গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বিপন্ন ও রক্তাক্ত
সোমনাথ গুহ
গত ২৯ মার্চ ‘গুজরাট ফাইলস’ খ্যাত সাংবাদিক রানা আয়ুবের লন্ডন যাত্রা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের নির্দেশে আটকে দেওয়া হয়। লন্ডনে দুটি অনুষ্ঠান ছাড়াও ইতালির পেরুজাতে ৮ এপ্রিল আন্তর্জাতিক সাংবাদিকতা উৎসবে তাঁর প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা। ইডি'র অভিযোগ, তিনি নাকি কোভিড ত্রাণের তহবিল নয়ছয় করেছেন। ১ এপ্রিল তাঁকে বহুক্ষণ ধরে জেরা করা হয়। তাঁর নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়; জলখাবারের জন্য বারবার অনুরোধ করার পর তা যখন তাঁকে এনে দেওয়া হয়, অফিসার তাঁকে বলেন সেটার দাম তাঁকে নিজেকেই দিতে হবে।
এটা নতুন কিছু নয়; সরকারের তাঁবেদার সংস্থাগুলি তথাকথিত দেশদ্রোহীদের এভাবেই অপদস্থ করে এবং সেটা প্রচার করতেও পিছপা হয় না। যেন বলতে চায়, দেখ, আমার বিরোধিতা করলে কীভাবে পদে পদে তোমাকে আমি হেনস্থা করতে পারি! মুমূর্ষু ফাদার স্ট্যান স্বামীকে যখন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, মৃত্যুপথযাত্রী সেই অশীতিপর বৃদ্ধকে এনআইএ জানিয়েছিল যে চিকিৎসার খরচ তাঁকেই বহন করতে হবে।
অবশেষে আদালতের অনুমতিতে আয়ুব বিদেশে যেতে পেরেছিলেন। আমরা জানি, তিনি তাঁর সাড়া জাগানো বই ‘গুজরাট ফাইলস’এ ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় রাজ্য সরকারের ঘৃণ্য সংখ্যালঘু-বিরোধী ভূমিকার পর্দাফাঁস করে দিয়েছিলেন, গণ্যমান্যদের জেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই থেকে গেরুয়া বাহিনী তাঁর জীবন দুর্বিষহ করে দিয়েছে। গত পনের বছর ধরে তাঁকে লাগাতার হত্যা ও ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কুৎসা রটানো হয়েছে, তাঁর ছবি বিকৃত করে পর্নোগ্রাফিক সাইটে প্রদর্শিত হয়েছে, বুল্লি সাল্লি অ্যাপে অন্য স্বনামধন্য মুসলিম নারীদের সাথে তাঁকেও নিলামে তোলা হয়েছে। ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস’ জানাচ্ছে, এই অনমনীয় সাংবাদিক ৮৫ লক্ষ বিদ্বেষমূলক টুইটের শিকার হয়েছেন। পেরুজাতে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান যে তাঁর পরিবারকে এখনও লাগাতার হেনস্থা করা হচ্ছে। তাঁর বৃদ্ধ পিতা যিনি ডিমেনশিয়ার রুগী, তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে, অভিজাত এলাকার বিলাসবহুল আবাসন থেকে তাঁর ভাইকে বিতাড়িত করা হয়েছে।
রানা আয়ুব না হয় নারী, মুসলিম, তাও আবার কাশ্মীরী; পবন জয়সওয়ালের 'ভারতীয়ত্বে' তো কোনও খাদ নেই। ২০১৯ সালে তিনি একটা ভিডিও তুলেছিলেন যাতে দেখা যাচ্ছে, উত্তরপ্রদেশের মির্জাপুরের একটি স্কুলে বাচ্চাদের মিড-ডে-মিলে রুটি আর নুন দেওয়া হচ্ছে। অমনি রাজ্যের ভাবমূর্তি খারাপ করার জন্য সরকার তাঁর বিরুদ্ধে কেস ঠুকে দিল। কয়েকদিন আগেই জয়সওয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হয়েছেন। চিকিৎসার জন্য যোগী আদিত্যনাথ থেকে রাজনীতির সব রথী-মহারথীদের কাছে আবেদন করেছিলেন; কেউ সাড়া দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
'শিলং টাইমস'এর বর্ষীয়ান সাংবাদিক প্যাট্রিসিয়া মুখিম পাঁচজন অ-আদিবাসী যুবকের ওপর আক্রমণের বিরোধিতা করে একটি ফেসবুক পোস্ট করেছিলেন। তিনি এরকমও মন্তব্য করেছিলেন যে মেঘালয় একটা ব্যর্থ রাজ্য কারণ ১৯৭৯ থেকে তথাকথিত বহিরাগতদের ওপর এই ধরনের নানা হামলা সত্ত্বেও সরকার কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নেয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অভিযোগ আনা হয়, ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়। মেঘালয় হাইকোর্টও তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। অবশেষে গত জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে প্যাট্রিসিয়া এই অভিযোগগুলি থেকে মুক্তি পান।
কাশ্মীরে তো সাংবাদিকতা বলে কোনও পেশার আর অস্তিত্ব নেই। সরকারের আজ্ঞাবহ কলমচি হতে পার, আবহাওয়া, নৈসর্গিক সৌন্দর্য নিয়ে লিখতে পার, ভ্রমণার্থীদের মাখোমাখো ছবি ছাপাতে পার, তার বেশি নৈব নৈব চ! ফাওয়াদ শাহ যিনি একটি পোর্টাল ও কাশ্মীরওয়ালা নামে একটি পত্রিকা চালান, তাঁর কাহিনী শুনলে কাফকার কথা মনে পড়ে যায়। পুলওয়ামা থানা তাঁকে ফেব্রুয়ারির চার তারিখে গ্রেফতার করে ও তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি এফআইআর দায়ের করে। অভিযোগ: রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদের গুণগান করা, ভুয়ো খবর ছড়ানো, মানুষকে উত্তেজিত করা। একটি কেসে জামিন পাওয়ার পর তাঁকে শোপিয়ান পুলিশ গ্রেফতার করে। দ্বিতীয় কেসে জামিনের পর শ্রীনগর পুলিশ গ্রেফতার করে। ৬ মার্চ তৃতীয় বার তিনি গ্রেফতার হন এবং এবার পুলিশ আর কোনও ঝুঁকি নেয়নি, তাঁকে কাশ্মীরের কুখ্যাত ‘পাবলিক সেফটি অ্যাক্ট’এ অভিযুক্ত করে। পিএসএ'তে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে ছয় মাস থেকে দু' বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা যায়। প্রেস কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া বলছে, কাশ্মীরে নানা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে মিডিয়ার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’এর সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ভারতের স্থান যে ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০'এ নেমে এসেছে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সূচকে স্থান নির্ণয় হয়: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত, আইনি কাঠামো ও সাংবাদিকদের নিরাপত্তা। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ভারতের স্থান রীতিমতো উদ্বেগজনক, আইনি কাঠামো তুলনামূলকভাবে ভালো। ভারতের নীচে আছে সুদান, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চিন ও অন্যান্যরা।
২০২১'এ এই একই সূচকে ভারতের স্থান ছিল ১৪২, ২০১৬'এ ১৩৩। আরএসএফ'এর রিপোর্ট বলছে, সত্যান্বেষী সাংবাদিকদের জন্য ভারত খুব বিপজ্জনক জায়গা। তাঁদের প্রত্যহ পুলিশ, দলীয় বাহুবলী এবং মাফিয়াদের হিংসার মুখোমুখি হতে হয়। এছাড়া আছে প্রবল দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন। সাংবাদিক নিগ্রহের বিষয়ে আমাদের দেশের আরও দুটি রিপোর্টের ওপরে আলোকপাত করতে পারি। ২০১৯'এ গীতা সেশু এবং উর্বশী সরকার ‘গেটিং অ্যাওয়ে উইথ মার্ডার’ নামে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেন। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯'এর মধ্যে সাংবাদিকদের ওপর ১৯৮টি আক্রমণ হয়েছে যাতে ৪০ জন মারা গেছেন; ২১ জন সংশয়াতীত ভাবে সাংবাদিকতার সূত্রে হত হয়েছেন। ৬৩টি কেস অনুসরণ করে এই সাংবাদিকদ্বয় দেখেছেন যে এই আক্রমণগুলির জন্য কারও কোনও শাস্তি হয়নি। আমরা জানি, ২০১৭'এ গৌরী লঙ্কেশ এবং পরের বছর ‘রাইজিং কাশ্মীর’এর সম্পাদক শুজাত বুখারির হত্যার এখনও কোনও বিচার হয়নি।
এই কাহিনী শেষ হওয়ার নয়, সব লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। ‘রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ’এর 'ইন্ডিয়া প্রেস ফ্রিডম রিপোর্ট ২০২১' একবার দেখে নেওয়া যেতে পারে। তারা বলছে, সাংবাদিকদের ওপর গত বছরে ১০৮টি হামলা হয়েছে, ৬ জন মারা গেছেন। ১৩টি মিডিয়া হাউস বা সংবাদপত্র নানা ধরনের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। যে সব রাজ্যে মিডিয়া সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সেগুলি হল- জম্মু ও কাশ্মীর (২৫), উত্তরপ্রদেশ (২৩), মধ্যপ্রদেশ (১৬), ত্রিপুরা (১৫), দিল্লি (৮), বিহার (৬)। লক্ষণীয়, দিল্লি ছাড়া প্রতিটি রাজ্যেই বিজেপি বা তাদের শরিক দল ক্ষমতাসীন। দিল্লিতেও বকলমে বিজেপিই ক্ষমতায়, বিশেষত তারা যখন পুলিশ ও আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণ করে। উপরোক্ত তথ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে কেন্দ্রে ও বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির উত্থানের সাথে সাথে সাংবাদিক নিগ্রহ বেড়েছে এবং মিডিয়ার ওপর এই আক্রমণ সামগ্রিক ভাবে ফ্যাসিবাদী বুলডোজার রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত।
সত্যের মুখোমুখি না হতে পারাটা একটা ভাইরাস এবং বলাই বাহুল্য, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও এর দ্বারা কমবেশি সংক্রামিত।
শুয়োরনেতায় পরিপূর্ণ দেশের সরকার 🖕🏽🖕🏽আর অফিসাররা এক একটা সেই শুয়োরের বাচ্চা । 🐷🐖😡😡😡😡😡😡😡😡🦶🏼
ReplyDelete