Pages

Monday, 28 June 2021

ফ্লয়েড হত্যার রায়

অতীতের আয়নার মুখোমুখি আমেরিকা

সোমনাথ গুহ


বর্ণ বৈষম্য নির্মূল করার লক্ষ্যে এক কদম এগলো আমেরিকা। গত বছরের ২৫ মে সারা বিশ্ব দেখেছে ডেরেক শভিন নামে এক দুর্বৃত্ত পুলিস অফিসার কীভাবে জর্জ ফ্লয়েডের গলা ৯ মিনিট ২৯ সেকেন্ড ধরে হাঁটু দিয়ে পিষে রেখেছিল। সারা সময়টা হতভাগ্য মানুষটি মিনতি করেছিলেন যে তিনি  শ্বাস নিতে পারছেন না। নির্দয় শভিন মুমূর্ষু মানুষটির কথায় কোনও কর্ণপাত করেনি, তার তিন সঙ্গী পাশে দাঁড়িয়ে মজা দেখেছে। 

ফ্লয়েডের এই নৃশংস মৃত্যুর কারণে দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে সারা আমেরিকা জুড়ে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপ সহ বিশ্বের আরও নানা দেশে। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন পুনর্জীবিত হয়। নভেম্বরে দেশের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দোষীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি করেন এবং অশ্বেতাঙ্গ মানুষদের বিপুল সমর্থন পান। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর বাইডেনের এজেন্ডায় প্রথমেই এই বিষয়টি ছিল। তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল আমেরিকার মজ্জাগত এই বর্ণ বৈষম্যকে উপেক্ষা করা। 

এই বছরের মার্চে শভিনের বিচার শুরু হয়। এপ্রিলে রায় ঘোষণা হয়। তাকে সেকেন্ড ডিগ্রি অনিচ্ছাকৃত হত্যা, থার্ড ডিগ্রি হত্যা এবং সেকেন্ড ডিগ্রি নরহত্যায় অভিযুক্ত করা হয়। গত শনিবার তাকে সাড়ে বাইশ বছর কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। এই ঘটনার পুরো ভিডিও রেকর্ডিং ছিল। মনে হতে পারে এর থেকে মোক্ষম প্রমাণ আর কী হতে পারে? আরও বহু কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর ক্ষেত্রেও অতীতে সে সব ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীরাও ছিল, কিন্তু দোষীদের কোনও সাজা হয়নি। 

১৯৯১'এ রডনি কিংকে বেধড়ক মেরে মৃতপ্রায় করে ফেলে রাখে চার অফিসার। সেটারও ভিডিও রেকর্ডিং ছিল। তা সত্ত্বেও দোষীরা বেকসুর খালাস হয়ে যায়। বিভিন্ন এলাকায় হিংসা ছড়ায়, দাঙ্গা হয়। এবারও অনেকে সন্দিহান ছিলেন, আদৌ দোষীদের শাস্তি হবে কিনা। পুনরাবৃত্তি যে হয়নি, তার পিছনে কিছু কারণ আছে। প্রথমত, ফ্লয়েডের হত্যা এত নির্মম ছিল এবং তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এত জোরালো হয়ে উঠেছিল যে তা আমেরিকার বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাকে নগ্ন করে দেয়। শাস্তি না দিলে বিশ্বের সর্বোত্তম গণতন্ত্রের কৌলীন্য রক্ষা হত না। দ্বিতীয়ত, জুরির এগারো জনের মধ্যে ছ' জন ছিলেন অশ্বেতাঙ্গ। যদিও রায় সর্বসম্মতিক্রমে হয়েছে, অভিজ্ঞ আইনজীবীরা বলছেন, শ্বেতাঙ্গরা সংখ্যাগরিষ্ঠ জুরি হলে শভিন খালাস হলেও হতে পারত। তেমন সম্ভাবনা ছিল। শভিনকে শাস্তি প্রদান করলেও জুরির মনোভাব ছিল, এটি একজন ব্যক্তির অপরাধ মাত্র, ব্যবস্থার কোনও গলদ নয়। ব্যবস্থাটাই যে বৈষম্যমূলক এটা স্বীকার না করতে পারার মধ্যেই বোঝা যায় সমস্যাটা কত গভীরে। তৃতীয়ত, যেটা অভুতপূর্ব, অন্য পুলিস অফিসাররা বিভাগের প্রধান সহ শভিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ইতিপূর্বে প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তাঁরা তাঁদের সহকর্মীর হয়ে ওকালতি করেছেন।  

ফ্লয়েডের হত্যার বিচার এবং তার সাজার মধ্যে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ১৯ জুন জুনটিন্থ দিবস আমেরিকায় ফেডারাল ছুটি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। জুনটিন্থ অর্থে জুন প্লাস নাইন্টিন্থ। ১৮৬৫ সালে ঐ দিনে ক্রীতদাস প্রথার বিলোপ ঘোষণা করা হয়। সারা দেশ জুড়ে মানুষ, বিশেষ করে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এই দিনটি অত্যন্ত সমারোহের সাথে উদযাপন করেন। অনেক রাজ্যে ছুটি পালিত হয়। এই দিনটিকে ঘিরে আমেরিকায় একটি বিশেষ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে। বাইডেন সরকারের এই পদক্ষেপ অবশ্যই একটি জনমোহিনী সিদ্ধান্ত, কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে তাদের জনভিত্তি এর ফলে আরও প্রসারিত হবে। একই সাথে আমেরিকান গণতন্ত্র কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে বর্ণ বৈষম্য নির্মুল করতে নতুন করে অঙ্গীকারবদ্ধ হল। 

দ্বিতীয় ঘটনাটি আরও গুরুত্বপূর্ণ: পুলিস রিফর্ম, যা দেশে একটি বহু বিতর্কিত বিষয়। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন পুলিসের কাজকর্মের ওপর বিধিনিষেধের প্রয়াস আমেরিকার কংগ্রেসে ধাক্কা খায়। রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় সেই বিল আটকে যায়। মার্চের শুরুতেই হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ'এ ‘জর্জ ফ্লয়েড জাস্টিস ইন পুলিসিং অ্যাক্ট’ মাত্র ২২০-২১২ ভোটে পাস হয়। এখন বিলটি সেনেটে পাস করতে হবে যেখানে সেটি অবশ্যই প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হবে। বিলটি আইন হলে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হবে। এর ফলে পুলিসের ওপর যে সব বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে তা হল: 

(১) Qualified Immunity বা যোগ্য অনাক্রম্যতার সুযোগ পুলিস আর নিতে পারবে না। এর অর্থ কোনও ব্যক্তির অধিকার হরণ করার জন্য তখনই তুমি কোনও অফিসারকে দায়ী করতে পারো যদি সেই অধিকার অতীতের কোনও মামলায় প্রশ্নাতীত ভাবে স্বীকৃতি পেয়ে থাকে। এই কথাটির সুবিধা হচ্ছে, এটি বহু ভাবে ব্যাখ্যা হতে পারে যার সুযোগ নিয়ে অতীতে বহু বর্ণবিদ্বেষী, পাশবিক শ্বেতাঙ্গ অফিসার পার পেয়ে গেছে। অধিকাংশ রিপাবলিকান এবং কিছু ডেমোক্রাটও এই ধারা বিলোপ করার বিরুদ্ধে।

(২) গলায় প্যাঁচ বা শ্বাসরোধ করা নিষিদ্ধ।

(৩) নো-নক ওয়ারেন্ট বাতিল। এর অর্থ, জানান না দিয়ে পুলিস কারও বাড়ি, অফিস ইত্যাদিতে প্রবেশ করতে পারবে না।

(৪) পুলিস এনকাউন্টারের তথ্য সংরক্ষিত রাখতে হবে।

(৫) বর্ণ, ধর্ম, জাতি অনুযায়ী অভিযুক্তদের বর্ণনা বা তালিকাভুক্ত করা বন্ধ করতে হবে।

সেনেটে এই বিল পাস হবে কিনা বলা দুষ্কর। মূলত প্রথম ধারাটি নিয়ে সেনেটারদের মধ্যে তুমুল দরাদরি চলছে। শ্বেতাঙ্গরা কোনওভাবেই Qualified Immunity ছাড়তে রাজি নন। অতীতের পাপক্ষালনের জন্য পুলিস রিফর্ম আবশ্যক। এছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের যে ভাবে ভোট দিতে বাধা দেওয়া হয় তা নিয়ে তারা সরব। পিউ চ্যারিটেবিল ট্রাস্টের একটি সমীক্ষায় বলা হচ্ছে, এটা বিভিন্ন ভাবে করা হয়- কৃষ্ণাঙ্গ এলাকায় বুথ কমিয়ে দিয়ে অন্যত্র বাড়িয়ে দেওয়া; জনগণনায় কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা কম করে দেখানো; পোস্টাল ব্যালট তাঁদের কাছে সময় মতো পৌঁছয় না ইত্যাদি। এটা করে কংগ্রেসে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিনিধিত্ব কম করে রাখার চেষ্টা হয়। তাঁরা অতীতের অত্যাচার  নিপীড়নের ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। আমেরিকার ইতিহাসে ক্রীতদাস প্রথার যে এক তরফা শ্বেতাঙ্গ-বান্ধব বয়ান তা সংশোধন করার দাবিও তাঁরা তুলেছেন। 

মার্কিন সমাজে যা প্রায় অনতিক্রম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হল এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বৈষম্য। ৭৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, বর্ণ বৈষম্য সমাজের প্রধান সমস্যা, ৫৭ শতাংশ মনে করেন কালো মানুষেরা বেশি পুলিসি অত্যাচারের শিকার। তাঁরা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ কিন্তু পুলিসের হাতে মৃত্যুর হার ২৪ শতাংশ। গড়পড়তা একটি শ্বেতাঙ্গ পরিবারের সম্পত্তি কৃষ্ণাঙ্গ পরিবারের চেয়ে দশ গুণ বেশি। শ্বেতকায় একজন স্নাতক সাত গুন বেশি ধনী একজন কৃষ্ণকায়ের থেকে। প্রসবকালীন মৃত্যু এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলার ক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গ মহিলার চেয়ে তিন থেকে চার গুন বেশি। বিনামূল্যে সরকারি স্কুলে শিক্ষার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু এই স্কুলগুলির মান বেসরকারি বিদ্যালয়ের চেয়ে যথেষ্ট নিম্নমানের। ‘ফেয়ার হাউসিং অ্যাক্ট’ আছে কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় কোনও এলাকায় কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়ি থাকলে সেখানে স্থাবর সম্পত্তির মূল্য কমে যায়। ব্যাঙ্ক ও ব্যবসায়ীরা চায় না কোনও ভাল এলাকায় তাঁরা বাড়ি করুক। ব্যাঙ্ক নানা অজুহাতে ঋণ দিতে অস্বীকার করে। এই কারণে পয়সা থাকলেও তাঁদের মহল্লাতে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। সেখানে অসুস্থ পরিবেশ, প্রবল দূষণ, নাগরিক পরিষেবা ক্ষীণ, নেশাড়ু ও চোরাচালানকারীদের স্বর্গরাজ্য। কোভিড মহামারিতে ট্রাম্পের হঠকারী মনোভাবের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হয়েছে। সাদা মানুষদের চেয়ে তাঁদের অন্তত দ্বিগুন মারা গেছেন।

বিশ্বের ‘উৎকৃষ্টতম’ গণতন্ত্রের থেকে সবচেয়ে জনবহুল গণতন্ত্র কী শিক্ষা নিতে পারে? ২০১৫ সালে মহম্মদ আখলাখ নামক একজন মানুষ ফ্রিজে ‘গোমাংস’ রাখার অপরাধে খুন হন। পরবর্তীকালে যতটুকু তদন্ত হয়েছে তাতে আদৌ সেটি গোমাংস ছিল কিনা তা প্রমাণিত হয়নি। গ্রামের বহু মানুষ এই হত্যা প্রত্যক্ষ করেছেন, হত্যাকারীরাও অঞ্চলের পরিচিত লোক কিন্তু কেউ গ্রেফতার হয়নি। উলটে তদন্তকারী অফিসার সুবোধ সিং বুলন্দশাহরে দক্ষিণপন্থী মব দ্বারা প্রহৃত হয়ে মারা যান। অভিযোগ, আক্রমণকারীদের মধ্যে আখলাকের হত্যার চার্জশিটে অকুতোভয় ঐ অফিসার যাঁদের নাম উল্লেখ করেছিলেন তাঁরা ছিলেন। এরপরে অগুন্তি সংখ্যালঘু মানুষ ধর্মান্ধ জনতার হাতে প্রাণ দিয়েছেন। কেউ গ্রেফতার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি। উলটে হত্যাকারীদের মালা পরিয়ে বিজয় মিছিল হয়েছে। 

আমেরিকা কিন্তু বছর ঘোরার আগেই শভিনকে জেলে পাঠিয়ে দিল। এনকাউন্টার হত্যা বস্তার, দান্তেওয়াড়ায় প্রতিনিয়ত হচ্ছে। কোন থানা হিসাব রেখেছে? বিনা ওয়ারেন্টে ঘরবাড়ি তল্লাশি তো সামান্য ব্যাপার, যত্রতত্র গ্রেফতার হচ্ছে। পরিবার, পরিজনদের না জানিয়ে বেঙ্গালুরু থেকে দিল্লি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, উদাহরণ দিশা রবি। তবুও বলব, গণতন্ত্র চলছে? উত্তর হাওয়ায় ভাসছে! 


No comments:

Post a Comment