Pages

Saturday, 13 May 2023

দ্য কর্নাটক স্টোরি

কুলোর বাতাস দিয়ে বিজেপি-বিদায় 

সুব্রত বসু



দক্ষিণের এই ৮৪ শতাংশ হিন্দু-রাজ্যে বিজেপি-র এবারের প্রচার বাঁধা ছিল শুধু বিদ্বেষ ও ঘৃণার তারে। কিন্তু আশার কথা, এ সব ছাপিয়ে কর্নাটকের সঙ্গীত বেজেছে ভালবাসার ধ্রপদী সুরেই। কর্নাটক বিদায় জানিয়েছে মোদী-শাহের বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতিকে।    

মোট আসন- ২২৪ (ম্যাজিক সংখ্যা- ১১৩) 

কংগ্রেস- ১৩৬ (+৫৬), বিজেপি- ৬৫ (-৩৯), জেডিএস- ১৯ (-১৮) 

দশাননের দশটা মাথা থাকলেও দশ মুখ দিয়ে একই সঙ্গে পরস্পর বিরোধী দশরকম বাণী নির্গত হত—এমন কথা মহাকবির রচনার কোথাও পাওয়া যায়নি। রামায়ণে যা হয়নি, কলিকালে ভূ-ভারতে বিজেপি নেতারা তার অনেকটাই করে দেখিয়েছেন। কর্নাটকের নির্বাচনের আগে  বিজেপির নেতাদের কথাবার্তা শুনে আমজনতার ঠিক তাই মনে হয়েছিল। 

এতদিন দলের ‘মুখিয়া’ নরেন্দ্র মোদী থেকে শুরু করে অমিত শাহ, জে পি নড্ডা-সহ তাবড় নেতার কথা শুনে মানুষের বারবারই মনে হয়েছে, এই দলটি ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না! দলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সব নেতার শয়নে-স্বপনে দেশের মানুষের উন্নয়ন ছাড়া আর কোনও ভাবনাই নেই! নোটবন্দি, জিএসটি, পেট্রল-ডিজেলের দাম বাড়ানো ইত্যাদি নানা বিচিত্র পদ্ধতিতে তাঁরা বিকাশের রথকে বুলেট ট্রেনের গতিতে ছুটিয়ে দেশকে রাতারাতি উন্নত অর্থনীতির তালিকায় ঢোকাতে বদ্ধপরিকর। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুন করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তো রাতের ঘুমই কার্যত ছেড়ে দিয়েছিলেন বলে ভক্তরা রটিয়ে থাকেন! চারিদিকে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের উন্নয়নের ঠেলায় ৫৬ ইঞ্চির ছাতির প্রধানমন্ত্রী এখন ‘বিশ্বগুরু-বিকাশপুরুষ’। 

এ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল! কিন্তু তাল কাটল কর্নাটকের নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি নেতাদের কথায়। সেখানে কর্মিসভায় সাংসদ এবং রাজ্য বিজেপির প্রধান নলিন কতীল ফস করে বলেই দিলেন, বিকাশ-টিকাশের কথা ছেড়ে দাও। জনগণকে ওসব কথা আর বলতে হবে না। তোমরা বরং ওদের কাছে গিয়ে লাভ-জেহাদের বিপদ নিয়ে বোঝাও। তাঁর কথায়, 'আমি তোমাদের বলছি, রাস্তা, নিকাশি ইত্যাদি ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কথা বলতে হবে না। তোমাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে যদি বিন্দুমাত্র আশঙ্কা থাকে, এবং তোমরা যদি লাভ জেহাদ বন্ধ করতে চাও, তবে বিজেপি-কেই সরকারে আনতে হবে।'

শুধু লাভ জেহাদই নয়, কখনও হিজাব কখনও হালাল- দক্ষিণের এই ৮৪ শতাংশ হিন্দুর রাজ্যে বিজেপি-র এবারের প্রচার বাঁধা ছিল শুধু বিদ্বেষ ও ঘৃণার তারে। কিন্তু আশার কথা, এ সব ছাপিয়ে কর্নাটকের সঙ্গীত বেজেছে ভালবাসার ধ্রপদী সুরে। দক্ষিণের এই রাজ্য বিদায় জানিয়েছে মোদী-শাহের বিভাজন আর ঘৃণার রাজনীতিকে। কার্যত কুলোর বাতাস দিয়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে এই দলটিকে। বিজেপির খুব পছন্দের স্লোগান 'কংগ্রেস মুক্ত ভারত'কে একটু পাল্টে এখন বলা যেতেই পারে, দক্ষিণ ভারত এখন বিজেপি-মুক্ত।

কিন্তু কেন বিজেপির এমন শোচনীয় পরাজয় হল কর্নাটকে? ধর্মীয় মেরুকরণের কোনও চেষ্টাই তো বাকি রাখেননি মোদী-শাহ জুটি। কখনও তা হিজাব নিয়ে, কখনও হালাল-ঝটকা মাংস নিয়ে, কখনও বা মাইক বাজিয়ে নমাজ পড়া নিয়ে। বিধানসভায় বিল পাশ করা হয়েছে জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করার বিরুদ্ধে। কার্যত একতরফা সাম্প্রদায়িক গোলমালে বারবারই তেতে উঠেছে দক্ষিণের একমাত্র বিজেপি শাসিত রাজ্যটি। এ বার লাভ-জেহাদের আতঙ্ক সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বজরং দল এবং শ্রীরাম সেনে নামের উগ্র মৌলবাদী সংগঠনকে হিংসা ছড়ানোর খোলা ছাড়পত্রও দেওয়া হয়েছে। উপকূলবর্তী কর্নাটক (ম্যাঙ্গালোর সহ নেত্রাবতী নদীর সংলগ্ন এলাকা) এবং মহারাষ্ট্র-লাগোয়া (মুম্বই-কর্নাটকে) এলাকায় সংখ্যালঘুদের হত্যাও করা হয়েছে নানা ছোটখাটো অজুহাত দেখিয়ে। কিন্তু ভোটের ফলাফল বের হওয়ার পর দেখা যাচ্ছে, বিজেপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই দুটি এলাকাতেও এই রাজনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাঘের হাঁ-য়ের মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে উপকূলবর্তী কর্নাটকের ১৯টি আসনের ৬টি ছিনিয়ে নিয়েছে কংগ্রেস। আর এই দুটি এলাকায় খারাপ ফলের জন্যই বিজেপি-র কোমর এতটাই ভেঙেছে যে তাদের পক্ষে আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি।

গত বিধানসভা নির্বাচনে আনন্দবাজারের প্রতিনিধি হিসেবে ওই রাজ্য ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, কর্নাটকে আমজনতা মূলত অসম্প্রদায়িক। কর্নাটকের বিজেপি-র কাণ্ডারী বলে যাঁকে ধরা হয়, সেই ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগ থাকলেও, উগ্র মৌলবাদীদের সমর্থন করতে কখনও তেমন ভাবে দেখা যায়নি। কিন্তু এবারের নির্বাচনে তাঁকে সরিয়ে সমনে রাখা হয়েছে শুধু মৌলবাদী প্রচারকদেরই। কর্নাটকের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় লিঙ্গায়েতরা এই বিষয়টিকে ভাল ভাবে নেননি। আর তার ফয়দা পেয়েছে কংগ্রেস (৩৩ কং, ১৬ বিজেপি)। লিঙ্গায়েতদের গড় বলে পরিচিত মুম্বই কর্নাটকে তাই ভরাডুবি হয়েছে বিজেপি-র।

অনেকটাই একই রকম ভরাডুবি হয়েছে এই রাজ্যের আর এক বড় সম্প্রদায় ভোক্কালিগাদের ঘাঁটি মহীশূর-কর্নাটকে। এই এলাকা অন্য কর্নাটকের চেয়ে শিক্ষা ও সেচ ব্যবস্থায় সেই রাজতন্ত্রের আমল থেকেই রাজ্যের অন্য অংশের থেকে উন্নত। এই এলাকার প্রধান শক্তি এইচ ডি দেবগৌড়া ও কুমারস্বামীর জনতা দল (সেকুলার)। কিন্তু এখানেও কংগ্রেস তাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। মনে হতেই পারে, ভোটাররা ভেবেছেন, ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সুবিধা পেতে পারে বিজেপি। তাই তাদের একটা বড় অংশই ভোট দিয়েছেন কংগ্রেসকে, স্থায়ী এবং মজবুত বিজেপি বিরোধী সরকার তৈরির জন্য। সারা রাজ্যে জেডি(এস)-এর ১৭টি আসন কমাটাকে এই মানসিকতার প্রতিফলন বলেই মনে করা যেতে পারে। 

কিন্তু বিজেপির এই ভরাডুবির মুখ্য কারণ, সরকারের কাজকর্মের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ। গত কয়েক বছরে কর্নাটকের জনতা দেখেছে, উন্নয়ন কী ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে রাজ্যে। সাধারণ কৃষক এবং আখচাষিদের আত্মহত্যা বাড়ছে। খোদ বেঙ্গালুরুর মতো শহর বর্ষাকালে চলে যাচ্ছে জলের তলায়। সরকারের বিরুদ্ধে উঠেছে দুর্নীতি ও সরকারি কাজে কাটমানি হজমের নানা অভিযোগ। টাকা ট্রান্সফারের একটি অ্যাপের নামের অনুকরণে রাজ্য জুড়ে ‘পে-সিএম’ পোস্টার পড়েছে। দলের মধ্যেও নানা ঝগড়া। ২০১৮ সালের  নির্বাচনে বিধানসভার ২২৪ আসনের মধ্যে বিজেপি ১০৪টি আসন পেলেও তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৬ শতাংশ। অন্যদিকে, কংগ্রেস ৩৮ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন পায় ৮০টি। বিজেপির থেকে আসন সংখ্যা কম হলেও প্রাপ্ত ভোটের শতকরা হার কংগ্রেসের একটু বেশিই ছিল। পরে কংগ্রেস-জেডি(এস)-এর জোট সরকার ভাঙিয়ে জোড়াতালি দিয়ে নিজেদের সরকার তৈরি করতে হয়েছিল বিজেপিকে। কিন্তু রাজ্যকে সুশাসনের রাস্তা দেখাতে পারেনি বিজেপি সরকার। 

এবার তাই জনগণের কাছে গিয়ে বলার মতো কোনও বিষয়ই ছিল না বিজেপির হাতে। উন্নয়নের ‘জুমলা’ নিয়ে জনতার কাছে গেলে হিতে-বিপরীতও হতে পারে বলে মনে করেছেন বিজেপি নেতারা। এ রাজ্য দিয়ে যাওয়ার সময় রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’-র সাফল্যও তাঁদের একটু বিপাকে ফেলে দেয়। তাই মেরুকরণকেই শেষ পর্যন্ত তুরুপের তাস হিসেবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। উত্তরপ্রদেশ মডেলে এখানেও একটি রামমন্দির তৈরির কথা ঘোষণাও করে বিজেপি সরকার। বলা হয়, রামচন্দ্র বনবাসের সময়ে পাঁচ বছর ছিলেন বেঙ্গালুরুর কাছে রামনগরে। এখানে একটি ছোট রামমন্দিরও আছে। সেই রামমন্দিরের বদলে অযোধ্যার আদলে তৈরি করা হবে দক্ষিণের ‘শানদার’ রামমন্দির। এই মন্দিরের উদ্বোধনে আসবেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ যোগী। 

দুর্নীতির অভিযোগে বরখাস্ত হওয়া মৌলবাদী নেতা ঈশ্বরাপ্পাকে ফোন করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ভোট-ময়দানে নামিয়ে মৌলবাদী প্রচারে আরও অক্সিজেন জোগান তিনি। প্রচারে তুলে আনেন 'দ্য কেরালা স্টোরি' নামে একটা গাঁজাখুরি সিনেমার কথাও। বজরং দল নিষিদ্ধ করার কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিকে স্বয়ং বজরংবলীর অপমান বলে উল্লেখ করে মেরুকরণের নিকৃষ্ট চেষ্টাও চালান।

গণদেবতা তো বটেই, স্বয়ং বজরংবলীও যে এই সব কাণ্ডকারখানা দেখে বিশেষ প্রসন্ন হননি, বিজেপি-নেতারা ২০২৪ সালের ভোটের আগে তা বুঝতে পারলেই মঙ্গল।


3 comments:

  1. বিভাজনের রাজনীতি আর হিন্দু খতরে মে হ্যায় দিয়ে যতদূর যাওয়া সম্ভব,বিজেপি ঠিক ততটুকুই গেছে, এবার তাদের পিছিয়ে আসার পালা।

    ReplyDelete
  2. আসুন আজ এই জয় আমরা সেলিব্রেট করি

    ReplyDelete
  3. ঘৃণার রাজনীতি সাফল্য লাভ করলেও তা দীর্ঘ সময় স্থায়ী হয়না। এই কারণেই ফ্যাসিস্ট শাসন কোথাও দীর্ঘদিন টিঁকে থাকেনি।
    হিন্দু খতরে মে হ্যায় বলে পেটের খিদে দীর্ঘদিন ভুলে থাকা যায় না।
    স্মরণ করি গণতন্ত্রের সেই গুরু বাক্য "কিছু মানুষ কে কিছু কাল বোকা বানানো যায়। সব মানুষকে চিরকাল বোকা বানানো যায় না।"

    ReplyDelete