পিছুটান
অনুপম চক্রবর্তী
ঢাকা থেকে মাইল দশেক দক্ষিণে মনেশ্বর গ্রাম। স্থানীয় থানায় পুলিশ অফিসার আমার দাদামশাই রাজেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার। অনেকটা জায়গা জমি নিয়ে তাঁর বাড়ি। প্রশস্ত চাতাল ঘিরে একাধিক দালান কোঠা। পূবে বৈঠকখানা, উত্তরে দুই দালান জুড়ে শোবার ঘর। ঠিক উল্টোদিকে হেঁসেল। এক কোণে ইঁদারা, তার দু' পা দূরেই স্নানঘর। মজুমদার বাড়ির আকর্ষণ তাঁদের মস্ত বাগান। হরেক প্রজাতির আম, কাঁঠাল ও লিচুগাছের সম্ভার সকলের নজর কাড়ে।
রাজেন্দ্র চন্দ্র ও তাঁর ভাই বীরেন্দ্র চন্দ্র একসঙ্গে থাকেন। বীরেন্দ্র চন্দ্র পেশায় ডাক্তার। তাঁর পরিবার বলতে স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ও মেয়ে বন্দনা। রাজেন্দ্র চন্দ্র ও সুরবালা দেবীর ভরাট সংসার। তাঁদের নয় সন্তান। হিরণ্ময়ী, কিরণময়ী ও লাবণ্যময়ীর পর একমাত্র ছেলে বিজয় গোবিন্দ দেখা দেয়। বিজয় গোবিন্দর পরের পাঁচজন যথাক্রমে জ্যোতির্ময়ী, প্রতিভা, রেণুকা, অনুপমা এবং সকলের ছোট নিরুপমা, আমার স্নেহময়ী মা।
ছোটবেলা থেকেই মা তাঁর ঠাকুমা, প্রসন্নকুমারী দেবীর বড় ন্যাওটা। ঠাকুমাও তাঁর আদরের নীলাকে চোখে হারান। রোজ সন্ধ্যাপ্রদীপ দেওয়ার আগে নাতনির কোমর ছাপানো চুল আঁচড়ে পরিপাটি করে বেঁধে দেন। রাতে কাছে নিয়ে ঘুমান। ফি বছর আমের মরসুমে তাঁরা পারলে বাগানেই বাসা বাঁধেন। আম কুড়ানো, ভালো আর দাগি আম আলাদা করা, কাঁচা-পাকা আম বাছাই করা, কতই না কাজ তাঁদের! দিনরাত এ হেন ব্যস্ততা দেখে আমার মামা বিজয় গোবিন্দ মাকে মজা করে বলেন,
'ভুতুম, তরে এবার আম-পেত্নীতে ধরবো।'
ভুতুম ভাবে পেত্নী ধরলেই বরং ভালো। পড়া মুখস্ত করার ঝঞ্ঝাট থেকে রেহাই পাবে।
সেদিন কী কারণে গৃহশিক্ষক আসেননি। আমার দিদিমা সুরবালা দেবী রান্নার ফাঁকে মা-র পড়া দেখতে এসেছেন। পড়ুয়া গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সামনে খোলা বই।
'ও মনু, আর পড়ন লাগবো না। তর বাবায় টকের ডাল খাইতে চাইছে। খানকয়েক কাঁচা আম রান্নাঘরে দিয়া যা।'
যেই না মা উঠতে যাবে, চুলে পড়েছে টান। সুরবালা দেখেন চুলের আগা খাটের সঙ্গে বাঁধা।
'তাই ভাবি, খাটের পায়ায় গোছা গোছা চুল লাইগ্যা থাকে কেন্!'
'কি করুম! পড়তে বইলেই ঝিমুনি আসে। তাই চুলটা খাটের লগে বাঁইনধা থুই। ঢুইল্যা পড়লেই চুলে টান পড়ে।'
'তরে এই কায়দাটা শিখাইল কে?'
'ঠাকুমায়। জানো মা, জানলার পাশে দেয়ালে ঝোলানো ঐ দড়িটায় টান দিলেই লিচু গাছে ঘন্টা বাজে। দড়ির অন্য মাথায় আরও অনেক দড়ি গিঁঠ দেওয়া। ঐ দড়িগুলায় ঘন্টা ঝোলান। সেইগুলা আবার লিচুগাছের সরু ডালে বাঁধা। রাতে যখনই ঠাকুমার ঘুম পাতলা হয়, দড়িতে হ্যাঁচকা টান মারেন, ঘন্টার আওয়াজে বাদুর পালায়। তা না হইলে আমাগো আর লিচু জুটতো না, ব্যাবাক অগো প্যাটেই যাইত।'
সুরবালা একগাল হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই অনুপমা বোনের কানে কী যেন বলে চলে গেল।
মা বাগানে গিয়ে দেখে অনুপমা একটা গাছ পাঁকা কাঁঠাল আগলে বসে।
'মনু, এইটারে খাবি কৈ? কেউ যদি দেইখ্যা ফেলায়!'
'চল্, গুদামঘরের পেছন দিয়া স্নানঘরে গিয়া ঢুকি।'
অনেকক্ষণ যাবৎ ঘর বাগান খুঁজেও কন্যাদ্বয়ের দেখা না পেয়ে স্নানঘর বন্ধ দেখে সুরবালা কৌতূহল বশে জিজ্ঞাসা করেন,
'ভেতরে মনু নাকি?'
'হ।'
'কাঁঠালের বাস নাকে লাগে যেন্।'
'আমি একা না, লগে অনুদিও আছে।'
এরমধ্যে মা-র থেকে বছর ছয়েকের ছোট খুড়তুতো বোন বন্দনা ঘটনাস্থলে উপস্থিত।
'অ্যাই ছোড়দি, আমার ভাগেরটা?'
'আমাগো প্যাটে। একটু সবুর কর, তরে আচার বানানো শিখাইয়া দিমু।'
মা-র নির্দেশ মতো বন্দনা, আমার ফেসুমাসি, কুলের আচার বানিয়ে ছোট ছোট দলা করে রোদে শুকোতে দিয়েছে। দলাগুলোর আকার ক্রমশই ছোট হয়ে যাওয়ার কারণ মাসি জানতে চাইলে উত্তরে মা বলে,
'তর মাথায় গোবর ভরা! এও বোঝস না, রোদে শুকাইয়া গিয়া ছোট হইয়া যাইতেয়াছে!'
দিন যায়, দলার আকার ছোট হতে হতে বিলুপ্তির পথে। এবার আর রহস্যের উৎস বুঝতে মাসির অসুবিধা হয় না। মা-র চুলের মুঠি ধরে পিঠে দমাদ্দম কিল। মাসি যত মারে, মা ততই হাসে আর বলে,
'ফেসু, তর হাতে মার খাইতে আমার কি যে ভালো লাগে!'
বাড়িতে অফুরান খুশির মেজাজ থাকলে কী হবে, দেশের তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা সকলকে বিচলিত করে তোলে। বঙ্গভঙ্গের ফলস্বরূপ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়ানক রূপ ধারণ করেছে। ছিনতাই, খুন, ধর্ষণ যেন রোজকার ঘটনা। রেণুকা, অনুপমা এবং নিরুপমার সত্বর বিয়ে দিতে না পারলে যে কোনও মুহূর্তে বড় বিপদের আশঙ্কা। চরম দুশ্চিন্তায় আমার দিদিমা প্রায় উন্মাদ। একদিন অপারগ হয়ে তিনি প্রতিভার স্বামী জগদীশ রায়কে বলেন,
'বাবাজীবন, তোমার কোনও অকল্যাণ হইব না, এই তিনগারে কুপাইয়া বুড়িগঙ্গার জলে ভাসাইয়া দাও। আমি আর এগো মুখ দেখতে পারি না!'
রায়মশাই এক মাসের মধ্যেই রেণুকা এবং অনুপমাকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিয়ে শাশুড়িমাকে সঙ্কটমুক্ত করেছিলেন।
মজুমদার বাড়িতে আজ শোকের ছায়া। প্রসন্নকুমারী দেবী অমৃতলোকের পথে। নীলার বিয়ে দেখে যাওয়ার বড় সাধ ছিল তাঁর। নীলা যখন বাবাকে হারায়, কতই বা তার বয়স! দশ-এগারো হবে। কাকা বীরেন্দ্র চন্দ্র ছেড়ে গেছেন আরও আগে, তার শৈশবে। এখন সে অষ্টাদশী। এই প্রথম মৃত্যুকে চিনল সে। শেষবারের মতো ঠাকুমাকে প্রণাম করে নীলা ধীর পায়ে পৌঁছে যায় আমবাগানে। মুকুলের গন্ধে ছুঁতে চায় তার ঠাকুমাকে।
১৯৪৬ সনের শীতের সকাল। ঠাকুরঘরের সামনে তার ঠাকুমার পিঁড়িতে মা একলা বসে উদাস মনে আকাশপানে চেয়ে। রাতভোর ছাতিমের তীব্র গন্ধ কুয়াশায় মিশে যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ধরিত্রী বড় নির্মম আজ। বিজয় গোবিন্দ, তাঁর মা, কাকিমা এবং ছোট দুই বোন, নিরুপমা ও বন্দনাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিলেন কলকাতার অভিমুখে। জন্মাবধি চেনা চরাচরের সঙ্গে সখ্য ছিন্ন হয়ে গেল এক লহমায়। রেলগাড়ি চলতে শুরু করে। জানলার ফাঁক দিয়ে মা খুঁজে ফেরে তাদের দালান কোঠা, চেনা বৃক্ষরাজি। চোখে পড়ে কেবল আদিগন্ত সবুজ ফরাশ পাতা ঢালাও তৃণভূমি। ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশির বিন্দু সকালের মিঠে রোদে যেন শত সহস্র মুক্তদানা, চলেছে তাদের সঙ্গে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার: বন্দনা ব্যানার্জী, গৌরি ঠাকুর, সুপর্ণা চক্রবর্তী এবং গৌতম চক্রবর্তী।
মনটা হু হু করে ওঠে।আমরাও পূর্ব বাংলার লোক। আপনার লেখায় সাহিত্যগুণ যথেষ্ট ।🙏
ReplyDeleteধন্যবাদ বিশ্ব 😊
Deleteবিশ্ব
ReplyDeleteSo closed and intensed. Carry on.
ReplyDeleteThank you 😊
Deleteআজ বড় নষ্টালজিক করলেন!...আমার ঠাকমা তাঁর ইয়াং এজে পূর্ববঙ্গ থেকে এসে হাওড়ায় বাসা নিয়ে থাকা সত্ত্বেও সারাজীবন বাঙালভাষায় কথা বলতো। আমার দিদি আর বোনকে "মনু" বলে ডাকতো।
ReplyDeleteমা কে মনে করে যখন লিখছিলেন চোখ তো ভিজেছে নিশ্চিত...আমার তো ভিজলো। শুধু একটা ধন্ধে রইলাম...লেখা পড়লাম, নাকি ছবি দেখলাম!
ধন্যবাদ 🙏🏽
DeleteAmi o jeno chaloman chhobi dekhlam.. ..
ReplyDeleteধন্যবাদ 🙏🏽
DeleteChamotkaar chhobi ek-khhaani. Ei desh chhede chirakaaler janye hataath chale aashaataa oi prajanmer kato maanusher jibane ki bhhishan shatyi! Bhhaashaar byabohaar ati shukhhapaathhya. Anupamer elem kramasha prakaashita hochhe!
ReplyDeleteDhanyobad Indra da 🙏🏽
Deleteখুবই সুন্দর ও মন ছুঁয়ে যাওয়া লেখা. আমাদের পরিবার ও ওপার বাংলার তাই অনুভব করলাম আরো গভীর ভাবে. ধন্যবাদ অনুপম দা.
ReplyDeleteধন্যবাদ শমিত। খুশি হলাম 😊
DeleteSundor lekha, besh bhalo laglo
ReplyDeleteDhonyobad 😊
Deleteখুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteধন্যবাদ 😊
Deleteবাঃ এই লেখাটায় একটা সময়কে খুব যত্ন সহকারে তুলে এনেছিস , ঢাকা ও তার আশপাশের অঞ্চলের
ReplyDeleteএমনকি বরিশালের লোকেরাও প্রায় এই ভাবেই আমরা নিজেদের মধ্যে কথা বলি । আমার বাবা কিংবা মামা নতুন কারোর সাথে পরিচয় হলে প্রথমেই তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন আপনার দেশ কোথায় ছিলো ,
এটাকেই বলে মাটির টান। যতই পড়ছি ততোই যেনো পূর্ব পুরুষদের ভিটেমাটির একটা গন্ধ পাচ্ছি ।
সুন্দর লিখেছিস। আমি ওপার বাংলায় যাই নি বটে, কিন্তু পূর্ব প্রজন্মের মুখে তাঁদের শিকড় ছেড়ে আসার বেদনা বেশ বোঝা যায়।
ReplyDeleteখুব সুন্দর!তন্ময়
ReplyDeleteধন্যবাদ তন্ময় 😊
ReplyDelete