Pages

Monday, 3 April 2023

রামনবমীর হিংসা!

ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতেই হবে

সুমন সেনগুপ্ত



গত তিন দিন ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে সারা দেশের পাশাপাশি আমাদের রাজ্যেরও বেশ কিছু জায়গা অশান্ত হয়েছে। বহু ছবি, বহু ভিডিও এসেছে। সচেতনভাবেই সেই ছবি কিংবা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দিতে চাইনি। মনে হয়েছে, এই ছবিগুলো ভয়ের ছবি, এই ছবি যত বেশি প্রচার করা হবে তত বেশি মানুষ ভয় পাবে। দ্বিতীয় দিনেও যখন হাওড়াতে গণ্ডগোল হয়, পুলিশ প্রশাসন অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে বেশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করেছে; যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের কারও হাতে বন্দুক, কারও হাতে খোলা তলোয়ার দেখা গেছে।

কেন্দ্রের শাসক দল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এবারের রামনবমীতে হিংসা ছড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল এবং সেটা শুধু এই রাজ্যে নয়, সারা দেশে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অশান্তি হতে পারে তা পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও তারা আগে থেকে কেন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি? গতকাল রাজাবাজারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলাম, বিশাল হনুমানের মুখ আঁকা গেরুয়া পতাকা। এইরকম বড় পতাকা আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। এইগুলো কেউ নিশ্চিত ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে বানায়নি। এগুলো বানানো হয়েছে সচেতনভাবে, যাতে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে অশান্তি সৃষ্টি করা যায়। আর হয়েছেও তাই। 

কেউ ব্যক্তিগতভাবে রামের পুজো করলে তাতে আপত্তির কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু রামের পুজোর নাম করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে ঝামেলা সৃষ্টি করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা নিয়ে কথা উঠবেই। প্রশ্ন, এই গণ্ডগোলের পরিস্থিতি তৈরি করে কার লাভ হল? সামনে কর্নাটক নির্বাচন। যা বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি যথেষ্ট অসুবিধায় আছে। এবিপি নিউজ-সি ভোটার সমীক্ষায় বিজেপির পরাজয় সুনিশ্চিত বলে গত সপ্তাহেই দেখানো হয়েছে। উপরন্তু, কিছুদিন ধরে যেভাবে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে সমস্ত সংবাদমাধ্যমে আলোচনা চলছে, তাতে বিজেপি স্পষ্টতই বেশ আতান্তরে পড়েছে। সুতরাং, বিজেপির প্রয়োজন ছিল এই ন্যারেটিভ বা ভাষ্যকে নিজেদের চেনা ছকে ফেলার। তারা সেটাই করার চেষ্টা করেছে। 

অনেকে বলছেন, বাংলায় সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন তাই মেরুকরণের রাজনীতি করতে পারলে আখেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা হলেও লাভবান হবেন। কিন্তু যাঁরা এই সরল সমীকরণে বিষয়টি দেখছেন, তাঁদের কাছে একটা বিনীত প্রশ্ন আছে। যদি বাংলায় দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাভ হয়, তাহলে বিহারেও নিশ্চিত নীতিশকুমার এবং আরজেডি'র লাভ হবে, রাজস্থানেও সুনিশ্চিত কংগ্রেসের লাভ হবে? কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? নাকি এই ধরনের দাঙ্গা করতে পারলে বিজেপির 'হিন্দু ভোট' আরও জোটবদ্ধ হবে? এই ধরনের পরিস্থিতি ওঁদের চেনা ছক, যা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তৈরি করে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে চর্চা করাটা বন্ধ করা যায়! রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখে হোক বা পাশে নিয়ে, যখন সমস্ত বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ছক তৈরি করা ছাড়া বিজেপির আর কোনও রাস্তা আছে কী?   

বাংলার ক্ষেত্রে এটা সত্যি যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল আকণ্ঠ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। প্রমাণ হল কি হল না তা পরের বিতর্ক। মুসলমান সমাজ, বিশেষ করে বাংলা ভাষী মুসলমান মানুষজন তাঁর দিক থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন। সাগরদীঘি তার অন্যতম উদাহরণ। মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ধীরে ধীরে কংগ্রেসের প্রতি বিশ্বস্ততা তৈরি হচ্ছে। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, দেশব্যাপী বিজেপিকে রুখতে একমাত্র রাহুল গান্ধীই হয়তো পারবেন, তাই তাঁরাও আবার কংগ্রেসমুখি হচ্ছেন। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়তো চেয়েছেন, তিনিই মুসলমান মানুষদের রক্ষা করতে পারেন- এই বার্তা যাতে পৌঁছয়। সেই জন্যেই তিনি হয়তো বলেছেন, রমজানের সময়ে মুসলমান অঞ্চল দিয়ে যাতে রামনবমীর মিছিল না যায়। কিন্তু মুখে বললেও তাঁর প্রশাসনের গাফিলতিতেই কিন্তু এই ঘটনা ঘটেছে। 

যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁরা যেহেতু ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু- তাঁদের হয়ে এখন বিরোধী দলনেতা থেকে শুরু করে বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই গলা ফাটাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ'র তদন্ত চাইছেন। এই এনআইএ এলে কী হবে? তারা সবার আগে বেছে বেছে মুসলমান যুবকদের তুলবে। গণমাধ্যমগুলো একযোগে এমন শিরোনাম করবে যে দেখে মনে হবে মুসলমানেরাই মূলত হাওড়াতে দাঙ্গা করিয়েছে। অথচ ছবি এবং ভিডিওতে স্পষ্ট যে, গেরুয়া ঝান্ডাধারীরাই এই কাজটির মূল হোতা। আমরা আবারও বিশ্বাস করতে শুরু করব, মুসলমান মাত্রই দাঙ্গাকারী, সন্ত্রাসবাদী। অথচ, এনআইএ আসা মানে যে আসলে কোনও তদন্ত হবে না, তা কি আমরা জানি না? আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। সেই কাঠামোকে বারংবার বিজেপি যে ভেঙেছে, ভাঙছে, তা কি আমরা দেখছি না? আমরা কি তখন এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করব? না করব না। কারণ, আমাদের মাথায় আছে, তৃণমূল চোর- এই চোরদের সরাতে পারলেই বাম থুরি রাম রাজ্য আসবে। আসলে অন্তর থেকে যে আমরা সাম্প্রদায়িক তা কি আমরা জানি?  

আমি একবারও বলছি না, তৃণমূলকে রেখে দিতে হবে, তাঁরাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। না, তা করবে না। কারণ, বিজেপির সমস্ত নীতিকেই তাঁরা এই রাজ্যে লাগু করেছে প্রাথমিক বিরোধিতার নাটক করে। কিন্তু আমাদের বিকল্পটা ভাবতে হবে, বিকল্প ভাষ্য তৈরি করতে হবে। কিন্তু বামেরা, যাঁদের প্রতি মানুষের এত আশা, তাঁরা কি সেই বিকল্প ভাষ্য বা চেহারা দেখাতে পারছেন? তাঁরা যদি ভাবেন, বিজেপিকে ছাড় দিয়ে তৃণমূলকে অনবরত আক্রমণ করে যাবেন, তাতে আখেরে কাদের লাভ হচ্ছে? একটা শেষ কথা (হয়তো অপ্রিয়)- একজন গড়পড়তা হিন্দু বাঙালির থেকে একজন মুসলমান বাঙালি যুবক কিন্তু রাজনীতি অনেক পরিষ্কার বোঝেন। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে বোঝেন। তাই কোনও দল যদি ভাবে যে তারা মুসলমান ভোট কেটে তৃণমূলের হারার পথ সুগম করবে, তাহলে তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছে।  

আগামী দিনে কী হবে তা সময় বলবে। কিন্তু তা যে বাংলা তথা দেশের জন্য খুব সুখকর নয়, তা সবাই বুঝতে পারছেন। এই সময়টা আরও বেঁধে বেঁধে থাকার সময়। তার পরিবর্তে আমরা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজেদের মধ্যে লড়াই করি, তাতে কি আখেরে আমাদের ভালো হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন তাঁর ওপর ভরসা রাখতে, তিনি দোষীদের গ্রেফতার করবেন। কিন্তু যাঁরা এই দাঙ্গার মূল মাথা, তাঁদের কি গ্রেফতার করার সাহস দেখাতে পারবেন তিনি? ভারতীয় রাজনীতিতে লালুপ্রসাদ সবাই হতে পারে না। যাঁর সেই শক্তি ছিল তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে কোনওদিন মাথা নত করেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি পারবেন অমিত মালব্য সহ অন্যান্য নেতানেত্রীদের গ্রেফতার করতে, যাঁরা এখনও উস্কানি দিয়ে চলেছেন। ভালো প্রশাসক হওয়া কিন্তু কঠিন কাজ, সেই পরীক্ষা তাঁকেই দিতে হবে। হিন্দু ভোট বা মুসলমান ভোটের অঙ্ক কষা কিন্তু একজন ভালো প্রশাসকের কাজ নয়। রাজনীতি এবং ধর্মকে আলাদা করা একজন দক্ষ প্রশাসকের কাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি পারবেন সেই জায়গা তৈরি করতে?

যদি খেয়াল করা যায়, বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোতেই কিন্তু গণ্ডগোল পাকানো হচ্ছে। রাজস্থান, বিহার, বাংলা। বাংলায় কিছুটা স্তিমিত হলেও বিহার এখনও জ্বলছে, মানুষ মারা যাওয়ার খবরও আসছে। তার মধ্যে রাজস্থানের একটি ভিডিও এসেছে। এমনিতে আমি এই ধরনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি, কিন্তু এই ভিডিওটা সবার দেখা উচিত। 



রাজস্থানে একটি রামনবমীর মিছিল যখন মুসলমান অঞ্চলে ঢোকে তখনই চালু হয় ডিজে। উস্কানিমূলক গান, সঙ্গে নাচ। ‘যব ভাগওয়া লেহেরায়েগা, তব মিয়াঁ কাটে যায়েগা’- অর্থাৎ, গেরুয়া পতাকা নিয়ে মোল্লাদের কাটতে হবে। ঠিক সেই সময়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ঐ ডিজে বক্সের ইলেক্ট্রিকের তারে শক খেয়ে তিনজন গেরুয়াধারী যুবক মারা যায়। এখনও অবধি কিন্তু এ নিয়ে কোনও খবর দেখতে পাবেন না, কোনও হিন্দু নেতার ট্যুইট পাবেন না। কারণ, এঁরা তো কেউ নেতা-নেত্রী নন, এঁরা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাঁদের কিছু টাকা দিয়ে উস্কে দাঙ্গা করানো যায়, দিনের শেষে তাঁরা সেই টাকা নিয়ে মদের দোকানে লাইন দেয়। এঁদের মা-বাবাদের ক্ষমতা নেই বাইরে পড়াতে নিয়ে যাওয়ার, তাই মুসলমান মারতে গিয়ে মারা গেলেও তাঁদের জন্য কোনও নেতা-মন্ত্রী চোখের জল ফেলবেন না। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই দাবার ‘বোড়ে’; আর কে না জানে, 'বড়' কিছুর জন্য এই ছোটখাট বোড়েদের আত্মাহুতি দেওয়াটাই দস্তুর।

 

No comments:

Post a Comment