Pages

Thursday, 3 November 2022

লাতিন আমেরিকা জুড়ে বাম অভ্যুত্থান

‘আমরা যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখি’

প্রবুদ্ধ বাগচী


 

আমাদের দেশে শুধু নয়, সারা দুনিয়ার বামপন্থীদের মধ্যে একটা সময় সুদীর্ঘ বিতর্ক হয়েছে সংসদীয় গণতন্ত্রের উপযোগিতা নিয়ে। সনাতন শ্রেণি সংগ্রাম যদি সরিয়েও রাখি, পিছিয়ে-পড়া গরিব মানুষের স্বার্থে কি সত্যি কাজ করা যায় সংসদীয় পথে? এই প্রশ্নে দেশে দেশে কমিউনিস্ট দল বিভাজিত হয়েছে, এ দেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু অন্তত সোভিয়েত পতনের পরে একটা কথা আজ সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন যে, সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে পাথর ছড়ানো থাকলেও এটা একটা পোক্ত ব্যবস্থা যাকে ইংরেজিতে বলা যায় সাস্টেনেবল সিস্টেম। তাছাড়া লেনিন, স্ট্যালিন যে মার্কসবাদের প্রায়োগিক চর্চা করেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার বদল ঘটেছিল। এশিয়ায় মাওজেদং বা ইউরোপে গ্রামশি, আলথুজার প্রমুখরা তার বিবর্তন ধরতে পেরেছিলেন। শুনেছি, স্ট্যালিন নাকি শেষ জীবনে মাও'এর পথ অনুমোদন করেছিলেন। অন্যদিকে, চে গুয়েভারা বা হো-চি-মিনের গেরিলা-যুদ্ধ নীতি বিশ দশকের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে রাষ্ট্র বিপ্লবের আগুয়ান পঙক্তিতে বসিয়ে দিতে পেরেছিল। ফলে, একবিংশ শতকে এসে দুয়েকটা ব্যতিক্রম ছেড়ে দিলে নানান আঙ্গিকে সংসদীয় গণতন্ত্রের চর্চাই আজ দুনিয়াদারির মূল ধারা। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া আগের চেহারায় না-ই বা থাকল, সংসদীয় পথেও দরিদ্র, অবদমিত মানুষের নানা স্বার্থ রক্ষা করার চেষ্টা হচ্ছে, যারা করতে চাইছেন তাঁরা বামপন্থী মতের মানুষ।

কিন্তু সত্যি বলতে কি, এখনও যারা সমস্ত রঙের কমিউনিস্ট দলের ওপর পুরো ভরসা না-রেখেও আজও, মানুষের মুক্তি না হোক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানহারা মানুষের সম্মানজনক বেঁচে থাকবার একটা আকাশের দিকে তাকাতে চান, অন্তত আমাদের দেশে তাদের পক্ষে ঘোর আকাল। দেশের দিকে তাকালে আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়, বিষণ্ণতা আর বিপন্নতায় অগোছালো হয়ে যায় জীবনযাপন। সম্প্রতি একটা ইউটিউব'এর আলোচনায় সেদিন শুনছিলাম শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি মন-কাড়া বক্তব্য। মনে উত্তাপের বদলে জমছিল হিম শীতল ভয়ের বুদবুদ। সংসদীয় গণতন্ত্রের আড়ালে গোপন চরণ ফেলে ফ্যাসিবাদ যে কায়েম হতে চলেছে এই দেশে, তার সমস্ত লক্ষণ আজ প্রত্যক্ষ। এমনকি আজ আর তা গোপন, এমন বলাও মুশকিল, কারণ কমলমুকুল দলের মতো সে প্রতিদিনই ফুটে উঠছে সেপ্টোপাসের খিদে নিয়ে। কর্পোরেট আর রাষ্ট্রের সখ্য এখন হিমবাহের মতোই জমাট, তারা দুজনেই তাদের পাওনা বুঝে নিতে চায় যে কোনও মূল্যে। পীড়িত মানুষের স্বার্থ, তাদের চাহিদা, দাবি-দাওয়া, যন্ত্রণা, অপমান রাষ্ট্রের কাছে মল-মূত্রের মতোই বর্জ্য মাত্র। এমনকি নাগরিকের মগজ জবরদখল করে সেখানে আগ্রাসন ও হিংসার ল্যান্ডমাইন পুঁতে দিয়ে আসাটাই কয়েক বছর ধরে প্রধান কর্মসূচি হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যৌথবাহিনীর। পাশাপাশি ‘মগজ প্রক্ষালন’এর বিরুদ্ধাচারীদের যে ‘লাইফ হেল’ করে দেওয়া হবে, এই স্পর্ধিত বার্তাও আজ ফেটে পড়েছে ‘মন কি বাত’এর খোলস সরিয়ে।

দুর্দিন। ঘোর দুর্দিন। সামাজিক রাজনৈতিক এই অমানিশার মধ্যে দেশ ও রাজ্যের সংসদীয় গণতান্ত্রিক পরিসরেও কমিউনিস্ট দলের প্রতিনিধিত্ব শূন্যে এসে ঠেকেছে। শুধু কি তাই? কোনও দলের ধামাধরা না হয়েও মার্কসবাদের সপক্ষে, পীড়িত মানুষের পক্ষে কথা বলার সামাজিক পরিসরও ক্রমশ সঙ্কুচিত। কোনও একটি বিশেষ মুখের জয়গান করা ভিন্ন আর কীই বা আমাদের কর্তব্য, তা বুঝে নিতে গিয়ে পথ হাতড়াতে হয়। এমনকি, ইদানিং নাকি রাজ্যের প্রাক্তন শাসক দলের পক্ষে ভাল ভিড় হচ্ছে এই চিত্র অবলোকন করেও বোঝা যায় না এটা মরুদ্যান না মরীচিকা!

এই অন্ধকারে হঠাৎ এক আলোর ঝলকানি হয়ে দেখা দিল সুদূর ব্রাজিলের নির্বাচন। সদ্য সেই দেশের পরাক্রান্ত প্রতিক্রিয়াশীল একনায়ক হারলেন তাঁর বামপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বী লুলা সিলভার কাছে। আমাদের কাছে কৈশোরের ব্রাজিল মানে ফুটবলের ‘রাজা’ পেলে আর কফি, সঙ্গে ভূগোল বইয়ের সিলেবাসে আমাজন অরণ্য। এ কালের তরুণরা অবশ্য 'আমাজন' বলতে অন্য কিছুও বোঝে, সেও এক ছেনালিময় সমীকরণ। কিন্তু ব্রাজিলের এই সদ্য পরাজিত সম্রাট নানা জনবিরোধী কাজের সমান্তরালে একইভাবে কর্পোরেটের হাতে হাত রেখে সেই বনভূমিকেই তাদের মৃগয়াক্ষেত্র করে তুলতে মরিয়া ছিলেন। তাঁর পরাজয় আন্তর্জাতিক পরিবেশ আন্দোলনের একরকম বিজয় বইকি! আমাদের ‘সকল দেশের রাণী’তেও একুশ শতকের প্রথম দশক থেকে এই পরিবেশ নিধনের সরকারি সন্ত্রাস গতিশীল। লড়াই এখানেও চলছে, ওখানেও চলেছে। কিন্তু ব্রাজিলের মানুষ আজ আপাতত আশ্বস্ত। তাদের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভরসা দিয়েছেন পরিবেশ নিয়ে এই মুনাফাবাজির বিপরীতেই হবে তাঁর অবস্থান।

লাতিন আমেরিকার ভৌগোলিক আয়তনের মধ্যে বেশ একটা বড় অংশ নিয়ে ব্রাজিল দেশটির অবস্থান। আর গত কয়েক বছরে এই দেশের সরকারের নানা কুকীর্তি বারবার শিরোনামে এসেছে। এর আগের নির্বাচনে বামপন্থী লুলা'কে কারাগারে আটকে রেখে নির্বাচনে লড়তেই দেওয়া হয়নি। এবার হাওয়া ঘুরেছে এবং আপাতভাবে প্রবল পরাক্রমী শাসকের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছে মানুষের ক্ষোভ যার ছাপ পড়েছে ভোটিং মেশিনে। কী অবাক কাণ্ড, পরাজিত প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন ইভিএম নিয়ে! গল্পটা কেমন আমাদের চেনা চেনা লাগছে না? কিন্তু এইসব গপ্পো গুজব পেরিয়ে অনেক দূরের ভারত ভূমিতে বসেও আমরা খুশির শরিক। কে গেলেন বা কে এলেন, এই বিচারের থেকেও বেশি জরুরি, কোন মতাদর্শ জয়ীর নিশান হাতে নিল। এইখানে স্বস্তি, এইখানেই ভরসা। আমাদের আজকের দমবন্ধ রাজনীতির ভুলভুলাইয়ায় এইটুকু স্নিগ্ধ সংবাদ তাই এত হর্ষ-জাগানিয়া হয়ে ঢুকে পড়তে চায় মনের অলিন্দে।

অবশ্য সব শুরুরই একটা আগের সলতে পাকানো আছে। এই তথ্য আমাদের না খেয়াল করলে চলবে না, লাতিন আমেরিকাই সেই একমাত্র মহাদেশ যেখানে সাবেক বামপন্থার দর্শন যুগের হাওয়ায় নিজেকে পাল্টে নিয়ে একেক দেশে একেক চেহারা নিয়ে মানুষের লড়াইয়ে নিজেদের শরিক করেছে। আর লাতিন আমেরিকাই সেই মহাদেশ যেখানে একসময় স্পেনীয় সাম্রাজ্যবাদ তার আস্তানা গেড়ে লুঠ করেছে সেখানকার শ্রম ও বিত্ত। পরের পর্বে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজেদের নিগড় পোক্ত করতে বারবার সেখানকার দেশগুলির সামরিক বাহিনীকে উস্কে ও নিজেদের বাহিনিকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে মাথা তুলতে একটানা বাধা দিয়ে এসেছে। 'স্ট্যাচু অফ লিবার্টি'র দেশ পৃথিবীর এই প্রান্তে খুল্লমখুল্লা প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে সেখানকার মার্কিন-পুতুল একেকজন একনায়ককে, সমস্ত গণতান্ত্রিক কর্মসূচি যেখানে প্রতিহত হয়েছে বিচারহীন কারাগারের দেওয়ালে। লাতিন আমেরিকার কারাগার সাহিত্য বা আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম আজও মুক্তিকামী চেতনার সহোদর। আবার নিকারাগুয়ার মতো দেশে বিপ্লবের কাণ্ডারী হয়েছে সাবেক মার্কসবাদ নয়, গড়ে উঠেছে খ্রিস্ট ধর্মের ভিতর থেকে এক নতুন মতবাদ ‘লিবারেশন থিওলজি’— যাজকদের একটা বিপ্লবী অংশ নিকারাগুয়ার বিপ্লবের কারিগর হয়েছিলেন। কেতাবী বামপন্থায় না মিললেও, তাদের ভাবনায় মানুষের সম্মানজনক জীবনযাপনের উপযোগী দেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি আছে। লাতিন আমেরিকা তাই সারা দুনিয়ার সামনে এক বিস্ময়। চে-র মৃত্যু আমাদের বাঙালি কবিকে একদিন অপরাধী করে দিয়েছিল, কিন্তু কাস্ত্রো আর মারকয়েজ সেই একই মহাদেশের সন্তান। নেরুদা আর নিকোনার পারা তাঁদের বিবেক। আমাদেরও তো এই ঐতিহ্য কম ছিল না! ফুলগুলি সব কোথায় গেল?

তাই একটু হিসেব করে দেখতেই হবে, সারা দুনিয়ায় যখন দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল রাজনৈতিক শক্তি তাদের দাপট বাড়িয়েছে তখন গত তিন বছরের পরিসীমায় লাতিন আমেরিকার একেকটি দেশে মাথা তুলেছে বাম-মতাদর্শী রাজনৈতিক প্রভাব। এর শুরু হয়েছিল ২০১৯-এ যখন কিউবাতে জিতে এলেন মিগুয়েল দিয়াজ কানেল, মার্কিনীদের সমস্ত কৌশল আর অবরোধকে প্রতিহত করে। এরপর দু' বছরের মধ্যে হন্ডুরাস, চিলি, পেরু, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া, কলম্বিয়া একে একে সব দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলেন বামপন্থী প্রেসিডেন্টরা। সব শেষে ব্রাজিল। এই জয়ের পরে বিবিসি লাতিন আমেরিকার একটি রঙিন ম্যাপ প্রকাশ করেছে যেখানে দেখা যাচ্ছে মহাদেশের শতকরা আশি ভাগের রং লাল। বিস্ময়কর হলেও সত্যি। কিশোরবেলায় একটা গান শুনেছিলাম, ‘আমাদের প্রিয় রং লাল’- আক্ষরিক অর্থেই আজ লাতিন আমেরিকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই গানের কথাকে সত্যে পরিণত করেছেন।  

আমাদের আজকের অবস্থান ভৌগোলিক ভাবে শুধু নয়, সবদিক দিয়েই বিপরীত মেরুতে। কিন্তু যে যেমন ভাবেই ভাবি না কেন, আমাদের সচেতন মানবমুখী চেতনার মধ্যেও যত ভাঙাগড়াই থাকুক, সারা বিশ্বে যে যেখানে লড়ে যায় তা কখন যেন আমাদেরই লড়াই হয়ে ওঠে, আমাদের মর্মে জাগিয়ে তোলে স্পন্দন। সেই ছন্দেই আমরা পা ফেলেছি অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট থেকে দেশের কৃষক আন্দোলনে। তাই আজ উদযাপন, তাই আজ এত শব্দের বুনন। অশোক মিত্র মশাই বলতেন, পেশাদার আশাবাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। সত্যিই নেই। তাই এক্ষুনি এ দেশেও ‘লাল সূর্যের ভোর’ জেগে উঠবে তা এক আপাত-অলীক ভ্রান্তিবিলাস মাত্র। এই বেয়াড়া আশাবাদে পা পিছলে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কিন্তু আজকের ব্রাজিল, আজকের লাতিন আমেরিকা আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া স্বপ্নের ভিতর উজ্জীবনী কোরামিন। আমাদের নতুন করে একটু প্রশ্বাস নেওয়ার স্পর্ধা। বেরঙিন আকালে ‘স্বপ্ন দেখার মহড়া’। ডুবজলে সাঁতার দেওয়ার মরিয়া প্রতিবেদন। উদয়াচলের পথযাত্রীদের এই দুঃসাহসের হাল ছাড়লে চলবে কী করে? রাত কত হল, তার উত্তর তো আমাদের খুঁজে পেতেই হবে, তাই না ?  

 

6 comments:

  1. অত্যন্ত সুন্দর এক আলোচনা এবং এই আলোচনার মধ্যে আমাদের দেশের অবস্থাও সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এবং আমরাও ভেঙে যাওয়া আশাকে আবার মনের মধ্যে ফিরিয়ে আনার একটু একটু সাহস পাচ্ছি।

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লিখেছেন। আমি বেশ কয়েকটি আড্ডায় পড়ে শুনিয়েছি।

    ReplyDelete
  3. অত্যন্ত সুন্দর আশা জাগানো আলোচনা। একটা সংবিধান অবলম্বন করে ভোটে জিতে ফ্যাসিস্ট রা বারে বারে সংবিধান কে হত্যা করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছে। আর আমাদের বামেরা একই ভাবে ক্ষমতায় এসে সারাক্ষণ আউড়ে গেলেন "এই সিস্টেমে কিছু করা যায় না"। সারাক্ষণ সরকার ভেঙে যাবার আশঙ্কায় দ্বিধাগ্রস্ত। চিলির আলেন্দে সরকার কিন্তু ফ্রন্টফুটেই খেলেছিলো। ফলতঃ লাতিন আমেরিকার বামপন্থা সংসদীয় পথে সাসটেইনেবল ডেভলপমেন্ট ভাবতে পারলেও আমরা পারিনা। আমরা এখনও কেরলে আদানীর সেজ (SEZ), সিঙ্গুরে মোটর কারখানা, আর নয়াচরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে গোঁয়ার্তুমি করলাম। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না ঘটালে এদেশে বামেদের আশার আলো দেখি না। দেশজুড়ে এতো বড়ো কৃষক আন্দোলন হয়ে গেলো, আন্দোলনের নেতারা এরাজ্যে এলেন। কিন্তু বামেদের বিশেষ সক্রিয়তা চোখে পড়লো কোথায়?

    ReplyDelete
  4. ভালো লাগলো।
    দক্ষিণপন্থী পরাজয় এক আশাবাদের সঞ্চার করে। মোদি,ট্রাম্প, বোলসেনারো তিন ঘাতক অপসারিত হ‌ওয়া চাই।
    অসিত

    ReplyDelete
  5. প্ৰয়োজনীয় আলোচনা ।

    ReplyDelete
  6. ভালো লাগলো পড়ে । আশাবাদ জাগছে-

    ReplyDelete