Pages

Thursday, 30 December 2021

প্রথম আলোর খোঁজে

মহাবিশ্বে উড়ল টাইম মেশিন!

শোভনলাল চক্রবর্তী 


মহাবিশ্বের প্রথম আলোর খোঁজে অবশেষে মহাকাশে পাড়ি জমাল জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। ২৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সময় সন্ধ্যা ৬টা ৫০ মিনিটে ফ্রেঞ্চ গায়ানার ইউরোপিয়ান কওরু স্পেসপোর্ট থেকে উৎক্ষেপণ করা হল টেলিস্কোপটি, যেটি বহন করে নিয়ে যায় একটা আরিয়ান রকেট। মহাকাশে যৌথভাবে এ টেলিস্কোপটি পাঠাচ্ছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইসা) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (সিএসএ)। আর এ মাহেন্দ্রক্ষণের জন্য বিজ্ঞানীদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩০ বছর! সব ঠিকঠাক থাকলে একবিংশ শতকের সবচেয়ে বড় বৈজ্ঞানিক অভিযান হবে এটাই। প্রায় এক মাস ধরে মহাকাশের বিশাল শূন্যতার মধ্য দিয়ে ছোটার পরে জেমস ওয়েব লক্ষ্যে পৌঁছবে। একে বলা হয় এল২ ল্যাগ্রাঞ্জ পয়েন্ট। গন্তব্যে যেতে যেতে ভাঁজ খুলবে জেমস ওয়েবের বিভিন্ন অংশের। লক্ষ্যে পোঁছনোর প্রায় ছয় মাস পরে এটি কার্যকর হয়ে উঠবে পুরোপুরি। ২০৩১ সাল পর্যন্ত সেখান থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রচুর তথ্য দেবে পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের। খুঁজে বেড়াবে মহাবিশ্বের প্রথম গ্যালাক্সির আলো।

জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ টেলিস্কোপের ওজন প্রায় ৬,২০০ কেজি আর আয়নার আকার ৬.৫ মিটার। আগামী ১০ বছর টেলিস্কোপটি কার্যক্ষম থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটিই হবে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। হাবল টেলিস্কোপের চেয়েও এটি ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী।

১৯৯৬ সালে প্রথম এই নভোদূরবীন বানানোর পরিকল্পনা করে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। ১৯৯৭ সালে উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করা হয় তখন। এরপর শুরু হয় ঝামেলা। বারবার পেছতে থাকে উৎক্ষেপণ। সর্বশেষ চলতি মাসের ১৮ তারিখ জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণের কথা থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তা পিছিয়ে যায়। এরপর নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২২ ডিসেম্বর। তবে খারাপ আবহাওয়ার কারণে সে তারিখও পিছিয়ে যায়। টেলিস্কোপটি মহাবিশ্বকে ইনফ্রারেড বা অবলোহিত আলোয় অবলোকন করবে। এর মূল আয়নাটি স্বর্ণ দিয়ে মোড়ানো বেরিলিয়াম ধাতুর ১৮টি ষড়ভুজ আকৃতির আয়না জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। ফলে, হাবলের তুলনায় অনেক দূরের আলো ও বস্তু দেখতে পারবে এটি। উল্লেখ্য, আলোর গতি সেকেন্ডে প্রায় এক লাখ ৮৬ হাজার মাইল। দূরবর্তী কোনও নক্ষত্র থেকে যখন আলো এসে আমাদের গ্রহ পর্যন্ত পৌঁছয়, তখন আমরা আসলে সেই আলোর যাত্রা শুরুর সময়কার অবস্থা দেখতে পাই। 

অর্থাৎ, এই টেলিস্কোপ যে চিত্র ধারণ করবে, তা হবে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার চিত্র। সুতরাং, এর মাধ্যমে আমরা ‘অতীতের’ ছবি দেখতে পাব বলা যায়। সেই কারণেই বিজ্ঞানীরা একে বলছেন টাইম মেশিন। ১৮৯৫ সালে ৮৪ পাতার 'টাইম মেশিন' নামে একটি বই লিখে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েলস। সেই প্রথম কেউ ভাবলেন অতীত দেখার কথা। তারপর বিজ্ঞান এক লম্বা খোঁজ লাগালো, আইনস্টাইন থেকে স্টিফেন হকিং সবাই বললেন সম্ভব, কিন্তু...! সেই 'কিন্তু'কে অতিক্রম করেছে ওয়েব। 

টেলিস্কোপটি এক মাস ধরে পৃথিবী থেকে ১০ লাখ মাইল দূরে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করবে। এ সময় পৃথিবী থেকে এটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে চলবে। জেমস ওয়েবের পূর্বসূরি হাবল টেলিস্কোপটি মাত্র ৩৪০ মাইল দূর থেকে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। প্রতি ৯০ মিনিট পর পর পৃথিবীর ছায়ার অন্তরালে চলে যায় সেটি। চাঁদে অবতরণকারী অ্যাপোলো নভোযানের একজন স্থপতির নামে নামকরণ করা হয়েছে এই টেলিস্কোপ। এটি আগের যে কোনও টেলিস্কোপের চেয়ে শতগুণ বেশি শক্তিশালী হবে। এ টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অপেক্ষা করছিলেন বিজ্ঞানীরা। এ নিয়ে উদ্বেগও ছিল। টেলিস্কোপটির যাত্রা সহজ ছিল না স্বীকার করে নাসার কর্মকর্তা বিল নেলসন বলেছেন, আমাদের এটা অনুধাবন করতে হবে যে এখনও অসংখ্য কাজ বাকি আছে এবং সেগুলো খুব যথাযথভাবে সম্পন্ন হতে হবে। কিন্তু আমরা জানি বড় পুরস্কারে বড় ঝুঁকিও থাকে। এটির ক্ষেত্রেও তাই। আর এই কারণেই আমরা অন্বেষণে সাহস দেখাই। 

ওয়েব অসাধারণ একটি মিশন। আমরা যখন বড় স্বপ্ন দেখি তখন কী অর্জন করতে পারি তার একটি উজ্জ্বল উদাহরণ এটি। আমরা সব সময় জানতাম যে, প্রকল্পটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ প্রচেষ্টা হবে। কিন্তু, যখন আপনি একটি বড় পুরস্কার চান, আপনাকে একটি বড় ঝুঁকি নিতে হবে। টেলিস্কোপটির মূল লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে সাড়ে ১৩ বিলিয়ন বছর আগের, অর্থাৎ, বিগ ব্যাংয়ের পরপরই সৃষ্ট আদি নক্ষত্রের তথ্য অনুসন্ধান করা। এ বস্তুগুলোর মধ্যে পারমাণবিক বিক্রিয়া থেকেই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রথম ভারী পরমাণুগুলো সৃষ্টি হয়। যেমন কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার সৃষ্টির জন্য এগুলো দায়ী। এর বাইরে এ টেলিস্কোপ দিয়ে দূরবর্তী নক্ষত্রের পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা যাবে। কোনও গ্রহ বাসযোগ্য কিনা বুঝতে সাহায্য করবে এ টেলিস্কোপ। মিশনের সঙ্গে যুক্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেইডি হ্যামেল বলেছেন, ‘আমরা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার সম্পূর্ণ নতুন পদ্ধতিতে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। একটি নতুন সীমান্ত। এটাই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ সম্পর্কে আমাদের রোমাঞ্চ তৈরি করেছে।’

বসে বসে দেখা ছাড়া টেলিস্কোপের বিশেষ আর কাজ নেই। ৩০ বছর ধরে হাবলও ওই কাজই করেছিল। উপহার দিয়েছিল মহাকাশের দারুণ সব ছবি। তবে জেমস ওয়েবের চোখ আরও সূক্ষ্ম, আরও বড় আয়না। তাতে ধরা পড়তে পারে মহাবিশ্ব সৃষ্টির সেই আদ্যিকালের ছবি। কোটি কোটি আলোকবর্ষ থেকে ছুটে আসা প্রথম দিককার নক্ষত্রের আলো শনাক্ত করার ক্ষমতাও আছে এর। অনায়াসে দেখতে পাবে দূরের গ্যালাক্সি, গ্রহ-নক্ষত্র। আরও নিখুঁতভাবে বলতে পারবে কোন গ্রহ বাসযোগ্য, কোনটি নয়। প্রাথমিকভাবে ওয়েব মহাকাশে তাকাবে তার ইনফ্রারেড চোখ দিয়ে। মানে খালি চোখে যা দেখা যাবে না, সেটাই দেখবে অনায়াসে। চারটি যন্ত্রের সমন্বয়ে ছবি তুলবে এটি। কভারেজে থাকবে ০.৬ থেকে ২৮ মাইক্রনের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (হাবল টেলিস্কোপের ছিল ০.৮ থেকে ২.৫ মাইক্রন)। নাসা আশা করছে, এত সূক্ষ্ম চোখে মহাকাশে নানা ধরনের বস্তু কণা ও বিল্ডিং ব্লক তৈরির রহস্য এবার ধরা পড়বেই। আর এতে করে বোঝা যাবে দূরের গ্যালাক্সিতে আদৌ অন্য কোনও প্রাণের অস্তিত্ব আছে কিনা। আর তাই সব মিলিয়ে বিজ্ঞান জগৎ আবার জমজমাট।


Monday, 27 December 2021

একটি ছবি ও গৃহ পরিচারিকারা

নিরন্তর জীবন-সংগ্রাম 

সূর্যশেখর দাস 


এক ব্যতিক্রমী ছবি 'স্যার'। মালিক অশ্বিনের সঙ্গে গৃহ পরিচারিকা রত্নার স্নিগ্ধ প্রেমের কাহিনি চমৎকার ভঙ্গিতে তুলে ধরেছেন পরিচালিকা রোহেনা গেরা। 

অশ্বিন নিউ ইয়র্কে ছিলেন। কিন্তু ভাই অসুস্থ হওয়ায় মুম্বই ফিরে আসেন। অশ্বিন এবং তাঁর প্রেমিকা সাবিনা গ্রামের বাসিন্দা রত্নাকে গৃহ পরিচারিকা হিসেবে নিয়োগ করেন। কিন্তু অশ্বিনের সঙ্গে সাবিনার সম্পর্ক ভেঙে যায়! ওদিকে পণ দিতে হবে না- এই আনন্দে রত্নার মা-বাবা রত্নার খুব দ্রুত বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের চার মাস পরেই রত্না বিধবা হন! তখন রত্নার বয়স মাত্র ১৯ বছর। রত্নার মতে, ওই বয়সে গ্রামের অনেক মেয়েরই জীবন কার্যত ফুরিয়ে যায়। কিন্তু উনি হাল ছেড়ে দেওয়ার মেয়ে নন। ফ্ল্যাটে শুধু একাকী অশ্বিন, আর কেউ নেই, সমাজের আর পাঁচজন কী দুর্নাম ছড়াবে- এসব উনি গুরুত্ব দেননি। তাঁর অশ্বিন স্যারকে বরাবরই ভালো মানুষ মনে হয়েছিল। রত্না অত্যন্ত পরিশ্রমী। কাজের ফাঁকে উনি অশ্বিনের অনুমতি নিয়েই টেলরিং'এর কোর্স করতে শুরু করেন। ওঁর ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন ছিল। ওঁর কাজে নিষ্ঠা দেখে অশ্বিন তাঁকে সেলাই করার একটি মেশিনও কিনে দেন। অশ্বিন রত্নার সঙ্গে কখনই খারাপ ব্যবহার করতেন না। ক্রমশ তাঁরা একে অপরকে বুঝতে শুরু করেন। অশ্বিনের রত্নার প্রতি প্রেম জন্মায়। কিন্তু‌ রত্না বুঝিয়ে দেন যে উনি হলেন একজন গৃহ পরিচারিকা এবং অশ্বিন হলেন তাঁর স্যার- এই পরিস্থিতিতে তাঁদের মধ্যে কোনও সম্পর্ক তৈরি হলে সমাজ কখনই ভালো চোখে দেখবে না। অথচ এর পরেও ওঁদের মধ্যে কোনও তিক্ততা তৈরি হয় না! একটা সময়ে রত্না কাজ ছেড়ে চলে যান। অশ্বিনও নিউ ইয়র্কে ফিরে যান। ওদিকে রত্না অশ্বিনের এক বন্ধুর ফ্যাশন ডিজাইনিং'এর অফিসে কাজ পান। রত্না বুঝতে পারেন, অশ্বিনই তাঁর নাম সুপারিশ করেছেন। শেষ পর্যন্ত এক অপরূপ স্নিগ্ধতার মধ্য দিয়ে ছবিটির পরিসমাপ্তি ঘটে। রত্না এবং অশ্বিনের ভূমিকায় যথাক্রমে তিলোত্তমা সোম এবং বিবেক গোম্বার অনবদ্য অভিনয় করেছেন।

পশ্চিমবঙ্গে কর্মরত মহিলাদের এক বড় অংশ গৃহ পরিচারিকা হিসেবে কাজ করেন। গৃহ পরিচারিকারা অবশ্যই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। তাই এঁদের ন্যূনতম বেতন-কাঠামো নেই। মালিকপক্ষ বা নিয়োগকারী এঁদের যখন-তখন ছাঁটাই করে দেন। অনেক শিক্ষিত মালিকও ঠাণ্ডা মাথায় এঁদের প্রাপ্য বেতন থেকে বঞ্চিত করেন। পরিচারিকাদের নির্দিষ্ট ছুটির কোনও বালাই নেই। উল্টে কাজে সামান্য ভুল হলেই অনেকের চূড়ান্ত লাঞ্ছনা জোটে। এঁদের সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্বই পায় না। অনেক সময়ে গৃহ পরিচারিকারা যৌন নিগ্রহের শিকার হন। সব কিছু জেনে-বুঝেও এঁরা মুখ-বুজে সহ্য করতে বাধ্য হন। কারণ, প্রতিবাদ করলে কাজটা চলে যাবে। কাজ চলে গেলে ওঁরা খাবেন কী? অনেকের স্বামী আবার উপযুক্ত কাজ করেন না। কারওর স্বামী আবার চূড়ান্ত মদ্যপ এবং অত্যাচারী। বহু পরিচারিকাকে ভাড়া বাড়িতে থাকতে হয়। সেই সূত্রে আলাদাভাবে ইলেকট্রিক বিল মেটাতে হয়। সেই সঙ্গে ডাক্তার-ওষুধপত্রের খরচ তো লেগেই রয়েছে। আবার কেউ প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক কিংবা অন্য কোনও সূত্র থেকে ঋণ নিয়েছেন। তাই ঋণ শোধ করার দায় এঁদেরকেই নিতে হয়। এঁরা খুব কষ্ট করে মেয়েদের বিয়ে দেন। সেই সব মেয়েদের অনেকেই শ্বশুরবাড়িতে লাথি-ঝাঁটা খেয়ে আবার বাপের বাড়িতে ফিরে আসতে বাধ্য হন।  তাছাড়া মেয়ে গর্ভবতী হলে তার খাওয়া-পরা এবং চিকিৎসার খরচও বহন করতে হয়। ফলে, সংসারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট গৃহ পরিচারিকাদের জীবন সত্যিই নরক হয়ে ওঠে। নানান দায়-দায়িত্বের বোঝা বইতে গিয়ে ওঁরা কার্যত ভারবাহী পশুতে পরিণত হন। তার ওপর এই কোভিড পরিস্থিতিতে এইসব পরিচারিকাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। 

পশ্চিমবঙ্গ গৃহ পরিচারিকা সমিতি গত বছরের জুন মাসের শেষ দিকে প্রায় ৫৫০০ জন গৃহ পরিচারিকার ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ৫৬ শতাংশ গৃহ পরিচারিকা লকডাউনের জাঁতাকলে পড়ে পুরোপুরি রোজগারহীন হয়েছিলেন। সে ক্ষেত্রে মাত্র ৬ শতাংশ পরিচারিকা তাঁদের জীবিকা ঠিকঠাক বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। গত বছর লকডাউন উঠে যাওয়ার পর যে তাঁদের অবস্থা আবার ভালো হয়ে গিয়েছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। আবার  ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইটস ইউনিয়ন (Domestic Workers Rights Union), বৃহৎ ব্যাঙ্গালোর গ্রুহকর্মীক সংঘ (Bruhat Bangalore Gruhakarmika Sangha) এবং মানেগেলাসা কার্মীকর ইউনিয়ন ( Manegelasa Kaarmikara Union) গত বছরের মে মাসে বেঙ্গালুরুর ২৪০০ জন গৃহ পরিচারক-পরিচারিকাদের ওপর এক সমীক্ষা চালিয়েছিল। সেই সমীক্ষা অনুযায়ী মালিকপক্ষ বা নিয়োগকর্তা ৮৭ শতাংশ পরিচারক-পরিচারিকাকে লকডাউনের সময় কাজে আসতে বারণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ৯১ শতাংশ কর্মী গত বছরের এপ্রিল মাসের কোনও বেতনই পাননি! যে সব কর্মীর বয়স পঞ্চাশের বেশি তাঁদের প্রায় ৫০ শতাংশ লকডাউনের ধাক্কায় কর্মহীন হয়েছিলেন। এইসব ভুক্তভোগী কর্মীদের একটা বড় অংশ হলেন পরিচারিকা। মনে রাখতে হবে, 'ডোমেস্টিক ওয়ার্কার্স'দের ৭৬.২ শতাংশই হলেন মহিলা। এঁদের অনেকেই বিধবা কিংবা স্বামী থেকেও নেই। কারও সন্তান থাকলেও সে আবার তার মায়ের কোনও দায়িত্ব পালন করে না। এমতাবস্থায় কর্মহীন হলে এইসব পরিচারিকাদের পেট চলবে কী করে? 

আবার গত বছরের লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের মর্মান্তিক দুর্দশা আমরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছি। এই হতভাগ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে অবশ্যই বহু গৃহ পরিচারিকা রয়েছেন। কোভিড-বিধ্বস্ত লকডাউনের সময় তাঁরা কেমন ছিলেন সেটা খুব ভালোভাবেই বোঝা গিয়েছে! করোনা-আক্রান্ত এই সময়ের বেশ কয়েক বছর আগেই নোবেল জয়ী দুই অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এস্থার দুফলোর করা গবেষণা আমাদের জানিয়েছিল যে বহু পরিচারিকা অপুষ্টিতে ভোগেন। কোভিড-১৯'এর 'আশীর্বাদ'এ এই অপুষ্টির কালো থাবা আরও প্রসারিত এবং মারাত্মক হয়ে উঠেছে। তাই, বর্তমান সময়ে করোনার 'কামড়' খানিকটা দুর্বল হলেও তাঁদের সমস্যা মিটে যায়নি।

গৃহ পরিচারিকারা যাতে ভালো থাকেন সে ক্ষেত্রে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে- এ কথা বলতে পারলে হয়তো খুব ভালো হত! হ্যাঁ, পরিচারিকারা যাতে 'ন্যূনতম বেতন আইন'এর(১৯৮৪) আওতায় আসেন সে ব্যাপারে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। আবার পশ্চিমবঙ্গ সরকারের 'লক্ষ্মীর ভান্ডার' প্রকল্প এঁদের আর্থিক দুরাবস্থার ক্ষতে মলম জুগিয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষে একা এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। যাঁরা পরিচারিকাদের নিয়োগ করেন তাঁদের এ ক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা নিতে হবে। এটা সংশ্লিষ্ট মালিকপক্ষকে দায়িত্ব নিতে হবে যাতে পরিচারিকারা ঠিক সময়ে বেতন এবং পুজোর 'বোনাস' পান। 'কাজের মেয়েদের' রোগ-অসুখ করলে সেটা মানবিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করতে হবে।

'স্যার' ছবিটি পরিচারিকাদের যাঁরা মালিক তাঁদের খুব মন দিয়ে দেখা উচিত। ওই সিনেমায় অশ্বিন সব সময়ই রত্নার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেছেন। অশ্বিন রত্নার বোনের বিয়ের সময় জোর করেই কিছু টাকা রত্নার হাতে গুঁজে দিয়েছেন। আবার ওঁর পরিচিত কেউ যখন রত্নাকে গাল-মন্দ করেছেন অশ্বিন কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করেছেন। এবং উনি কখনই রত্নাকে লোভনীয় 'এক টুকরো মাংস' ভাবেননি। হ্যাঁ, উনি এক দিনের জন্যও ওঁর পরিচারিকাকে বিছানার সম্পর্কে যেতে বাধ্য করেননি। এমনকি রত্না যখন বুঝিয়ে দিয়েছেন যে সামাজিক বিভাজনের জন্য তাঁর সঙ্গে অশ্বিনের সম্পর্ক গড়ে ওঠা সম্ভব নয়, তখনও অশ্বিন হিংস্র হয়ে ওঠেননি। সব থেকে জরুরি বিষয়টা হল, অশ্বিন রত্নাকে একজন মানুষ হিসেবে পুরোপুরি মর্যাদা দিয়েছেন। 

অশ্বিনের কাছ থেকে গৃহ পরিচারিকাদের নিয়োগকর্তারা অনেক কিছু শিখতে পারেন।


Sunday, 26 December 2021

দেশের সমস্ত নাগরিক যখন সন্দেহভাজন

ধর ধর! ওই চোর, ওই চোর!

প্রবুদ্ধ বাগচী


নভেম্বর মাস পেরিয়ে গেছে। নভেম্বর মানে বিপ্লবের মাস। নভেম্বর মানে রেড স্কোয়ার আর দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। আবার নভেম্বর মানে জীবনানন্দের প্রিয় হেমন্তকাল। ‘হেমন্ত এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/ তাহাদেরও ঢের আগে আমাদের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু।’ যদি জীবনানন্দের এই প্রত্যয়কে আক্ষরিক অর্থে না-ও নিই তবু নভেম্বর মানে আরেকটা পর্ব। রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকারের আওতায় যত পেনশনভোগী আছেন, এই নভেম্বরের মধ্যেই তাঁদের জীবিত থাকার প্রমাণপত্র সরকারি দফতরে জমা দিতে হয়। না হলেই বিপদ, তাঁদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে। বুড়ো মানুষরা এই নিয়ে বড় চিন্তায় থাকেন আজকাল। নভেম্বর পড়তে না পড়তেই ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় লাইনে দাঁড়িয়ে পড়া, এদিক ওদিক উদ্বেগ ভরে তাকানো এবং অধস্তন ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের মুখঝামটা খাওয়া- তবু তাঁরা নিরুপায়। পেনশন মানে তাঁদের ভাতের থালা। 

আমাদের দেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১ এপ্রিল ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল বলে এই দেশে আর্থিক বছর শুরু হয় ওইদিন থেকে। কিন্তু ক্যালেন্ডার বর্ষ হিসেব করে ডিসেম্বরের বদলে কেন এই নভেম্বরেই বেঁচে থাকার জন্য ‘বেঁচে আছি’ চিরকুট সরকারের জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে আসতে হয় তার কোনও ব্যাখ্যা গুগল বিশ্বকোষেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা খুব ঝামেলার, অন্তত গত প্রায় সাত/আট বছরে এই ব্যবস্থাটা ক্রমশই একটা আতঙ্কের মতো চেপে বসছে সিনিয়র সিটিজেনদের বুকের ওপর। অথচ বলা হচ্ছে, এই জীবন প্রমাণ দাখিলের পদ্ধতি নাকি সরলায়িত হয়েছে। আদপে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। কারণ, অনেকের কাছে প্রযুক্তি মানে সব কিছু ‘স্যাটাস্যাট’ হয়ে যাওয়া মনে হলেও সকলের কাছে বিষয়টা ‘এমনি এমনিই খাই’এর মতো এত অনায়াস নয়। 

আসলে গত সাত-আট বছরে সরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা বীজমন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যে সরকারি সুবিধা পাওয়া নানা প্রকল্পের যারা উপভোক্তা তাঁরা অনেকেই নাকি প্রকৃত প্রাপক নন। আর তাই প্রযুক্তির বকলেস-বাঁধা স্নিফার ডগ লেলিয়ে দিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে কারা আসলি কারা নকলি। আসল-নকলের দ্বন্দ্ব যে নেই তা নয় । কারণ, আমাদের রাজনীতির মূল বুননে ‘পাইয়ে দেওয়া’র একটা স্পষ্ট পরিসর আছে। রাজনীতি যারা যে দলেরই করুন না কেন, নিজেদের সমর্থকদের কিছু একটা পাইয়ে না দিলে ভোটের চাকা ঘোরে না। আজ যারা কেন্দ্রের সরকারের চালক হয়ে বসেছেন, তাঁরাও ভোটে জিতেই এসেছেন আর তাই ব্যবহারিক রাজনীতির জায়গায় তাঁরা ধোয়া তুলসিপাতা এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই দেশের সব নাগরিককে ‘চোর’ ঠাওরানো আসলে একটা ‘মহান’ দ্বিচারিতা- চৌকিদারকে চোর ধরে দেখাতে হয়, চোর চোর বলে চিৎকার করলে হয় না। সমস্যার কথা, এ ক্ষেত্রে চিৎকার শুধু নয়, গোটা দেশের নাগরিকের জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়ে দেওয়ায় আগুয়ান ভূমিকা নিয়ে খলনায়কের ভূমিকায় প্রযুক্তি। প্রযুক্তি তো আর নিজে নিজে হাঁটতে পারে না, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় নিজেদের মতাদর্শ মতো- ‘নাচে কারা? তারা তারা !’ 

সদ্য যখন গ্যাসের ভর্তুকির  জন্য এলপিজি গ্রাহকের সঙ্গে তাঁর মোবাইল নম্বর জোড়ার কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তখন দেখা হয়েছিল বিবর্ণ মলিনা এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে, কলকাতায় ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির ঝাঁ-চকচকে সদর দফতরে। সেখানে লিফটের গায়ে নম্বর লেখা ইংরেজিতে, আধিকারিকদের নামের বোর্ড হিন্দি বা ইংরেজিতে। এই মহিলা নিতান্তই স্বল্পশিক্ষিতা, সম্ভবত রান্নার কাজ করেন, এমনকি তাঁর নিজের একটা মোবাইল অবধি নেই- ওই চকচকে বাড়িতে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কী করবেন? কোথায় যাবেন? নিরাপত্তারক্ষী অবধি তাঁকে ধমকচমক করছেন। অথচ গ্যাসের ভর্তুকি এঁরই দরকার সবচেয়ে বেশি। আর ইনিই জানেন না কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট, মোবাইল নম্বর সব এক সরলরেখায় আনলে পরে তবে তাঁর কিছু সাশ্রয় হতে পারে। এবং ভর্তুকি পাওয়ার অন্যতম শর্ত হয়ে উঠল নিজের একটি মোবাইল থাকা! সম্পন্নতর কেউ কেউ ভর্তুকিতে গ্যাস পাচ্ছেন বলে এই দরিদ্র মহিলাকে সরকারি অফিসের দরজায় দরজায় যদি ঘুরে বেড়াতে হয় তবে প্রযুক্তি তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের এক ভুলভুলাইয়া। একে সংবেদনশীলতা বলে না। 

মানছি, সরকারি পেনশনভোগীরা এমন দরিদ্র নন। কিন্তু তাই বা বলি কী করে? সরকারি অফিসে কাজ করার বাইরেও দরিদ্র বিধবারা, সহায়হীন বৃদ্ধারা বা বিশেষ ভাবে সক্ষম নাগরিকরাও পেনশন ভাতা পান। জীবনের প্রমাণপত্র তাদেরও দাখিল করতে হয়। কিন্তু সরকারের প্রত্যক্ষ পেনশনভোগীদের দায়টা আরও বেশি, কারণ তাঁদের পেনশনের পরিমাণ তুলনায় বেশি। এটা ঠিক, কিছু অসাধু পরিবার আছেন যারা তাঁদের পরিবারের পেনশন প্রাপকের মৃত্যু হলে সময়মতো জানান না। এতে সরকারি অর্থের অপব্যয় হয়। যদিও দেশে সরকারি অর্থের অপব্যয়ের যে ব্যাপ্ত চিত্র তার মধ্যে এটা নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। আর সেই গুটি কয়েকের জন্য সমস্ত পেনশনভোগীদের যে যন্ত্রণা ও উদ্বেগ তা তুলনীয় নয়।

উদ্বেগ কেন? গত কয়েক বছরে মূলত এই কাজ করা হচ্ছে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। হয় মোবাইল ফোনের কোনও অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপস) ব্যবহার করে নয়তো সরাসরি ব্যাঙ্কে গিয়ে বায়োমেট্রিক মেশিনে। বাইরে থেকে করিয়ে আনলে তার জন্য পেনশনারদের সাহায্য লাগছে বাইরের কোনও এজেন্সির, তাঁদের একটা মোটা টাকা দিতে হচ্ছে। যে সব শারীরিকভাবে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাইরে থেকে করিয়ে আনতে পারবেন না, ডাক্তার ডাকার মতো এজেন্সির লোককে ডাকতে হচ্ছে বাড়িতে; দক্ষিণা বেড়ে যাচ্ছে। 

এর পরেও আছে সংশয়। বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রির ছাপ মেলা বেশ সমস্যার কথা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেলে না, কারণ, তাঁদের আঙুলের চামড়ার রেখা মসৃণ হয়ে যায়, অনেক সময় আঙুল বেঁকে থাকে। তবু তাঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়ার অন্ত নেই। কারণ, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ থেকে সরকারি দফতর, প্রত্যেকেরই মগজে এই জপমালা যে প্রতিটি পেনশনারই ভুয়ো- কাজেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা লাউঞ্জের মতো তাঁদের আপাদমস্তক সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে তল্লাশি করাই বিধেয়। ঘটনাটা যে প্রায় তেমনই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

এটা ঠিক, ২০১৪ সালে এইসব নতুন নিয়মকানুন চালু হওয়ার পরেই গোটা দেশ জুড়ে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে, বছর দুয়েক বাদে কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে, পেনশনাররা প্রযুক্তির অসুবিধের কারণে লাইফ সার্টিফিকেট দিতে না পারলে তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কথাটা বলা সহজ, কাজে করে দেখানো অতটা সরল নয়। ব্যাঙ্কগুলিতে কর্মচারীর যে আকাল তাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জীবিত পেনশনারদের খুঁজে তাঁদের পেনশন চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। আর মানসিকতার ছাপটাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে। যারা নিয়ম করছেন তাঁরাই চাপে পড়ে নিয়ম শিথিল করছেন। এর মধ্যে একটা চাপে পড়ে ঢোক গেলার ব্যাপার আছে। 

তাছাড়া আবারও বলি, এটা ভাবনার অভিমুখের ব্যাপার। আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করার সময় সরকার যেভাবে সেটাকে ‘আর্থিক বিল’এর মর্যাদা দিয়ে কোনও বিতর্ক ছাড়া সংসদে পাশ করিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল গোটা দেশের সকলেই সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি, ‘আধার কার্ড’এর বেড়া তুলে সরকার তাঁদের ছেঁকে বার করে নেবে। পরবর্তীকালে, নোটবন্দি'র সময়েও প্রায় একই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মানে, বারবারই সরকার মনে করছে দেশশুদ্ধ লোক ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে উঠেছে- যেন তেন প্রকারেণ তাঁদের ঢিট করা দরকার। তাহলে এই তালিকায় পেনশনার 'বুড়ো-বুড়ি'রাই বা বাদ যাবেন কেন? তারা ভুয়ো পেনশন তুলে জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য টাকা জোগাচ্ছে কিনা কে জানে!

একটু খেয়াল না করে উপায় নেই, সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেছেন, নিরাপত্তার প্রশ্নে দেশের নাগরিকদের দিকে নাকি তাঁদের নজরদারি করা দরকার। আর এই উচ্চারণের এক মাসের মধ্যেই রব উঠেছে আধার ও ভোটার কার্ড যোগ করার- সংসদে সদ্য সেই বিল দ্রুত পাশ হয়ে গেল। আসলে স্বীকার করি বা না-করি, কেন্দ্রীয় সরকারের চেতনার অভিমুখ নাগরিক অধিকারের বিরোধী। স্বীকৃত নাগরিকের ভোটে জিতে নাগরিকত্বের বৈধতা নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা যায়, আইন করা যায়। প্রতিটি নাগরিককে সন্দেহ করা যায় ভুয়ো অথবা ভুয়ো উপভোক্তা বলে- সোজা কথায় ‘চোর’ বলে। এই আবহেই বিচার করা দরকার পেনশনভোগীদের নিয়ে এই ছেলেখেলার রীতিকে। গুরুদেবের ভাষায় একেই বোধহয় বলা হয় ‘ধর! ধর! ওই চোর! ওই চোর!’ হায়, কোন চোরকে কে ধরে! কার মায়ের গলা যেন উঁচু স্বরে বেজে ওঠে? 

এখনও ডিসেম্বর ফুরোয়নি। এই মাসের পেনশন ঢুকবে তো তাঁদের আকাউন্টে? সেই থরো থরো আশঙ্কায় শীতরাত্রির প্রহর কাটছে তাঁদের। এরাও আমার দেশের নাগরিক। 


Friday, 24 December 2021

পরিবর্তিত সময়

মহানগরের পৌরসভার গল্প

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

গত ১৯ ডিসেম্বর কলকাতা পৌরসভা নির্বাচনের দিন যখন বেলা করে ভোট দিতে যাচ্ছি, পথে একটি চায়ের দোকানে সিপিএমের বর্ষীয়ান এক সমর্থক (এক সময়ে কিছুটা সক্রিয়) এমন দুটি কথা বললেন যা আমাকে চিন্তার খোরাক জোগাল।

কথা ১: ‘আমরা জার্সি বদল করি না। যে দলকে ভোট দিয়েছি সেই দলকেই ভোট দেব, সে হারুক বা জিতুক।’

 

কথা ২: ‘মধ্যবিত্তদের জন্য কোনও পার্টি নেই। (ক্ষমতাসীন পার্টিগুলি) হয় গরিবকে দ্যাখে, নয়তো বড়লোকদের।’

হরে দরে প্রথম কথাটি আমি সম্প্রতি আরও দু-একজন সিপিএম সমর্থকের মুখে শুনেছি। এতে করে আমার ধারণা হচ্ছিল, সিপিএম কর্মী ও সমর্থকদের যে ভোটগুলি গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি’র বাক্সে পড়ছিল, তার একটা কমবেশি অংশ এবার যাতে সিপিএমের ঝুলিতে ফিরে আসে সে জন্য পার্টি থেকে একটা সচেতন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কথায় বলে, ‘বেটার লেট দ্যান নেভার’।

দ্বিতীয় কথাটিতে হতাশার সুর। মনে মনে আমি ওই প্রশ্নের একটা উত্তর দিয়েছিলাম। আমার উত্তরটা ছিল এই: বামপন্থী পার্টিগুলিকেই তো আমরা গরিবের পার্টি বলে জানতাম; এখন কি সেই প্রস্তাবে বদল এসেছে! মুখ ফুটে কিছু বলিনি, কারণ, হতাশায় বিদ্ধ মানুষজনকে তাঁদের ভাবনার বিপরীতের কথাগুলি সোজাসাপ্টা বলতে নেই।

কিন্তু পাশাপাশি এও তো দেখলাম, তৃণমূল এ রাজ্যে যখন এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি এবং কলকাতা পৌরসভায় অন্তত ১৩০টা আসন পাওয়া তাদের প্রায়-সুনিশ্চিত বলে মিডিয়া থেকে নির্বাচনী-সমীক্ষা সকলেই আস্থার সঙ্গে বলছে (গত বিধানসভা ও উপনির্বাচনগুলির প্রবণতাও তাই), তখন নির্বাচনের দিন তাদের সকাল থেকেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয় কেন? যখন, এই ধরনের হুজ্জোতিতে জড়িয়ে না পড়ার বার্তা পার্টির শীর্ষমহল থেকে বেশ জোরের সঙ্গে প্রচার করা হয়েছে! এই সন্ত্রাস কয়েকটি মাত্র বুথে হয়েছে নাকি আরও বহু জায়গায় চলেছে- এই তর্কেরও আর কোনও অবকাশ থাকে না যখন শাসকের তরফে দায় ছিল এই ধরনের একটিও ঘটনা না ঘটার। যদি বা সত্যিই নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়েই এমনতর কিছু ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে পার্টির তরফে কি উচিত ছিল না এ ব্যাপারে কড়া দৃষ্টান্ত স্থাপন করা? তা তো দেখা গেল না। 

এই ব্যাপারটার তত্ত্ব-তল্লাশে পরে আবার আসব, আপাতত একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিতের দিকে তাকানো যাক।

আসলে গত কয়েক বছর ধরে বিশ্ব জুড়েই রাজনৈতিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসার ফলে (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল ভুবন, ক্রিপ্টো দুনিয়া ইত্যাদির প্রভাবে) আমাদের দেশের রাজনীতির জগতেও এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, যার অভিঘাত আমরা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছি। এ নিয়ে পাতার পর পাতা লিখে যাওয়া যায়, কিন্তু এখানে তার অবকাশ কম, তাই দু-একটি মোদ্দা কথা উত্থাপন করব মাত্র।

সম্প্রতি খবরে প্রকাশ, রাজ্যে কিছু চটকল শিল্পে কর্মসংস্থান কেন্দ্র থেকে কয়েকশো মাধ্যমিক অনুত্তীর্ণদের পাঠানো হয়েছিল বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের জন্য যেখানে প্রশিক্ষণ শেষে সফল কর্মপ্রার্থীদের চাকরিতে বহাল করার কথা। কিন্তু দেখা গেল, বহু কর্মপ্রার্থীই এই প্রশিক্ষণে যোগ দেননি। ঘটনাটি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য! আমরা জানি, বিশ্ব জুড়ে ও এ দেশেও ‘গ্রেট রেজিগনেশন’এর আবহে শ্রমিক ও কর্মচারীদের মধ্যে কাজ ছেড়ে দেবার হিড়িক পড়েছে, যখন মজুরি বৃদ্ধি করেও অনেককে কাজে ফেরানো যাচ্ছে না। কেউ কেউ বলছেন, অল্প টাকায় অথবা কাজের নিম্নমানের কারণে বহু মানুষ আর কাজ করতে চাইছেন না। কিন্তু আমরা তো জানি, কর্মের আকালের যুগে পেটের দায়ে মানুষ যে কোনও কাজ করতে চান এবং সামান্য মজুরিতেও তাঁরা রাজী হয়ে যান। কিন্তু কী এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হল যে মানুষ কাজ ছেড়ে পালাচ্ছে অথবা বহু কাজই গ্রহণ করতে রাজী হচ্ছে না! তাহলে কি কাজের জোগান এখন কাজের চাহিদা থেকে বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে? এই প্রশ্ন নিয়ে সকলেই মাথা চুলকোচ্ছেন।

বাস্তবতা হল, ডিজিটাল ভুবনের অসীম প্রসারে এমন এক পরিবর্তনশীল কাজের জগৎ গড়ে উঠছে যেখানে মানুষের সামনে নানাবিধ দুয়ার খুলে যাচ্ছে। এর সত্যাসত্য নিয়ে আমাদের দেশে এখনও তেমন সমীক্ষা হয়নি বটে কিন্তু আমরা যে এক গভীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পার হচ্ছি সে ব্যাপারে কোনও সংশয় রাখার অবকাশ আর নেই। সে আলোচনা আমি নানা জায়গায় করেছি, আবারও অন্যত্র করা যাবে। আপাতত বলার কথা এই যে, এই স্বতঃস্ফূর্ত আঙ্গিকগত পরিবর্তনের ফলে রাজনৈতিক পরিসরে এক প্যারাডাইম শিফট হতে চলেছে। তা হল, রাজনৈতিক দলগুলির ওপর মানুষের যে বাধ্যত নিত্য নির্ভরশীলতা তার অবসান হয়ে চলেছে। একদিকে রাজনৈতিক দলগুলির চাকরি দেওয়ার ক্ষমতা সীমিত এবং অন্যদিকে উদ্ভুত গিগ অর্থনীতি নানা ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ (যদিও তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্থায়ী ও স্বল্প চরিত্রের) তৈরি করে চলেছে যার হদিশ আজকের তরুণ-তরুণীরা বেশ ভালমতো ধরে ফেলেছে। বরং, এই অযূত ধরনের অস্থায়ী কাজগুলির জন্যই কর্মরত ও কর্মপ্রার্থী মানুষজনেরা দর কষাকষির একটা অবাধ সুযোগও পেয়ে গেছেন। তাঁরাও কোনও একটি কাজে স্থিত হয়ে বেশি দিন থাকতে চাইছেন না, কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করে নতুন কাজে বেশি মাইনে বা মজুরিতে ঢুকে পড়ছেন। এছাড়াও কাজের নানারকম আউটসোর্সিং ও বিকেন্দ্রীকরণের কারণে অনেকেই স্বাধীন উদ্যোগপতি (ছোট ছোট) হয়ে উঠেও সফলতা পাচ্ছেন।

এই প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বোঝা যাবে, কেন প্রায় সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলি আজ মতাদর্শের প্রশ্নটিকে সরিয়ে রেখে অনেক বেশি পরিমাণে সর্বজনগ্রাহ্য ‘কর্মসূচি ভিত্তিক’ দল হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ, রাজ্য সরকারই হোক কি পৌরসভা অথবা পঞ্চায়েত- সকলেই কাজের পারদর্শিতা, নব নব প্রকল্প এবং গরিব মানুষের হাতে অর্থ তুলে দেওয়ার কর্মসূচি রূপায়ণেই এক ধুন্ধুমার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। একটি প্রাচীনপন্থী মতাদর্শগত দল হিসেবে বিজেপিও এই আবহটিকে আর অস্বীকার করতে পারছে না। দীর্ঘ এক বছর ধরে চলা উত্তর ভারতের কৃষক আন্দোলন ও তার সামনে কেন্দ্রীয় সরকারের নতজানু হয়ে তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া এই প্রখর আবহের দিকেই ইঙ্গিত করছে। যদিও তারা এখনও তাদের সাবেক হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে পুরোপুরি সরিয়ে রাখতে পারেনি। মনে হয়, এ কারণেই তাদের পতন আরও ত্বরান্বিত হবে। এই পরিবর্তনের তোড় এত তীব্র যে, ২০১৪ সালের কথা বাদই দিলাম, এমনকি ২০১৯ সালের থেকেও আমরা বহু দূর এগিয়ে চলে এসেছি।

তাই, এবারের কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে মূল এজেন্ডা ছিল পরিষেবাগত কর্মসূচি। আর এ কথা খোলা মনে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, গত এক-দু বছরে কলকাতা পৌরসভার পরিষেবা আগের তুলনায় নানা ভাবে উন্নত হয়েছে, বহু ওয়ার্ডে জনগণের সমস্যাগুলিকে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষত, ‘টক টু মেয়র’ অনুষ্ঠানটি মানুষজনকে প্রয়োজনে কাউন্সিলারকে অতিক্রম করে এলাকার সমস্যাগুলিকে শীর্ষ স্তরে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। এইভাবে কাজের একটি নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়েছে যার ওপর শহরের অধিকাংশ মানুষ আস্থা রাখতে চেয়েছেন। তার ওপর ‘দুয়ারে সরকার’ এবং ‘পাড়ায় সমাধান’ উদ্যোগে দেখেছি, নিম্নবিত্ত এলাকায় দলে দলে মানুষ এইসব শিবিরে গিয়ে নিজেদের সমস্যাগুলিকে নথিবদ্ধ করেছেন ও বহু ক্ষেত্রে সমাধান পেয়েছেন। সবটা মিলিয়ে এমন একটা আস্থা গড়ে উঠেছে যে, ছোট ছোট কাজগুলি দ্রুত হয়ে যাবে, বড় কাজগুলি ধীরে হলেও হতে শুরু করেছে।

এই যে এলাকার কাউন্সিলরকে অতিক্রম করে মানুষকে পৌরসভার শীর্ষ স্তরে যোগাযোগ গড়ে তুলতে শাসকেরা বাধ্যত অনুমোদন দিয়েছে, তার একটা ব্যুমেরাং হয়ে যাওয়ার ভয় হয়তো অনেকের মনে ছিল। তাই, সব সময় মানুষের মনের হদিশ পেতেও অনেককে হয়তো কালঘাম ছোটাতে হয়েছে। এই উদ্যোগে হয়তো মহানাগরিক অথবা মুখ্যমন্ত্রী বাহবা পেয়েছেন কিন্তু অকর্মণ্য কাউন্সিলররা ক্ষমতা হারানোর ভয়ে ভীত হয়েছেন। হয়তো বা, সেই আশঙ্কা থেকেই জেতার ব্যাপারে ষোলআনা নিশ্চিত হতেই কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে হিংসার ঘটনা দেখা গেল।

তবে সবটা মিলিয়ে প্রশ্ন এই- কলকাতার আরও তীব্র সমস্যাগুলি কি যাদুদণ্ডের ছোঁয়ায় মিলিয়ে গেল? একেবারেই না। কলকাতার বহু অঞ্চলে জল জমার তীব্র সমস্যা এখনও বিদ্যমান। প্রমোটারি বাড়বাড়ন্ত বহু জায়গায় ঘোরতর বাস্তব। তা নিয়ে গোলাগুলি চলাও তেমন বন্ধ হয়নি। জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে বহুতল তুলে ফেলাও কম কিছু ঘটেনি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রশ্নটিও সমান সদর্থক। ওয়ার্ড কমিটি গড়ে ওয়ার্ডের কাজকে আরও গণমুখি করার উদ্যোগ এখনও বিশ বাঁও জলে। অবশ্য নতুন বোর্ডের ভাবী মহানাগরিক দুটি প্রাথমিক আশ্বাস দিয়েছেন: এক, কলকাতা পৌরসভার তরফে বছরওয়ারি এবার থেকে রিপোর্ট কার্ড প্রকাশ পাবে; দুই, প্রায় সমস্ত পরিষেবাকে অনলাইন ব্যবস্থায় নিয়ে আসা হবে

দেখা যাক।

 

 

Wednesday, 22 December 2021

কৃষি ক্ষেত্রের বাস্তবতা

কৃষি পুঁজির সক্ষমতা

সোমনাথ গুহ


বামপন্থী আন্দোলনের প্রাথমিক পাঠ শুরু হত জমি দখলের লড়াই দিয়ে এবং তাতে শ্রেণি লাইন বোঝাটা আবশ্যিক ছিল। সেই শ্রেণি লাইনে কৃষি ক্ষেত্রে স্পষ্টতই পরিষ্কার একটা বিভাজন ছিল। একদিকে বিপুল সংখ্যক দুঃস্থ, নিরন্ন চাষি, বিপরীত দিকে জমিদার, মহাজন ও তাদের লেঠেল বাহিনী। আর এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতেন ভুমিহীন ও ক্ষুদ্র চাষি এবং কৃষি মজুরেরা। 

আশির দশকে পাটনা এবং সন্নিহিত অঞ্চলে কৃষি মজুরদের নেতৃত্বেই গ্রামাঞ্চলে বিপ্লবী অগ্রণী বাহিনী গড়ে ওঠে। এঁদের আন্দোলনের মূল দাবি ছিল, কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, জমিদার ও ধনী চাষিদের দখলে থাকা উদ্বৃত্ত, খাস জমি দখল করে গরিব চাষিদের মধ্যে বণ্টন করা এবং দলিত ও পিছিয়ে পড়া জাতগুলির সামাজিক মান মর্যাদার আন্দোলন গড়ে তোলা। এই আন্দোলনে মধ্য চাষিদের অবস্থান ছিল দোদুল্যমান। এটা সমস্যা তৈরি করে, যা হয়ে ওঠে প্রায় অলঙ্ঘনীয়। সচেতন প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মধ্য চাষিরা অনেক সময় আন্দোলনের মূল প্রতিপক্ষ হয়ে পড়ে। এর ফলে আন্দোলন ধাক্কা খায়। আন্দোলন সম্পর্কে অভিযোগ ওঠে যে কৃষি শ্রমিক ও দরিদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে কৃষক ঐক্য গড়তে গিয়ে ব্যাপক কৃষক ঐক্যে ফাটল ধরানো হচ্ছে। বলাই বাহুল্য, সমালোচনাটা তারাই করেছিল যাঁদের নিজেদের ভিন্ন কোনও আন্দোলন গড়ে তোলার বিন্দুমাত্র কোনও তাগিদ ছিল না।  

এই একই সময়ে দেশের অন্তত তিনটি রাজ্যে ভিন্ন ধরনের কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের উত্থান ঘটে। তিনি ছিলেন উত্তরপ্রদেশ ও হরিয়ানার সর্ববৃহৎ ও সবচেয়ে শক্তিশালী বালিয়ান খাপের সর্বেসর্বা। মহেন্দ্র সিং ছিলেন টিপিকাল ‘গেঁয়ো’ বা ‘রাস্টিক’ ভূস্বামী যিনি বিস্তীর্ণ খোলা জায়গায় খাটিয়ায় বসে হুঁকোয় সুখ টান দিতে দিতে কৃষক সমাজকে শাসন করতেন। ১৯৮৮ সালে দিল্লির বোট ক্লাবে পাঁচ লাখ কৃষক সমাবেশিত করে তিনি তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকারকে হিলিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর মূল দাবি ছিল আখের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি এবং বিদ্যুৎ ও জলের খরচ মকুব করা। পরবর্তীকালে কৃষি ঋণ মকুব এবং কৃষকদের জমির ক্ষতিপূরণের জন্য তাঁর সংগঠন রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় লাগাতার আন্দোলন করেছে। 

মহারাষ্ট্রের শরদ জোশি ১৯৮০ সাল নাগাদ ‘শ্বেতকারি সংগঠন’ নামে একটি কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এক বহুমুখী মানুষ- একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ যিনি রাষ্ট্রসঙ্ঘে প্রায় দশ বছর কাজ করেছেন। তিনি আখ, তুলো, পেঁয়াজের সহায়ক মূল্যের দাবিতে বহুবার আন্দোলন করেছেন। তিনি মনে করতেন যে কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করার জন্য কৃষি উপকরণের দাম কীভাবে উৎপাদন মূল্যকে প্রভাবিত করছে সেটা বোঝা দরকার। তিনি স্বতন্ত্র এক কৃষক নেতা ছিলেন। উপরন্তু, নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন, ডব্লিউটিও এবং ডাঙ্কেল প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন, কারণ, তিনি মনে করতেন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রফতানি করতে পারলে কৃষক উপকৃত হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন কৃষি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উপস্থিতি যত কম হয় তত ভালো এবং কৃষকদের উন্মুক্ত বাজার এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের সম্পূর্ণ সুযোগ দেওয়া উচিত। কৃষি পুঁজির রূপান্তর বোঝার জন্য তাঁর তাত্ত্বিক অবস্থান তাৎপর্যপূর্ণ। এটা বিশেষ করে যে রাজ্যগুলিতে সবুজ বিপ্লব হয়েছে সেগুলির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাঁর মতে, পুরনো কৃষির পরিবর্তে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি পণ্যের রফতানি ও বাণিজ্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় কৃষক ভারতীয় পণ্য উৎপন্ন করবে, পশ্চিমি নয়। বহুজাতিকদের সাথে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা হবে। শিল্পপতিদের অনুদান প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু কৃষকদের নয়, কারণ কৃষকরা রাষ্ট্রের সাহায্য ছাড়া নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম। তাঁর মতে একজন কৃষিজীবী শুধুমাত্র একজন কৃষক নন, তিনি একজন উদ্যোগপতি। খাদ্যের প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি পণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ, ব্যাপারী বা বাণিজ্যিক কৃষির ওপর তিনি জোর দেন। তিনি ‘ভারত বনাম ইন্ডিয়া’ আওয়াজ তোলেন এবং অভিযোগ করেন যে ইন্ডিয়ার অভিজাত শ্রেণি ভারতকে শোষণ করছে। এই শ্লোগানের মধ্যে সদ্য স্থগিত হয়ে যাওয়া কৃষক আন্দোলনের কর্পোরেট পুঁজি বিরোধী অনমনীয় মানসিকতার প্রাথমিক ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

এই আশির দশকেই কর্নাটকের অধ্যাপক এমডি নাঞ্জুন্দাস্বামী বাঙ্গালোরে বহুজাতিক সংস্থা কেএফসি আক্রমণ করে হৈচৈ ফেলে দেন। নাঞ্জুন্দাস্বামী শরদ জোশির পুরো বিপরীত অবস্থানে ছিলেন। তিনি ডব্লিউটিও'র মুখর সমালোচক ছিলেন এবং তৃতীয় বিশ্বে বহুজাতিক সংস্থাগুলির ব্যবসা করার বিরোধী ছিলেন। তিনি ১৯৮০ সালে ‘কর্নাটক রাজ্য রায়ত সংঘ’ (কেআরআরএস) স্থাপিত করেন যা কৃষির কর্পোরেটিকরণ ও বহুজাতিক সংস্থার তীব্র বিরোধিতা করে। তাঁর মতে, ভারতে বহুজাতিক সংস্থার ব্যবসা করা নতুন করে উপনিবেশ স্থাপন করার শামিল। কেএফসি ছাড়াও তাঁর সমর্থকরা কার্গিল, পেপসি, ম্যাকডোনাল্ড ইত্যাদি কোম্পানির বিরুদ্ধে লাগাতার বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন, মনস্যান্টোর জিএম শস্য পুড়িয়ে দেন। তিনি মনে করতেন, সবুজ বিপ্লব ভারতীয় কৃষির অপূরণীয় ক্ষতি করেছে, পরিবেশ ধ্বংস করেছে। সবুজ বিপ্লব চাষিকে দেনাগ্রস্ত করেছে, তাঁদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তাঁর আশঙ্কা ছিল, ইউরোপের মতো এখানেও কৃষকরা তাঁদের জমি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাবে। আজকের বাতিল হয়ে যাওয়া কৃষি আইন কৃষকদের মধ্যে একই ধরনের আশঙ্কা তৈরি করেছিল। কেআরআরএস ফসলের সহায়ক মূল্য বৃদ্ধি, নিখরচায় বিদ্যুৎ, সারের জন্য অনুদান ইত্যাদি দাবি নিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন করেছে। 

আশির দশকের শুরু থেকে বিভিন্ন কৃষক আন্দোলনের একটা সারাংশ করা যেতে পারে। প্রথমত, যে রাজ্যে সবুজ বিপ্লব হয়নি, সেখানকার আন্দোলনের প্রকৃতি, যে রাজ্যে সবুজ বিপ্লব হয়েছে তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কৃষি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি বা উদ্বৃত্ত ও খাস জমি বন্টনের জন্য আন্দোলন বিহারের অন্য জেলা বা রাজ্যে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন স্থগিত হওয়ার পরেই পাঞ্জাবে দলিত ক্ষেতমজুররা যে রেল রোকো আন্দোলন করেন, অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যে সেখানে তাঁদের মজুরি বৃদ্ধির কোনও দাবিই ছিল না। তাঁদের মূল দাবি ছিল ঋণ মকুব করা এবং বিল না দেওয়ার জন্য ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ পুনঃস্থাপন করা। অসমে অখিল গগৈ'এর ‘কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতি’ মূলত বৃহৎ বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ভুমিহীন চাষির সংখ্যা ১১.২৪ শতাংশ, এক একরের কম জমি এমন চাষির সংখ্যা ৪০.১১ শতাংশ। অথচ জমির প্রতি কৃষকের আর কি সেই আকর্ষণ আছে? থাকার কথা নয়, কারণ জমি নিয়ে কী হবে যখন চাষ আর লাভজনক নয়? একজন দরিদ্র কৃষিজীবীর মোট উপার্জনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অন্যান্য কাজ থেকে আসে। সেই কারণে যে সব রাজ্যে কৃষকের গড় জমি কম তাঁরা এমএসপি বা বিদ্যুৎ বিল মকুবের জন্য আন্দোলনে কোনও আকর্ষণ বোধ করেন না। 

দ্বিতীয়ত যেটা লক্ষণীয়, উল্লিখিত তিনটি রাজ্যেই কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি ছিল এমএসপি বা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, যার ফলস্বরুপ স্বামীনাথন কমিটি তৈরি হয়। সহায়ক মূল্যের দাবি সবুজ বিপ্লবের বাইরের রাজ্যেও ছড়ায়। মধ্যপ্রদেশের মতো একটি পিছিয়ে পড়া রাজ্যে ২০১৭ সালে সহায়ক মূল্যের জন্য আন্দোলনে মন্দসৌরে ছ' জন কৃষক মারা যান। এই আন্দোলন করছেন এমন কৃষকরা যাঁদের অন্তত কিছু জমি আছে, যাঁরা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন। স্বাভাবিক ভাবেই কৃষক আন্দোলনের মূল দাবি জমি বা মজুরি বৃদ্ধি থেকে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, মান্ডি ব্যবস্থার দিকে সরে গেছে; আন্দোলনের নেতৃত্বও ভুমিহীন কৃষকের থেকে মধ্য ও ধনী কৃষকের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছে। 

তৃতীয়ত, সবুজ বিপ্লবের কারণে গ্রামে বিপুল ব্যাংক পুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে। এক সময় ব্যাংক থেকে চাষির ঘরে ঘরে গিয়ে ট্র্যাক্টরের ঋণ দেওয়া হত। ট্র্যাক্টরের জন্য বেশি ঋণ দিতে পারলে ব্যাংক অফিসারদের আলাদা ইনসেন্টিভ দেওয়া হত। যেখানে সবুজ বিপ্লব হয়নি সেখানেও ঢেলে কৃষি ঋণ দেওয়া হয়েছে। উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সার, পোকা মারার ওষুধ, স্প্রে'র কারণে গ্রামাঞ্চল বহুজাতিক সংস্থার লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠে। এসবের ফলে সাবেকি সামন্ততান্ত্রিক পুঁজির চরিত্রের রূপান্তর ঘটে। জমি, মহাজনী কারবারে বন্ধক থাকা পুঁজি সচল বাণিজ্যিক, ব্যাপারী পুঁজিতে রূপান্তরিত হয়। এই নব্য পুঁজির প্রতিনিধিরাও আর সেই লেঠেল পরিবৃত জমিদার/জোতদার নয়। এঁদের মধ্যে রাকেশ টিকায়েতের মতো সাবেকি ভূস্বামী যেমন আছেন, তেমনি আছেন দর্শন পাল সিং'এর মতো চিকিৎসক-বুদ্ধিজীবী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ভোট বিশারদ যোগেন্দ্র যাদব, এনআরআই ব্যবসায়ী, দলিত ও মহিলা আন্দোলনের নেত্রী। 

সবুজ বিপ্লবের কুফলে ভারতীয় কৃষি জর্জরিত হয়েছে আবার এই সবুজ বিপ্লবের কারণেই কৃষি পুঁজি উত্তরোত্তর শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং তা এতটাই যে আজ কর্পোরেট পুঁজির সাথে টক্কর দিতে সক্ষম; তার দাপটে আম্বানি-আদানিদের সমর্থন পুষ্ট রাষ্ট্রকেও পিছু হঠতে হয়। গ্রামাঞ্চলে এই পুঁজির উত্থান গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে স্বস্তিদায়ক, একটি অতি প্রয়োজনীয় দখিনা বাতাস।


Monday, 20 December 2021

যে চিঠি বিগ মিডিয়া কখনই ছাপে না!

বুদ্ধিজীবীর স্বপ্নবিলাস!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


(আনন্দবাজার পত্রিকায় গত ১ অক্টোবর ২০২১'এ প্রকাশিত সুগত মারজিৎ'এর নিবন্ধের জবাবে সমালোচনামূলক এই লেখাটি চিঠির আকারে গত ২ অক্টোবর সকালে ইমেলে আনন্দবাজার দফতরে পাঠানো হয়। আজও চিঠিটি প্রকাশ না পাওয়ায় সেই পুরনো সংশয়ই দৃঢ়বদ্ধ হল যে আনন্দবাজার আছে আনন্দবাজারেই। তারা বিরুদ্ধ-সমালোচনা ও মতামতকে বরাবরই উপেক্ষা ও ঘৃণা করে। সে যাক গে, অপেক্ষার সুযোগ নিয়ে লেখাটিকে কতকটা পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে এখানে প্রকাশ করা হল।)

‘আজ-কালের গল্প, পরশুর নয়’ নিবন্ধে (আনন্দবাজার, ১/১০) সুগত মারজিৎ আক্ষেপ করেছেন যে, বুদ্ধিজীবীদের কথা আমজনতা শুনতে চাইছেন না। তাঁর মতে, জনতা যেন অনেক বেশি স্বার্থগন্ধ লালায়িত; কোথায় কোন রাজনৈতিক নেতা কোন মন ভোলানো কথা বললেন বা জনমোহিনী প্রকল্পের কিছু তোড়া মুখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হল- সেদিকেই তাঁদের মন। মোদ্দা কথায়, নিজ সংকীর্ণ গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে বৃহৎ করে কিছু ভাবার চেষ্টা করা, এতে যেন তাঁদের (আমজনতা) বড্ড বেশি অনীহা। পড়ে ভালো লাগল যে তিনি এ বিষয়ে তাঁর হতাশার কথা অকুন্ঠ চিত্তে ব্যক্ত করেছেন।

প্রশ্ন হল, বুদ্ধিজীবীদের কথা কে কবে শুনেছেন? তার চেয়েও আরও বড় কথাটি হল, বুদ্ধিজীবী কে বা কারা? প্রথমত, স্পষ্ট করে নেওয়া যাক, বাংলা বাজারে ‘বুদ্ধিজীবী’ বর্গটির জনপ্রিয় চল কবে থেকে! 

এই শতকের প্রথম দশকে মূলত বাংলা টিভি সংবাদ চ্যানেলের আলোচনার আসর থেকে এই শব্দটির ধীরে ধীরে জনপ্রিয় উদ্ভব। বিশেষ বিশেষ বিষয়ের ওপর আলোচনার আসরে বিষয়-বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণে শব্দবন্ধটি মিডিয়াকুল দ্বারা বার বার বর্ষিত হওয়ার ফলে সমাজে এর একটি অস্তিত্ব-গ্রাহ্যতা তৈরি হয়। বিশেষত, সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম আন্দোলন পর্বে শব্দবন্ধটি সকলের নজর কাড়ে। এখন অবশ্য টিভি সিরিয়ালের জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীরাও মিডিয়ার আনুকূল্যে ‘বুদ্ধিজীবী’ পদবাচ্য। দ্বিতীয়ত, এর আগেও ‘বুদ্ধিজীবী’ বর্গের একটা হাল্কা ব্যবহার ছিল এবং কোনও কোনও সময়ে লেখক-শিল্পী-অভিনেতা-বুদ্ধিজীবীদের সমাজের নানান ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার মধ্যে তার কিছু পরিচয় আমরা পেয়েছি। যেমন, সত্তর দশকে বন্দীমুক্তি আন্দোলনের মিছিলে ও অন্যান্য নানান ঘটনাবলীতে তাঁদের স্বাক্ষর-সম্বলিত ইশতেহারে আমরা তাঁদের আংশিক অংশগ্রহণ দেখেছি। কিন্তু তা সব সময়েই ছিল এক বৃহৎ গণ-রাজনৈতিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদের নানা মাপের সহায়ক-ধর্মী অংশগ্রহণে পুষ্ট। এমনটা কখনও হয়নি যে তাঁরা কোনও মত বা পথের দিশারী হয়ে জনসাধারণকে পথ দেখিয়েছেন। সত্যজিতের ‘নায়ক’ ছবিতেও একটি দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই, জনপ্রিয় অভিনেতাকে শ্রমিক আন্দোলনের পৃষ্ঠভূমিতে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়ে সংহতি জ্ঞাপনের চেষ্টা, যা নায়কের আপত্তিতে শেষমেশ দানা বাঁধেনি।

অবশ্য, সংহতি জ্ঞাপনের উদ্যোগে ‘বুদ্ধিজীবী’দের সামিল করার প্রচেষ্টা বহু পুরনোকালের। যেমন, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথও পথে নেমেছিলেন এবং গান বেঁধেছিলেন (যদিও তাঁকে কেউ কখনও ‘বুদ্ধিজীবী’ বলেননি)। কিন্তু যদি মনে করা হয়, অতএব, এনারা রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের নেতাদের মতো জনসাধারণের অগ্রণী হয়ে সমাজ পরিবর্তন বা সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টায় জড়িয়ে পড়বেন (দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন), তাহলে তা বাতুলতা। সুগতবাবু’র নিবন্ধটি পড়ে মনে হবে যে তিনি বোধহয় বুদ্ধিজীবীদের এমন এক নেতৃত্বের আসনে দেখতে চাইছেন যেখানে তাঁদের মত নিয়ে আলোড়ন তৈরি হবে বা আমজনতা ভাববেন; সে ক্ষেত্রে তো তাঁদের বাস্তব অনুশীলনে অংশ নেওয়ার প্রশ্ন উঠবে। কারণ, আমজনতা বুঝে নিতে চাইবেন তাঁদের পাশে কে বা কারা আছেন। কিন্তু তাঁরা তা থাকেন না। তাই আমজনতার কাছে তাঁদের গ্রাহ্যতা পাওয়ার কোনও প্রশ্নও ওঠে না। তবে সরকার পরিচালনায় কিছু কিছু নীতি গ্রহণের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীদের অবশ্যই ভূমিকা থাকে আর তা তাঁদের পেশাদারি দায়িত্ব থেকেই।

এর অর্থে আমি বলতে চাইছি, অধ্যাপক হন কি গবেষক, চলচ্চিত্র পরিচালক অথবা লেখক, অভিনেতা কিংবা নাট্যকর্মী- এঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ও বহু ক্ষেত্রেই অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু সেই ভূমিকার যাথার্থ্য ও সীমাবদ্ধতা- দুইই উপলব্ধিতে রাখা প্রয়োজন (বুদ্ধিজীবী ও আমজনতা দু' তরফেই)। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বুদ্ধিজীবী ও আমজনতার মধ্যে সংযোগের এক গভীর সমস্যা রয়েছে; তা হয়তো অনতিক্রম্য কিন্তু সব সময় দুর্ভেদ্য নয়। তপস্যার অধিকারে হাত দিয়েছিলেন বলে সে কালে শম্বুকের গলা কাটা গিয়েছিল; কিন্তু পুঁজিবাদ যেহেতু বাজার থেকেই আহরণের নিয়ম জানে, তাই তপস্বী শম্বুকদের আজ মনোরঞ্জন ব্যাপারী হয়ে ওঠায় কোথাও কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। অস্যার্থ, 'কেউ কারও নয় গো মা'।

বলার কথা এই, আমজনতা রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের নিরিখেই তাঁদের পছন্দের শীর্ষ নেতানেত্রীদের অনুগামী হন, যারা যথেষ্ট বুদ্ধি, চিন্তা ও প্রজ্ঞার ধারক। প্রাক-স্বাধীনতা কালে, স্বয়ং গান্ধীজী অথবা নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু কি একাধারে জনপ্রিয় নেতা ও চিন্তার দিশারী ছিলেন না? স্বাধীনতা-উত্তরকালে জয়প্রকাশ নারায়ণ কিংবা শঙ্কর গুহ নিয়োগীকে কি আমরা একই সাথে চিন্তাবিদ ও জননেতা বলতে পারি না? 

মনে হয়, সুগতবাবু একাডেমিক জগতের অধ্যাপক ও গবেষকদেরই শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবী হিসেবে ঠাওর করতে চেয়েছেন যাঁদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে গবেষণায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা বৃহত্তর সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবেন! কারণ, প্রত্যক্ষ বাস্তব অনুশীলন বিনা জনগণের অগ্রভাগে স্থান পাওয়াটা অনেকটাই বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন এবং সে হেতু তাঁদের এক সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠাটাও কতকটা অবাস্তব। তাই বুঝতে হবে, পেশাগত গবেষক এবং জনতার মধ্যে প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ করা রাজনীতিক-গবেষক- এই দুইয়ের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। রাজনীতির পরিসর যতই কলুষিত হোক না কেন, যেহেতু আমজনতাকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির অনুশীলনের মধ্য দিয়েই জীবনধারণ করতে হয়, তাই তাঁর কাছে রাজনৈতিক নেতা যেমন কাছের মানুষ আবার দূরেরও। কিন্তু বুদ্ধিজীবীরা সব সময়েই অনেকটা দূরের জন।

বিষয়টি আরও কিছুটা মোড় পেয়েছে গত পাঁচ-দশ বছরে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে এক আমূল পরিবর্তনের ফলে। কলিম খান দু' দশক আগেই বলে গিয়েছেন, জ্ঞানের জগৎ কথাটি অসম্পূর্ণ, আসলে আমাদের ভাবতে হবে জগতের জ্ঞান নিয়ে। যখনই বলব জ্ঞানের জগৎ, তখন জ্ঞান এক সীমায়িত পরিসরে প্রাক-নির্ধারিত উপায়ে অবস্থিত; সেই জ্ঞান নানাবিধ ক্ষমতার প্রকোষ্ঠ থেকে জাত। কিন্তু যখন 'জগতের জ্ঞানের' কথা ভাবব, তখন তা অসীম, অনন্ত ও শৃঙ্খল-মুক্ত। রাজার দরবার, কুক্ষিগত মিডিয়া ও একাডেমিকস'এর প্রান্তর থেকে জ্ঞানবীক্ষার যে স্ফুরণ এতদিন মানবসমাজকে চালনা করেছে, তা আজ সোশ্যাল মিডিয়ার দৌরাত্মে ও গিগ অর্থনীতির উদয়ে এক লাগামছাড়া ঠিকানা পেয়েছে। তাই হোয়াটসআপ ইউনিভার্সিটির জঞ্জালের সাথে সাথে নানাবিধ দমিত সদর্থক-চিন্তাগুলিও আজ দিনের আলোয় দৃশ্যমান ও বহুজনে স্পর্শমান, যে চিন্তার প্রকরণগুলিকে মিশেল ফুকো বলেছিলেন, 'সাবজুগেটেড নলেজ'। এইখানেই ক্ষমতাশীলদের ভয় ও হতাশা।

যেমন, বহু পণ্ডিতজনকে যখন জিজ্ঞেস করেছি, রামকৃষ্ণদেব কথিত 'ব্রহ্ম কখনও এঁটো হয় না' কথাটির অর্থ কী, তাঁদের 'রায় ও মার্টিন'এ এর কোনও উত্তর নেই, অতএব, তাঁরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছেন। আশার কথা এই যে, চাইলে কোনও বক্তব্যই আজ আর মানুষের দুয়ারে পৌঁছয় না- তেমনটি বিশেষ বলা যাবে না।


Thursday, 9 December 2021

প্রকৃতি পরিবর্তনের রূপ

কেন 'জাওয়াদ' পরিণত হল নির্বিষ নিম্নচাপে?

শোভনলাল চক্রবর্তী


পৃথিবীর বুকে এখন একদল নতুন প্রজাতির মানুষ তৈরি হয়েছেন যাঁদের বলে নেটিজেন। এনারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সমস্ত খবর সংগ্রহ করেন ও প্রচার করেন। এর মধ্যে থাকে প্রচুর ভুয়ো খবর, যার সত্য-মিথ্যা কেউ যাচাই করে দেখেন না। তেমনই সব নেটিজেনরা 'জাওয়াদ' ঝড় নিয়ে সমাজমাধ্যমে ঝড় তুলেছেন। নেটিজেনদের যেন খানিকটা মন খারাপ, কারণ 'জাওয়াদ' তাঁদের হতাশ করল। অনেক নেটিজেন ক্যামেরা রেডি করে বসেছিলেন সমাজমাধ্যমে ঝড়ের প্রথম ছবি দেবেন বলে। অনেকে নিষেধ না মেনে হাজির হয়েছিলেন সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে, ঝড়ের সময় 'লাইভ' হবেন বলে। সে সব শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠল না, কারণ ঝড় পরিণত হল নিম্নচাপে। 

এ পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু এর পরেই নেটিজেনরা শুরু করলেন- কেন ঝড় তার শক্তি হারাল, সেই কারণ নির্ণয় করার। আর তাতে যে সব চমকপ্রদ ব্যাখ্যা উঠে এল, তা নিয়ে তৈরি হয়ে গেছে কাঁড়ি কাঁড়ি মিম। যে ব্যাখ্যাটি সবচেয়ে বেশি সাড়া ফেলেছে তা হল এই যে, বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে বেড়ে যাওয়া সমুদ্রের উষ্ণতা। বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে নেটিজেনরা ভাবছেন, এটা ভালো। সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বেড়েছে, এ তথ্যও সঠিক। কিন্তু 'জাওয়াদ' কেন ধাপে ধাপে শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণাবর্ত থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে ফুঁসতে থাকা অবস্থা থেকে কয়েক ঘন্টার মধ্যে পরিণত হল নির্বিষ নিম্নচাপে, তা ভাবাচ্ছে বিজ্ঞানীদের। তাঁদের মতে, এর কারণ গভীর চিন্তার। তাঁরা দেখেছেন, সমুদ্রের জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি নয়, বরং 'জাওয়াদ'এর ক্ষেত্রে ঘটেছে ঠিক উল্টোটা। দক্ষিণবঙ্গ যে বড়সড় দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা পেল, তার কারণ প্রধান কারণ উত্তর পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের শীতলতা। 'জাওয়াদ' তৈরি হয়েছিল থাইল্যান্ড উপকূলে। এই ঘূর্ণাবর্তকে ইন্ধন জুগিয়ে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত করেছিল ভারত মহাসাগরের সমুদ্রতলের অতিরিক্ত তাপমাত্রা। কয়েকশো কিলোমিটার আসার পর সেই তাপমাত্রাই কেড়ে নিল ঘূর্ণিঝড়ের সব তেজ। কোনও ঘূর্ণিঝড় শেষ পর্যন্ত কোন জায়গায় গিয়ে পৌঁছবে, তা নির্ভর করে বাতাসের অভিমুখের উপরে। 'জাওয়াদ'কে সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় বারো কিলোমিটার উপরে পশ্চিমি ঝঞ্ঝা যে ভাবে ঠেলেছে, তাতে শেষ পর্যন্ত সেটি বাংলার খুব কাছ দিয়েই গেল। যদিও তখন তার আর শক্তি প্রায় কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সব শক্তি শেষ হলে কী হবে, নিম্নচাপ হওয়ায় ডিসেম্বর মাসের বৈশিষ্ট্য বিরোধী অবিরাম বৃষ্টি হয়েছে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে। 

পশ্চিমবঙ্গের ঘূর্ণিঝড় প্রবণ মাস হল অক্টোবর আর নভেম্বর। ডিসেম্বর মাসে এখানে ঘূর্ণিঝড় হয় না। গত ৪০ বছরে ডিসেম্বর মাসে বাংলায় ঘূর্ণিঝড়ের নজির মাত্র একটি। ১৯৮১ সালের ৯ ডিসেম্বর থ্রি বি নামের ওই ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে। বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ছিল ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার। প্রাণহানি হয়েছিল অন্তত ২০০ জনের, বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন ১০ লক্ষ মানুষ। সে কথা মাথায় রেখে ঝড়ের মুখ বাংলার দিকে ফিরতে রীতিমতো চিন্তায় পড়েছিলেন প্রশাসনিক কর্তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের ইন্ধনে তৈরি ঘূর্ণিঝড়কে শান্ত করে দিল সমুদ্রই। বিজ্ঞানীদের মতে, ঘূর্ণিঝড় তৈরি হতে সমুদ্রতলের উষ্ণতা ২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে হয়। যেখানে 'জাওয়াদ' তৈরি হয়েছিল সেখানে সমুদ্রতলের উষ্ণতা ছিল ২৮-২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। ফলে, জলীয় বাষ্পের জোগান পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি 'জাওয়াদ'এর। কিন্তু এরপর বাতাসের দিক অনুযায়ী সরতে সরতে 'জাওয়াদ' এমন জায়গায় এসে হাজির হয়, যেখানে সমুদ্রতলের উষ্ণতা কম। ফলে, জলীয় বাষ্পের ঘাটতি ঘটায় নির্বিষ হয়ে পড়ে সে। এই ঘটনা ঘটে ওড়িশায় ঢোকার আগে পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে। ফলে, ওড়িশা সীমানা পার করে বাংলায় ঢোকার সময় সেটি নিছকই নিম্নচাপ। কিন্তু তবুও বছরের শুষ্কতম মাসে, অর্থাৎ ডিসেম্বরে যে বৃষ্টি হল, তার জন্য দায়ী নিম্নচাপ। 

অসময়ের এই বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়লেন কৃষিজীবীরা। ধান আগেই কেটে নেওয়ার ফলে কিছুটা রক্ষা পেলেও, ক্ষতি হয়েছে সবজি, ফুল এবং আলু চাষের। মাঠে থাকা সরষে গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। ক্ষতি হয়েছে পটল, ফুলকপি ও বাঁধাকপি চাষের। নিম্নচাপ এবং অমাবস্যার কোটালের জোড়া ফলায় জলোচ্ছ্বাসের জেরে বাঁধ ভেঙ্গে জল ঢুকে পড়েছে বহু সমুদ্র তীরবর্তী চাষের জমিতে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যেমন সমুদ্রতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি তৈরি করবে জোরালো ঘূর্ণিঝড়ের, তেমনই আবার 'ঠাণ্ডা সমুদ্র' ঘটাতে পারে এই ধরনের অসময়ের নিম্নচাপ। ভারতের সমুদ্র উপকূলে এই ধরনের 'ঠাণ্ডা সমুদ্রে'র ঘটনা প্রথম ঘটল। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, যেমনটা আমরা ভূগোলে পড়ে থাকি, সমুদ্রতলের উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটলে সারা পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমুদ্রে একটি নির্দিষ্ট অভিমুখে জলপ্রবাহ দেখা যায়। ফলে, ঘূর্ণিঝড় বা নিম্নচাপ বেশ কিছুটা আগে থেকে আন্দাজ করতে পারেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বর্তমানে জলবায়ুর পরিবর্তন ও বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উষ্ণতা বৃদ্ধি স্বাভাবিক জলস্রোতকে ব্যাহত করছে। ফলে, এক সমুদ্রে যখন উষ্ণতা অনেকটা বেড়ে যাচ্ছে, তখন অন্য সমুদ্রে তার তুলনায় উষ্ণতার হ্রাস হচ্ছে। এই ঘটনা বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বে লক্ষ করলেও একটি ঘূর্ণিঝড়ের উপর তার কী প্রভাব পড়তে পারে, তা প্রথম দেখিয়ে দিল 'জাওয়াদ'। ভবিষ্যতে অসময়ের আরও নিম্নচাপের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।

লেখা শুরু করেছিলাম নেটিজেনদের কথা দিয়ে, শেষ করা যাক তাঁদের কথা দিয়েই। একজন নেটিজেন পরামর্শ দিয়েছেন, বঙ্গোপসাগরকে মনস্তাত্ত্বিকের কাছে নিয়ে যেতে, এত ঘনঘন ডিপ্রেশনে চলে যাওয়ার লক্ষণ ভালো নয়! আসলে কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকের কাছে এক্ষুনি যাওয়ার কথা তাঁদের যারা জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে বসে থেকে, যেন কিছুই হয়নি ভাব করে দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। প্রকৃতি কিন্তু বারবার তার পরিবর্তনের রূপ তুলে ধরছে মানুষের সামনে, কিন্তু মানুষের কোনও হেলদোল নেই। আর কী কী হলে মানুষের হুঁশ ফিরবে সেটা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।


Sunday, 5 December 2021

দ্বন্দ্বমুখর ব্যক্তিত্ব

ভারতের ইতিহাস ও নীরদ সি চৌধুরী

শোভনলাল চক্রবর্তী


নীরদ চৌধুরী এক বহুলালোচিত চরিত্র। সুনিপুণ গদ্যকার ও স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ইতিহাসবেত্তা রূপে দেশে-বিদেশে প্রচুর সম্মান ও প্রশংসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি স্ববিরোধী, উন্নাসিক, আত্মশ্লাঘাবিশিষ্ট বলে নিন্দাও পেয়েছেন অনেক। নীরদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর The Guardian লিখেছিল, 'Nirad Chandra Chaudhuri, …was one of the most remarkable products of the encounter between India and European culture.'

এই কথাগুলি পড়ে আমাদের মনে হবে যে, ইঙ্গ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিলন সাধন করে তিনি এক অভূতপূর্ব সুরুচিসম্পন্ন সংস্কৃতি যাপনের দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন। আবার বহু সমালোচকই তাঁর জীবনধারা, তাঁর বিভিন্ন স্ববিরোধী বক্তব্য, দৌর্বল্য পরিচায়ক বিবিধ কার্যকলাপ প্রভৃতির মাধ্যমে এটা প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন যে, তাঁর আগাগোড়া সমস্ত কাজই একটা প্রদর্শনপ্রিয় মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। তাই আমাদের আলোচনার মূল লক্ষ হবে, প্রশস্তি ও নিন্দার মধ্য থেকে নিরপেক্ষ ভাবে একটি সিদ্ধান্তে উত্তীর্ণ হওয়ার চেষ্টা করা ও সেই আলোকে নীরদবাবুর ভারতেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটিকে বিচার করা।

নীরদবাবুর ইতিহাস-দর্শনের প্রসঙ্গ অবতারণার আগে তাঁর লিখনশৈলী ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কয়েকটি কথা না বললে অন্যায় হবে। তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি যা লিখেছেন, তা আবেগের উপর নির্ভর করলে ও লঘুভারচিত্ততা জাত তাৎক্ষণিক বিশ্লেষণ প্রবণতায় চালিত হলে এত গভীর ও সুচারু ভাবে তাঁর মত তিনি প্রকাশ করতে পারতেন না। অন্তঃসারহীন কোনও বিষয়কে ভাষার কৌশলে, বর্ণনা-চাতুর্যে মোহনীয় করে কতকটা উপস্থাপন করা যায় বটে, কিন্তু যত্নশীল পাঠকের কাছ থেকে তার কঙ্কালটা বেশিক্ষণ আড়াল করে রাখা যায় না। তাঁর সমালোচকেরা যত নিন্দাই তাঁর করে থাকুন না কেন, পাণ্ডিত্যর প্রসঙ্গ যখনই এসেছে, কেউ তা স্বীকার করতে তেমন কুণ্ঠাবোধ করেননি। সত্যজিৎ রায় সহ আর যে-ক’জন বাঙালি সুঠাম, সুললিত ইংরেজি গদ্য লেখার নিদর্শন রেখে গিয়েছেন, নীরদবাবুকে সেই তালিকায় অসংশয়ে অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তাঁর লিখনশৈলীর একটি বিশিষ্ট দিক এই যে, শব্দচয়নের ব্যাপারে তিনি আদ্যন্ত ‘পারফেক্ট।’ এই অভেদ্য গাঁথনির, ‘এলিট’রীতিয় স্বাদু গদ্য অবলীলায় প্রথম থেকে শেষাবধি পড়ে ফেলা হয়তো যায় না; মাঝে মাঝে ক্ষণিকের বিরাম নিয়ে অর্থটুকু সম্যকরূপে উপলব্ধি করে নিতে হয়। 

নীরদবাবু পর্বতের পাদদেশ থেকে আরম্ভ করে পাঠককে দিকনির্দেশ দিয়ে, পথ দেখিয়ে, উত্তুঙ্গ শৈলচূড়ে নিয়ে যান না; তিনি আরম্ভই করেন কোনও সুউচ্চ পর্বতসানুতে দাঁড়িয়ে। সেই অজেয় উচ্চতা থেকেই তিনি ছড়িয়ে দেন তাঁর আত্মপ্রত্যয়ী সৃষ্টির ধারাবারি; আর যখন তাঁর লেখনি থেমে যায়, আমরা দেখি, অধিত্যকা পূর্ণ করে ছড়িয়ে আছে এক অবিস্মরণীয় আবেশ। তাঁর আত্মজীবনী ‘Autobiography Of An Unknown Indian’ (১৯৫১)'এর প্রথম খণ্ডের চতুর্থ অধ্যায় Into The World'এর Prefatory Note'এ 'An Essay On The Course Of Indian History' শীর্ষকে নীরদবাবু একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। আর তার প্রায় একেবারে আদিতেই একটু ছলনাশ্রয়ী বিনয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন, ইতিহাস-দর্শনের প্রশ্নে স্বদেশবাসীর সাথে তাঁর একটা দুস্তর ব্যবধান রয়েছে- যেটা, তাঁর মতে, পৃথিবী সম্বন্ধে যথাক্রমে কোপারনিসীয় ও প্রাক-কোপারনিসীয় ধারণার প্রভেদের সাথে তুল্য। সব লেখাতেই তিনি নিজের সম্পর্কে উচ্চাশা পোষণ করেছেন। এই প্রবন্ধও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গবেষণার প্রবৃত্তি, বিষয়মুখিনতা আর বৌদ্ধিক সততা একজন সাধারণের চরিত্রে দুর্লভ- এ কথা বলে আদতে তিনি নিজে যে এই গুণগুলির অধিকারী সেটিই প্রকারান্তরে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। সে যাই হোক, এরপরেই ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে তিনি একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন, 'Indian history… presents its own synthesis'- আমাদের দেশের ইতিহাস সম্পর্কে এর চেয়ে বৃহৎ সত্য আর কী-ই বা আছে? অথচ এমন গভীর দর্শনের কথা যিনি বলেন, তিনিই আবার সমগ্র প্রবন্ধ জুড়ে, বা বলা ভাল সমগ্র আত্মজীবনীটি জুড়েই আপন শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এই স্ববিরোধ তাঁর প্রায় সকল লেখাকেই কিছুটা নিম্নগামী করেছে। সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। 

স্বতঃবর্ণনশীলা ভারতেতিহাসকে নীরদবাবু বিভক্ত করেছেন কালানুক্রমিক ভাবে তিনটি পর্যায়ে। ইতিহাসের এই যুগবিভাগ- এক যুগ থেকে অপরাপর যুগে সংস্কৃতির যে অনিরুদ্ধ প্রবাহ, একের সাথে অপরে মিশে সঙ্কর ও সুন্দর সংস্কৃতি বিনির্মাণের এই যে কালব্যাপী সহজাত প্রণালী, এর সাথে যেভাবে জীবের অভিযোজনের ইতিবৃত্ত, প্রজাতি থেকে পরবর্তী প্রজাত্যন্তরে বৈশিষ্ট্যের ক্রমোন্নতি প্রভৃতির সাদৃশ্য দেখিয়েছেন তিনি, তাতে তাঁর শক্তিশালী দর্শনশৈলীর পরিচয় মেলে। তিনি লিখেছেন, 'By applying the criterion of cultural character it is certainly justifiable to call the first cycle Hindu, the second Islamic, and the third the European.' তাঁর মত, ভারত এই প্রতিটি যুগেই তার সমকালীন বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী সভ্যতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে এবং তার সকল বৈশিষ্ট্যকে আত্তীকরণ করে, বিশ্বমিলনের হোমানলে তাকে আহুতি দিয়ে, উদ্ভূত সুবাসকে দিকে দিকে পরিব্যাপ্ত করেছে। তবে স্থূলভাবে তাঁর বক্তব্য এই হলেও এর বিশ্লেষণ তিনি স্বকীয়ভাবে করেছেন। The Guardian জানাচ্ছে, 'His interpretation of Indian history as a whole - at its dottiest in The Continent Of Circe (1965) - was based on the notion that, because most Indians were descended from immigrants, they were not really 'auto-chthonous'. They had always absorbed the incomers' ideas, and should have done so properly with the British, instead of, as usual, 'wearing out, outraging, and degrading everything great and good' that came in.' বিশ্বের প্রতিটি  সুবৃহৎ সাম্রাজ্যের প্রতিই তাঁর মোহ ছিল (সে কথা তাঁর আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড Thy Hand, Great Anarch!'এর My Faith in Empires অধ্যায়টি পড়লেই বোঝা যায়) এবং হয়তো সেই মোহাবেশই তাঁকে এই ভাবনায় ভাবিত করেছে। 

হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি সম্পর্কে নীরদ চৌধুরী একটি স্বতন্ত্র মনোভাব পোষণ করতেন। তিনি বলেছেন, এই শ্রেণির অস্থিরতার কারণ যে কোনও সামাজিক পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মানসিকতা ও বিভিন্ন সমাজাচারকে নিজেদের মধ্যে সুসংহত করার অভ্যেস। ভারতে মুসলমান শাসনকালে হিন্দু মধ্যবিত্তরা মুসলমানি পোশাক পরেছে, ফারসি শিখেছে, শাসনযন্ত্রে অংশ নিয়েছে এবং শাসকশ্রেণিকে অনুকরণ করে সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জনের চেষ্টা করেছে; কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই তাদের একটা স্বার্থ ছিল। সেই শাসনকাল যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, সমাজ ও কালের নিয়মেই এই মানসিকতাও দূর হয়ে গিয়েছে। মধ্যযুগীয় গণসংস্কৃতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, সে’ সময়কার অস্থির পরিবেশে হিন্দু ও মুসলমান সমাজ অপেক্ষা উভয়ের সংমিশ্রণে তৈরি সমাজই ছিল অধিকতর স্থিতিশীল, কারণ, এই সমাজ-বিনির্মাণের মধ্যে একটা ঐক্যস্থাপনের প্রয়াস ছিল। তবে উভয় ধর্মের সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করে এরপর তিনি দু’য়ের মধ্যে সাদৃশ্যগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। উভয়ের সংমিশ্রণে জাত সংস্কৃতির প্রতি কীভাবে সাধারণের মনে এক শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছিল, সে’ সম্পর্কেও একটি মনোজ্ঞ আলোচনা তিনি করেছেন। 

ইংরেজ সাম্রাজ্যকালে ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাগুলি ইংরেজি ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কীভাবে তাদের syntax পুনর্গঠিত হয়েছে, তার সম্পর্কেও কয়েকটি কথা নীরদবাবু বলেছেন। এটা উল্লেখ্য যে, ইতিহাসের সামগ্রিক আলোচনার ক্ষেত্রে ভাষার উপর তিনি বেশ অনেকটা গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দৈর্ঘ্যের সীমার কারণে তার প্রতিটির কথা আমরা হয়তো বলতে পারব না। তবে এটা বলতেই হবে যে, আধুনিক ভারতীয় সংস্কৃতির প্রামাণ্য হিসেবে তিনি দেখেছেন আধুনিক ভারতীয় ভাষাকে, যা উৎপন্ন হয়েছে ইংরেজি ভাষার প্রভাবে, লেখ্য আঞ্চলিক ভাষা ও বিবিধ কথ্য ভাষার সংমিশ্রণে। দেশীয় সাহিত্যে গদ্যের প্রথম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ব্রিটিশরাজকেই তিনি যাবতীয় কৃতিত্ব দিয়েছেন। 

নীরদবাবুর দাবি, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যাঁদের আমরা নবজাগরণের পথিকৃৎ বলে জানি এবং মানি, প্রতীচ্যে উপযুক্ত সম্মান না পেলে আমরা দেশবাসী তাঁদের প্রতি এই সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম না। সপক্ষ সমর্থনে তিনি বিবেকানন্দের একটি কথাকে উদ্ধৃত করেছেন, 'I travelled twelve years all over India, finding no way to work for my countrymen, and that was why I went to America'; রামমোহন,  রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁর অভিমত। তিনি আরও বলেছেন, বঙ্কিমবাবু যে এনাদের তুলনায় সমোচ্চতায় বিচার্য হন না, তার প্রধান কারণ, পাশ্চাত্যবাসীর কাছে তিনি অতটাও ‘recognition’ পাননি। রামমোহন রায় সম্পর্কে Jacquemont'এর একটি বক্তব্য তিনি উদ্ধৃত করেছেন, 'He has known this pain of isolation. He has grown in a region of ideas and feelings which is higher than the world in which his countrymen live'- নীরদবাবুর কথায় যুক্তি বা সত্য যাই থাক না কেন, রামমোহন সম্বন্ধে এ কথা যে কতখানি সত্য তা পাঠক নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন। প্রবন্ধের শেষের দিকে এসে নীরদ চৌধুরী লিখেছেন, '…[I]n the course of history the internal proletariat of India is being perpetually reinforced by the same foreign motive power which is keeping the country within the orbit of civilization.'

তিনি বলছেন যে এর সঙ্গে সঙ্গে এই ইন্টারনাল প্রলেটারিয়েত শ্রেণির মধ্যে একটি দ্বিস্তরীয় পরিবর্তন ঘটে যায়। প্রথমত, শ্রেণির মধ্যে আসে অধিক বিষমত্ব; আর দ্বিতীয়ত, ইতিহাসের প্রতিটি যুগেই এই শ্রেণির মধ্যে যারা নতুন আর পুরনো সংস্কৃতির বাহক ও লালনকর্তা, তাদের অনুপাতটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। ভারতেতিহাসের একটা সুবৃহৎ অংশই, তাঁর মতে, নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এই শ্রেণির দ্বারা। সব শেষে ইতিহাসের বর্ণনা প্রসঙ্গে খুব সুন্দরভাবে তিনি নিয়ে এসেছেন ভারতের বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূগোলের কথা। 

এই গোটা প্রবন্ধটিতে নিঃসন্দেহে নীরদবাবুর অসামান্য পাণ্ডিত্যের প্রতিফলন ঘটেছে, কিন্তু The Guardian যে জানাচ্ছে, 'For a writer who showed so strong a distaste for the 'indiscipline' of the Indians’ lives, Chaudhuri was himself undisciplined in the structure of his books, though an elegant writer in detail.'- তা এই প্রবন্ধটির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বেশ কিছু স্থানে আলোচনায় কিছু পুনরুক্তি এসেছে, এসেছে আত্মম্ভরিতা, কোনও বিষয়ের প্রয়োজনের তুলনায় দীর্ঘ আলোচনা রচনাকে ভারাক্রান্ত করেছে। অবশ্য এটাও ঠিক যে, যেখানে যেখানে তিনি সাধারণ ভাবনার বিপ্রতীপে গিয়ে একটি স্বতন্ত্র অবস্থান নিয়েছেন, সেখানেই এই আত্মপক্ষ সমর্থনে বিস্তার করা যুক্তিজাল একটু দীর্ঘ হয়েছে। 

ইতিহাসকে নীরদ চৌধুরী দেখেছেন কতকটা ‘magisterial’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। একটা উচ্চ শাসনবেদীতে বসে তিনি যেন আপনার চাইতে নিকৃষ্ট সকলের যাবতীয় কার্যকলাপ, তাদের জীবনচর্যা আর যাপনকে কিছুটা করুণার, কিছুটা ভ্রূকুটিত আর কিছুটা ক্ষমার চোখে দেখেছেন। অনেক জায়গাতেই তিনি যা লিখেছেন, তাঁর জীবনের কথা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে তিনি আদৌ তা করেননি, বরং নিজের আদর্শের একেবারে বিপরীতে গিয়ে যা করাকে তিনি ঘৃণার চোখে দেখেছেন, তাই-ই করেছেন। কিন্তু কেন এই স্ববিরোধ? ডঃ রাধা নাগ তাঁর ‘আত্মঘাতী নীরদ চৌধুরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, 'মনোবিজ্ঞানীরা নীরদবাবুর ন্যায় এই ধরনের ব্যক্তিত্বের নাম দিয়াছেন- Narcissistic personality'; মনোরোগবিদ ডঃ ধীরেন্দ্রনাথ নন্দীর মতে, সব বিষয়েই এরা নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, অপরের সাফল্যকে এরা ঈর্ষান্বিত চোখেই দেখে। নীরদবাবুর আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হওয়ার পরে তিনি বলেছিলেন, 'উহা প্রকাশের পরই বিলাতে যেভাবে প্রশংসিত হইয়াছিল ও যেভাবে আলোচিত হইয়াছিল, তাহা ইহার পূর্বে কোনও ভারতীয়ের লেখা ইংরাজি বইয়ের বেলাতে দেখা যায় নাই, এমনকি জবাহরলাল নেহরুর আত্মজীবনীর জন্যেও নয়।' ইংরেজি লেখার গুণগত মানের বিচারে পণ্ডিতজী না নীরদবাবু- কার লেখা অধিক প্রশংসনীয়, সে প্রশ্নটুকু বাদ রেখেও বলা চলে, এই যে আত্মদর্প, আপনাকে সকলের চাইতে উপরে প্রতিষ্ঠিত দেখাবার এই যে উদগ্র বাসনা, তা তাঁর লেখাকেই কালিমালিপ্ত করেছে। তাই The New York Review of Books'এ Ian Buruma যখন লেখেন, 'Anyone who wishes to understand what has happened in India in the twentieth century politically and culturally must read Nirad C. Chaudhury.', আমরা তার সাথে সহমত হতে পারি না। নীরদ চৌধুরীর ভারতেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিকে তাই ব্যতিক্রমী বলেই শিরোধার্য হিসেবে গ্রহণ করা চলে না।

এটা অনস্বীকার্য যে, আপন বক্তব্যের সারকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি যথেষ্ট দায়িত্বশীলই হয়েছেন; কিন্তু তাঁর যুক্তিজালের মধ্যে থেকে যেগুলি সত্যই পক্ষপাতদুষ্ট নয়, সেগুলিকে আমাদের খুঁজে নিতে হবে। ‘আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ’, ‘বাঙালি জীবনে রমণী’, ‘আমার দেবোত্তর সম্পত্তি’ প্রভৃতি গ্রন্থে যে দ্বিচারিতা তিনি দেখিয়েছেন, তাতে অক্সফোর্ডের ডিলিট, সাহিত্য অকাদেমি, ডাফ কুপার স্মৃতি পুরস্কার কিংবা দেশিকোত্তম কোনওটিরই প্রতি সুবিচার তিনি করেননি। ডঃ রাধা নাথের কথায়, ব্যক্তি নীরদ আর লেখক নীরদের যে দ্বন্দ্ব আজীবন তাঁর লেখাকে কতকটা নিম্নগামী করে গেল, সেই দ্বন্দ্বটুকুকে মাথায় রেখেও ভারতের ইতিহাস, তার সমাজ, তার আবহমানকালীন সংস্কৃতি সম্পর্কে যে অতলান্ত প্রজ্ঞার নিদর্শন তিনি স্থলে স্থলে রেখে গিয়েছেন, তা যেন আমরা অস্মৃত না হই।


Friday, 3 December 2021

সঞ্জয় মজুমদার

সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা এক মানুষ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এমন একটা কিছু লিখতে হতে পারে, তা তো কখনও ভাবিনি। তাই দিনকতক কিছুটা স্তব্ধ হয়ে থাকা!

দিনান্তে সমস্ত কাজ অবসানে মানুষ যেমন ঘরে ফিরে আসে, সঞ্জয় সেভাবে আর ঘরে ফেরেনি। হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও সে তার ভাবনাকে জারি রেখেছিল। আমরা অনেকে ধরতেই পারিনি, স্মার্ট ফোনের আঙ্গুলে যখন সে অবিরাম শব্দ খোদাই করে চলেছে, তখন তার ফুসফুস ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে জীবন-সায়াহ্নের অভিমুখে। তবুও সে অদম্য। চলে যাওয়ার একদিন আগেও সে তার নিকটজন সকলকে রোজকার মতো হোয়াটস অ্যাপে খবরের কাগজের পিডিএফ সংস্করণগুলো পাঠিয়েছে। যেন কিছুক্ষণের জন্যও সে মারণরোগের স্পর্ধাকে বরদাস্ত করতে রাজী নয়।

আমার সঙ্গে তার আলাপ তো চার-পাঁচ বছরের বেশি নয়! বইমেলায় ‘একক মাত্রা’র ছোট টেবিলে যখন পাঠকের হুমড়ি খেয়ে পড়া ভীড়, তখন ঠিক তার পিছনেই তার মুখটি প্রথম দেখেছিলাম। কিছু বলতে চাইছে, ভীড় ঠেলে পত্রিকাগুলোর কাছে আসতে চাইছে। আর সেই থেকেই আলাপ। সেই আলাপ গড়ায় খানিক বন্ধুত্বে ও তার একক মাত্রা’য় যোগদানে।

শুধুমাত্র কর্মঠ বললে খুবই কম বলা হয়। প্রখর, বুদ্ধিদীপ্ত এক মানুষ, বাঙালির গৎ-বাঁধা চিন্তা থেকে বহু যোজন এগিয়ে। কর্মসূত্রে একাডেমিক জগতের মানুষ হয়েও একেবারেই ‘সবজান্তা’, ‘নিজেকে জাহির করা’ ব্যক্তি নয়। তার প্রতিটি লেখার মধ্যেই ছিল এক অনাবিল খোঁজ ও সংস্কার-মুক্ত অন্বেষণ (এই ব্লগে সঞ্জয়ের অনেকগুলো লেখা আছে, অবশ্যই পড়ে নেবেন)। শুনেছি, তার একটি গ্রন্থ প্রকাশের পথে, যা না দেখেই তার চিরবিদায়।

সকলেই জানেন, ‘একক মাত্রা’র কাজ মানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ। এখানে বাবুয়ানার কোনও জায়গা নেই। যিনি লিখছেন, পত্রিকা বানাচ্ছেন, তিনিই আবার ঘাড়ে করে পত্রিকার কপি নিয়ে জেলার মেলায় যাচ্ছেন, কিংবা ঘুরে ঘুরে গ্রাহক সংগ্রহ করছেন। ‘একক মাত্রা’য় যুক্ত হয়ে সঞ্জয় এইসব কাজে নির্দ্বিধায় ও অনায়াসে হাত পাকিয়ে নিয়েছিল। একাডেমিক অচলায়তন ও মূঢ়তা ভেঙ্গে তার কর্মক্ষেত্র (যেখানে সঞ্জয় পড়াত) মুরলীধর গার্লস কলেজে ‘একক মাত্রা’র দু’ দুটি অনুষ্ঠান করা গিয়েছিল মূলত তার সৃজনশীল উদ্যোগ ও সহকর্মীদের অদম্য উৎসাহে। শুধুমাত্র তাই নয়, আধুনিক প্রযুক্তিতে সড়গড় সঞ্জয় কোভিড-সময়ে অনলাইন সেমিনারেরও আয়োজন করে (তখনও এইসব ব্যবস্থাদির তত চল হয়নি) সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

আরও বহু কথা বলার আছে। কিন্তু অনুজ কেউ যখন এভাবে হঠাৎ করে চলে যায় (২৯ নভেম্বর ২০২১), তখন কথাগুলোও কেমন জানি গলার কাছে এসে আটকে যায়। এ হেন জনপ্রিয় ও ছাত্রদরদী শিক্ষক এবং অন্বেষক মানুষ তো আজকাল বিরল, তাই আচম্বিতে সঞ্জয়কে হারানোর শোক এই মুহূর্তে অকল্পনীয় এখনও। জীবনে কোনও কোনও মানুষের সরব-নীরব উপস্থিতির তো কোনও সীমানা হয় না!