এ রাজ্যে ভ্রাতৃঘাতী হিংসা কবে বন্ধ হবে?
অশোকেন্দু সেনগুপ্ত
আমরা একদা ছোট আঙারিয়া থেকে নেতাই কাণ্ডে বামফ্রন্ট সরকারের আচরণে বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছি। তখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলন তুঙ্গে। আমরা যারা পথে ছিলাম, তারা সকলে তৎকালীন সরকারের পতন বা অপসারণ চেয়েছিলাম। আর এবার দেখছি রামপুরহাটের নৃশংস গণহত্যা। দেখছি টিভিতে, খবর পাচ্ছি সংবাদমাধ্যমে। তখন এসব ছিল না তেমন। এবার ঐ সংবাদমাধ্যমগুলোই জানাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের ব্যাখ্যা-টীকা। আমরা তা গ্রহণে প্রস্তুত কী? মানুষকে হত্যা করা হয়েছে সে কি কোনও রাজনৈতিক ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়ায়?
কেউ বলছেন, চাই বিচারবিভাগীয় তদন্ত, কেউ বলছেন রাষ্ট্রপতির শাসন লাগু হোক, কেউ চাইছেন সিবিআই তদন্ত। খবরে প্রকাশ, মহামান্য কলকাতা হাইকোর্ট ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য সরকার সিট গঠন করেছে। আই সি/ এসডিপিও'কে সাসপেন্ড করা ও সরানো হয়েছে। অনেকটা দেরিতে হলেও, তৃণমূলের ব্লক সভাপতি আনারুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ২২ জন গ্রেফতার হয়েছে। যথেষ্ট হল কী? সরকারের ভূমিকায় অধিকাংশ মানুষ কিন্তু সন্তুষ্ট নন।
কেন বলছি অধিকাংশ? তা বুঝতে কিছু প্রশ্ন রাখি সামনে। কেন প্রতিবাদ ধ্বনিত হচ্ছে না দলীয় কর্মীদের কণ্ঠে? মূল নায়ক বলে মুখ্যমন্ত্রী যাকে চিহ্নিত করেছেন সেই আনারুলকে গ্রেফতার করতে যারা বাধা দিয়েছে, তারা কারা? আনারুলদের মতো লোকেদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ দল। কেন? কারা এমন চক্রান্ত করতে পারে? বারে বারে পুলিস ব্যর্থ, তবু কেন পুলিশমন্ত্রী সেই বাহিনীতেই (যারা মৃতের সঠিক সংখ্যাও বলতে পারে না) আস্থা রাখছেন?
এ কথা তো অনস্বীকার্য এবং দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলিকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ও গভীর এক দুর্নীতি চক্র এ রাজ্যে প্রবল শক্তিধর হয়েছে। সেই সুত্র ধরেই রামপুরহাটেও বেআইনি বালি ও পাথর উত্তোলনকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন ধরে এক মাফিয়া চক্র শাসক দল ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ক্রমেই মহীরূহ হয়ে উঠেছে। তাই, সামান্য ডাক-মাস্টার থেকে ভাদু শেখ রাতারাতি হয়ে ওঠে এলাকার ত্রাস ও ধনপতি; একদা রাজমিস্ত্রী আনারুল মাত্র এক দশকেই প্রাসাদোপম বাড়ি হাঁকিয়ে নিমেষে হয়ে ওঠে এলাকার অর্থ ও ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি। পুলিশ ও প্রশাসন তার হুকুমেই নড়েচড়ে। তার অধীনে থাকা ৯টি পঞ্চায়েত এলাকায় বিরোধীরা ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোনও প্রার্থী দাঁড় করানোর সাহস পর্যন্ত পায় না। এসব কি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের কেউ জানতেনই না? কেউ সে কথা বিশ্বাস করবেন? তাই খুব স্বভাবিক, আঁটুনি যখন বজ্র সম তখন তার ফস্কা গেরোও থাকবে। ভিত্তি যখন লুঠপাট, তখন তার বখরা নিয়ে হাঙ্গামাও হবে, আর তা গণহত্যাতেও গড়াতে পারে। তাইই হয়েছে।
মহিলা ও শিশু-সহ বহু মানুষকে খুন করে তারপর আগুনে ঝলসানো হয়েছে। এই গণহত্যার কোনও নিন্দাই যথেষ্ট নয়। তবু বলি, ৩৫৫/৩৫৬ নয়- চাইছি রাজনীতির ঊর্ধে উঠে এমন হত্যালীলার চিরতরে অবসান। মানতে হয় যে এ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমস্যা। সেই সমস্যা মেটাতে বাংলার মানুষকেই এগোতে হবে। রাজ্যপাল মহোদয় কিছু করতে পারবেন না। তিনি নাক গলাচ্ছেন কেন (তিনি কি গোপাল গান্ধী হতে পারেন!)? তবুও মেনে নেওয়া যেত, যদি তিনি আগেও বিজেপি নামের কৃষক হত্যাকারী দলটির পাশে দাঁড়াতে ব্যস্ত না হয়ে উঠতেন। তাঁর নিরপেক্ষতাই যে আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে!
রাজনীতির ঊর্ধে উঠে কিছু চাওয়ার দিন কি বিদায় নিয়েছে এই বঙ্গ থেকে? আমরা ভুলি কেমনে যে এই বাংলাতেই একদা জন্ম নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, কর্মে বিস্ময়ের ঢেউ তুলেছেন বিদ্যাসাগর- তবে কেন কেবল ধান্দাবাজির রাজনীতিতে ডুব দেব? কেন এ দেশে এত ধরাধরির রাজনীতি? চাকরির লোভে মেধা থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ বেচে দেব কেন? জিডিপি বাড়াতে দেশের অগুন্তি মানুষকে কালো ধোঁয়ার বিষে চোবাব কোন অধিকারে? যারা এই ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত চাইছেন তারা কি দেখেননি 'হিজাব' ও অন্য নানা মামলায় বিচার বিভাগের ভূমিকা? রাধাবিনোদ পালেদের দিন গিয়াছে, বর্তমানে প্রশাসন ও বিচার বিভাগের বড় এক অংশ সর্বদা সরকারের পাশে থাকাটাই শ্রেয় জ্ঞান করে। আর সরকার?
রাজ্য সরকারের কথা বলি আগে। এই সেদিন রিজওয়ানুর হত্যাকাণ্ডে জ্ঞানবন্তর ভূমিকা দেখেও এই সরকার তার হাতেই তামাক খেতে চায় কেন? এই সেদিনও সরকারের প্রধান একটা ব্যঙ্গচিত্র পর্যন্ত সহ্য করতে পারলেন না! দায় কার? এই রাজ্য সরকারের ওপর ভরসা রাখতে পারি কই? হয়তো এও সত্য যে, এই মুখ্যমন্ত্রীকেই এখনও বাংলার মানুষ সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন। বিকল্পে ভরসা নেই।
ভরসা রাখতে পারি না কেন্দ্রের সরকারের ওপরও। দাভোলকর থেকে স্ট্যান স্বামী- প্রতিটি মৃত্যুর জন্য তাদের দায় মানতেই হয়। গুজরাত দাঙ্গা থেকে লখিমপুর- কোনও ঘটনাতেই তারা দায় অস্বীকার করতে পারে না।
একটাই অনুরোধ, দয়া করে লাশের রাজনীতি করবেন না কেউ। দয়া করে ভুলবেন না, যাদের প্রাণ গেল তারা আমার-আপনার সন্তান।
ধন্যবাদ আশকেন্দুবাবু।
ReplyDeleteমনের কথাটি তুলে ধরেছেন।
দলমত নির্বিশেষে প্রতিবাদ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে না পেরে কেউ কেউ যে কোথায় গেলো সেই বুদ্ধিজীবীগণ, মেরুদন্ড খুঁজে তাঁরা নাকাল, কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না ইত্যাদি বলে পরোক্ষে বৃদ্ধ বিগতযৌবনদের কাছে কাকুতি মিনতি করছেন, নিজেরা না পারলে তাঁরা বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করুন, যাতে মৃতরা পুনর্জন্ম নিয়ে তাঁদের হয়ে আন্দোলন করেন।