Pages

Thursday, 10 June 2021

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত

‘এই তো নিয়ম, এসো দূরে যাই’

প্রবুদ্ধ বাগচী


পঁয়ত্রিশ বছর আগে একদিন দুপুরে গিয়েছিলাম তাঁর কাছে। তখন ‘দূরত্ব’ ও ‘গৃহযুদ্ধ’ দেখে মুগ্ধ ও উত্তেজিত। সেই অঞ্জন দত্তের মাউথঅরগানে ধীর লয়ে বাজানো ‘উই শ্যাল ওভারকাম’। সেই সুনীল মুখোপাধ্যায়ের গোলকিপারের ভূমিকা, সিনেমায় তাঁর চরিত্রের নাম ছিল শীতল। আর অনবদ্য মমতাশঙ্কর। আর মোদ্দা কথাটা হল, সাংবাদিক হিসেবে একটা অন্যায়ের তদন্ত করতে গিয়ে যে ভাবে সাংবাদিক চরিত্রের গৌতম ঘোষকে নিহত হতে হল, তা আসলে আমাদের এক গভীর রাজনৈতিক সত্যের দিকে টেনে আনে। অন্যায়ের পক্ষে সব সময়েই থাকে ক্ষমতার সমর্থন। কখনও তার নাম মিল মালিক, কখনও বিকিয়ে যাওয়া ট্রেড ইউনিয়ন নেতা, অথবা রাজনীতির কেষ্টবিষ্টুরা। তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে, রেড রোডের নির্জনতায় অচেনা গাড়ি এসে থেঁতো করে দিতে পারে প্রতিবাদীর শরীর। এই নিকেশ করার শিল্প গত সাড়ে তিন দশকে আরও ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে। পরিচালকের এই সিরিজের তৃতীয় ছবি ‘অন্ধিগলি’ হিন্দিতে হওয়ায় খুব সহজে তা দেখা হয়ে ওঠেনি। তবে তার পরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি দেখে যাওয়ার চেষ্টা করেছি বারবার। 

সেই সাড়ে তিন দশক আগের এক দুপুরে তাঁর সেলিমপুরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলাম একটা সাক্ষাৎকার নিতে। আমি, আমার এক বন্ধু ও আমাদের এক স্কুলের মাস্টারমশায়। যদিও আমরা দুই বন্ধু তখন কলেজে। আমি যাদবপুর, বন্ধু আরজিকর। মফস্বল শহরের এঁদো পরিবেশ থেকে গিয়ে সেই প্রথম এক চিত্র পরিচালকের মুখোমুখি হওয়া। তবে সুবিধে ছিল একটা, চিত্র পরিচালক স্বয়ং মফস্বলের জীবন সম্পর্কে ছিলেন পুরো ওয়াকিবহাল। কারণ, তিনি নিজে ছিলেন হাওড়ার জাতক, বাবার চাকরির সূত্রে ঘুরেছেন এখানে ওখানে। নিজে অধ্যাপক হিসেবে পড়িয়েছেন মফস্বলের কলেজে। আর এই সূত্রেই তিনি আমাদের কথাবার্তার মধ্যে তুলে ধরেছিলেন এক আশ্চর্য প্রসঙ্গ। আসলে তা তাঁর পরবর্তী কোনও সিনেমার আকরভাবনা। তিনি বলেছিলেন এমন একটি চরিত্রের কথা, যিনি মফস্বল এলাকায় একেবারে নিজের উদ্যোগে একটা আঞ্চলিক খবরের কাগজ চালান। তার জীবনটা ঠিক কেমন হতে পারে? বড় পত্রিকার সঙ্গে তার বিরোধ অথবা আন্তঃসম্পর্ক কীভাবে তৈরি হতে থাকে ভিতরে ভিতরে? এইসব নানা কথা বলছিলেন তিনি। ভাবছিলেন, এইরকম চরিত্র নিয়ে একটা ফিল্মের কথা। সেই ছবি শেষ অবধি তিনি আর করে উঠতে পারেননি। কিন্তু ভাবনা হিসেবে সেটা ছিল একটা নতুন হাওয়া। বাংলার সাহিত্যে ও সমাজে প্রান্তীয়তার ধারণা এর পরে নানা ভাবে বিকশিত হয়েছে কিন্তু এত বছর আগে সেটা ছিল বেশ অবাক করার মতোই। 

এই ছবি না করলেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বেশির ভাগ ছবির পটভূমি মফস্বল বা একেবারে প্রান্তীয় এলাকা। লং শটে আবছায়া পাহাড়ের রেখা, তার সামনে উঁচু রাস্তা, আদ্যিকালের ভাঙ্গা জিপ গাড়ি, প্রান্তীয় মানুষজন- এসব বুদ্ধদেবের ছবির টিপিকাল অনুষঙ্গ। এবং তার সঙ্গে উচ্চকিত রাজনীতির চড়া সুরকে শমিত করে আলতো ভাবে একটা সুরকে ভাসিয়ে দেওয়া, আদপে যা রাজনৈতিক ভাষ্য। 

‘উত্তরা’ ছবিটার কথাই ধরা যাক না। সেই এক কুস্তিগীরের ছবি, যে গোটা ছবি জুড়ে লড়াই করে যায়। এরই আড়ালে খ্রিস্টান ধর্মযাজককে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ছায়া ফেলে। অথবা ‘বাঘ বাহাদুর’- সেও তো আসলে এক অসম লড়াইয়ের গল্পই শোনায়। কিংবা ‘তাহাদের কথা’র মতো কমলকুমারীয় গদ্যকে চিত্রভাষা দেওয়া খুব সহজ কাজ ছিল না মোটেই, সেই কাজ তিনি করে ফেলেছেন। আর সেই গল্পও তো এক অবহেলিত স্বাধীনতা সংগ্রামীর আখ্যান, যিনি তার প্রতিবাদকে মূর্ত করে তোলেন তার শারীরিক বায়ু নির্গমনকে সশব্দে জানিয়ে দিয়ে। এইভাবেও প্রতিবাদ হতে পারে? পরে অবশ্য আমরা নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখায় এইসব ‘অশীলিত’ প্রতিবাদকে আরও চওড়া ক্যানভাসে পেয়েছি। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। আর দারিদ্রের সুতীব্র কশাঘাত ঠিক কেমন ভাবে ছবিতে ধরিয়ে দেওয়া যায় তার এক অনবদ্য চিত্রায়ন তাঁর ‘নিম অন্নপূর্ণা’- এটাও কমলকুমারের কাহিনি। এখানে বলা দরকার, এই দারিদ্রের সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’কে যেন কেউ গুলিয়ে না ফেলেন। সত্যজিৎ, দারিদ্র নয়, জীবনের ছন্দকে ধরেছেন তাঁর ছবিতে, বুদ্ধদেবের সেই দায় নেই। তিনি সরাসরি একটা পরিবারের দারিদ্রকে ফুটিয়েছেন সেলুলয়েডে, শুধু ওই বিড়ম্বিত জীবনটুকু দেখাবেন বলেই। 

 

একটা অভিযোগ তাঁর ছবি বিষয়ে ছিলই। তার পরের দিকের ছবিগুলি বড় শ্লথ। কথাটা একেবারে ভুল নয়। আসলে প্রথম দিকের ছবি থেকে যত তিনি পরের দিকে এগিয়েছেন তত তার মধ্যে তৈরি হয়েছে একটা অন্য ঝোঁক। সেলুলয়েডের ক্যানভাসে ছবি আঁকার প্রবণতা। এখন ছবি ব্যাপারটা নিজে ঠিক গতিশীল মাধ্যম নয়। ভালো ছবির সামনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাকে আঁতিপাঁতি করে চিনতে হয় শিল্পের শর্তে। অথচ সিনেমার মতো একটা গতিশীল মাধ্যমে ছবিকে দাঁড় করানো একটা নিরীক্ষা হিসেবে দেখা যেতেই পারে, কিন্তু তাই বলে সব ক্ষেত্রেই তা সফল হবে এমন নাও হতে পারে। বিশেষ করে তাঁর ‘স্বপ্নের দিন’ ও ‘কালপুরুষ’ এইদিক দিয়ে খুব উত্তীর্ণ এমন নয়। আর তাঁর ছবি দেখতে দেখতে আমাদের এই আফসোস হয়েছে, সব ছবির মধ্যেই একটা গতির বিরুদ্ধ স্রোত প্রবাহিত করতে গিয়ে কিছু ছবির প্রতি সুবিচার বাধা পেল না তো? 

আলাদা করে দুটো ছবির কথা বলব। একটি ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ (কাহিনি: প্রফুল্ল রায়) এবং ‘টোপ’ (কাহিনি: নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়)। দুটি ছবির গল্পে এমন উপাদান ছিল যা উৎকৃষ্ট ছবির পক্ষে সহায়ক। বিশেষ করে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পটি তো বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পাঠ্যও হয়েছে। কিন্তু অনেক আশা নিয়ে ছবি দুটো দেখতে বসে যথেষ্ট আশাভঙ্গ হয়েছিল। অতিরিক্ত আঙ্গিক-নির্ভরতা ছবিতে গল্প বলার গতিকে আটকে ধরেছে বারবার। ‘টোপ’ গল্পের যে অসামান্য ট্রাজেডি তা ছবিতে ফুটে উঠল কই? ছবির দর্শককে অনেকটা অনুমান করে নিতে হয় এইখানে।

অবশ্য একজন লেখকের সব লেখা যেমন ভাল হয় না, একজন পরিচালকের সব ছবিই সবার ভাল লাগবে এমন নয়। বিশেষ করে শেষের দিকে তাঁর ছবি মেইনস্ট্রিম হলে প্রায় রিলিজই হত না, বেশিটাই যেত পুরস্কারের জন্য বিদেশে। বরং আজ তাঁর অনুপস্থিতির সামনে দাঁড়িয়ে অন্য একটা কথা বলা দরকার। সেটা তাঁর কবিসত্তার কথা। চিত্র পরিচালনার আগে তিনি ছিলেন ষাটের দশকের একজন উজ্জ্বল কবি। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গভীর এরিয়েলে’, ‘কফিন কিংবা সুটকেশ’, ‘হিম যুগ’, ‘ছাতা কাহিনী’ বা ‘রোবটের গান’ ছিল একদম নতুন ধরনের কবিতার উচ্চারণ। সেখানে আমরা পেয়ে যাই ‘মাগুর মাছের স্বপ্ন’র কথা, পাই ‘পিপড়ে জন্মের’ স্বাদ, ‘শুয়ে থাকা বন্দুকের’ ক্রোধ, ‘রবারের রাস্তা’ বা রোবটের জন্য লেখা ‘এপিটাফ’- একেবারে এক ভিন্ন জগতের পরাবাস্তব। একটা সময়ের পর কবিতা থেকে ফিল্মে গেলেও আসলে কবিতা তাঁকে ছেড়ে যায়নি। সিনেমা তৈরির পাশে পাশে সেই কবিতার বিচিত্র জগত তাঁকে ভিতরে ভিতরে নির্মাণ করেছে। 

খুব সহজেই মনে করতে পারি তাঁর দুটি অনবদ্য ছবির কথা- ‘চরাচর’ ও ‘লাল দরজা’। কার্যত এই দুটি ছবির বুননে প্রধান নায়ক তাঁর কাব্যভাষা। ছবি দুটির সামগ্রিকতায় যেন এক কবিতা লিখবার আন্তরিক প্রয়াস। তাই ‘চরাচর’এ জমিদার বাড়ির নিমন্ত্রণে খেতে বসা রাজিত কাপুর (সিনেমার চরিত্রের নাম মনে পড়ছে না) যেভাবে পাখি হত্যার বার্তা পেয়ে প্রত্যাখ্যান করে সেই নিমন্ত্রণ, তা তো এক শিল্পিত কবিতাই। আর ‘লাল দরজা’য় সেই দন্ত চিকিৎসক (অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়) সিনেমার মধ্যে বারবার একটা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে থেমে যান একটা লাল দরজার সামনে, এই পৌনঃপুনিক আবর্তনের ভিতর দিয়ে উঠে আসে ব্যক্তির এক সংকট চিত্র, যা তিনি একদিন লিখেছিলেন তার কবিতায় ‘একদিন অদ্ভুতভাবে দ্যাখা হবে/ মুখোমুখি/ দাঁড়াতে হবেই, কোথায় পালাবে’। 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আসলে এই কবিতা আর ফিল্মের মধ্যে এক যোজক হয়েই থেকে যাবেন অনেক দিন। তাঁর ছবির সঙ্গে বসে আমরা কবিতা পড়তে পারব অনায়াসেই। তাই হয়তো মনে পড়ে গেল তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হওয়া সন্ধ্যেটা। স্টুডেন্টস হলে কবি ভাস্কর চক্রবর্তীর স্মরণসন্ধ্যায় তিনি চুপ করে বসেছিলেন তাঁর সমকালীন বন্ধু কবির প্রতি আনত শ্রদ্ধায়, পেছন দিকের চেয়ারে। অনুষ্ঠান শেষের কিছু আগে ভিড় এড়িয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন নির্জনে। এই বিবিক্ত পটভূমিতেই তাঁকে হয়তো আরও ভাল করে চিনতে পারব আমরা ।


2 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো লেখাটা পড়ে। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত চিত্রকথক, তাঁর মুন্সিয়ানা আমার কাছে ভারি মোহময়, জীবনের অন্তর্লীন অনুভব সমৃদ্ধ

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লিখেছেন। কলেজের ছাত্রজীবনের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমরা কয়েকজন বন্ধু বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে পর্দায় গিলছি। সত্যজিৎ ঘরানা থেকে যাঁরা বেরিয়ে আসছেন তাঁরা তখন আমাদের হিরো। ভক্ত ছিলাম তাঁর কবি তারও। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সম্ভবত ২০০৮/৯ সাল। আমি সেদিন কৃষ্ণনগর গভর্নমেন্ট কলেজের অফিসার ইনচার্জের দায়িত্বে। খবর এলো, এক ভদ্রলোক আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। পিওনকে বললাম আমার চেম্বারে নিয়ে আসুন। ভদ্রলোক এলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম চলচ্চিত্র পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না ঘটনাটা। যাইহোক ওঁকে বসতে বললাম। অনেক কথা হলো। উনি জানালেন কেন এসেছেন। সরকারি উদ্যোগে হেরিটেজ বিল্ডিং নিয়ে একটা তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। কলেজের ছবি তুলতে চান। ছাড়পত্র চাইতে এসেছেন। আমি পড়লাম বিপদে। বিকাশভবনের অনুমোদন ছাড়া সরকারি ভবন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া যায় না। সেদিন ছিল শনিবার। নিতান্ত বাধ্য আমার অপারগতা জানালাম কাচুমাচু মুখে। ড্যামেজ কন্ট্রোল করলাম ওঁর হিম যুগ বইয়ের একটা কবিতা শুনিয়ে। আমি জানি না, সেই ডকুফিল্মটা আদৌ তিনি বানাতে পেরেছিলেন কিনা। শ্রদ্ধা জানাই।

    ReplyDelete