পদার্থবিদ্যার নতুন বলের খোঁজ!
শোভনলাল চক্রবর্তী
আইনস্টাইন মানতেন যে মহাবিশ্বের জন্ম বলে কিছু নেই। মহাবিশ্ব নিশ্চল ও স্থবির। কিন্তু নিয়তির এমন পরিহাস যে তাঁর নিজের হাতে তৈরি তত্ত্ব ও আবিষ্কার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ প্রমাণ করে ছাড়ল যে মহাবিশ্ব স্থির নয় বরং অস্থির। সত্যিই মহাবিশ্বের এক নীহারিকাপুঞ্জ, আইজাক নিউটন আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ অনুযায়ী, অন্য নীহারিকাপুঞ্জকে আকর্ষণ করছে। এর পরিণাম স্বরূপ মহাবিশ্ব আয়তনে সঙ্কুচিত হয়ে যাওয়ার কথা। এই সব বুঝে শুনে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের কিছু পরিবর্তন ঘটান। তাঁর সূত্রে আমদানি করেন একটি নতুন জিনিস- একটি বল, যেটা কাজ করছে মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে। আইনস্টাইন এর নাম দেন কসমোলজিক্যাল কনস্টান্ট বা মহাজাগতিক ধ্রুবক। নীহারিকাপুঞ্জের মধ্যে আকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে ক্রিয়াশীল ওই বলের প্রভাবে মহাবিশ্ব সঙ্কুচিত হবে না, এই ছিল আইনস্টাইনের বিশ্বাস। সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সূত্রে এই গোঁজামিল হিসেবে মহাজাগতিক ধ্রুবক আইনস্টাইন আমদানি করেন ১৯১৭ সালে। এক দশক কালের মধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করে বসেন যে মাধ্যাকর্ষণকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মহাবিশ্ব দিব্বি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে- বেলুন ফোলালে বেলুনের তলটা যেমন প্রসারণশীল হয় তেমন ভাবে। অবশেষে আইনস্টাইন স্বীকার করে নেন যে মহাজাগতিক ধ্রুবক তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
এখন প্রশ্ন হল, মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে মহাবিশ্ব কতকাল ধরে প্রসারিত হবে? মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে কি মহাবিশ্বের প্রসারণের হার বিন্দুমাত্র কমবে না? ১৯৮০-র দশকের শেষে দুই দল জ্যোতির্বিজ্ঞানী এই দুটি প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে আদাজল খেয়ে লেগে পড়েন। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁরা উপনীত হলেন এমন এক সিদ্ধান্তে যার জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁদের পরীক্ষায় দেখা যায়, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার কমছে তো নাই'ই উল্টে তা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এই আবিষ্কারের জন্য ২০১১ সালে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন ওই পরীক্ষার নেতৃস্থানীয় তিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। জ্যোতির্বিজ্ঞানী মহলে এই আবিষ্কার অপার বিস্ময়ের উদ্রেক করে, কারণ, এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের ধারণাটি ভুল নয়, বরং সর্বৈব সত্য বা সোজা কথায় ঠিক। কিন্তু কী কারণে এই ধ্রুবক বিদ্যমান, এখনও তার হদিস মেলেনি।
মহাজাগতিক ধ্রুবকের উৎসে কী আছে, তা বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের এক বড় ধাঁধাঁ। সেই রহস্য আরও বেড়েছে সাম্প্রতিক একটি আবিষ্কারে। চিলির আটাকামা মানমন্দিরে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন যে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি-মুহূর্তে একটি নয়, দুটি মহাজাগতিক ধ্রুবক উপস্থিত ছিল। একটির উপস্থিতির কারণ যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তখন দ্বিতীয়টির উপস্থিতি বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। এর মধ্যে আশার কথা এই যে, দ্বিতীয় মহাজাগতিক ধ্রুবকের আবিষ্কার জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্য একটি ধাঁধার সমাধান করেছে।
মহাবিশ্বের প্রসারণের বেগ একটি বড় প্রহেলিকা। নানা উপায়ে এই বেগ নির্ধারণ করা হয়। বিভিন্ন উপায়ে নির্ণীত এই বেগের মান নানারকম বের হয়। অথচ মহাবিশ্ব কী হারে প্রসারিত হচ্ছে তার একটাই মান পাওয়া উচিত। অনেক অনুসন্ধান করেও বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা পদ্ধতির কোনও ত্রুটি খুঁজে পাননি। স্বভাবতই তাঁরা ধন্দে ছিলেন। এখন বোঝা যাচ্ছে যে দুই মহাজাগতিক ধ্রুবকের কারণেই এমনটা হচ্ছে। সুতরাং, একটা ধন্দের নিরসন হল। কিন্তু এই দ্বিতীয় মহাজাগতিক ধ্রুবক ঠিক কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে মহাবিশ্বের প্রসারণের বেগ? এ ব্যাপারে কোনও হাতে গরম তথ্য নেই। বিজ্ঞানীদের মধ্যে যাঁরা প্রাচীনপন্থী তাঁরা বলছেন, প্রথম মহাজাগতিক ধ্রুবকের অস্তিত্বই এক প্রহেলিকা, তার মধ্যে এই দ্বিতীয় মহাজাগতিক ধ্রুবকের অস্তিত্ব গোটা ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলল। কিন্তু বিজ্ঞানের তরুণ তুর্কিরা বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানে একটি নতুন বলের প্রয়োজনের কথা বলে আসছেন। কিছুদিন আগেই আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল জ্যোতির্বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেছিলেন এমন একটি নীহারিকাপুঞ্জ যেখানে কোনও ডার্ক ম্যাটার বা কৃষ্ণবস্তু নেই। মহাবিশ্বের মোট ভরের বেশির ভাগটাই অধিকার করে আছে এই ডার্ক ম্যাটার। প্রত্যেক নীহারিকার আপাত ভরের চেয়ে প্রকৃত ভর অনেক বেশি। কত বেশি? সেটাই ওই নীহারিকাতে উপস্থিত ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ। এই ডার্ক ম্যাটার তৈরি হয়েছে আমাদের পরিচিত ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ছাড়া অন্য কণা দিয়ে। এই ডার্ক ম্যাটারের দোসর হল ডার্ক এনার্জি।
এতদিনের চেনা তত্ত্ব ছিল এই যে, ওই ডার্ক এনার্জিই সাহায্য করছে বিশ্বের প্রসারণের হারকে বাড়াতে। এবার যদি আমরা পরপর দুটি নতুন পর্যবেক্ষণকে পাশাপাশি রাখি তবে দেখব, একটিতে দেখা যাচ্ছে ডার্ক ম্যাটার নেই অথচ নীহারিকাপুঞ্জ আছে, তার মানে কণা তত্ত্বে আসতে পারে নতুন ধারণা। আবার সৃষ্টি-মুহূর্তে দুটি মহাজাগতিক ধ্রুবকের অস্তিত্বের অর্থ দুটি বল সৃষ্টি মুহূর্তে একত্রে ছিল। সে ক্ষেত্রে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে নতুন তত্ত্ব মডিফায়েড গ্র্যাভিটির (পরিবর্তিত মহাকর্ষ) দিকে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি নতুন বল বা পদার্থবিদ্যার যে চারটি পরিচিত বল- স্ট্রং ফোর্স, উইক ফোর্স, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স, গ্রাভিটেশন ফোর্স (মহাকর্ষ বল)- এরপর একটি পঞ্চম বল দিয়ে নিউটনের মহাকর্ষের আকর্ষণ বলকে সংশোধিত করতে হবে। একদল বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই গাণিতিক প্রমাণ সহযোগে দাবি করে আসছেন যে নিউটনের মহাকর্ষ বলের ফর্মুলায় অদলবদল ঘটালে ডার্ক ম্যাটারের সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তারপর এখন দুটি মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের পর্যবেক্ষণ পঞ্চম বলের দাবিকে আরও জোরদার করল, সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানের যে কোনও নতুন অবদান মানবসভ্যতাকে অনেকটা এগিয়ে দেয়। চোখের সামনে খুলে দেয় এক নতুন দিগন্ত। অল্প সময়ের ব্যবধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ পঞ্চম বলের দিকে এক জোরালো সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়েছে। এটুকু অন্তত বোঝা যাচ্ছে যে, অচিরেই একটি পঞ্চম বল পদার্থবিদ্যায় যুক্ত হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
No comments:
Post a Comment