-আমার’ জ্ঞান বর্জন করে, লোভকে সংযত করে, ত্যাগের মাধ্যমে ভোগ করতে হবে, অপরের ধনে লোভের দৃষ্টি দিলে হবে না।' 

চরম ধনী থেকে অতি গরিব যদি এই অনুভূতির দ্বারা নিজেদের মনের সৃজন করতে পারে তাহলেই এই দুনিয়ায় একটা সুখ ফিরবে। সুখী মানুষ সর্বদাই ক্ষমাশীল। আর লোভী ও ঈর্ষা দ্বারা আবিষ্ট মানুষ হিংস্র, জিঘাংসা দ্বারা চালিত। কিন্তু এই পথই যে সহজ। ত্যাগের পথ কঠিন। ফলে, আমার নাকে ওই গন্ধটা বোধহয় থেকেই যাবে। একইসঙ্গে যে-মানুষগুলি এভাবে হিংসার পথ গ্রহণ করে, আমি দেখতে পাই তাদের প্রত্যেকের পিঠে-বুকে ছুরি গাঁথা – হতাশার, ক্লান্তির, লোভের ও ক্রোধের।