Pages

Saturday, 7 August 2021

জনকল্যাণ কর্মসূচি মানে কি ভিক্ষা দেওয়া?

পুরনো রোগ: দাওয়াই নাই

মালবিকা মিত্র


'The bourgeoisie can't exist without constantly revolutionising the instrument of production.' অবিরাম যন্ত্রের উন্নতি না ঘটিয়ে বুর্জোয়া শ্রেণি বাঁচতে পারে না। উৎপাদন হয় পর্বত প্রমাণ। অপরদিকে যন্ত্রের উন্নতি মানবিক শ্রমকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলে। কর্মহীনতা, ছাঁটাই, মজুরি সংকোচন বাড়তে থাকে। পরিণতি বাজারে চাহিদা হ্রাস। অতি উৎপাদনের সমস্যা। অর্থনৈতিক মন্দা।

এই চক্রবৎ দূষিত আবর্তনের প্রেসক্রিপশনটি আজ থেকে ১৭৪ বছরের পুরনো। ১৮৪৮'এ লেখা কমিউনিস্ট ইশতেহার। চক্রবৎ এই সংকট আসে, আবার সামলে ওঠে। যে দেশে শিল্প যত বেশি আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর, সংকটের চেহারা সেখানে ততই ভয়ঙ্কর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নির্ভর অর্থনীতিতে এই সমস্যা তুলনায় কম। কিন্তু দুই বিশ্বযুদ্ধ অন্তর্বর্তী সময়ে এই সংকট ১৯২৯ সালে গভীরতর রূপ ধারণ করে। আর কোনও জোড়াতালি সমাধান চলছে না। পরিণতি হিসেবে রাজনীতিতে জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের তত্ত্ব, গণতান্ত্রিক সমাজবাদ, হ্যারল্ড লাস্কি, উইলিয়াম বেভারিজ প্রমুখের উত্থান। আর অর্থনীতিতে যুগপুরুষ কেইনস'এর আবির্ভাব। তিনি সংকটের জন্য অপরিকল্পিত মুক্ত বাজার অর্থনীতি, উৎপাদক শিল্পপতিদের 'un-coordinated optimism'কে দায়ী করেন। তিনি বিশেষ বিশেষ ভারি শিল্পের উৎপাদনে আংশিক পরিকল্পনার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শিল্পপতিদের উপর কিছু শুল্ক আরোপ, সামাজিক দায়িত্ব আরোপ করার পরামর্শ দেন। এর মাধ্যমে সরকারের আয় বৃদ্ধি করে সেই আয়কে জনকল্যাণে ব্যয় করার বিধান দেন। যে কোনও উপায়ে ক্রয়ক্ষমতাহীন মানুষের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছে দিতে হবে; নানাবিধ ভাতার মাধ্যমে। দীর্ঘমেয়াদী আর্থিক পরিকল্পনা নয়, সরাসরি অর্থ পৌঁছে দেওয়া চাই। একবার মজুরি দিয়ে পুকুর কাটাও, আবার মজুরি দিয়ে পুকুর ভরাট করো। 

এই সময় বুর্জোয়া অর্থনীতিতে বেকার ভাতা, বার্ধক্য ভাতা, অবসরকালীন সুযোগ ও ভাতা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনাজনিত কারণে ভাতা, কর্মস্থলে নিরাপত্তা রক্ষা- এইসব কত না আয়োজন। সংকটের যুগে ধনতন্ত্রের রূপ গণতান্ত্রিক সমাজবাদ। হ্যাঁ, বনসাই। সমাজবাদের বনসাই। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের রূপ। এইভাবে বহু দিন টিঁকে ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ সমগ্র খাঁটি বা ভেজাল সমাজতন্ত্রের পতন হল। ধনতান্ত্রিক দুনিয়া একমেরু বিশ্ব অনুমান করে জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড থেকে সরে যেতে থাকে। শিল্পপতির দেওয়া শর্তে সরকার লগ্নি আনে। শিল্পগোষ্ঠীর ইচ্ছায় মুক্ত বাজারের বিশ্বায়ন হয়। আবার চিনা পণ্যের প্রবেশ ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা জারি চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আউটসোর্সিং'এর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়। তবুও ঠেকাতে পারে না অর্থনৈতিক মন্দা। আসলে সমস্যা তো সমাজবাদ নয়, একমেরু দ্বিমেরু বিশ্ব নয়। ব্যাধি তো জন্মগত। ১৭৪ বছর পূর্বে রোগ নির্ণয় করা হয়েছে। 

অতএব, আজকের এই সংকট করোনা ১৯ জনিত নয়। আরও আগে থেকেই। জন্মগত। করোনা ১৯ ব্যাধির প্রকাশকে তীব্রতর করেছে মাত্র। ফলে, আজ বুর্জোয়া অর্থনীতিকে পুনরায় কেইনস'এর শরণাপন্ন হতে হয়েছে। নানাবিধ ভাতা ত্রাণ অনুদান নিয়ে জনকল্যাণের রূপ ধারণ করে হাজির। সমস্ত অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজারে অবিলম্বে চাহিদা সৃষ্টি করে বাজারকে সচল করা প্রয়োজন। তার জন্য অবিলম্বে মানুষের কাছে নগদ অর্থ পৌঁছে দেওয়া দরকার। এতে ক্রয়ক্ষমতা ও বাজারে চাহিদা বাড়বে। 

ফলত, বার্ধক্য ভাতা, বিধবা ভাতা, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড এসবই বুর্জোয়া অর্থনীতির অনিবার্য রূপ। সংসদীয় বামেরা বিপ্লবী পথ বর্জন করেছে। অথচ দাবি করছে 'সকলের জন্য কাজ চাই'। ভাতা এদের কাছে ভিক্ষা। তারা এসএসসি, শিল্পায়ন দাবি করছে। অথচ একদা এদের দাবি ছিল 'হাত আছে কাজ দাও, নইলে বেকার ভাতা দাও'। এরা দাবি করছে, কারখানা বৃহৎ শিল্প লগ্নি চাই। অথচ মন্দার সময় প্রয়োজন ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প, হস্ত ও কুটির শিল্প ইত্যাদির প্রসারে জোর দেওয়া। বিশ্বব্যাপী বাজার গড়ে উঠলেই সংকট ও মন্দা দেখা দেয়। 

বাম নেতা রবীন দেব ২০১৬'র নির্বাচনের সমগ্র প্রচারপর্বে সিঙ্গুরে ন্যানো মোটরে চেপে ঘুরে গোহারা হারলেন। ২০১৯'এর ভোটে সেই একই প্রচার এবং হার। ২০২১'এর ভোটে নবীন প্রার্থী সৃজন ভট্টাচার্য টাটা মোটরস'এর প্রতীকী শিলান্যাস করে প্রচার শুরু করে পুনরায় ধরাশায়ী। আর অপরদিকে গোঁয়ার কর্পোরেট পুঁজির সেবাদাস মোদী, সীতারমন নগদ সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার পরিবর্তে নানাবিধ ঋণ, প্রকল্প ঘোষণা করছেন, যা তাৎক্ষণিক ভাবে সমস্যা সমাধানে সক্ষম নয়। বিপদের দিনে যে কর্পোরেটকে কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সেই সত্য বিস্মৃত হয়েছে। এই সংকট পরিবেশ বিধি লঙ্ঘন করে জল, জমি, জঙ্গল, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা তুলে দিচ্ছে পুঁজিপতিদের হাতে। কৃষকের স্বার্থ রক্ষাকারী ন্যূনতম সংগ্রহ মূল্য প্রত্যাহার করে নতুন কৃষি আইনে কৃষককে আম্বানি আদানির বলির পাঁঠা করা হয়েছে।

আসলে ধনতান্ত্রিক সংকটের তীব্রতার কালে ধনতন্ত্রের সামনে দুটি মাত্র বিকল্প পথ:

১) আংশিক ভাবে সংকটের বোঝা নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়া। একটু কৌশলে দায়িত্বশীল ভাবমূর্তির মুখোশ ধারণ। কিছু সুযোগ-সুবিধা প্রদান। এভাবে অনেকদিন টিঁকে থাকা যায়। 

২) সংকটের বোঝা সম্পূর্ণ ভাবে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া। বেলাগাম শোষণ-পীড়ন চালানো। পরিণতি গণ অসন্তোষ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ। তবে শক্তিশালী বিরোধী রাজনৈতিক দল না থাকলে সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়াও সম্ভব হয়। 

মনে রাখা প্রয়োজন, ফ্যাসিবাদ ও গণতান্ত্রিক সমাজবাদের আবির্ভাবের পটভূমি কিন্তু একই। নরমপন্থী উপায়ে সাময়িক সমাধান ও উপশম হল গণতান্ত্রিক সমাজবাদ। আর উগ্র দেশপ্রেম, জাতি-ধর্ম বিদ্বেষী মতাদর্শের সাহায্যে সমস্ত প্রতিবাদ ভিন্ন মতামতকে দেশদ্রোহী দেগে দিয়ে মানুষের কাঁধে সংকটের বোঝা বিনা বাধায় আরও ভারী করে তোলার কৌশল হল ফ্যাসিবাদ। দুটিরই জন্ম দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী অর্থনৈতিক সংকট ও বিশ্ব মন্দার সময়ে। এ দুটিই ধনতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান। 

ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধের একটি তৃতীয় প্রায়-অনুশীলনহীন পন্থা হল শ্রমজীবী আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করে জণগণের সুদৃঢ় ঐক্য। এর আশা-দুরাশা দু' দিকই আছে। শ্রমজীবী নামধারী ভেজাল দলীয় সংগঠনের পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। বাস্তবে সংসদীয় কমিউনিস্ট পার্টিগুলি গণতান্ত্রিক সমাজবাদের আদলে সংগঠিত, অথচ কর্মসূচির ক্ষেত্রে এরা বিপ্লবী। এরা অতি সহজেই জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের কর্মসূচির অংশীদার হতে পারত। পরিবর্তে, বিধবা ভাতা, বার্ধক্য ভাতাকে এরা ভিক্ষা বলে সমালোচনা করল। আবার শ্রমজীবী শ্রেণিকে শুরু থেকেই আত্মসাহায্যে অক্ষম একটি শ্রেণিতে পরিণত করে পেটি-বুর্জোয়া প্রধান দল গঠন করেছে। হবে নাই বা কেন, জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক গুরু লন্ডনের গণতান্ত্রিক সমাজবাদের প্রবক্তা হ্যারল্ড লাস্কি।

অতএব তৃতীয় পন্থাটির করুণতম দশা। বাবা রামদেবের মতো মাথার চুল, মুখের চুল, বুকের চুলে জড়াজড়ি করে হাঁসজারু বকচ্ছপ। বিপ্লবী কর্মসূচি, পেটি বুর্জোয়া প্রধান পার্টি, সংসদীয় পন্থা ঘেঁটে ঘন্ট। আমরা বাংলার বহু মানুষ যারা ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস'এর বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলাম, আমরা ও আরও অনেকে দান খয়রাত জনকল্যাণকেই বেছে নিলাম ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে। জানি এটা স্থায়ী সমাধান নয়, কিন্তু এই সময়ের, এই মুহূর্তের আশু কর্তব্য। 

ফ্যাসিজম সম্পর্কে আর পি দত্ত বলেন, ফ্যাসিবাদ শ্রমজীবী শ্রেণিকে ধ্বংস করেনি, তাদের সেই সাধ্য ছিল না। কমিউনিস্ট ও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের আন্দোলনহীনতা, সংসদ সর্বস্বতা, বৃহত্তর ঐক্য গঠনের ব্যর্থতা শ্রমজীবী জনতাকে আঘাত, আহত ও হতাশ করে। তখন ফ্যাসিস্ট শৃগালরা সেই আহত সিংহকে আক্রমণ করে হত্যা করে। আমাদের এক শ্রেণির তথাকথিত বাম ও কমিউনিস্টরা কি সেই পথই অনুসরণ করছেন না? 


1 comment:

  1. খুব পরিস্কার মত। সাবলীল লেখা।
    সঠিক বক্তব্য।
    তবে তৃতীয় ক্ষেত্রটির বিস্তৃত পর্যালোচনা দরকার।
    বৈপ্লবিক সম্ভাবনার শর্ত ওউপাদান ও উদ্দ্যোগের।
    ধন্যবাদ লেখককে।

    ReplyDelete