Pages

Sunday, 26 December 2021

দেশের সমস্ত নাগরিক যখন সন্দেহভাজন

ধর ধর! ওই চোর, ওই চোর!

প্রবুদ্ধ বাগচী


নভেম্বর মাস পেরিয়ে গেছে। নভেম্বর মানে বিপ্লবের মাস। নভেম্বর মানে রেড স্কোয়ার আর দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন। আবার নভেম্বর মানে জীবনানন্দের প্রিয় হেমন্তকাল। ‘হেমন্ত এসেছে আজ পৃথিবীর বনে/ তাহাদেরও ঢের আগে আমাদের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু।’ যদি জীবনানন্দের এই প্রত্যয়কে আক্ষরিক অর্থে না-ও নিই তবু নভেম্বর মানে আরেকটা পর্ব। রাজ্য ও কেন্দ্রের সরকারের আওতায় যত পেনশনভোগী আছেন, এই নভেম্বরের মধ্যেই তাঁদের জীবিত থাকার প্রমাণপত্র সরকারি দফতরে জমা দিতে হয়। না হলেই বিপদ, তাঁদের পেনশন বন্ধ হয়ে যাবে। বুড়ো মানুষরা এই নিয়ে বড় চিন্তায় থাকেন আজকাল। নভেম্বর পড়তে না পড়তেই ব্যাঙ্কের দোরগোড়ায় লাইনে দাঁড়িয়ে পড়া, এদিক ওদিক উদ্বেগ ভরে তাকানো এবং অধস্তন ব্যাঙ্ক কর্মচারীদের মুখঝামটা খাওয়া- তবু তাঁরা নিরুপায়। পেনশন মানে তাঁদের ভাতের থালা। 

আমাদের দেশে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১ এপ্রিল ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয়েছিল বলে এই দেশে আর্থিক বছর শুরু হয় ওইদিন থেকে। কিন্তু ক্যালেন্ডার বর্ষ হিসেব করে ডিসেম্বরের বদলে কেন এই নভেম্বরেই বেঁচে থাকার জন্য ‘বেঁচে আছি’ চিরকুট সরকারের জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে আসতে হয় তার কোনও ব্যাখ্যা গুগল বিশ্বকোষেও পাওয়া যায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা খুব ঝামেলার, অন্তত গত প্রায় সাত/আট বছরে এই ব্যবস্থাটা ক্রমশই একটা আতঙ্কের মতো চেপে বসছে সিনিয়র সিটিজেনদের বুকের ওপর। অথচ বলা হচ্ছে, এই জীবন প্রমাণ দাখিলের পদ্ধতি নাকি সরলায়িত হয়েছে। আদপে ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। কারণ, অনেকের কাছে প্রযুক্তি মানে সব কিছু ‘স্যাটাস্যাট’ হয়ে যাওয়া মনে হলেও সকলের কাছে বিষয়টা ‘এমনি এমনিই খাই’এর মতো এত অনায়াস নয়। 

আসলে গত সাত-আট বছরে সরকারি প্রতিটি ক্ষেত্রে একটা বীজমন্ত্র তৈরি করা হয়েছে যে সরকারি সুবিধা পাওয়া নানা প্রকল্পের যারা উপভোক্তা তাঁরা অনেকেই নাকি প্রকৃত প্রাপক নন। আর তাই প্রযুক্তির বকলেস-বাঁধা স্নিফার ডগ লেলিয়ে দিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে কারা আসলি কারা নকলি। আসল-নকলের দ্বন্দ্ব যে নেই তা নয় । কারণ, আমাদের রাজনীতির মূল বুননে ‘পাইয়ে দেওয়া’র একটা স্পষ্ট পরিসর আছে। রাজনীতি যারা যে দলেরই করুন না কেন, নিজেদের সমর্থকদের কিছু একটা পাইয়ে না দিলে ভোটের চাকা ঘোরে না। আজ যারা কেন্দ্রের সরকারের চালক হয়ে বসেছেন, তাঁরাও ভোটে জিতেই এসেছেন আর তাই ব্যবহারিক রাজনীতির জায়গায় তাঁরা ধোয়া তুলসিপাতা এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ক্ষমতায় এসেই দেশের সব নাগরিককে ‘চোর’ ঠাওরানো আসলে একটা ‘মহান’ দ্বিচারিতা- চৌকিদারকে চোর ধরে দেখাতে হয়, চোর চোর বলে চিৎকার করলে হয় না। সমস্যার কথা, এ ক্ষেত্রে চিৎকার শুধু নয়, গোটা দেশের নাগরিকের জীবনযন্ত্রণা বাড়িয়ে দেওয়ায় আগুয়ান ভূমিকা নিয়ে খলনায়কের ভূমিকায় প্রযুক্তি। প্রযুক্তি তো আর নিজে নিজে হাঁটতে পারে না, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় নিজেদের মতাদর্শ মতো- ‘নাচে কারা? তারা তারা !’ 

সদ্য যখন গ্যাসের ভর্তুকির  জন্য এলপিজি গ্রাহকের সঙ্গে তাঁর মোবাইল নম্বর জোড়ার কাজ আরম্ভ হয়েছিল, তখন দেখা হয়েছিল বিবর্ণ মলিনা এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে, কলকাতায় ইন্ডিয়ান অয়েল কোম্পানির ঝাঁ-চকচকে সদর দফতরে। সেখানে লিফটের গায়ে নম্বর লেখা ইংরেজিতে, আধিকারিকদের নামের বোর্ড হিন্দি বা ইংরেজিতে। এই মহিলা নিতান্তই স্বল্পশিক্ষিতা, সম্ভবত রান্নার কাজ করেন, এমনকি তাঁর নিজের একটা মোবাইল অবধি নেই- ওই চকচকে বাড়িতে তিনি উদ্ভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কী করবেন? কোথায় যাবেন? নিরাপত্তারক্ষী অবধি তাঁকে ধমকচমক করছেন। অথচ গ্যাসের ভর্তুকি এঁরই দরকার সবচেয়ে বেশি। আর ইনিই জানেন না কীভাবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে আধার কার্ড, ব্যাঙ্ক আকাউন্ট, মোবাইল নম্বর সব এক সরলরেখায় আনলে পরে তবে তাঁর কিছু সাশ্রয় হতে পারে। এবং ভর্তুকি পাওয়ার অন্যতম শর্ত হয়ে উঠল নিজের একটি মোবাইল থাকা! সম্পন্নতর কেউ কেউ ভর্তুকিতে গ্যাস পাচ্ছেন বলে এই দরিদ্র মহিলাকে সরকারি অফিসের দরজায় দরজায় যদি ঘুরে বেড়াতে হয় তবে প্রযুক্তি তাঁর কাছে দুঃস্বপ্নের এক ভুলভুলাইয়া। একে সংবেদনশীলতা বলে না। 

মানছি, সরকারি পেনশনভোগীরা এমন দরিদ্র নন। কিন্তু তাই বা বলি কী করে? সরকারি অফিসে কাজ করার বাইরেও দরিদ্র বিধবারা, সহায়হীন বৃদ্ধারা বা বিশেষ ভাবে সক্ষম নাগরিকরাও পেনশন ভাতা পান। জীবনের প্রমাণপত্র তাদেরও দাখিল করতে হয়। কিন্তু সরকারের প্রত্যক্ষ পেনশনভোগীদের দায়টা আরও বেশি, কারণ তাঁদের পেনশনের পরিমাণ তুলনায় বেশি। এটা ঠিক, কিছু অসাধু পরিবার আছেন যারা তাঁদের পরিবারের পেনশন প্রাপকের মৃত্যু হলে সময়মতো জানান না। এতে সরকারি অর্থের অপব্যয় হয়। যদিও দেশে সরকারি অর্থের অপব্যয়ের যে ব্যাপ্ত চিত্র তার মধ্যে এটা নিতান্তই একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। আর সেই গুটি কয়েকের জন্য সমস্ত পেনশনভোগীদের যে যন্ত্রণা ও উদ্বেগ তা তুলনীয় নয়।

উদ্বেগ কেন? গত কয়েক বছরে মূলত এই কাজ করা হচ্ছে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে। হয় মোবাইল ফোনের কোনও অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপস) ব্যবহার করে নয়তো সরাসরি ব্যাঙ্কে গিয়ে বায়োমেট্রিক মেশিনে। বাইরে থেকে করিয়ে আনলে তার জন্য পেনশনারদের সাহায্য লাগছে বাইরের কোনও এজেন্সির, তাঁদের একটা মোটা টাকা দিতে হচ্ছে। যে সব শারীরিকভাবে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বাইরে থেকে করিয়ে আনতে পারবেন না, ডাক্তার ডাকার মতো এজেন্সির লোককে ডাকতে হচ্ছে বাড়িতে; দক্ষিণা বেড়ে যাচ্ছে। 

এর পরেও আছে সংশয়। বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে বায়োমেট্রির ছাপ মেলা বেশ সমস্যার কথা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেলে না, কারণ, তাঁদের আঙুলের চামড়ার রেখা মসৃণ হয়ে যায়, অনেক সময় আঙুল বেঁকে থাকে। তবু তাঁদের নিয়ে টানাহেঁচড়ার অন্ত নেই। কারণ, ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ থেকে সরকারি দফতর, প্রত্যেকেরই মগজে এই জপমালা যে প্রতিটি পেনশনারই ভুয়ো- কাজেই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা লাউঞ্জের মতো তাঁদের আপাদমস্তক সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে তল্লাশি করাই বিধেয়। ঘটনাটা যে প্রায় তেমনই, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 

এটা ঠিক, ২০১৪ সালে এইসব নতুন নিয়মকানুন চালু হওয়ার পরেই গোটা দেশ জুড়ে সমস্যা দেখা দেয়। ফলে, বছর দুয়েক বাদে কেন্দ্রীয় সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করে বলে, পেনশনাররা প্রযুক্তির অসুবিধের কারণে লাইফ সার্টিফিকেট দিতে না পারলে তাঁদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু কথাটা বলা সহজ, কাজে করে দেখানো অতটা সরল নয়। ব্যাঙ্কগুলিতে কর্মচারীর যে আকাল তাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জীবিত পেনশনারদের খুঁজে তাঁদের পেনশন চালু রাখা প্রায় অসম্ভব। আর মানসিকতার ছাপটাও তো বিবেচনায় রাখতে হবে। যারা নিয়ম করছেন তাঁরাই চাপে পড়ে নিয়ম শিথিল করছেন। এর মধ্যে একটা চাপে পড়ে ঢোক গেলার ব্যাপার আছে। 

তাছাড়া আবারও বলি, এটা ভাবনার অভিমুখের ব্যাপার। আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করার সময় সরকার যেভাবে সেটাকে ‘আর্থিক বিল’এর মর্যাদা দিয়ে কোনও বিতর্ক ছাড়া সংসদে পাশ করিয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল গোটা দেশের সকলেই সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি, ‘আধার কার্ড’এর বেড়া তুলে সরকার তাঁদের ছেঁকে বার করে নেবে। পরবর্তীকালে, নোটবন্দি'র সময়েও প্রায় একই যুক্তি দেওয়া হয়েছিল। মানে, বারবারই সরকার মনে করছে দেশশুদ্ধ লোক ‘দেশদ্রোহী’ হয়ে উঠেছে- যেন তেন প্রকারেণ তাঁদের ঢিট করা দরকার। তাহলে এই তালিকায় পেনশনার 'বুড়ো-বুড়ি'রাই বা বাদ যাবেন কেন? তারা ভুয়ো পেনশন তুলে জঙ্গি গোষ্ঠীর জন্য টাকা জোগাচ্ছে কিনা কে জানে!

একটু খেয়াল না করে উপায় নেই, সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা এজেন্সির সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করেছেন, নিরাপত্তার প্রশ্নে দেশের নাগরিকদের দিকে নাকি তাঁদের নজরদারি করা দরকার। আর এই উচ্চারণের এক মাসের মধ্যেই রব উঠেছে আধার ও ভোটার কার্ড যোগ করার- সংসদে সদ্য সেই বিল দ্রুত পাশ হয়ে গেল। আসলে স্বীকার করি বা না-করি, কেন্দ্রীয় সরকারের চেতনার অভিমুখ নাগরিক অধিকারের বিরোধী। স্বীকৃত নাগরিকের ভোটে জিতে নাগরিকত্বের বৈধতা নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা যায়, আইন করা যায়। প্রতিটি নাগরিককে সন্দেহ করা যায় ভুয়ো অথবা ভুয়ো উপভোক্তা বলে- সোজা কথায় ‘চোর’ বলে। এই আবহেই বিচার করা দরকার পেনশনভোগীদের নিয়ে এই ছেলেখেলার রীতিকে। গুরুদেবের ভাষায় একেই বোধহয় বলা হয় ‘ধর! ধর! ওই চোর! ওই চোর!’ হায়, কোন চোরকে কে ধরে! কার মায়ের গলা যেন উঁচু স্বরে বেজে ওঠে? 

এখনও ডিসেম্বর ফুরোয়নি। এই মাসের পেনশন ঢুকবে তো তাঁদের আকাউন্টে? সেই থরো থরো আশঙ্কায় শীতরাত্রির প্রহর কাটছে তাঁদের। এরাও আমার দেশের নাগরিক। 


No comments:

Post a Comment