Pages

Thursday, 2 September 2021

ইতিহাস ধ্বংসের আয়োজন

জালিয়ানওয়ালাবাগ থেকে সবরমতি আশ্রম

শোভনলাল চক্রবর্তী


সরু গলিপথ দিয়ে সেদিন শুধু ব্রিটিশ সেনার বুটের শব্দ। জেনারেল ডায়ারের সেনারা সেদিন ওই পথ ধরেই মার্চ করে ঢুকেছিল জালিয়ানওয়ালাবাগে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠেছিল তাদের রাইফেল, হাজার হাজার মানুষের রক্তে সেদিন লাল হয়ে গিয়েছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ। অপরিসর সে গলিপথ দিয়ে পালানোর সুযোগ পায়নি হতভাগ্য মানুষগুলো। জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার শতবর্ষ কেটে যাওয়ার পরও সেই গলিপথ ছিল একইরকম। ইতিহাস বিজড়িত সেই অপরিসর রাস্তাটুকুই যেন সেদিনের নারকীয় হত্যালীলার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। 

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্বোধন করা জালিয়ানওয়ালাবাগের নতুন কমপ্লেক্সে কোথায় সেই নানকশাহি ইটে বানানো অপরিসর গলিপথ? তার জায়গায় বসেছে ম্যুরাল শোভিত গ্যালারি! আধো-অন্ধকার গলিপথ এখন ঝাঁ-চকচকে রাস্তা। গলিপথের মাথা ঢেকেছে আচ্ছাদনে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইতিহাসকে সুরক্ষিত করতেই নাকি এই ভোলবদল। কিন্তু থিম পার্ক, লেজার লাইট, ম্যুরাল গ্যালারিতে সজ্জিত এই 'নয়া' জালিয়ানওয়ালাবাগ- এটা ইতিহাসকে সুরক্ষিত করা নাকি ধ্বংসের চেষ্টা? ঐতিহাসিক সৌধের কর্পোরেট লুক দিলে আধুনিক স্থাপত্য তৈরি হয় বটে, কিন্তু হারিয়ে যায় ঐতিহ্য। আসলে, সুকৌশলে ১৯১৯-এর সেই ভয়াবহ গণহত্যার যেটুকু চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল, তা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হল। স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আরএসএস-বিজেপি'র এই হল দৃষ্টিকোণ। জনতাকে সব ভুলিয়ে দাও, তারপর নতুন করে শুরু হবে স্বাধীনতার বিনির্মাণ। ইতিহাস বইয়ে যে স্থানটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে, সেই স্থানটাকেই আজ ইতিহাস করে দেওয়া হল। এরপর ওই বর্ণনা মুছে দেওয়া হবে ইতিহাসের পাতা থেকে। 


এই বিনির্মাণ পদ্ধতি শুরু হয়েছে, কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস-বিজেপির কোনও অবদান নেই; উল্টে তাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে সঙ্গ দিয়েছিল ব্রিটিশদের। প্রসঙ্গত, গত ১০২ বছরে বেশ কয়েকবার জালিয়ানওয়ালাবাগের ছোটখাটো সংস্কার হলেও, সংকীর্ণ এই গলিপথ বা দেওয়ালে গুলির দাগ- গণহত্যার এই জ্বলন্ত চিহ্নগুলি বিন্দুমাত্র বদলানো হয়নি। এই বিপর্যয় তারাই ঘটাতে পারে, যারা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে অজ্ঞ। যে প্রধানমন্ত্রী মুখে বলছেন, অতীতের ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে যাওয়া কোনও দেশের পক্ষেই উচিত নয়, তিনিই বেছে বেছে অতীতের কোন ভয়াবহ স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে হবে, আর কোন ভয়াবহ স্মৃতি মানুষের মনে জাগিয়ে রাখতে হবে তা ঠিক করে দিচ্ছেন। জালিয়ানওয়ালাবাগের ত্যাগ ভুলিয়ে দাও আর দেশভাগের দাঙ্গার স্মৃতি মানুষের মনে খুঁচিয়ে জাগিয়ে তুলে দেশ জুড়ে বিভাজনের রাজনীতি জারি রাখ- এই হচ্ছে মোদী-শাহ জুটির ক্ষমতা ধরে রাখার ফর্মুলা। এই বিভাজনের ফর্মুলা যে 'অব্যর্থ আবিষ্কার', তাঁরা গুজরাট দাঙ্গা করে হাতেকলমে প্রমাণ পেয়েছেন। তাই সেই গুজরাট ল্যাবরেটরির সাফল্য দেশের দিকে দিকে ছড়িয়ে দিতে তাঁরা ব্যস্ত। 

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের আরও বিকৃতি ঘটাতে গুজরাট ও কেন্দ্রীয় সরকার যৌথভাবে এবার হাত দিয়েছে বাপুজির সবরমতি আশ্রমে। সেখানে ১২০০ কোটি টাকায় গড়ে উঠবে গান্ধী থিম পার্ক। এই পার্ক হল আসলে গান্ধীকে দ্বিতীয়বার হত্যা করার সামিল। ৫৪ একর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই আশ্রমকে নতুন প্রকল্পে গড়ে তোলা হবে এক 'ওয়ার্ল্ড ক্লাস টুরিস্ট স্পট' হিসাবে। আশ্রমের শান্তি, পরিবেশ ও আবেদন এর ফলে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আসলে, এই ভাবে আরএসএস-বিজেপি তাদের মতো করে গান্ধীকে বিশ্বের দরবারে হাজির করবে। এও ওই স্বাধীনতা সংগ্রামের বিনির্মাণেরই অংশ। তার প্রথম ধাপ গান্ধীর নামের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যকীকরণ করা।

সবরমতি আশ্রমের সেবাগ্রামের মহাফেজখানায় রক্ষিত রয়েছে গান্ধীজী সংক্রান্ত অমূল্য সমস্ত নথি। সেই সব নথির বিলুপ্তি না ঘটাতে পারলেও সরকার সেগুলির দখল নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সেবাগ্রামের বর্তমান পরিচালন সমিতি। বর্তমান সরকারের একটা বড় অংশের সদস্যকুল গান্ধীর হত্যাকারীকে পূজা করেন। ফলে, তাঁদের হাতে ওই নথির কী পরিণতি হতে পারে তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আশ্রমের 'হৃদয় কুঞ্জ' গৃহে যেখানে গান্ধীজী ১৯১৭ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত কাটিয়েছেন এবং তার সংলগ্ন যে স্মারক মিউজিয়াম, সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ দেশ-বিদেশ থেকে আসেন। সেই ঘর এবং মিউজিয়ামে ঢোকার পথে আজও গান্ধীজীর ইচ্ছা অনুযায়ী কোনও নিরাপত্তা রক্ষী রাখা হয়নি এবং মানুষ এখানে আসেন মূলত অনাড়ম্বরতার টানে। ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে 'হৃদয় কুঞ্জ'-এর পাশে এই মিউজিয়ামের নকশা করেছিলেন বিখ্যাত স্থাপত্য শিল্পী চার্লস করেয়া; যে মিউজিয়ামের স্থাপত্যে ধরা রয়েছে গান্ধীর অনাড়ম্বর জীবনের প্রতিফলন। এই গৃহ ও সংলগ্ন মিউজিয়ামের নন্দনতত্ত্ব, খোলামেলা পরিবেশ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশের টানেই মানুষ এখানে বারবার আসেন। সেই পরিবেশকে হত্যা করে এই নতুন প্রকল্পে গড়ে তোলা হবে নতুন মিউজিয়াম, এমফিথিয়েটার, ফুড কোর্ট এবং দোকান ও সঙ্গে মল। 

আশ্রমের ভিতরে আজও রয়েছে গান্ধীজীর নিজের হাতে গড়ে তোলা হরিজন পল্লী। সেখানে বসবাস করেন বহু মানুষ। নতুন প্রকল্পে ওই পল্লী আর থাকবে না। পল্লী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ওই জায়গায় পর্যটকদের জন্য তৈরি হবে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত কটেজ। মোটা টাকার বিনিময়ে সেখানে রাত কাটানো যাবে। সরকার ভুলে গেছে যে সবরমতিতে কেউ বিলাসিতা করতে আসেন না। তাঁরা এখানে সুন্দর করে সাজানো বিশাল উঁচু মিউজিয়াম দেখতে আসেন না। তাঁরা দেখতে আসেন পর্ণ কুটির ও সাধারণ জীবনযাপনের এক ছবি। সেটাই মানুষের মন থেকে মুছে দিতে এই পরিকল্পনা। এর বিরোধিতা করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। কিন্তু সেই সব স্মারকলিপি যে চলে যাবে ছেঁড়া কাগজের ঝুলিতে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। গান্ধীকে আরএসএস-বিজেপি যেমন সাজে সাজাবে তেমনটাই আমাদের মেনে নিতে হবে- এটা প্রধানমন্ত্রীর আত্মসুখের অংশ। তিনি যেমনটা চাইবেন তেমনটাই হবে সব কিছু- অন্য যে কোনও একনায়কের মতো এটা তাঁর মজ্জাগত। তবে মনোবিদরা বলেন, এটা একটা অসুখ। নিজেকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে তোলা। সেই বেলুনে পিন ফোটাতে পারেন একমাত্র দেশের জনতা। 

ইতিহাস থিম পার্ক নয়, তা ইতিহাস ধ্বংসের সামিল। ইতিহাস মানে ডকুমেন্টেশন, তা সেইদিন হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ঢুকবে।


2 comments:

  1. বড্ড একতরফা বিশ্লেষণ |দেশ ভাগের বেদনা জাগিয়ে তোলার প্রয়োজন আছে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে | ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েছিল পাঞ্জাব আর বাংলা |ধর্মনিরপেক্ষতার মহানুভবতা ও উদারতার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি বংশপরম্পরায় |

    ReplyDelete
  2. প্রয়োজন আছে বই কি, ওপার বাংলার মানুষের হৃদয়ের ক্ষত জাগিয়ে তাঁদের একটা ভোট ব্যাংকে পরিণত করা! এই মহান উদ্দেশ্য। ইতিহাসের একটা ভুলের বিরুদ্ধে আরেকটা ভুলকে অপরিণামদর্শীতা বলে।তবে এখানে ইতিহাস নয়, এখানে আরএসএস বিজেপি চাইছে পরিষ্কার সাম্প্রদায়িক বিভাজন। তার জন্য দেশ জুড়ে দাঙ্গা হলে হলে বেশ হয়। আমরা টিনের তলোয়ার নাটকের নায়িকার মত হাততালি দেব আর বলবো,"কি মজা, দাঙ্গা, দাঙ্গা..."

    ReplyDelete