কিন্তু না আঁচালে বিশ্বাস নেই
প্রবুদ্ধ বাগচী
বছর তিনেক আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ‘ঐতিহাসিক’ রায় দিয়ে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করে দেন। যে বিরোধের সূচনা হয়েছিল কয়েক দশক আগে, যা নিয়ে সারা দেশে প্রচুর গোলমাল হয়েছে, উত্তেজনা দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছে, তার সমাধান যে এইভাবে হয়ে যেতে পারে তা অনেকেই ভাবতে পারেননি। এই বিস্ময়ের প্রধান কারণ, এই দ্বন্দ্ব আসলে সুচতুরভাবে তৈরি করা হয়েছিল একটা ‘বিশ্বাস’কে ভিত্তি করে, যে বিশ্বাসকে আদৌ কোনও আইনের সঙ্গে ন্যায্যতার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু দশক পেরিয়ে আসা মামলার এই জাদু সমাধান যে হতে পারল তার কারণ স্বয়ং প্রধান বিচারপতির ওই বিশ্বাস যে, রামচন্দ্র ওইখানেই জন্মেছিলেন, তাই এটাকে আইনের কাঠামোর মধ্যে স্বীকৃতি দিয়ে দিলেন।
ভারতীয় বিচারব্যবস্থা এর আগে এমন কোনও ‘আজগুবি’ বিচার দেখেছে বলে মনে হয় না। দেশের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির একটা মর্যাদা আছে, সেই পবিত্র মর্যাদা রক্ষা করার দায় একেবারেই তাঁর। এ ক্ষেত্রেও তেমন একটা ব্যতিক্রম ঘটে গেল। রামমন্দির বানানোর ছাড়পত্র হাতে পেয়ে মন্দিরপন্থীরা যখন আহ্লাদে আটখানা ঠিক তখনই সেই বিচারপতি অবসর নিলেন আর ছ’ মাসের মধ্যে রাজ্যসভায় সাংসদ নির্বাচিত হলেন ওই মন্দিরপন্থীদের ভোটে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এমন নড়বড়ে অবস্থান এর আগে ভারতের গণতন্ত্র প্রত্যক্ষ করেনি।
একসঙ্গে সব মানুষ তো নিজেদের বিকিয়ে দিতে পারেন না বা দেনও না। রামমন্দির নিয়ে আদালতের রায়ে দেশের বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যারা যুক্ত তাঁরা কমবেশি তাঁদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ চুপ ছিলেন। এর পরেও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নানা গড়িমসি করেছে, কারও নাম কেটে দিয়েছে, কাউকে জুড়ে দিয়েছে। অভিসন্ধি খুব স্পষ্ট। তবুও, দেশের বর্তমান প্রধান বিচারপতি অনেকদিন পরে নিজস্ব একটা ব্যক্তিত্ব ও কণ্ঠস্বর দিয়ে ওই গ্লানিময় অতীতের আবর্জনা কিছুটা সরাবার চেষ্টা করেছেন। দেশদ্রোহ বিষয়ক আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এবার অনেকটা ইতিবাচক। প্রাক-স্বাধীনতা যুগের একটি ঔপনিবেশিক আইনের ধারা কেন আজকের স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে থাকবে এবং তা বারবার ব্যবহৃত হবে এই প্রশ্ন একদম সঙ্গত।
বিষয়টা আরও গুরুত্ব পায় এই কারণে যে, ভারতীয় পেনাল কোড তৈরি করার সময় এইসব আইন বাতিল না করা হলেও এবং তার প্রয়োগ অন্যায্য হলেও ছিল সীমিত। কিন্তু গত দশ বছরে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্যে রাজ্যে তাদের ধামাধরা রাজ্য সরকারগুলি প্রায় নির্বিচারে এই আইন প্রয়োগ করে সাধারণ নাগরিক থেকে সমাজকর্মী, সংবাদকর্মীদের জীবন বিড়ম্বিত করে তুলেছে। এমন সব তুচ্ছ কারণে এই আইন প্রয়োগ করা হয়েছে যাতে প্রশাসনের প্রতিহিংসার কদাকার মুখ বারবার ফুটে বেরয়। এই পরিস্থিতি নাগরিক অধিকার রক্ষার পরিপন্থী এবং বলাই বাহুল্য, এই ধরনের নিবর্তন সাংবিধানিক ভাবে অনুমোদিত নয়। কিন্তু এ কথা বলবে কে?
আরও উল্লেখযোগ্য তথ্য হল, আজ অবধি যত মানুষকে এই দেশদ্রোহ ধারায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তদন্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেছে একেবারে হাতে গোনা কয়েকজনের ক্ষেত্রে, তাও এখনও তাঁদের বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। বুঝতে পারা যায়, ‘দেশরক্ষা’র অজুহাতে আসলে দেশের নাগরিকের অধিকার হরণ করারই এ এক কূট ছলমাত্র। মজার ব্যাপার হল, আজকের বিশ্বায়িত ভুবনে খুব চুপি চুপি কিছু করে ফেলা বেশ সমস্যার। সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার নিরিখে ভারত যে গ্লোবাল ইন্ডেক্সে বেশ কিছুটা নেমে এসেছে এই খবর একেবারে সাম্প্রতিক। এটাও তো তাহলে দেশের অবস্থানের নিরিখে একরকমের 'মুখ পোড়া'- তাহলে এই পরিস্থিতির কারিগররাও কি ‘দেশদ্রোহী’ নন, এদের পেছনেও তো তাহলে ১২৪ নম্বর ধারার ছুঁচোবাজি লাগিয়ে দেওয়া উচিত!
এই পরিপ্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের একটা অবস্থান এইরকম যে, এই আইনের পুনরায় মূল্যায়ন ও সংস্কার দরকার। ঠিক। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। কেন্দ্রীয় আইন বিভাগ মুখে বলছে এই আইনের পুনর্বিবেচনা তারা করবে, কিন্তু বললেই তা কার্যকর করা তত সহজ নয়। অবশ্য তাই বা বলি কেমন করে? করোনা কালে নামমাত্র সংসদ খোলা রেখে একের পর এক আইন পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে কোনও আলোচনা না করেই। যে তিনটি কৃষি আইন নিয়ে সারা দেশ পরাক্রমশালী এক আন্দোলন দেখল তারও প্রস্তাবনা ও প্রবর্তনা ঘটেছিল এই পথেই। এমনি ভাবেই আধার কার্ড সংক্রান্ত আইন রাজ্যসভায় অনুমোদন করানো যাবে না বিবেচনা করে নজিরবিহীন ভাবে সেটাকে অর্থ বিলের মর্যাদা দিয়ে কৌশলে পাশ করানো হয়েছিল সংসদে। আবার গত নভেম্বরে (২০২১) কৃষি আইন বাতিল করার প্রকাশ্য ঘোষণা হলেও আজ পর্যন্ত সরকার সেই বিষয়ে 'রা কাড়েনি। কাজেই সবটাই ইচ্ছে, বলা ভাল রাজনৈতিক ইচ্ছের বিষয়।
আর এই রাজনৈতিক ইচ্ছের কথাই যদি বলতে হয় তাহলে এটা খুব পরিষ্কার, বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল যে মনোভঙ্গিমা বা ভাবনার অনুবর্তী, তাতে তাদের এই ‘দেশদ্রোহ’ বিষয়ক আইন নিয়ে খুব বেশি নড়েচড়ে বসার ইচ্ছে থাকা সম্ভব নয়। স্বাভাবিক, তারা দেশ জাতি সম্প্রদায় নিয়ে যে একমুখি কেন্দ্রীয় মতাদর্শের দাবিদার তার মধ্যে আমাদের দেশের বিপুল বৈচিত্র্যের কোনও পরিসর নেই। এক ধর্ম এক ভাষা এক দেশ- এই হল তাদের কাঙ্ক্ষিত ভারতভূমি। কিন্তু এই চাপিয়ে দেওয়া ‘দেশ’ ভাবনা সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য নয় সেটাও তারা বোঝে, তাই সরকারিভাবে ‘দেশ’এর সংজ্ঞার যারা বিপরীত ভাববেন তাদের বুঝিয়ে দেওয়া দরকার আসলে ‘কেষ্ট কেমন ঠাকুর’! তাই এই আইন, তাই তার এমন অবাধ প্রয়োগ!
সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রের সরকারের কাছে যে প্রস্তাব রেখেছে তাতে তারা বলতে চায়, যতদিন না এই আইনের সংস্কার হয় ততদিন এর আওতায় এফআইআর করা মুলতুবি থাকুক। সাধু প্রস্তাব! সুপ্রিম কোর্ট আইন তৈরি বা তার সংস্কার করার এক্তিয়ার রাখে না কিন্তু আইন নিয়ে সুচিন্তিত মন্তব্য বা রায় দিতে পারে। এর বিপরীতে কেন্দ্রীয় প্রভুদের প্রতিক্রিয়া খুব সজীব নয়। তারা কত দিনে শীতঘুম থেকে জাগবেন বা আদৌ জাগবেন কিনা তা কোটি টাকার প্রশ্ন। কিন্তু সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনাপ্রবাহে সুপ্রিম কোর্ট যে নিজেদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের একটা সচেতন প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এটা শুভ ইঙ্গিত। যদিও স্বতন্ত্র মর্যাদা থাকলেও সুপ্রিম কোর্টকেও বহুলাংশে এখনও কেন্দ্রীয় আইন বিভাগের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই পাশাপাশি সংশয় এসে জড়িয়ে ধরে। সত্যিই না আঁচালে বিশ্বাস নেই!
অত্যন্ত যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবেদন। বেশ লাগলো।
ReplyDeleteবেশ ভাল লেখা সন্দেহ নেই। সুপ্রিম কোর্ট এই আইন রদ করল ঠিকই কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর এসম্পর্কে মন্তব্য প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও মহুয়া মিত্র এই মামলাটি করেছিলেন, কিন্তু বাম দলগুলোর ভূমিকা ত অতি ন্যক্কারজনক, তারা সংবাদ মাধ্যমে একটি কোথাও বলে নি। বোধহয় বলে নি এই কারণেই কারণ তারাও ত ক্ষমতায় থেকে এই আইনের প্ৰয়োগ কম করে নি। এদের মুখোশ টাও খোলা দরকার ছিল।
ReplyDelete