Pages

Wednesday, 31 August 2022

শেয়ার বাজারের অর্থনীতি

আসতে পারে নতুন বুল রান

পার্থ  হালদার


গত বছরের অক্টোবর মাসে নতুন উচ্চতায় পৌঁছনোর পর এই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত শেয়ার বাজার ক্রমেই নিম্নমুখি হয়েছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায়, চড়া মুদ্রাস্ফীতি, সুদের হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও তার আগের বছরগুলিতে শুধু বেলাগাম অর্থ জোগানের কারণে বাজারের অস্বাভাবিক উত্থান। তাই, বাজারের পতন অস্বাভাবিক ছিল না। তার উপর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি ও ভোজ্য তেলের হঠাৎ দাম বৃদ্ধি সারা পৃথিবীর অর্থনীতির কাছে বড়  চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। গত এক বছরে আমেরিকার ফেড ও অন্যান্য সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলি সুদের হার বৃদ্ধি করতে থাকে ও বাজারে অতিরিক্ত অর্থ জোগান কমতে থাকায় শেয়ার বাজারে বড়রকম পতন দেখা দেয়। এই পতন জুলাই মাস পর্যন্ত চলার পর মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং ওপেক ও অন্যান্য তেল উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখি হয়। উপরন্তু, ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রফতানি আবার শুরু করায় খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। এছাড়াও, শ্রীলংকার আর্থিক সংকটের জন্য ভারতের রফতানি সে দেশে বাধাপ্রাপ্ত হলে ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাবও পড়েছে।

এত কিছুর মধ্যেই জুলাই মাসের শেষ দিক থেকে ধীরে ধীরে পৃথিবীর সমস্ত শেয়ার বাজারই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। তার প্রভাব ভারতীয় শেয়ার বাজারেও পড়ে। জুলাইয়ের মধ্য ভাগ থেকে মাথা তুলতে শুরু করে ভারতীয় শেয়ার সূচক। এবারের উত্থানে যেটা লক্ষণীয়, প্রথমেই ভালো প্রদর্শন করেছে অটো শেয়ারগুলি। মাহিন্দ্রা অ্যান্ড মাহিন্দ্রা, টাটা মোটর্স, হুন্ডাই প্রভৃতি কোম্পানিগুলি একের পর এক ইলেকট্রিক কার বাজারে আনতে শুরু করেছে। ফলে, আগামী দিনে ভারতকে অনেক কম পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করতে হবে। জ্বালানি তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের কাছে এটি একটি বড় সুখবর। এতে একদিকে যেমন পরিবেশ দূষণমুক্ত হবে, তেমনই বাঁচবে বৈদেশিক মুদ্রা। অটো সেক্টর'এর সঙ্গে সঙ্গে ভালো প্রদর্শন করেছে ক্যাপিটাল গুডস সেগমেন্ট। 

ভারতীয় অর্থনীতির কাছে আর একটি সুখবর হল, আগামী অক্টোবর মাস থেকে ৫জি  পরিষেবার সূত্রপাত। এই পরিষেবা দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক জগৎকে আরও গতিশীল করে তুলবে, যার প্রভাব পড়তে চলেছে শেয়ার বাজারে। টাকার দামের পতন আপাতত বন্ধ হওয়ার কারণে ভারতীয় মুদ্রাবাজার এখন স্থিতিশীল। এই অবস্থা আগামী দিনে বজায় থাকলে অবশ্যই তার সুপ্রভাব শেয়ার বাজারে  আসতে চলেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে মন্দার আশঙ্কা এই মুহূর্তে বেশ কম। তাই সারা পৃথিবীব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি কমা শুরু হলে ও উপরিউক্ত সমস্ত প্রভাবগুলি আসতে শুরু করলে তার উপর ভর করে শুরু হতে পারে নতুন বুল রান। গত দু' মাসে আমাদের দেশেও ভোজ্য তেল ও শাকসবজির দাম কিছুটা কমায় আশার আলো দেখতে শুরু করেছে ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ফলে, খুব তাড়াতড়ি চড়া ভাবে সুদের হার বাড়ার সম্ভাবনাও কম। সারা বিশ্বের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের চোখ এখন আগামী দিনে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার উপর।

এসবের মধ্যে অবশ্যই কিছু আশঙ্কাও থেকে গেছে। আদানি গ্রুপের ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে সতর্ক করেছে স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর। কোনও কারণে এই ব্যাঙ্ক ঋণ মন্দা অবস্থার মধ্যে পড়লে তার পরিণতি হতে পারে মারাত্মক এবং ঋণ নিয়ে কোনও কোম্পানি অধিগ্রহণ কখনই ভালো বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নয়। অন্যদিকে চীন এবং তাইওয়ানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক টানাপোড়েন শেয়ার বাজারের উত্থানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অগস্ট মাসের ফেড'এর মিটিং'এ ফেড চেয়ারম্যান জেরম পাভেল জানিয়েছেন যে, আমেরিকাতে সুদের হার দীর্ঘদিন বেশি থাকতে পারে। তাই বহু আর্থিক বিশেষজ্ঞ এখনই বাজার বাড়ার সম্ভাবনা না দেখলেও অনেকের মতে, উঁচু সুদের হার আগামী দিনে সেরকম কোনও প্রভাব ফেলবে না। হয়তো আগামী জানুয়ারিতেই নতুন উচ্চতায় পৌঁছবে শেয়ার সূচক। তবে বিনিয়োগের কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া জরুরি।

 

Tuesday, 23 August 2022

দুর্নীতির রাজনীতি

চরম বৈষম্য ও বঞ্চনার খেলা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

দেখাই যাচ্ছে, কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, মুম্বই থেকে ইম্ফল- দেশের সরকার ইডি, সিবিআই, আয়কর দফতর, এনআইএ, ইউএপিএ ইত্যাকার নানাবিধ এজেন্সি, আইন ও উর্দিধারীদের নিয়ে বিরোধীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেন, যা কিছু অপরাধ, যা কিছু দুর্নীতি, সব তথাকথিত বিরোধী দল বা ব্যক্তিদেরই অপকর্ম মাত্র। এইসব কাজে শাসকদের কেউ কোথাও ‘যুক্ত নয়’! মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির প্রাক্কালেও এই ছবিটাই বহুলাংশে দেখা গিয়েছিল।

ঘটনা এই যে, আমাদের দেশের কোনও রাজনৈতিক দলই ধোয়া তুলসিপাতা নয়। হয় দুর্নীতি, নয়তো কাজে অপারদর্শিতা বা পদ্ধতিগত ত্রুটি অথবা জনবিরোধী নীতি, নচেৎ ক্ষমতার সন্ত্রাস এমনতর বিবিধ পঙ্গুতা ও জরায় এরা বরাবর কমবেশি আক্রান্ত। কিন্তু আজ যেন হঠাৎই দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসক ছোটবড় যে কোনও বিরোধী পদস্খলন, দুর্নীতির গন্ধ পেলে তো কথাই নেই, এমনকি মিথ্যা অভিযোগ এনেও সর্বতোভাবে শুধুমাত্র বিরোধী দলগুলির ওপরই সারা দেশ জুড়ে এজেন্সি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এমন নগ্ন আক্রমণ আগে কখনও দেখা যায়নি। এ বিষয়ে তাদের কোনও চক্ষুলজ্জারও বালাই নেই: হাজার অপরাধেও নিজেদের দল ও চরম দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল করতে তারা বিন্দুমাত্র কুন্ঠিত নয়। তারা যে কতবড় নির্লজ্জ তা আমরা সদ্য সদ্য দেখলাম- স্বাধীনতা দিবসে বিলকিস বানোর ধর্ষকদের আজীবন সাজাপ্রাপ্তি থেকে গুজরাত সরকার কীভাবে বেহায়ার মতো মুক্তি দিল।

অবশ্যই এমনটা ভাবারও কোনও কারণ নেই যে, বিরোধী দলগুলির নেতারা কোনও বড়মাপের দুর্নীতি করেনি। করেছে, অবশ্যই করেছে। বিশেষত পার্থ চট্টোপাধ্যায়, অনুব্রত মণ্ডল প্রভৃতি সম্পর্কে যে সমস্ত অভিযোগ উঠে এসেছে, তাকে আপাত-মান্যতা না দেওয়ার কোনও কারণ নেই। আমরা বহুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গে নানাবিধ দুর্নীতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নজির চলতে-ফিরতে টের পাচ্ছিলাম। হয়তো, আমাদেরও অনেকেই সেই সব দুর্নীতির ঘোরতর শিকার। স্কুল-কলেজে শিক্ষক নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হয়েছে, তা শাক দিয়ে ঢেকে রাখার উপায় নেই। আদালতের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে তা এখন দিনের আলোর মতো উদ্ভাসিত। তাই, যে কারণে বা উদ্দেশ্যেই হোক, তদন্ত যে শুরু হয়েছে, ফলে, কিছু কার্যকরী ফলাফলও আমরা দেখতে পাচ্ছি, উচ্চপদস্থ নেতারা জেলবন্দী হচ্ছেন, তা হওয়ারই ছিল, হয়ে ভালই হয়েছে। আইনের বিচারে ভবিষ্যতে যদি অন্যতর কিছু প্রকাশ পায় তবে তা নিশ্চয়ই এক নতুন মাত্রা নিয়ে আসবে; যদিও তা অভূতপূর্ব কিছু নয়। কারণ, আমরা তো আগেও দেখেছি, শাসকেরা কতশত মিথ্যা অভিযোগে বিরোধীদের নিকেশ করেছে। তাই, এই হেনস্থা হওয়ার ঝঞ্ঝাটটা রাজনীতিবিদদের বহন করতেই হয়, তা নিয়ে আক্ষেপ করে লাভ নেই। কিন্তু শুধুমাত্র সেটুকু বললে গল্পের অর্ধাংশটা অধরা থেকে যায়, যা এক গভীর গেমপ্ল্যানের অংশ।

একদিকে যেমন দুর্নীতির দায় বিরোধীদের অনেকেরই আছে, বহুবার বহু বিরোধী নেতা দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছেন, অন্যদিকে শাসকের তরফ থেকেও অযথা হেনস্থা অথবা তিলকে তাল করে দেখিয়ে টার্গেট করাটাও সমানতালে চলেছে। উপরন্তু, বিজেপির দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের আড়াল করে তাদের বাঁচিয়ে নেওয়া বা তাদের সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগগুলোকে বিন্দুমাত্র আমল না দেওয়া- এই প্রক্রিয়াটিও চালু আছে সমানতালে। যেমন, কী সুন্দর গায়ে বাতাস লাগিয়ে শুভেন্দু অধিকারী, নিশীথ প্রামাণিক, হিমন্ত বিশ্ব শর্মারা দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অর্থাৎ, বিজেপি’র গেমপ্ল্যানটা হল: ১) ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে যতটা সম্ভব সমস্ত বিরোধী দলগুলির সুনাম ও অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে বিপ্রতীপে নিজেদের শুদ্ধ, ওয়াশিং মেশিনে ধবধবে সাদা হয়ে আসা ‘ইমেজ’কে নিশ্চিত করা; ২) সর্বত্র এক সন্ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে বিজেপির পায়ে পরে বাঁচতে চাইবে; ৩) বামপন্থী মতাদর্শকে তীব্র ভাবে আক্রমণ করা, যা ব্যতিরেকে নিজেদের ধর্মান্ধ মতাদর্শকে তারা মানুষের মনে ভাসাতে পারবে না। খেয়াল রাখি, বামপন্থী মতাদর্শ শুধুমাত্র তথাকথিত বাম দলগুলির মধ্যে আজ আর সীমায়িত নেই। বামপন্থী মতাদর্শের বহু কিছুকে আজ অ-বামপন্থীরাও হাতিয়ার করেছে। সে অর্থে, বামপন্থা্র নতুন ভাবে প্রাণসঞ্চার হচ্ছে। এই জায়গাটাকেই বিজেপি দুরমুশ করতে চায়, তাই বামপন্থী দলগুলির থেকেও বেশি করে বাম-ধারণার প্রচ্ছায়ায় অবস্থিত 'অবাম দলগুলি'কেই তারা এখন টার্গেট করেছে যারা এই মুহূর্তে তাদের সামনে রাজনৈতিক বিপদ। যেমন, আপ, ডিএমকে, তৃণমূল, টিআরএস, আরজেডি, সমাজবাদী দল ইত্যাদি। ‘রেউড়ি’ বা জনকল্যাণ রাজনীতির বিরুদ্ধে মোদীর আচম্বিত বিষোদগার কতকটা এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই।

আমরা দেখলাম, নিউ ইয়র্ক টাইমস’এ দিল্লির আপ সরকারের স্কুল পরিচালনার সাফল্য নিয়ে বড় করে খবর প্রকাশের পরপরই সিবিআই কীভাবে হামলে পড়ল উপমুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার বাড়িতে। তার মাসখানেক আগেই ইডি দিল্লির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সত্যেন্দ্র জৈনকে তুলে নিয়ে গেছে। কারণ, সত্যেন্দ্র জৈন’র নেতৃত্বে দিল্লি সরকার স্বাস্থ্যক্ষত্রেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করেছে এবং মহল্লা ক্লিনিক সারা দেশ জুড়েই এক অভূতপূর্ব নিদর্শন হয়ে উঠেছে। সবিশেষ উল্লেখ্য, আপ নেত্রী অতিশী সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন, বিজেপি’র পক্ষ থেকে যিনি মণীশ সিসোদিয়াকে বিজেপিতে যোগ দিলে সমস্ত কেস প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে বলে যে বার্তাটি দিয়েছেন, সেই তিনিই শুভেন্দু অধিকারী, মুকুল রায়, হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকেও একই প্রস্তাব দিয়ে দলে ভিড়িয়েছিলেন। আশাকরি, দুর্নীতির বহর ও খেলাটি এবার খোলসা হচ্ছে। সম্প্রতি, পশ্চিমবঙ্গেও আয়কর বিভাগ থেকে কলকাতা টিভি’র দফতর ও তাদের অধিকর্তাদের বাড়িতে ৮০ ঘন্টা ব্যাপী ব্যাপক অভিযান চালানো হয় এবং তাদের জনপ্রিয় ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ শীর্ষক সম্প্রসারণটি শুধুমাত্র বন্ধ করে দেওয়া নয়, তার পরিচালক সুচন্দ্রিমা পালকে ব্যক্তিগত ভাবেও তুমুল হেনস্থা করা হয়। কারণ, ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ নামক ওই সম্প্রসারণটিতে বহু খোলামেলা কথা বলা হত যা বিজেপি’র কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল। উল্লেখ্য, এই অভিযানে সিবিআই'কে কিন্তু খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে; হেনস্থা করাটাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য।

কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হল, দুর্নীতির এই দুর্বিনীত খেলা কি চলতেই থাকবে? এত আলোড়ন, হৈ-হট্টগোলের পরেও তার থেকে কি কোনও নিস্তার নেই? মুশকিল হচ্ছে, এই কিছুদিন আগেও বড় গলায় কেউ কেউ বলতেন, সমস্ত কাজকর্ম যদি ডিজিটাল হয়ে যায়, ঘরে বসে অনলাইনে যদি লেনদেন করা যায় তাহলে দুর্নীতির প্রকোপ কমে আসবে। কথাটা আংশিক সত্য। ছোট ছোট খুচরো সরকারি দুর্নীতির ক্ষেত্রে তা সত্য। কিন্তু ডিজিটাল ভুবন জোড়া যে গভীর ফাঁদ বিস্তৃত, তাতে অহরহ আর্থিক তথ্য সমেত ধরা পড়ে যাওয়া ও সর্বস্বান্ত হওয়া এখন নিত্যকার ঘটনা মাত্র। খুব সজাগ ও সতর্ক ব্যক্তি ছাড়া এই ফাঁদে অধিকাংশ মানুষই নানা উপায়ে পড়ছেন ও প্রতারিত হচ্ছেন। অর্থাৎ, ডিজিটাল দুনিয়া এক নতুন ধরনের বাটপাড়ি ও দুর্নীতির পথ খুলে দিয়েছে। তার সঙ্গে ‘ডার্ক ওয়েব’এর অভূতপূর্ব অন্ধকার জগতের কারবার তো আছেই। আর কর্পোরেট দুর্নীতি? যেখানে লক্ষ কোটি টাকা হাপিশ করে গায়েব হয়ে যায় তথাকথিত কর্পোরেটরা! কর্পোরেট বন্ধুকে খাতিরদারি করতে দেশের শীর্ষতম শাসকেরা মকুব করে দেয় রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের ঋণ! পিএম কেয়ার ফান্ড? ইলেক্টোরাল বন্ড? যে বিপুল অর্থের কোনও সরকারি অডিট নেই, উৎস জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই! তাহলে কি দুর্নীতিকে আইনত মান্যতা দেওয়ার তোড়জোড় চলেছে বর্তমান শাসকের আমলে?

বলাই বাহুল্য, আপনি যদি দুর্নীতির জগতে প্রবেশ করতে না চান, প্রদানকারী ও গ্রহণকারী উভয় ভূমিকাতেই নিজেকে দুর্নীতি মুক্ত রাখতে চান, এবং শুধু আপনি নন, অধিকাংশ মানুষই তেমনটা চান, তাহলে দুর্নীতির শিকড় আলগা হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কর্পোরেট দুর্নীতি আমার-আপনার ভাবনা নির্ভর নয়। তা শাসকের নীতি-প্রকৌশলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সে দুর্নীতিকে রোধ করতে হলে জনসমাজকে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে নামতে হবে। সেই ভাবনার জগতে আমরা অধিকাংশেরা পৌঁছতে পারব কিনা, তা বলা দুষ্কর, কিন্তু পৃথিবীর বহু দেশ আছে যেখানে দুর্নীতির ঘটনা প্রায় শূন্য (যেমন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড)। তার জন্য অবশ্যই জনতার স্বার্থবাহী এমন এক ব্যবস্থা থাকা উচিত যা পুরোদস্তুর কাজ করতে সক্ষম। সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। দিল্লি ও পঞ্জাবের রাজ্য সরকার এ বিষয়ে নিশ্চয়ই তাদের যথাসাধ্য অবদান রেখেছে ও ইতিবাচক ফলাফলও পেয়েছে। এখন দেখার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ডিজিটাল ভুবন যে আংশিক ভাবে হলেও দুর্নীতিকে রোধ করতে সক্ষম বলে দাবি করা হয়, তা কতটা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারে। কারণ, জনমানসে দুর্নীতি যদি এক সামাজিক-মান্য বর্গ হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে, তাহলে তা হানাহানিতেই লিপ্ত থাকবে যে কোনও পরিস্থিতিতেও। এই ‘মেনে নেওয়া’র মানসিকতা দানা বাঁধতে যেমন সময় নিয়েছে, তেমনই খুব অল্প সময়ে তা নিরসনও হবে না, কিন্তু প্রচেষ্টা ও জনমত দুইই সচল থাক। কতটা এগোনো গেল বোঝা যাবে। এবার অন্তত সে যাত্রা শুরু হোক।

        

Thursday, 18 August 2022

স্বাধীনতা দিবসের মর্যাদা হানি

গণধর্ষকদের নির্লজ্জ মুক্তি

নীলকন্ঠ আচার্য


 

এ বছরের স্বাধীনতা দিবস আমাদের কাছে যে বিশেষ কয়েকটি কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার মধ্যে অন্যতম গুজরাত দাঙ্গায় গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন কুখ্যাত অপরাধীর সরকারি বদান্যতায় সমস্ত আইনি বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করে জেল থেকে মুক্তি। স্বাধীনতার 'অমৃত মহোৎসবে' সারা দেশ এই সরকারি বেপরোয়া ন্যক্কারজনক ঘটনায় স্তম্ভিত। একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর লালকেল্লা থেকে ৮৩ মিনিটের অদ্ভুত ভাষণের এক অংশে দেশের নারী সমাজকে সম্মান দেওয়া, সুরক্ষিত ও শক্তিশালী করার কথা উদাত্ত ভাবে তুলে ধরা হচ্ছিল, অন্যদিকে তার কিছুক্ষণের মধ্যেই গুজরাতের সরকারের নির্দেশে গোধরার সাব-জেল থেকে ১১ জন খুনী ও ধর্ষকদের ঘটা করে মিষ্টি খাইয়ে ও ফুলের মালায় বরণ করে বের করে আনা হল। এই ঘটনা বহু আইনজীবীকেও হতবাক করেছে। কারণ, দেশের সংবিধান, শীর্ষ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের (গুজরাত) রেমিশন নীতি অনুযায়ী ধর্ষণ ও পরিকল্পিতভাবে খুনের অপরাধে আজীবন‌ সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের কোনও অবস্হাতেই ক্ষমা প্রদর্শন করা যায় না, এ কথা স্পষ্টভাবে বলা আছে। তবুও কেন এই সিদ্ধান্ত? 

প্রাথমিকভাবে এর একটাই  উত্তর হতে‌ পারে: সরকারি খোলসের মধ্যে (কেন্দ্র ও গুজরাত) বিরাজমান এই চরম জনবিরোধী, অমানবিক, দেশবিরোধী ফ্যাসিস্ত শক্তিটি আজ আরও উদ্ধতভাবে তার নির্দিষ্ট অশুভ লক্ষ্যের দিকে দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইছে। অতএব, এই বেপরোয়া উদ্ধত পন্থা গ্রহণে তাদের‌ আর কোনও দ্বিধা নেই। বরং বলা যায়, এই লক্ষ্যে তাদের প্রস্তুতি প্রায় সম্পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছেছে।      

দিনটা ছিল অভিশপ্ত ৩ মার্চ, ২০০২'র সকাল; যখন ১৯ বর্ষীয়া বিলকিস বানো (পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা) গোধরায় তাঁর পৈতৃক বাড়ি থেকে তিন বছরের মেয়ে, মা সহ পরিবারের প্রায় ১৭ জনের একটি আর্ত দলের সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে উর্ধ্বশ্বাসে কোনও নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছিলেন, তখন উগ্র হিন্দুত্ববাদী নরঘাতকদের একটি দল তাঁদের পথ আটকায়। ওই ঘাতক দলের মধ্যে ১১ জন ছিল বর্তমানে সরকারি মদতে জেল থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত খুনী ও গণধর্ষণকারীরা। এদের মধ্যে অনেকেই বিলকিসের পরিচিত। ঘাতকের ওই দল সেদিন মোট ১৪ জনকে হত্যা করে যার মধ্যে বিলকিসের তিন বছরের মেয়েটিও ছিল, যাকে বিলকিসের সামনেই আছাড় দিয়ে মেরে ফেলা হয়। একই সঙ্গে বিলকিস সহ ওই পরিবারের কয়েকজনকে গণধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বিলকিসকে মৃত ভেবে ঘাতকের দল বধ্যভূমি ত্যাগ করে।

বর্তমানে‌ সেই ১১ জন ঘাতককে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে বিলকিসের অবশিষ্ট পরিবার পুনরায় আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। উল্লেখ্য, ১১ জন যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এই ঘাতকের দলকে এভাবে ছেড়ে দেওয়ার পিছনে শীর্ষ আদালতেরও পরোক্ষ ভূমিকা আছে। ওই ঘাতকদের একজন ক্ষমা প্রার্থনার জন্য শীর্ষ‌ আদালতে আবেদন‌ জানালে গত ২৩ মে ২০২২ আদালত একটি প্যানেল গঠন করে তাদের ওপর ক্ষমা প্রদর্শন সংক্রান্ত বিষয়টি ফয়সালা করার দায়িত্ব দেয়। সংশ্লিষ্ট প্যানেল পরোক্ষভাবে ক্ষমা প্রদর্শনের পক্ষে মতামত জ্ঞাপন করে গুজরাত সরকারকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলে। ঘুঁটি সাজানোই ছিল। গুজরাত সরকার হরিয়ানা উচ্চ আদালতের রেমিশন সংক্রান্ত একটি রুলিংকে অজুহাত করে অপরাধী ১১ জনকে 'ক্ষমা প্রদর্শনের' মাধ্যমে মুক্তির নির্দেশ দেয়।   ‌‌‌‌‌                          

বিচারশাস্ত্রের মাপকাঠিতে গোটা প্রক্রিয়াটি বিতর্কিত এবং অনেকের মতেই এটি আইন ব্যবস্হার পরিপন্থী। বিলকিস বানোর আইনজীবী বলেছেন, এত বড় একটা ঘটনা আদালত ও সরকারের অংশগ্রহণে হয়ে গেল, অথচ এ বিষয়ে বাদী পক্ষকে আগাম কোনও প্রতিলিপিও দেওয়া হল না! তাঁর প্রশ্ন, যেখানে শীর্ষ আদালতের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ থেকে ২০০৫ সালে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আজীবন কারাবাস মানে জীবনের 'শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত' কারাবাস, যেখানে জানুয়ারি ২০১৪, গুজরাত ও কেন্দ্রীয় সরকারের রেমিশন নীতিতে ধর্ষক এবং পরিকল্পিতভাবে হত্যাকারীদের ক্ষমা প্রদর্শন নীতির বাইরে রাখা হয়েছে, তখন এই ঘটনা বিচার ব্যবস্হা ও সরকারি প্রশাসনকে একসঙ্গে অভিযোগের কাঠগড়ায় তুলে দেয়।

গুজরাতের জনৈক মানবাধিকার কর্মীর মতে, ওই রাজ্যের সমস্ত কারাগারে অধিকাংশ সাজাপ্রাপ্তরা হলেন সাধারণ অপরাধী। এদের অনেকের জন্য এর আগে রেমিশন চাওয়া হলেও কোনও সুরাহা হয়নি। এই 'অমৃত মহোৎসবে' এদের অনেকেই তো রেমিশন পাওয়ার যোগ্য। সরকার ও আদালত এ বিষয়ে নিষ্ক্রিয় কেন? প্রশ্ন আরও আছে। যেখানে আজীবন সাজাপ্রাপ্ত ধর্ষক ও খুনীরা আইন অনুযায়ী কোনওভাবেই জেল থেকে ছাড়া পেতে পারে না, সেখানে সেই সাজাপ্রাপ্তরা আবেদন করেই ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে। অথচ, এই একই গণতান্ত্রিক(!) বিচার ব্যবস্হার মধ্যে আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় ৮৪ বছরের  নিরলস ব্যক্তিত্ব ফাদার স্ট্যান স্বামীকে- যিনি তীব্র পারকিনসন রোগে আক্রান্ত- একজন বিচারাধীন কারাবন্দী থাকাকালীন জল ও তরল খাদ্য খাওয়ার জন্য জেল ও আদালতের কাছে একটি সিপার দেওয়ার জন্য আবেদন করলেও তাঁকে তা দেওয়া হয়নি। জীবনের অন্তিম লগ্নে আদালতের কাছে শেষ কয়েকটা দিন সবুজ প্রকৃতি ঘেরা আদিবাসী অঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য জামিনের আবেদন করলেও এই ন্যায় (!) প্রদানকারী বিচার ব্যবস্থা এবং হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিস্ট প্রভুদের পদলেহনকারী কেন্দ্রীয় সংস্থা NIA সংশ্লিষ্ট হিংস্র গোয়েন্দা অধিকর্তারা তা অনুমোদন করেনি। শুধু তাই নয়, উক্ত মিথ্যা মামলায় আটক বিচারাধীন বয়স্ক অসুস্হ আরও অনেক মানবাধিকার কর্মীদের জামিনের আবেদন বার বার করা হলেও এই বিচার ব্যবস্হা তা অনুমোদন করছে না। এই মুহুর্তে সোমা সেন, আনন্দ টেলটুম্বে, গৌতম নাভলাখা, রানা জ্যাকব, অরুণ ফেরেইরা, ভারনন গনজালভেস, হ্যানিবাবু, উমর খালিদ, শারজিল ইমাম, সিদ্দিকী কাপ্পান সহ সারা দেশে প্রায় ৬ হাজার রাজনৈতিক বন্দীদের বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছে। পশ্চিমবাংলায় এই সংখ্যা প্রায় ১০০। এদের মধ্যে অনেকেই ইতিমধ্যে ১৪/১৫ বছর বিনা বিচারে আটক আছেন। 

সম্প্রতি শীর্ষ আদালতের পরবর্তী প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত এক দূরদর্শন সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সারা দেশে বিচারাধীন বন্দীদের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ, যদিও ২০২০ সালের NCRB-র প্রিজন স্ট্যাটিস্টিকস অনুযায়ী এই সংখ্যা হল ৭৬.১ শতাংশ। এই সূত্র মতে, দেশে মোট কারাবন্দীর সংখ্যা ৪,৮৮,৫১১ (৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত)। অতএব, বিচারাধীন বন্দীর সংখ্যা তাহলে ৩,৭১,২৬৮। দেশের এই বিচার ব্যবস্হায় আজ সরকারি মতে প্রায় পৌনে চার লক্ষ বন্দী রয়েছেন দোষী সাব্যস্ত না হয়েও কারারুদ্ধ এবং জামিন পাচ্ছেন না। সম্প্রতি, তিস্তা শেতলাবাদ, হিমাংশু কুমারের মামলা সম্পর্কে এক আলোচনা সভায় বর্ষীয়ান সুপরিচিত আইনজীবী কপিল সিব্বল খুব দুঃখের সঙ্গে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এই শীর্ষ আদালত সহ দেশের বিচার ব্যবস্হার প্রতি তাঁর সমস্ত আশা ভরসার সমাপ্তি ঘটেছে। প্রখ্যাত গান্ধীবাদী অধিকার রক্ষা কর্মী হিমাংশু কুমার বলেছেন, কয়েকজন বিচারপতি মানে আদালত নয়। দেশের আদালত ও বিচার ব্যবস্হাকে রক্ষার জন্য সাধারণ মানুষদের আজ এগিয়ে আসতে হবে। প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেছেন, আদালতের কোনও রায় অন্যায্য অনৈতিক জনবিরোধী হলে তার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করতে হবে। তার স্বরূপ মানুষের মধ্যে উন্মোচিত করতে হবে। 

তাই, এই গোটা প্রেক্ষাপটে আজ বিলকিস বানো সহ দেশের সামগ্রিক পরিস্হিতিকে আমাদের বুঝতে হবে। এখন ফ্যাসিবাদ শুধু একটা শব্দ নয়। এই চরম অপশক্তিটি আমাদের জনজীবনে ক্রমশ প্রবেশ করে চলেছে। রাষ্ট্রশক্তি ও এই ফ্যাসিস্টদের যেন বর্তমান সন্ধিক্ষণে সব থেকে নিবিড়ভাবে পরস্পরের পরিপুরক হয়ে একে অপরের সঙ্গে লীন হয়ে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। একে প্রতিরোধ করতেই হবে। একে আটকাতেই হবে। এবং একে নিশ্চিন্হ করার জন্য সবাই মিলে, হ্যাঁ, সবাই মিলেই আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী নির্ভীক বন্ধুর অভিযানের পথে এগোতেই হবে। অন্য আর কোনও বিকল্প নেই।


Saturday, 13 August 2022

‘রেউড়ি’ রাজনীতি

গরিবকে দিলে ‘রেউরি’

কর্পোরেটকে দিলে ‘বিকাশ’

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশের এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ‘রেউরি সংস্কৃতি’র বিরুদ্ধে সবিশেষ সোচ্চার হন। তিনি বোঝাতে চান, যে ভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে নানান উৎসবাদিতে রেউরি (এক ধরনের উত্তর ভারতীয় মিষ্টি) বিলি করা হয়, সে ভাবেই নাকি বিরোধী দলগুলি সরকারি অর্থ মানুষের মধ্যে বিলি করে এ দেশে ‘রেউরি সংস্কৃতি’র আমদানি করেছে।

বলাই বাহুল্য, এর পটভুমি প্রস্তুত ছিল। প্রধানমন্ত্রী শুধু সলতেয় আগুন দিয়েছেন আর তা নিয়ে এক রাজনৈতিক সোরগোল খুব পরিকল্পিত ভাবে শুরু করে দেওয়া হয়েছে। বিচার বিভাগকেও এর মধ্যে টেনে আনা হয়েছে। অর্থাৎ, দেশের অর্থনীতির পথ কী হবে, তা একমাত্র এবং শুধুমাত্র একটি কি দুটি লোকই (মোদী-শাহ) ঠিক করবে, বাকী সকলকে তা মানতে বাধ্য থাকতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হল, জনকল্যাণ প্রকল্পগুলি নিয়ে হঠাৎ করে মোদী সাহেব এত ক্ষেপে গেলেন কেন? কারণ, তিনি এখন বেশ বিপদে। সম্প্রতি সি-ভোটার কৃত একটি সমীক্ষায় প্রকাশ (ইন্ডিয়া টুডে চ্যানেলে দ্রষ্টব্য), এনডিএ চালিত দেশের অর্থনীতির অবস্থাকে জানুয়ারি ২০২১ সালে ৬৭ শতাংশ মানুষ ‘ভাল’ বলেছিলেন, অগস্ট ২০২২’এ এসে ৪৮ শতাংশ ‘ভাল’ বলছেন। পাশাপাশি, ওই ২০২১’এর জানুয়ারিতে মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ অর্থনীতির অবস্থাকে ‘খারাপ’ বলেছিলেন যা অগস্ট ২০২২’এ এসে বলছেন ২৯ শতাংশ মানুষ। বোঝাই যাচ্ছে, মানুষ ক্রমেই মোদী সরকারের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন। তদুপরি, এলপিজি’র দাম ১১০০ টাকা ছুঁইছুঁই, পেট্রল-কেরোসিন বহুদিন হল ১০০ টাকার সীমানা পেরিয়েছে, আটা-মুড়ির ওপর জিএসটি লাগু হয়েছে, ওষুধের দাম গগনচুম্বী- সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠেছে। অর্ধভুক্ত মানুষের একটা অংশ যে ভাবে অতি সস্তার বিষাক্ত নেশা করে খিদে ভুলে পড়ে থাকে (মরেও যায়), সে ভাবেই ধর্মের নেশা দিয়ে আমাদের পঙ্গু করে রাখার প্রয়াস চলেছে। এতে যে কোনও ‘কাজ’ হয়নি, তা তো নয়! কিন্তু গত কয়েক মাসে ছবিটা যেন দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সম্ভবত, নেশার ঘোরও আস্তে আস্তে কাটছে।

বিশেষ করে আগামী নভেম্বরে গুজরাত নির্বাচন বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আঞ্চলিক বিভিন্ন সমীক্ষায় প্রকাশ পাচ্ছে যে, এবারে গুজরাতে বিজেপি ও নব উদিত আপ’এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চলেছে। সাম্প্রতিক পঞ্জাবে অভাবনীয় সাফল্যের পর গুজরাতেও যে আপ অকল্পনীয় কিছু করে ফেলতে পারে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই বেশ প্রত্যয় তৈরি হয়েছে। প্রতি মাসে অন্তত তিন-চারবার অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুজরাত সফরে যাচ্ছেন ও বিশাল বিশাল জনসভা করছেন। দিল্লি ও পঞ্জাবে আপ সরকার যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি নিয়েছে তা একপ্রকার রাজ্যের চেহারাই বদলে দিয়েছে, বিশেষত গরিব মানুষের জীবনযাপনে প্রভূত সহায়তা ও খুশখবরই এনেছে। বিদ্যালয় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে দিল্লি সরকার আগেই এক বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং পঞ্জাবেও অনুরূপ কাজগুলিকে তারা হাতে নিয়েছে। উপরন্তু, ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি ফ্রি বিদ্যুৎ গরিব মানুষের জীবনে এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন এনেছে। এখানেই বিজেপির সব থেকে বেশি ব্যথা লাগছে। কারণ, গুজরাতে গিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন যে তাঁরা ক্ষমতায় এলে দিল্লি ও পঞ্জাবের মতো ২০০ কি ৩০০ ইউনিট অবধি বিদ্যুৎ ফ্রি করে দেওয়া হবে। এই ঘোষণাটি শোনামাত্র দেশের শাহেন শাহ ও তাঁর দোসর (দুজনেই যখন আবার গুজরাতের লোক) নিজেদের আর স্থির রাখতে পারেননি। গুজরাতই যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর থাকেটা কী! অতএব, খড়্গহস্ত হয়ে তাঁরা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলির ওপরেই বিষোদ্গার শুরু করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিতে কীভাবে রোক লাগানো যায়, তারও অঙ্ক কষতে লেগেছেন। কারণ, লড়াইটা আসলে দু’ ধরনের ‘রেউরি বিলি’র চরিত্রের মধ্যে (আদতে দুই শ্রণির মধ্যে)।

কথাটা হল, ‘রেউরি’ (মোদীর ভাষায়) বা সরকারি অর্থ সাধারণ গরিব মানুষের উন্নতিকল্পে ব্যবহার করা হবে, নাকি, কতিপয় ঘনিষ্ঠ কর্পোরেট হাউজকে দেওয়া হবে তাদের সম্পদ ও মুনাফা বৃদ্ধির জন্য- এখানেই মূল দ্বন্দ্বটা নিহিত আছে। শুধু আপ বলেই নয়, বিভিন্ন রাজ্যেই আঞ্চলিক দলগুলি নানা ধরনের জনকল্যাণমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে চেষ্টা করেছে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের সক্ষমতা প্রদানে। এই অনুশীলনে নানারকম দুর্নীতিও দেখা গেছে (আপ পরিচালিত সরকার কিছুটা ব্যতিক্রম), সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ ও বিরোধী দলেরা সোচ্চারও হয়েছে, কারও কারও শাস্তিও হয়েছে; কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির অজুহাতে জনকল্যাণ প্রকল্পগুলিকে কখনই বন্ধ করে দেওয়া যায় না। কারণ, আমাদের দেশের দুর্নীতির সিংহভাগ (অন্তত ৭৫ শতাংশ) হচ্ছে কর্পোরেট লুঠ, যেখানে ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তুলে কেন্দ্রীয় শাসকের মদতে হয় দেশ ছেড়ে লুঠেরারা পালিয়ে যায়, নয়তো রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে নেওয়া তাদের ঋণ মকুব করে দেওয়া হয়, অথবা জলের দরে তাদের হাতে সরকারি জমি, সম্পত্তি তুলে দেওয়া হয়। ললিত মোদী (যাকে সুস্মিতা সেন খুঁজে পান কিন্তু ভারত সরকার খুঁজে পায় না), নীরব মোদী, মেহুল চোক্সি, বিজয় মাল্য ইত্যাদিরা আমাদের সামনে এই ধারার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। কেন্দ্রীয় শাসকদের অতি ঘনিষ্ঠ আদানি-আম্বানিদের গত কয়েক বছরে বিপুল সম্পদ লাভ আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে এই প্রবণতাকে স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়। এখন তো আবার বন সংরক্ষণ আইনকে সংশোধন করে বিনা বাধায় আদিবাসীদের জমি দখল নেওয়ার নীল নকশা তৈরি হয়েছে। এ এক সর্বগ্রাসী লুঠ। 

এই ভয়ঙ্কর লুঠকেই মোদী সরকার চাইছে ‘রেউরি’র হকের দাবিদার বানাতে। অর্থাৎ, সরকারের অর্থ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ন্যূনতম জীবনযাপন, রাস্তাঘাট, পরিবেশ এইসব সর্বজনীন জনকল্যাণমূলক খাতে ব্যয় করা হলে তাকে বলা হবে ‘রেউরি’ বিলি, আর সেই অর্থ যদি কর্পোরেটদের দেয় অপরিশোধযোগ্য ঋণ, কর্পোরেট কর মকুব, পাইপলাইন মনেটাইজেশনের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রগুলিকে জলের দরে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়ার ফন্দি-ফিকির হিসেবে বিলি করা হয় তবে তাকে ‘রেউরি বিলি’ বলা যাবে না। কারণ, এটা সর্বজনবিদিত যে লক্ষ লক্ষ কোটি সরকারি টাকা বন্ধু কর্পোরেটদের দিলে তার একটা অংশ ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ হিসেবে আবার বিজেপি’র কাছে ফেরত আসে। আর তাই এটাকেই বলতে হবে ‘বিকাশ’। এ নিয়ে নীতি নির্ধারণের পথেও এগোতে চলেছে মোদী সরকার। অথচ শুধু কেজরিওয়াল নন, ঊড়িষ্যার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কও এ প্রসঙ্গে স্পষ্টতই জানিয়েছেন, তাঁর নিজ রাজ্যে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের আরও সক্ষমতা দিয়েছে। আমরা জানি, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানার রাজ্য সরকারগুলিও বেশ কয়েক বছর ধরে এমনতর জনকল্যাণমূলক প্রকল্প অনুশীলন করে মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও জীবনযাপনে কিছুটা হলেও উন্নতি এনেছে।

আজ যখন সারা বিশ্ব জুড়ে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে, অগাধ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগকে অর্থনীতির সর্বজনীন পথ হিসেবে মান্যতা দেওয়া হচ্ছে, তখন সে পথকে ‘রেউরি বিলি’ অপবাদ দিয়ে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের বিরুদ্ধে মোদী সরকারের যুদ্ধ ঘোষণা এক অশনি সংকেতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ২০২৪ সালে ক্ষমতা দখল অটুট রাখতে মরীয়া বিজেপির সামনে এখন তাই মূলত দুটি পথ খোলা: এক) আদানি-অম্বানিদের মতো কর্পোরেট বন্ধুদের থেকে ইলেক্টোরাল বন্ড ও অন্যান্য পথে লক্ষ কোটি টাকা নিয়ে অর্থবলের জোরে ক্ষমতা হাসিল করা; আর তাই, ‘রেউরি’টা কর্পোরেটদের মধ্যে বিলি করার একটা পাক্কা বিধিব্যবস্থা তৈরি করা; দুই) সে ক্ষেত্রে গরিব ও প্রান্তিক মানুষদের ধর্মের আফিম খাইয়ে বুঁদ করে ভোট আদায় করা।

এইভাবে কতকটা সফলতা গত কয়েক বছরে তো তারা পেয়েছে। ২০১৭-১৮ সাল থেকে তুলনামূলক ভাবে অনেকটা শক্তি কমলেও তারা তৃতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে আসার খোয়াব দেখছে। যদি ঘটনাচক্রে তা বাস্তব হয়ে যায় (তর্কের খাতিরে ধরে নিলে) তাহলে আমরা শুধু ধর্মীয় হানাহানির এক অতল চক্রে নিমজ্জিত হব না, অর্থনৈতিক মহাবিপর্যয়ের এক করালগ্রাসেও নৃশংস ভাবে বিলীন হয়ে যাব। বিহারে জেডিইউ বিজেপির হাত ছেড়েছে, একে একে বহু দলই তাদের সঙ্গ ত্যাগ করেছে, অনেক রাজ্যেও তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে; এবার আশা করতে পারি, দেশের আমজনতাও তাদের হাত ছাড়তে বাধ্য হবে।

 

Tuesday, 9 August 2022

নাগরিকত্ব বনাম এনআরসি

'প্রধানমন্ত্রীর কোনও নথি দেখানোর প্রয়োজন নেই'

নীলকন্ঠ আচার্য


পর্ব ২


গত ৪ অগস্ট এই ব্লগে জানিয়েছিলাম, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় নাগরিকত্বের সপক্ষে কী প্রামাণ্য নথি আছে তা জানতে চেয়ে আমি ২০২০ সালে একটি আরটিআই আবেদন করি। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দু' বছর পর প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিনা নথিতেই আমাকে একটি উত্তর দেওয়া হয়। সেই উত্তরে আমি সন্তুষ্ট না হওয়ায় দেশের মুখ্য তথ্য কমিশনারের কাছে যথাযথ বিহিত পেতে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি দেখতে চাই। কারণ, এই নাগরিকত্বের প্রামাণ্য নথি 'না থাকার' কারণে যখন অসম সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে 'বিদেশি' বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে, তখন এটা অনুমান করা যেতেই পারে যে প্রধানমন্ত্রী সহ মন্ত্রী পরিষদের কাছে নাগরিকত্বের নিশ্চয়ই এমন কোনও প্রামাণ্য নথি আছে যা দেখিয়ে তাঁরা বহাল তবিয়তে রয়েছেন ও দেশ শাসন করছেন। কী সেই নথি? তা জানতেই আমার আরটিআই আবেদন যার বিবরণ আমি পর্ব ১'এ লিখেছি। তার লিঙ্ক:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2022/08/blog-post_4.html 

আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে মুখ্য তথ্য কমিশনারের পক্ষ থেকে ৮ অগস্ট অনলাইন ভিডিও কনফারেন্স মারফত শুনানির জন্য উত্তর ২৪-পরগণায় বারাসাতে জেলা শাসকের অফিসে আমাকে দুপুর ১২টায় তলব করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, দেশের মুখ্য তথ্য কমিশনার ওয়াই কে সিনহা'র (প্রাক্তন রাষ্টদূত: যুক্তরাজ্য, শ্রীলঙ্কা) সমীপে অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে নির্ধারিত শুনানিটি এক ঘন্টা দেরি করে শুরু করেও তড়িঘড়ি করে শেষ করে দেওয়া হল! না, এই শুনানীর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের পক্ষে কোনও নির্দিষ্ট প্রামাণ্য নথির সন্ধান এই কমিশন দিতে পারল না।

শুনানির একদম শুরুতেই কমিশনার যেন একটু কর্কশ সুরেই বললেন, 'আমাদের প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের জন্য তথ্য চাই আপনার? তাই না? যা উত্তর আপনাকে দেওয়া হয়েছে তা একদম ঠিকই দেওয়া হয়েছে।' এর জবাবে যখন আমি বলি, কমিশনের দেওয়া নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫-র প্রতিলিপিতে কোথাও তো প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের কোনও তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেল না! এই কথায় কমিশনার সদর্পে বলে ওঠেন, 'ঐ আইনে না আপনার, না আমার, না প্রবীণজী (CPIO/US/PMO), না প্রধানমন্ত্রী মোদিজীর, কারওরই নাগরিকত্বের প্রমাণ পাওয়া যাবে না। ঐ আইনে নাগরিকত্বের বিষয়ে যদি আর কোনও বিশেষ তথ্য থাকত তাহলে সেটা আপনাকে নিশ্চয়ই দেওয়া হত। প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্ব সম্পর্কে আপনার কোনও সন্দেহ থাকলে আদালতে যেতে পারেন। আপনি যেমন প্রশ্ন করেছেন তার জন্য ঠিক এরকমই উত্তর পাবেন।'

স্বভাবতই অবাক হয়ে বলতে হয়, আবেদনে চাওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনও নথির, কিন্তু আমাকে দেওয়া হয়েছে একটা আইনের আংশিক প্রতিলিপি মাত্র! এই আইনটা তো প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের কোনও নির্দিষ্ট প্রামাণ্য নথি নয়! চাওয়া হল প্রামাণ্য নথি আর দেওয়া হল একটা আইনের নাম ও প্রতিলিপি! এটা কেমন হল? 

ওনাকে এও বলি, আমার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্ব সম্পর্কে কোনও সন্দেহের কথা বলা হয়নি বরং এই আবেদন করার অন্যতম প্রধান কারণ, ওনার মতো দেশের একজন উচ্চপদস্থ সরকারি ব্যক্তিত্ব ও পদাধিকারীর নাগরিকত্বের কোনও প্রামাণ্য নথি যদি কমিশনের মাধ্যমে পাওয়া যায় তবে তা এই আবেদনকারীকে সব থেকে ভালো ভাবে বুঝতে সাহায্য করবে যে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য প্রামাণ্য নথির ধরনটা ঠিক কেমন হওয়া উচিত। 

উত্তরে মুখ্য তথ্য কমিশনার স্পষ্টভাবে বলেই দিলেন‌, 'আমি যতদূর জানি, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জন্ম ভারতেই। উনার মা-বাবাও ভারতীয়। সুতরাং, ওনার কোনও প্রমাণপত্রের দরকার নেই।' উনি আরও বলেন, 'এই আইনটাই (অর্থাৎ নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫) হল নথি।' ওনার তাহলে নথি থাকার কোনও প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে উনি ঠিক এভাবেই বললেন, 'ওনারও নথি থাকার দরকার নেই, আমারও (অর্থাৎ কমিশনারের ) দরকার নেই, এই প্রবীণজীরও দরকার নেই।' কারণ, প্রবীণজী যেহেতু ভারত সরকারের চাকরিজীবী হিসেবে ছিলেন, আছেন, তাই উনি নাকি এই কারণেও নিশ্চিত ভাবে ভারতের নাগরিক!

এই শুনানিতে আবেদনকারীর সঙ্গে চলমান পারস্পরিক সংলাপের এক জায়গায় উক্ত CPIO/US/PMO প্রবীণ কুমার (যিনি আমাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছিলেন বলেই মুখ্য তথ্য কমিশনারকে হস্তক্ষেপের আবেদন জানানো হয়েছিল) বলে ফেলেন যে, 'আপনি যা চাইছেন তা আমার কাছেও নেই।' সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করি, 'আপনার কাছে কী নেই স্যার? আরেকবার একটু বলুন।' প্রত্যুত্তরে উনি বিষয়টি থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরে গিয়ে বলেন, 'এই কথাটা আপনাকে বোঝানোর জন্য বলেছিলাম। আমার কাছে কী নেই, কী আছে এসব কথা এখন বলতে গেলে আলোচনাটা অন্যদিকে চলে যাবে। এভাবে কথা বলে কিছু হবে না।' সেই সময় মুখ্য তথ্য কমিশনার ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, 'এসব কথা এখন থাক।'

এরপর কমিশনার নাগরিক আইনের ধারা-৩ ইত্যাদির কথা অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলতে শুরু করেন। মাত্র ১২ মিনিট মতো সংলাপ বা শুনানি চলার মধ্যেই কমিশনারের আচরণে শুনানির পর্বটাকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি করে শেষ করে ফেলার একটা প্রবণতা প্রকট হয়ে ওঠে। আমার পক্ষ থেকে আরও কিছু কথা বলার চেষ্টা করা হলে ওনার মধ্যে কোথাও একটা ধৈর্যচ্যুতির লক্ষণ ফুটে ওঠে। আলোচনা গুটিয়ে ফেলার উদ্দেশ্যে উনি অবশেষে আমাকে অদ্ভুতভাবে এ কথাও বলেন যে, 'আপনি যেখানেই কাজ করে থাকুন না কেন আপনি অবশ্যই একজন ভারতীয় নাগরিক। কারণ, আপনার RTI-আবেদনকে স্বীকার করে এর উত্তরও দেওয়া হয়েছে আপনাকে একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।' ওনার এই মন্তব্যে অবাক হওয়ার পর যথারীতিই জানতে চাই, 'তাহলে আপনার মতে ভারতীয় নাগরিকত্বের অন্যতম দুটি মাপকাঠি হল: ১) যারা RTI-আবেদনকারী এবং ২) যারা ভারত সরকারের চাকরিজীবী, তাই তো?'

এরপর খুব আশ্চর্যজনকভাবে হঠাৎই উনি বলে ওঠেন, 'ছাড়ুন ছাড়ুন এসব বিষয়। আপনাকে অনেক সময় দেওয়া হয়ে গেছে। ধন্যবাদ। ধন্যবাদ৷' এই কথা বলে উনি এই শুনানির দ্রুত সমাপ্তি ঘোষণা করে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যান এবং আমি অগত্যা নিরুপায় হয়ে অসহায় দৃষ্টিতে ঝকমকে ঐ বড় ভিডিওর পর্দায় পৃথিবীর তথাকথিত বৃহত্তম গনতান্ত্রিক দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদাধিকারীর এ হেন দ্রুত প্রস্হান অবলোকন করতে থাকি। ঝলমলে কনফারেন্স ঘরের আলোক বিচ্ছুরিত আধুনিক বাতিগুলো ঘরের উজ্জ্বল নীরবতার সঙ্গে একীভূত হয়ে আমার কাছে যেন অসহায় সাক্ষী হয়ে থেকে যেতে চায়। 

মনের আঙিনায় ভেসে ওঠে অসম ও দেশের নানান প্রান্তের সেই সব লক্ষ লক্ষ অসহায় মানুষের মুখগুলি, যাঁদের কাছে নাকি নাগরিকত্বের যথাযথ নথি পাওয়া যায়নি বলে তাঁরা আজ বাদ 'ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স' (এনআরসি) থেকে, তাঁরা আজ 'বিদেশি'। কিন্তু নাগরিকত্বের নথিটা ঠিক কী আর তা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষেত্রে কেন দেওয়া হল না, সে প্রশ্ন অধরাই থেকে গেল।


Thursday, 4 August 2022

ভারতীয় নাগরিকত্বের নথি কী?

একটি আরটিআই আবেদন ও দু' বছরের গড়িমসি শেষে

নীলকন্ঠ আচার্য

পর্ব ১

দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী'র কি নিজের নাগরিকত্বের পক্ষে কোনও প্রামাণ্য নথি আছে? নিশ্চয় থাকবে। থাকার তো কথা। থাকা উচিত- এমন ভাবাটা তো অযৌক্তিক কিছু নয়। শুধু তাঁর কেন, বর্তমান মন্ত্রীসভার সমস্ত সদস্য-সদস্যা সহ সমস্ত সাংসদদেরও তো তা থাকার কথা। কারণ, কংগ্রেস দল সহ বর্তমান সরকার এবং এর পূর্ববর্তী বাজপেয়ী সরকারের প্রবক্তারাই ভারতের নাগরিকত্বের বিষয়টাকে নিয়ে অনেক জল ঘোলা করেছে এবং এখনও করে চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এরা সরকার, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থার যৌথ উদ্যোগে গোটা অসম জুড়ে NRC নামক অভিযান চালিয়ে ৩১ আগস্ট ২০১৯ পর্যন্ত মোট ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জন দেশবাসীকে 'প্রামাণ্য কাগজ' দেখাতে না পারার কারণে নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। এর ফলে, এইসব অধিকাংশ প্রান্তিক ও অসহায় দেশবাসীকে আজ নিদারুণ যন্ত্রণা ও কষ্টের মধ্যে বিভীষিকাময় দিনযাপন করতে হচ্ছে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, দেশবাসীর কাছে নাগরিক হিসেবে কী এমন মহামূল্য ও যথার্থ ধরনের প্রামাণ্য নথি বা কাগজপত্র থাকার কথা যা না থাকলে যে কোনও দেশবাসীকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে ও হবে? তদুপরি, এইসব কাগজপত্র বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবক্তাদের কাছে নিশ্চয়ই থাকবে যারা এই ধরনের প্রামাণ্য নথির পক্ষে ওকালতি করে চলেছেন?

অতএব, ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য প্রামাণ্য নথিটি ঠিক কী- তা ঠিকমতো জানার জন্যই আমি গত ১১ মার্চ ২০২০ তারিখে তথ্য জানার অধিকার আইন, ২০০৫ অনুসারে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সংশ্লিষ্ট তথ্য আধিকারিকের কাছে বিধিসম্মতভাবে আবেদন করি। আবেদনটি ছিল, 'আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ভারতীয় নাগরিকত্বের প্রমাণস্বরূপ কোনও প্রামাণ্য নথি থাকলে তা আমাকে অনুগ্রহপূর্বক জানানো হোক।' এর উত্তরে বহুদিন বাদে ঐ সংশ্লিষ্ট তথ্য আধিকারিক আমাকে ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ তারিখের চিঠিতে জানান যে, 'ভারতের নাগরিকত্বের বিষয়টি নাগরিকত্ব আইন, ১৯৫৫ এবং এর অধীনস্থ নিয়মাবলীর দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ সম্পর্কিত তথ্যের জন্য এই ওয়েবসাইটটি দেখুন: https://indiancitizenshiponline.nic.in।' (নিচে দ্রষ্টব্য)।


বস্তুত, এই প্রত্যুত্তরে কোথাও জ্ঞাতব্য নির্দিষ্ট তথ্যটি পাওয়া যায়নি। ফলে, আমি এই বিষয়টি মুখ্য তথ্য আধিকারিককে জানাই (২ জানুয়ারি ২০২১) এবং লিখি যে, 'আমাকে আমার নির্দিষ্ট জ্ঞাতব্য তথ্যটি (অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রীর নাগরিকত্বের প্রামাণ্য কোনও নথি দেখানো) না জানিয়ে আমাকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে মুখ্য তথ্য‌ আধিকারিককে অনুরোধ করছি, উনি হস্তক্ষেপ করুন এবং আমাকে আমার জ্ঞাতব্য বিষয়টি জানানোর ব্যবস্থা নিয়ে আমাকে বাধিত করুন।' (নিচে দ্রষ্টব্য)।


এর প্রত্যুত্তরে ভারতের কেন্দ্ৰীয় তথ্য কমিশনের প্রধান দফতর থেকে ১৯ জুলাই ২০২২ তারিখে লেখা একটি শুনানির নোটিশ (Hearing Notice for Appeal, File No. CIC/PMOIN/C/2021/102959) আমাকে ডাকযোগে পাঠানো হয় যা আমি গত ৩০ জুলাই ২০২২'এ হাতে পাই। এতে বলা হয়, আগামী ৮ অগস্ট ২০২২ তারিখে 'অনলাইনের' মাধ্যমে মুখ্য আধিকারিকের সমীপে বেলা ১২টায় আমাকে এবং প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সংশ্লিষ্ট তথ্য আধিকারিককে উপস্থিত হতে।' আমার উপস্থিত হওয়ার ঠিকানা জানানো হয়, বারাসাতের (উত্তর ২৪ পরগণা ) জেলাশাসকের প্রশাসনিক ভবনের NIC (National Informative Centre) District Centre'এর দফতরে। অনুরূপ, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের সংশ্লিষ্ট তথ্য আধিকারিককেও দিল্লিস্থিত কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের দফতরে হাজির হতে বলা হয়। উল্লেখ্য, উক্ত নোটিশে আমাকে আবেদনকারী (Appellant)/ অভিযোগকারী (Complainant) এবং সংশ্লিষ্ট তথ্য আধিকারিককে অভিযুক্ত (Respondent) নামক শব্দে আখ্যায়িত করা হয়েছে। (নিচে দ্রষ্টব্য)।


যেহেতু তথ্য কমিশনের ক্ষমতা ও কাজের ধারায় (Powers & Functions of Information Commission) কোথাও এই ধাঁচের শুনানির কথা লেখা নেই,‌ তাই আমি জনৈক বিশিষ্ট অধিকারক্ষা কর্মীর সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার পর কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের দফতরে একটি আবেদন (২ অগস্ট ২০২২) পাঠিয়ে জানতে চাই যে, RTI Act, 2005-এর ঠিক কোন ধারা বা অনুচ্ছেদের আওতায় এই শুনানির নোটিশ জারি করা হয়েছে?

আরও উল্লেখ্য, এই শুনানির নোটিশে দুই পক্ষকেই তাদের স্ব-স্ব অনুমোদিত প্রতিনিধি সহ উপস্থিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি গত ৪-৫ দিন ধরে বারাসাত ও কলকাতায় এই বিষয় সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক মহলের বন্ধু, সমাজকর্মী ও অধিকার কর্মীদের কাছে একজন সহযোগী আইনজীবীকে ঐদিন আমার সঙ্গে থাকার জন্য কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা বিবেচনা করতে অনুরোধ করি। এর মধ্যে একাংশ আমাকে তাঁদের যথাসাধ্য সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করার চেষ্টা করেন। কিন্তু অন্য অংশটি বড়ই অদ্ভুতভাবে নির্লিপ্ত থাকে ও এমন দায়সারা ভাব দেখায় যা আমাকে বেশ অবাক করে।

যাই হোক, আগামী ৮ অগস্ট ২০২২'এ নির্ধারিত স্থান ও সময়ে উক্ত শুনানিতে আমি উপস্থিত হতে চলেছি এবং আশা করছি মুখ্য তথ্য আধিকারিক দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নাগরিকত্বের কোনও প্রামাণ্য নথির অস্তিত্ব সম্পর্কে যে আবেদন আমি বিধিসম্মতভাবে করেছি তার সুরাহা করবেন।

পরিশেষে জানাই, ৮ আগস্টের শুনানির ফলাফলের উপর ভিত্তি করে আমার দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি যথাসময়ে উপস্থাপন করব।

 

Monday, 1 August 2022

বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২

বন ও আদিবাসী জীবন ধ্বংসের আরও এক হাতিয়ার

শশাঙ্ক দেব


কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক গত ২৮ জুন সংসদের দুই কক্ষেই অনুমোদনের জন্য পেশ করেছে Forest Conservation Rules, 2022 [বন সংরক্ষণ বিধি, ২০২২] যা বর্তমান অধিবেশনেই পাশ হয়ে যাবে। এই বিধি এর আগে তৈরি ২০০৩'এর বিধি এবং ২০০৪, ২০১৪ ও ২০১৭-র পরবর্তী সংশোধনীগুলিকে প্রতিস্থাপন করবে। এই বিধি চালু হলে ভারতে বনাঞ্চল সংরক্ষণের জন্য যে রক্ষা কবচগুলি আছে তার সবগুলিকেই দুর্বল বা অক্ষম করে দেবে। সাফ কথা, যে মূল আইন Forest (Conservation) Act, 1980 [বন সংরক্ষণ আইন ১৯৮০]–এর আধারে এই বিধিগুলি তৈরি হয়েছিল, তার মূল উদ্দেশ্যের বিপরীতে এই নতুন বিধি তৈরি হয়েছে।

অন্যদিকে কেন্দ্রীয় সরকারেরই আর এক মন্ত্রক, আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের জারি করা আইন Scheduled Tribes and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights) Act, 2006 [চালু নাম– বনাধিকার আইন, ২০০৬] এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধিগুলির সম্পূর্ণ বিপরীতে ব্যবহৃত হবে এই নতুন বিধি। বনগ্রামের আদিবাসীদের তৈরি গ্রামসভাকে যেটুকু অধিকার অন্তত কাগজে কলমে দেওয়া হয়েছিল তার আর কোনও অর্থই রইল না। উক্ত আইনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের কথা বলা হয়েছিল- সম্প্রদায়গত অধিকার এবং পারিবারিক অধিকার। চিরাচরিত ভাবে যে সমস্ত বনবাসীরা বিভিন্ন বনগ্রামে বাস করে আসছেন এবং সম্প্রদায়গত ভাবে বনাঞ্চলের রক্ষণাবেক্ষণ এবং ভোগদখল করছেন, তাঁদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল এই আইন। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্যও নির্দিষ্ট করা হয়েছিল যাতে চিরাচরিত বনবাসীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আইনে বলা হয়েছে, গ্রাম স্তরে যাঁরা বসবাস করেন সেই প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাররা গ্রামসভা গঠন করবেন। এই গ্রামসভা স্তরেই গঠিত হবে বনাধিকার কমিটি। বনাধিকার আইন, ২০০৬-এ স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, বনাঞ্চলের জমির চরিত্র যদি কোনও সাধারণের প্রয়োজনে বদলাতে হয়– যেমন স্কুল, হাসপাতাল, অঙ্গনওয়াড়ি, রেশন দোকান, ইলেকট্রিক লাইন, পুকুর খনন, জলের লাইন, প্রচলিত শক্তি কেন্দ্র, রাস্তা ইত্যাদি, তা গ্রামসভার উদ্যোগে করা যাবে। কোনও ব্যবসায়িক প্রকল্প, যেমন খনি, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পর্যটন ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট গ্রামসভার অনুমোদন ছাড়া করা যাবে না।

বনাঞ্চলের চরিত্র বদলাতে হলে বন সংরক্ষণ আইন, ১৯৮০-তেও নানা বিধি নিষেধ ছিল। এই বিধিনিষেধগুলি অবশ্য ক্রমশ হাল্কা করে দেবার প্রক্রিয়াও অব্যাহত ছিল। পরে কেন্দ্রীয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রকের ২০০৯ সালের নির্দেশে বলা হয়, বনাঞ্চলে কোনও প্রকল্প চালু করতে হলে তা বনাধিকার আইনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে করা বাধতামূলক হবে। ফলে, এই ধরনের প্রকল্পে গ্রামসভার অনুমোদন পাওয়া অন্যতম প্রাথমিক শর্ত ছিল। এই শর্ত লঙ্ঘন করার ফলেই উড়িষ্যায় নিয়মগিরি পাহাড়ে বেদান্ত লিমিটেড এবং উড়িষ্যা মাইনিং কর্পোরেশনের বক্সাইট উত্তোলন প্রকল্প ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্টের  নির্দেশে বাতিল হয়ে যায়। ২০২২-এর এই বন সংরক্ষণ বিধির ফলে সেই রক্ষাকবচ আর থাকল না।

অবশ্য এই বিধি হঠাৎ আসেনি। এর আগেও ২০১৮ সালের জাতীয় বন নীতি, ২০১৯-এর ভারতীয় বন আইনের (Indian Forest Act) সংশোধনী এবং ২০২১-এর বন সংরক্ষণ আইনের (Forest Conservation Act) সংশোধনী সহ বিভিন্ন প্রস্তাব, নির্দেশ ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে দেশের বনাঞ্চলগুলিকে ব্যবসার স্বার্থে কর্পোরেটদের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা ধারাবাহিক ভাবে করা হয়েছে। ফলে, প্রতি বছরে বনাঞ্চল ধ্বংসের হার গড়ে ৬০০০ থেকে ১০,০০০ হেক্টরে পরিণত হয়েছে।   

২০২২-এর নতুন এই বন সংরক্ষণ বিধি অনুযায়ী, কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত বা কর্পোরেট কোম্পানির কোনও মাইনিং বা বিদ্যুৎ অথবা অন্য কোনও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বনাঞ্চলের জমির প্রয়োজন হলে আগে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পর চূড়ান্ত অনুমোদন করবে। এই অনুমোদন পাবার পর রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলগুলির দায়িত্ব হবে- অন্যান্য সমস্ত আইন ও বিধি, এমনকি বনাধিকার আইন ও তৎসংক্রান্ত বিধিগুলিকে মান্যতা দিয়ে এবং কার্যকরী করে জঙ্গলের জমি লিজ দেবার বা তার চরিত্র পরিবর্তন করার অথবা বনাঞ্চলের সেই অংশকে সংরক্ষণের আওতা থেকে বার করে আনার। এই মর্মে রাজ্য সরকার নির্দেশ জারি করবে। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রিয় সরকারের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর রাজ্য সরকার আবার তার অনুমোদন দেবে এবং বাকি আইনগুলি প্রয়োগের (যা একবার প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেলে কার্যকর করা অসম্ভব) দায় নেবে। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, এই সমগ্র অনুমোদন থেকে প্রকল্প রূপায়ণের প্রক্রিয়ায় গ্রামসভার কোনও ভূমিকার কথাই উল্লেখ করা হয়নি; অর্থাৎ তা বাতিল করা হয়েছে। যদি রাজ্য সরকারগুলি বনাধিকার আইন প্রয়োগ করতেও চায় বা অন্যান্য আইনের মাধ্যমে বনাঞ্চল সুরক্ষিত রাখতেও চায়, তাহলেও তা করা সম্ভব হবে না। কেননা, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন দেওয়া হয়ে যাবে। ফলে, নিজের রাজ্যের আদিবাসী ও অন্যান্য চিরাচরিত বনবাসীদের সঙ্গে রাজ্য সরকারের বিরোধ তৈরি হবে।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বনাধিকার কর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করেছেন যে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিবেশ, বন ও আবহাওয়া পরিবর্তন মন্ত্রক (Ministry of Environment, Forest and Climate Change)-এর বিভিন্ন আইন এবং বিধির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারেরই আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রকের (Ministry of Tribal Affairs)-এর আইন এবং বিধিগুলির সাযুজ্য না থাকায়, বনাধিকার কার্যকরী করা জটিল ও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে তৃণমূল স্তরে প্রতিটি ক্ষেত্রে বন কর্মীদের কার্যকলাপের সঙ্গে আদিবাসীদের উদ্যোগের কোনও তালমিল থাকছে না। রাজ্যে রাজ্যে বন বিভাগের বাজেট, ক্ষমতা ও অধিকার অনেক বেশি হওয়ায় আদিবাসী উন্নয়ন বা ঐ জাতীয় দফতরগুলি কোনও গুরুত্বই পায় না। একমাত্র শাল পাতা, মধু ইত্যাদি কেনাবেচা ছাড়া বন পরিচালনায় তাদের অংশগ্রহণের কোনও সুযোগ নেই। এই সমস্যাগুলির সমাধানের উদ্দেশ্যে গত বছর (৬ জুলাই ২০২১) কেন্দ্রীয় পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন দফতর এবং কেন্দ্রীয় আদিবাসী বিষয়ক দফতর এই প্রথম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি যৌথ সার্কুলার প্রকাশ করে। বনাধিকার আইন ২০০৬ এবং তার বিধিগুলি কার্যকরী করার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তার জন্য বিভিন্ন পথনির্দেশ করা হয়। যদিও তাতেও বনবাসীরা বন দফতরের ক্ষমতা মুক্ত হয়ে বন পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন কিনা তাতে বেশ কিছু সংশয় ছিল। তাহলেও সমস্ত রাজ্যের প্রধান সচিবকে চিঠি দিয়ে বাস্তব অবস্থা স্বীকার করা হয়- 'যাদের এই আইনের সুযোগ সুবিধা প্রাপ্য তাঁদের সামুদায়িক অধিকার এবং বনগ্রামবাসীদের পারিবারিক ও চিরাচরিতভাবে ভোগ করে আসা জমির অধিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্বীকৃত হয়নি।' এই যৌথ সার্কুলারে বলা হয়, এই আইন কোনও ক্ষেত্রেই অস্পষ্ট নয় কিন্তু তা স্বত্ত্বেও যদি কোনও বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে, রাজ্যগুলিকে বলা হয় তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে যৌথভাবে মীমাংসা করার। এই যৌথ সার্কুলারেও বন বিভাগের প্রাধান্য অক্ষুণ্ণ থাকে, তা স্বত্ত্বেও বনাধিকার আইন প্রয়োগ করা যে বন বিভাগেরও দায়িত্ব, তার স্বীকৃতি মেলে। কিন্তু নতুন এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২ সেই দায়িত্বকে আবার অস্বীকার করে বনাঞ্চলের সর্বময় কতৃত্ব বন বিভাগের উপরই ন্যস্ত করল।

এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২-এ প্রস্তাব করা হয়েছে, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বনাঞ্চলের জমির চরিত্র পরিবর্তন করতে হলে ক্ষতিপূরণের জন্য নতুন বনাঞ্চল তৈরি করতে বনবাসীদের সামুদায়িক জমি এবং নষ্ট হয়ে যাওয়া বনাঞ্চলের জমি নিয়ে জমি ব্যঙ্ক তৈরি রাখতে হবে যাতে ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলিকে দ্রুত ছাড়পত্র দেওয়া যায়। ফলে, ব্যবসায়িক প্রকল্পগুলির জন্য প্রস্তাবনা আসার আগেই জমি ব্যাঙ্ক তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। বনাধিকার আইনের প্রয়োগ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হবে। 

যে সমস্ত জাতীয় উদ্যান, স্যাংচুয়ারি, ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে গ্রামবাসীদের স্থানান্তর করার পর এখনও বনাঞ্চল তৈরি করা হয়নি, এই বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২-এ বলা হচ্ছে যে নতুন প্রকল্প উদ্যোক্তারা সেই সমস্ত জায়গায় গাছ লাগিয়ে বনসৃজন করলে তা ঐ প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজনের স্বীকৃতি পাবে। অর্থাৎ, ইতিমধ্যেই যে সমস্ত এলাকায় বনসৃজনের জন্য বনগ্রামগুলিকে স্থানান্তর করা হয়েছিল, সেই সমস্ত এলাকার বনসৃজন নতুন প্রকল্পের ক্ষতিপূরণমূলক বনসৃজন হিসাবে স্বীকৃতি পাবে। এইভাবে বেসরকারি উদ্যোগ নতুন বনসৃজনের জন্য এলাকা চিহ্নিত করার দায়িত্ব এবং খরচ থেকে মুক্তি পাবে। এই ভাবে বনাঞ্চলের সম্প্রসারণও সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে বা বলা ভাল বনাঞ্চল সঙ্কুচিত হবার প্রবণতা অক্ষুণ্ণ থাকবে।

একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে। বনাধিকার আইন অনুযায়ী গ্রামসভার সামুদায়িক এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বগুলি নিষ্পত্তি হয় জেলা স্তরে। এই দাবি নিষ্পত্তির কোনও সময় সীমা নির্দিষ্ট নেই। অন্যদিকে বনাঞ্চলে বেসরকারি উদ্যোগে প্রকল্পগুলির ছাড়পত্র দেবার সময়সীমা নির্দিষ্ট আছে। বিশেষত নতুন বিধি অনুযায়ী কেন্দ্রীয় স্তরে প্রথম পর্যায়ের অনুমোদন পেয়ে গেলে রাজ্য বা জেলা স্তরের পরবর্তী পর্যায়ের অনুমোদন দেবার চাপ আরও বাড়বে। 

সমস্যা হল, সংসদের দুই কক্ষেই এই বিধি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় গৃহীত হবে। আদিবাসী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণে আপামর আদিবাসীর বঞ্চনার অবসান হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ থাকে কী?