Pages

Tuesday, 9 May 2023

নিষিদ্ধকরণ পথ নয়

'দ্য কেরালা স্টোরি'র মিথ্যাচার

শোভনলাল চক্রবর্তী



আলোচিত-সমালোচিত চলচ্চিত্র ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শান্তি-সৌহার্দ্য বজায় রাখতেই নাকি পশ্চিমবঙ্গে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই ছবিতে যে সব দৃশ্য দেখানো হয়েছে, তা রাজ্যের শান্তিশৃঙ্খলার পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে বলে মনে করছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে তামিলনাড়ুতেও এই ছবি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে মধ্যপ্রদেশের রাজ্য সরকার আবার ছবিটিকে করমুক্ত ঘোষণা করেছে। শাবানা আজমি ট্যুইট করে জানিয়েছেন, 'যারা 'দ্য কেরালা স্টোরিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছেন, তাঁরা 'লাল সিং চাড্ডা'কে নিষিদ্ধ করার দাবি যারা তুলেছিলেন তাঁদের মতোই ভুল করছেন। সেন্সর বোর্ড কোনও ছবিকে যদি একবার পাস করে দেয় তাহলে কারও আর অতিরিক্ত সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ বনবার অধিকার থাকে না।'

সম্প্রতি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অবশ্য, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে সাংবাদিক বৈঠকে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র প্রাসঙ্গিকতা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে ‘দ্য কেরালা স্টোরি’র সমালোচনা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত, 'রাজনৈতিক দলগুলো আগুন নিয়ে খেলছে। তারা জাত-ধর্ম-বর্ণ নিয়ে ভেদাভেদ তৈরির চেষ্টা করছে। 'দ্য কাশ্মীর ফাইলস' কেন? একটি সম্প্রদায়কে হেনস্তা করার জন্য। 'দ্য কেরালা স্টোরি'? সে-ও এক অসত্য ও বিকৃত কাহিনি।’ এর আগে ছবিটি নিয়ে প্রবল আপত্তি তুলেছিলেন কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই ভিজয়ন। তিনি বলেছেন, এটা ‘প্রচারণামূলক’ ছবি, কোনওভাবেই তাঁর রাজ্যের গল্প নয়। ছবিটির মুক্তি বাতিলের আবেদনও করা হয়। তবে সুপ্রিম কোর্ট সে আবেদন খারিজ করে দেয়, যদিও ছবির টিজারে উল্লিখিত '৩২,০০০ মহিলা'র সন্ত্রাসবাদী দলে যোগ দেওয়ার অপ্রামাণ্য ও প্ররোচণামূলক তথ্যটি বাদ দিতে কড়া নির্দেশ জারী করে। নানা বিতর্কের মধ্যে অবশেষে ১০টি দৃশ্য ছেঁটে সেন্সর সার্টিফিকেট পায় ‘দ্য কেরালা স্টোরি’। গত শুক্রবার ভারতের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় ছবিটি।

ছবিতে শালিনী উন্নিকৃষ্ণণ থেকে ফতিমায় রূপান্তরিত হতে হয় নায়িকা আদা খানকে। সন্ত্রাসীদের একজন ছাত্রী সেজে ঢুকে পড়ে নার্সিং কলেজে। তারপর সেই কৌশলে শালিনীকে যোগ দেওয়ায় নিজেদের দলে। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রকে বোরখায় মুখ ঢাকতে হয়। কেরলের ভিন ধর্মাবলম্বী, মূলত হিন্দু ও খ্রিস্টান মেয়েদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করে জঙ্গি গোষ্ঠী আইসিস-এ যোগদান করানোর ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ছবির কাহিনি লেখা হয়েছে। ধর্মান্তরিত নারীর অসহায় জীবন সংগ্রামই এই ছবির মুখ্য উপজীব্য। অর্থাৎ, ছবিতে হিন্দু মহিলাদের উপর ইসলাম আগ্রাসনের কাহিনি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে তোলার জন্য যথেষ্ট বলেই মনে করছেন অনেকে। যেমন, ছবিটি মুক্তির আগেই কংগ্রেস নেতা শশী থারুর এই ছবি নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছিলেন। তাঁর অভিযোগ, কেরলের পরিস্থিতিকে বিকৃত এবং অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। কেরলকে বলা হয়েছে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর। তাই এ ছবি মুক্তি পেলে অশান্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। এবার সেই পথে হাঁটলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। যদিও পরিচালক সুদীপ্ত সেন দাবি করেছেন, এসব অভিযোগ সত্য নয়। তিনি বলতে চেয়েছেন, তিনি আদতে সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী একটি ছবি তৈরি করেছেন যার নেপথ্যে রয়েছে অনেক গবেষণা, পরিশ্রম ও তথ্যের বিশ্লেষণ। গোটা কাহিনিই সত্য ঘটনা অবলম্বনে বলেও দাবি করেছেন তিনি। যদিও নেটফ্লিক্স-এর 'ক্যালিফেট-৩' ছবির সঙ্গে সুদীপ্ত'র ছবির হুবহু মিল দেখে অনেকেই বলতে শুরু করেছেন যে ছবিটি পুরোটাই টোকা। 

কেরালা সরকার ছবিটি ব্যান করেনি, বয়কট করতে বলেছে সাধারণ মানুষকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ছবিটি কিন্তু কেরালায় একেবারেই চলেনি। মাত্র ১১টি প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি চলছে, তাও শো-এর সংখ্যা কমে এসেছে ৪ থেকে ১-এ। ছবিটিতে এত বেশি ধর্মীয় প্রচারমূলক বক্তব্য যে সংলাপ ও দৃশ্যায়ন অত্যন্ত দুর্বল। সিনেমা হিসেবে অন্তত কেরালায় মুখ থুবড়ে পড়েছে 'দ্য কেরালা স্টোরি'। 

সলমান রুশদি থেকে তসলিমা নাসরিন হয়ে মকবুল ফিদা হোসেন- ভারতে নিষিদ্ধের কাহিনি নেহাত ছোটগল্প নয়। বই, ছায়াছবি বা কোনও ব্যক্তিকে যখন রাষ্ট্রশক্তি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তখন এটা বোঝা খুব সহজ যে ওই বই, ছবি বা ব্যক্তিকে আসলে রাষ্ট্র ভয় পেয়েছে। নিষিদ্ধকল্পের আর একটি মূল লক্ষণ বিবেচনা শক্তির লোপ। আজ যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে 'দ্য কেরালা স্টোরি' নিষিদ্ধ করলেন তাঁদের সঙ্গে সেই অসভ্য উত্তাল জনতার চিন্তার দীনতার কি কোনও তফাত রইল যাঁরা 'পদ্মাবতী'র সেটে ভাঙচুর করে শুটিং বানচাল করেছিলেন, ধার্য করেছিলেন ছবির অভিনেত্রীর মাথার দাম। কিংবা যাঁরা 'লাল সিং চাড্ডা' ছবি চলাকালীন সিনেমা হলে ঢুকে পড়ে সিনেমা বন্ধ করে দিয়েছিলেন? উত্তর, না। তাই যদি হবে তবে কেন এই নিষিদ্ধের রাস্তা? বাস্তবতা হল, আজ এই ইন্টারনেটের যুগে কোনও ছবিকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয়। নানা প্ল্যাটফর্ম থেকে ছবিটি দেখানো হবে, নানা সাইট থেকে মানুষ ছবিটি দেখবেন। নিষিদ্ধ ছবি দেখার হিড়িক পড়ে যাবে। এই তো কয়েক দিন আগে বিবিসির তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ হল ভারতে। নিষিদ্ধ হওয়া মাত্র আরও বিপুল সংখ্যক মানুষ তথ্যচিত্রটি দেখলেন এবং বুঝলেন যে আসলে মোদিজি এখন ভোল বদল করেছেন। তাই নতুন প্রজন্মের সামনে ওই সব গোধরার পুরনো কাসুন্দি না আনাই শ্রেয়। কিন্তু সফলতা এল কী? একেবারেই নয়, উল্টে ঝুলি থেকে বেড়াল বেরিয়ে পড়ল। 

কর্নাটক নির্বাচনের প্রচারে মোদি 'দ্য কেরালা স্টোরি'র উল্লেখ করেছেন। সবরকম সৌজন্য শিকেয় তুলে কর্নাটকের মাটিতে দাঁড়িয়ে পাশের রাজ্য কেরল সম্পর্কে বলেছেন জঙ্গি রাজ্য, মানুষকে সাবধান করেছেন ওই রাজ্য সম্পর্কে। কিন্তু এত করেও লাভ কিছু হয়নি। কর্নাটকের যুবক-যুবতীরা বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি প্রভৃতি জ্বলন্ত ইস্যু নিয়ে মোদির নীরবতাকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল সরকারকে মরণ কামড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। হতে পারে যে, প্রয়োজনে দাঙ্গা লাগিয়ে তারা স্বার্থসিদ্ধি করার চেষ্টা করবে। হয়তো সেই কাজে সত্যিই 'দ্য কেরালা স্টোরি'র গল্পের গরু গাছে ওঠার মতো ৩২,০০০ হিন্দু মেয়ের হারিয়ে যাওয়ার কাহিনী কাজে লাগানো হত। কিন্তু, রাজ্য প্রশাসন কি এতটাই দুর্বল যে গুটি কয়েক দাঙ্গাবাজদের দাঙ্গা সামলানোর ক্ষমতা তাদের বিলুপ্ত? আর এ রাজ্যের মানুষও কি এতই অসচেতন যে একুশ শতকে কুড়িরও বেশি বছর কাটিয়ে তারা এখনও দাঙ্গা-ফ্যাসাদে জড়িয়ে পড়তে চাইবেন? 

দাঙ্গা ঠেকাতে 'দ্য কেরালা স্টোরি' নিষিদ্ধ করতে হল- এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের খুব ভালো বিজ্ঞাপন হল না কিন্তু। মানুষের উপর 'মানুষের সরকার' আর একটু ভরসা রাখতে পারতেন। হয়তো দেখা যেত, কেরালার মতোই এ ছবি দেখতে মানুষ মোটেই আগ্রহী নন, অথবা, তীক্ষ্ণ সমালোচনায় এ ছবির অকাল গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটত।



2 comments:

  1. নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের কৌতুহল বেশি। তাই কোনো বই বা সিনেমা নিষিদ্ধ হলে তা পড়া বা দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়। সুতরাং নিষিদ্ধ করার উদ্দেশ্য সফল হয় না। এক্ষেত্রে সিনেমাটি এমনিতেই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ত। যেমনটা হয়েছিল অক্ষয়কুমারের রামসেতু ছবির ক্ষেত্রে। কেননা গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষ প্রচার শুনতে হলে যায় না।

    ReplyDelete
  2. বাংলার নিয়োগ দুর্নীতি ও স্বজন পোষণ সম্পর্কে "বেঙ্গল ফাইল" দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete