Pages

Tuesday, 7 March 2023

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া

খ্যাপারা মরে না 

বিশ্বজিৎ মিত্র



আমার ধারণা হয়েছিল, একেবারে যারা হাঘরে তাদের নিয়ে ফিল্ম বানানো এখন আর সম্ভব নয়। ঋত্বিক পারতেন, কারণ তিনি এ বিষয়ে যাজক ছিলেন না, ছিলেন খ্যাপা। এমন খ্যাপা আর ভূ-ভারতে তৈরি হয়নি। যদিও বাড়তি আবেগে মাখোমাখো হয়ে যাওয়ার দুর্দশা কিঞ্চিৎ উপহার দিয়ে গেছেন, কিন্তু খ্যাপা বলেই একদম অন্ত্যজদের কথা বলবার সাহস তাঁর ছিল। ক্ষমতাও। ভাবতাম, তিনি অনন্য। কিন্তু খ্যাপা বেশি গজায় না। তাই এমনটাই মনে হত। কারণ বলতে গেলে, এক তো সিনেমার অক্ষ চূড়ান্তভাবেই শহুরে- পরিচালকের বাসস্থান কি প্রযুক্তির প্রকৌশল– তায় সিনেমার নতুন ঢেউ তো অনেকদিনই পুরনো হয়ে গেছে। এক দোকানে দেখেছিলাম– বিশ্বাস মৃত, ধার তাহাকে হত্যা করিয়াছে। তেমনই বলতে হচ্ছিল, চলচ্চিত্রে ছন্নছাড়াদের আখ্যান বলার দিন গতাসু, শহর ও বাণিজ্য তাহাকে নিধন করিয়াছে। বাণিজ্যিক চোখরাঙানি, হুকুম-হুঁশিয়ারি এড়িয়ে প্রযুক্তির প্যাঁচঘোঁচ শিখে কোনও শহুরে মানুষের পক্ষে কি আর সত্যিই সম্ভব সত্যিকারের প্রান্তিক মানুষের কথা বলা? এক অঙ্গে এত রূপ কি সাধ্য? পরিচালককেও তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে। তাই সম্ভাবনা গণিত ঠারেঠোরে বলছিল, সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটা মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের এক ইদানীং'এর খামতি, বোধ হত। 

কিন্তু ক্ষীণ হলেও সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। পরিচালক মুহাম্মদ কাইউমের ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সেই সম্ভাবনাকে আকার দিয়েছে। ওনার অতীত জীবনের আভাস না পেলেও জানলাম, কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছেন উনি এই ছবি তৈরির জন্যে। এবং তিনিই প্রযোজক। অর্থনৈতিক দায় তাঁরই। বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায় যে, দুর্মদ আবেগ কতদিন পুইয়ে রেখে তিনি ঋতুর পর ঋতু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনামী শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার বুকের পাটা দেখিয়ে আর বড় কল্পনা করে শেষে এই পরশপাথরটি পেয়েছেন। আর আমাদের সওগাত দিয়েছেন। তাঁকে সেলাম দিই। বিহ্বলতায় এখনও দিন কাটছে।

দ্বিতীয় অনুভবের কথা বলা যাক। সবসময়েই মনে হয়েছে, জীবন, সৌন্দর্য আর শিল্প এই তিন মহীরূহের এক জটিল ত্রিঘাত সমীকরণ আছে। একে অপরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবে না, নির্ভর করার দায়ও নেই পরস্পরের, কিন্তু আশ্রয় করবে সুবিধেমতো। এদের কেউই শুধু নিজের পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সব মিলে মিশে এক চমৎকার আমাদের সামনে উদ্ভিন্ন হবে, এ-ই আমরা চাই। জীবন বা শিল্পকে সুন্দর হতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি– দেবতা বা রাজনৈতিক নেতা অথবা সুবিমল মিশ্র। 

‘কুড়া’তেও এই কুড়ান আমার অব্যাহত। যখন স্থির নির্ঝরিণীর মতো ছবির পর ছবি সৌন্দর্যচেতনার দখল নিচ্ছিল, তখনই হাওড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে অভিঘাত জন্ম নিল। রূঢ়তার, বৈষম্যের। অবশ্যই জীবনের। মনে হয়েছে, এই বৈচিত্র, বৈপরীত্য বা কন্ট্রাস্টই ফিল্মটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। এবার, কায়ুম সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব এইজন্য যে, অতি-গাঢ় কোনও আবেগ-উচ্চারণে এই অভিঘাতের পরিবেশন হয়নি। আবার একেবারে নিরাবেগ কবিত্বহীনও নয় তা। বরং, বেশ স্বাভাবিক তার চয়ন, চলন। এই ভারসাম্য বাঁচিয়ে চলা খুবই স্বস্তির। যদিও কঠিন। জীবন অনেক বড় বস্তু, বিষমও। সবার চেয়ে বড়। সুন্দর-অসুন্দর, সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ, শরীর-মন সব নিয়েই তার রঙের বহু মাত্রা।  কিন্তু আমরা যখন একটি ছবি দেখতে বসেছি, তখন কিন্তু ভেতরে ভেতরে শিল্পই আমাদের চাহিদা। এ ক্ষেত্রে শিল্প যে জীবনের অসুন্দরকে সুন্দর করে দেখাতে চায়নি– বা কুৎসিত ক’রেও- এ বড় নিশ্চিন্দির কথা। গভীর শিল্পচিন্তার ফসল। বিশিষ্ট জীবনবোধেরও।

জীবনই উপজীব্য এখানে। এই অসুন্দর জীবনেও যে সঙ্গীত আছে, লোকাচার আছে, লোকমুখে শোনা কাহিনীর অধিবাসীদের মনে উপস্থিতি আছে, গরিবজনের সঙ্গতিপূর্ণ অনুচ্চকিত প্রেম আছে, মানুষের ঘিরে ঘিরে থাকা আছে, আকীর্ণ হাওড়ের মতোই সরল মানুষের সময়বিশেষের আবেগ প্রকাশ আছে। হাওড় গিলে খাচ্ছে জীবন, কিন্তু তার সঙ্গে বাসিন্দাদের এ কেমন খুনখুনে ঘুরঘুরে আশ্লেষ। আলিঙ্গন। আবার রুকু বলছে সেই কুড়া পাখির কথা, যার কোনও দুখ্যু নেই, যার জীবন সতত আরামের। এই তো পড়ে-যাওয়া মানুষের হাত ধরে কেউ যেন বলছে, ওঠো, আবার উঠে পড়ো। পাশাপাশি, পরিবেশের অনুচ্চার সাবধানবাণীও শুনতে পেলাম যেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটি মহাকাব্যিক। ও বহুমাত্রিক। প্রকাশ মাত্রার সংখ্যা এক বা দুই হলে শিল্পের অভিঘাত তত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু কুড়া-র পাখনার ঢেউয়ের মাত্রা এত বেশি যে, ভালোমন্দের ওপর পৌঁছে মন কেমন যেন ছেয়ে মতো থাকে। আছে। দেখার আঠারো ঘন্টা পার হয়েও। থাকবেও বহু দিন।

ছায়াছবির রঙ, মনে হল, যাচাই ক’রে বাছাই করা। মাটো। বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। অভিনয় খুবই যথাযথ। কলাকুশলীদের নির্বাচন চমৎকার। শুধু রুকুকে শহরের মেয়ে বলে মনে হয়েছে সামান্য হলেও। তবে আমি ভুলও হতে পারি। ছেলে হারানো মায়ের কষ্ট, মরে যাওয়া ধান কোলে নিয়ে চাষীর কান্না, রুকুর সন্ধান করা মায়ের আর তার হবু বাবার মিলনের ছোট গল্প বোকা আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল। 

আর একটা কথা। সুনামগঞ্জের হাওড়ের মানুষ কি এতই হতভাগা যে সরকারি কোনও স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাও তাদের জোটেনি? জুটে থাকলে তার সুবিধে-অসুবিধের কথা বললে আর একটা মাত্রা যোগ হত, এই আর কি।

শেষে বলব কায়ুম সাহেবকে, এমন খ্যাপামি করে চলুন। দেখেছি, খ্যাপারা মরে না।


2 comments:

  1. অভিনন্দন শুভেচ্ছা নিরন্তর শুভকামনা রইল আজীবন

    ReplyDelete
  2. দেখব। ভালো লাগলো।

    ReplyDelete