Pages

Wednesday, 22 June 2022

একটি ব্যতিক্রমী আলোচনা

শরীরের অধিকার ও অন্যান্য

শোভনলাল চক্রবর্তী


বাংলা প্রবন্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটি আলোচনাসভায় স্বপ্নময় চক্রবর্তী একবার বলেছিলেন, 'কেবল ভগবদ্গীতা মেড-ইজ়ির আলুসেদ্ধ খেলে হবে না, নব্যন্যায়ের সজনে ডাঁটা-ও বাঙালির পাতে পড়া চাই।' অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় 'শরীরের স্বত্ব ও স্বরূপ' বইটি পড়তে বসে বার বার এই কথাগুলো মনে পড়ছিল।

বইটিতে রয়েছে দুটি বড় প্রবন্ধ। প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম 'শরীরের সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্র'। এখানে প্রশ্নটা গোলমেলে- ‘আমি’ আর ‘আমার শরীর’ দুটো কি এক? বিজ্ঞান তাই বলে, অথচ বিজ্ঞান-অনুগতরাও প্রিয়জনের মৃত্যুতে টলে যায়। অকালমৃত বান্ধবীর উদ্দেশে লেখা হয় কবিতা- 'তোকে দাহ করে ফিরতে কত রাত হল/ তুই এক বার ফোন করে খবর নিলি না।' অভিমানী প্রশ্ন, আবার গুরুতরও বটে। শরীর চলে গেলেই কি কর্তব্যের অবসান? প্রশ্নগুলো বাঙালি পাঠকের কাছে তুলেছেন অর্ধেন্দু। দিগ্দর্শীদের চিন্তার সন্ধান দিয়ে উস্কে দিতে চেয়েছেন শরীর-চিন্তা। ব্যক্তি, চেতনা, রাষ্ট্র ও শরীর—  এরা কোথায় আলাদা, কেনই বা রক্ত-মাংসের শরীরকে ঘিরে ঘৃণা-তাচ্ছিল্য-মুগ্ধতার ভাবোচ্ছ্বাস। লেখক দর্শন, সাহিত্য, বিজ্ঞানের নানা গলিতে তার খোঁজ করেছেন। চিন্তা চিবিয়ে যাদের সুখ, তেমন উৎসুকচিত্ত পাঠকের কাছে বইটির এই প্রবন্ধটি একটি মূল্যবান সম্পদ।

মস্তিষ্ক, চেতনা, আমিত্ববোধ— আলাদা না কি অভিন্ন? ‘মস্তিষ্কই আমি’- এ দাবি কি মানা যায়? স্নায়ুবিজ্ঞান, শারীরবিজ্ঞান, জ্ঞানতত্ত্ব, মনের দর্শন- এ সব পরতে পরতে খুলে মেলে ধরে বলতে হয়, ঠিক যেমন বইয়ের বিদ্যা-বিজ্ঞানকে কাগজ-আঠা-সুতোয় পর্যবসিত করা চলে না, তেমনই মগজ-স্নায়ু-রক্ত দিয়ে চেতনা তৈরি হলেও, প্রেম বা কল্পনাকে মগজে পর্যবসিত করা চলে না। মস্তিষ্ক আর চেতনা, এই দুইয়ের মধ্যে ‘দ্বন্দ্বসহিষ্ণু’ সম্পর্ক। অসুস্থ শরীর নিয়ে এই প্রবন্ধে আলোচনা শুরু করেছেন লেখক, তা নিয়েও একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। অসুখজনিত ব্যথার অনুভূতি হয় কেবল রোগীর, অথচ, অসুখের কারণ ও প্রতিকার জানেন শুধু ডাক্তার। মাঝে রয়েছেন সেবাকর্মী, যিনি বার বার ‘কেমন লাগছে’ প্রশ্ন করে জেনে নেন অনুভূতি-নির্ভর বর্ণনা। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে ডাক্তার ফের চিকিৎসা নির্ধারণ করেন। অসুখের জ্ঞানতত্ত্ব (এপিস্টেমোলজি) তাই সেবা-পরিচর্যার নৈতিকতার (এথিকস) সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। নৈতিকতা শুধু নিরাময়ে নয়, রোগীর ডাকে সাড়া দেওয়াতে— ‘শুশ্রূষা’ মানেই তো শোনার ইচ্ছা। এখানে মনে হয়, অসুখ যেন শরীরের একটা ডাক, একটা চাহিদা, একটা দাবি।... অসুখের মধ্যে দিয়ে মানুষ তার শারীরিক-সামাজিক অন্য নির্ভরতা, ক্ষত-যোগ্যতা, দরদ-উৎকণ্ঠার দরকারের জানান দেয়। রোগীর শিয়রে চুপ করে বসে থাকা কমলালেবুটিরও যেন সেই ডাকে সাড়া দেওয়ার একটা দায়িত্ব জন্মে যায়।

শরীরের এই দাবি মানলে বলা যায় যে, আইসোলেশন ওয়ার্ডে রোগীকে একা ফেলে রাখা শুধু ক্লেশকর নয়, অনৈতিক। বিচ্ছিন্নতাই এক অ-সুখ। ভাল থাকা কী, কাকে বলে অসুখ, পরিচর্যা বা নিরাময়কে কী ভাবে দেখব, তার অনুসন্ধানকে বলা চলে ‘ব্যাধির দর্শন’। দর্শন চর্চার একটি নতুন আঙ্গিক। লেখক অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব, নীতিতত্ত্ব, নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টি থেকে মানবদেহ নিয়ে বিচার করেছেন। এ দেহ ঘর নাকি খাঁচা, চির-আশ্রয় নাকি ক্ষণিকের বিশ্রামস্থল, তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও 'মাই বডি, মাই রুলস' ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত তা সামনে এনেছেন।

দ্বিতীয় প্রবন্ধের শিরোনাম 'ধর্ষণের অপরাধতত্ত্ব' বিতর্কিত এবং সময়োপযোগী বিষয় সন্দেহ নেই। ১৯৭৬ সালে স্যামুয়েল ডি. স্মিথিম্যান পত্রিকায় একটি অদ্ভুত বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন: 'আপনি কি ধর্ষক? গবেষক আপনার সাক্ষাৎকার নিতে ইচ্ছুক। পরিচয় ‍লুকিয়ে বেনামে আপনার সাক্ষাৎকার নেওয়া হবে। কল করুন …. নম্বরে।' তিনি ভাবেননি কোনও ফোন কল পাবেন। কিন্তু একের পর এক বেজে উঠল ফোন। ২০০টি ফোন কলে কথা বললেন তিনি। বিচিত্র সব ঘটনার মুখোমুখি হলেন। টেলিফোনের অপর প্রান্তে ছিলেন একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী যিনি তাঁর বান্ধবীকে ধর্ষণ করেছেন; একজন চিত্রশিল্পী, যিনি তাঁর পরিচিত একজনের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছেন। একজন স্কুল অভিভাবক যিনি ১০-১৫টি ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা করেছেন। স্মিথ ৫০ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, প্রস্তুত করেছিলেন তাঁর গবেষণার ভিত্তি: The Undetected Rapist। স্মিথিম্যানের কাছে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল এই যে, কত স্বাভাবিক ছিল তাদের কণ্ঠস্বর, আর কত বিচিত্র তাদের ভিত্তিমূল।

স্মিথিম্যান ছিলেন একজন ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট। 'সাইকোলজি অফ ভায়োলেন্স' গবেষণা-পত্রিকার সম্পাদক শেরি হ্যাম্বি মনে করেন, ‘আপনি যদি অপরাধীকে বুঝতে না চান, আপনি যৌন-আগ্রাসনকেও বুঝতে পারবেন না।' এ লক্ষ্যে অনেক গবেষক ধর্ষণকে গবেষণায় বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। যেমন, মার্টিন এল লালুমিয়েরে, গ্র্যান্ট টি হ্যারিস, ভারনন এল কোয়েনসি, মারনি ই রাইস, আন্তোনিয়া অ্যাবি। ধর্ষণ বিষয়ে সবার মত অভিন্ন নয়। শেরি যেমন মনে করেন, 'যৌন আগ্রহ থেকে যৌন নির্যাতন ঘটে না, বরং মানুষকে দমিত বা নিয়ন্ত্রণে রাখাই ধর্ষণের উদ্দেশ্য।' কিন্তু অনেকেই মনে করেন, যৌন আগ্রহ থেকেই ধর্ষণের জন্ম। ধর্ষণের নানা ধরনের ব্যাখ্যা আছে: সমাজতাত্ত্বিক, সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক, আইনতাত্ত্বিক ইত্যাদি। কোনওটিই পরস্পর সম্পর্কবিহীন নয়। তাই বলে এ মীমাংসা কেউ মেনে নেননি যে, ধর্ষণ মূলত মনস্তাত্ত্বিক রোগ। কোনও কোনও ধর্ষকের ক্ষেত্রে মনোরোগ প্রভাব ফেললেও ধর্ষণ মূলত একটি যৌন অপরাধ। অন্য সব অপরাধের মতো ধর্ষণও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ধর্ষক কী ভাবে? তার মনের জগতের ভাবনা কী? আচরণিক মনোবিজ্ঞান, যৌন মনোবিজ্ঞান, সমাজ-মনস্তত্ত্ব নানাভাবে যুক্তি ও ব্যাখ্যা দিয়েছে। সেগুলোর সরলীকৃত রূপ কেমন তা নিয়ে বিশদে আলোচনা রয়েছে প্রবন্ধটিতে। প্রকৃতপক্ষে অধিকাংশ ধর্ষকের মনোরোগ নেই; সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কেউ কেউ অস্বাভাবিক যৌন আচরণ বা ধর্ষণ করে থাকলেও ধর্ষণ করার সঙ্গে মনোরোগের সম্পর্ক অনিবার্য নয়। ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব কোনও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আদলে গড়ে ওঠে না। একেক ধর্ষক একেক রকম মনোভঙ্গি প্রকাশ করে থাকে। প্রত্যেকের শ্রেণি, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা সামাজিক অবস্থান এক নয়। এ কারণে ধর্ষকের মনস্তত্ত্ব একটি মাত্র প্রবণতা দ্বারা গঠিত নয়। তবে সব ধর্ষকই নারীকে যৌনবস্তু মনে করে থাকে; নারীর সম্মতি ধর্ষকের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

সামগ্রিকভাবে মনে হয়, ধর্ষণকে শুধু ঘটনা হিসেবে না দেখে ধর্ষকের মনস্তত্ত্বের পাঠ নেওয়াও জরুরি। একজন ধর্ষকের ধর্ষক হয়ে ওঠার কার্যকারণ ‍অনেক ধরনের। শুধু পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা, ধর্ষণ ও ধর্ষকের ব্যাখ্যা, ধর্ষণের অনেক ঘটনাকেই ব্যাখ্যা করতে পারে না। যেমন ধরা যাক, বিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে বা শিশু ধর্ষণ, পঞ্চাশোর্ধ্ব বিবাহিত বা অবিবাহিত পুরুষ কর্তৃক ছেলে বা মেয়ে শিশু ধর্ষণ। সমাজের নিম্ন শ্রেণিরাই ধর্ষণ করে এই ধারণাও ব্যাখ্যা করতে পারে না পুরুষতন্ত্র বিষয়ক সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আসলে কে ধর্ষক নয়? এটিই একটি গুরুত্বপূূর্ণ প্রশ্ন; কারণ যে কোনও পেশা, শ্রেণি, বয়সের মানুষ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত কিংবা ধর্ষকামী মনোবৃত্তি পোষণ করে। আমাদের দেশে এই বিষয়ক গবেষণা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে অর্ধেন্দু এমন একটি কাজ রেখে গেলেন, যার পরিসর অপরিসীম। সম্ভাব্য ধর্ষক নির্মূল করতে গবেষণাফল সহায়তা করতে সক্ষম হতে পারে। 

বইটির প্রচ্ছদ বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। যেমন দাবি রাখে প্রকাশনার মান, নির্ভুল বানান, ছাপার ভুল বর্জিত একটি বই, যা আজ প্রায় বিরল। সব শেষে অর্ধেন্দুকে প্রশংসা করব তাঁর লেখক পরিচিতির জন্য। তিনি লিখেছেন, 'লেখক কতখানি চিন্তাক্ষম তা বহন করে তাঁর লেখা। আর সেটাই লেখকের একমাত্র পরিচয়।' হক কথা।


2 comments:

  1. বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরী হল। প্রকাশনার নাম কী? কোথায় পাওয়া যাবে?

    ReplyDelete
  2. এবং অধ্যায়

    ReplyDelete