Pages

Tuesday, 25 May 2021

প্রলয়ের মুখে

বিপন্ন কলকাতা ও সুন্দরবন

সোমনাথ গুহ


এক বছর আগে এই মে মাসে আমফান যখন তার রুদ্র রূপ নিয়ে কলকাতার দোরগোড়ায়, তখন সুদূর আমেরিকাতে বসে স্বনামধন্য সাহিত্যিক অমিতাভ ঘোষ শহরে তাঁর প্রিয়জনদের নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে টুইট করেন: 

'ঠিক এই মুহুর্তে কলকাতায় আমার পারিবারিক বাড়ি ঘূর্ণিঝড় আমফানের চোখে অবস্থিত। ল্যান্ডলাইন এখনও কাজ করছে। ঝড় আরও তীব্র হচ্ছে এবং এই সময়ে নিজের আপনজনদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মন অস্থির হয়ে উঠছে।'

লেখক তাঁর এক বিদেশি বৈজ্ঞানিক বন্ধুর মাধ্যমে এই সাইক্লোনের দাপট সম্পর্কে কয়েক দিন আগে থেকেই অবহিত ছিলেন। তিনি কলকাতায় তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের সতর্ক করেন। তিনি বলেন, দু-একজনের মনোভাব ছিল ‘ও দেখা যাবে’ ধরনের। আসলে বেশির ভাগ বাঙালির ধারণা হচ্ছে যে ঝড়গুলো হয় ওড়িশা নয় বাংলাদেশের দিকে চলে যায়। 

বঙ্গোপসাগর ঐতিহাসিক ভাবে ঘূর্ণিঝড় প্রবণ। একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, পৃথিবীর ইতিহাসের অতি প্রবল ৩৫টি সাইক্লোনের মধ্যে ২৬টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। সাইক্লোন থেকে মৃত্যুর ৪২ শতাংশ হয়েছে বাংলাদেশে, ২৭ শতাংশ ভারতবর্ষে। অতীতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, যাতে আজকের ওড়িশা এবং বাংলাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা বহুবার ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত হয়েছে। পরবর্তীকালেও এই অঞ্চলের যে কোনও শক্তিশালী ঝড় এই দুটি রাজ্য এবং দেশকে একই সাথে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ১৭৩৭'এর বেঙ্গল সাইক্লোন ভারতবর্ষের ইতিহাসে রেকর্ডভুক্ত সবচেয়ে মারাত্মক ঝড় হিসাবে গণ্য হয়। তিন লক্ষ মানুষ মারা যান, ২০,০০০ জাহাজ ধ্বংস হয়। আরেকটি মারণঘাতি ঝঞ্ঝা ছিল ১৮৬৪'র 'ক্যালকাটা সাইক্লোন' যাতে ষাট হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। খেজুরি আর হিজলির বন্দর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। 

ইদানীংকালের অন্যতম ধ্বংসাত্মক ঝড় হচ্ছে ১৯৯৯'র ওড়িশা সাইক্লোন, যদিও এটি পশ্চিমবাংলাকে সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি। মৃতের কোনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। মনে করা হয়, সংখ্যাটা ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০। এই সুপার সাইক্লোনের পর ওড়িশা সরকার তাদের বিপর্যয় মোকাবিলার সিস্টেম ঢেলে সাজায় যা এখন বিশ্বে অন্যতম সেরা বলে গণ্য করা হয়। ২০০২'এর নভেম্বর মাসের ঝড় ১০০ কিমি বেগে সাগরে ভূমি স্পর্শ করে, পশ্চিমবাংলায় ১৩৭ জন মারা যান।

তারপরে ২০০৯'এ আসে বহুকথিত আয়লা যা বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গকে ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, পশ্চিমবাংলায় ৪৫ জন মারা যান, যার মধ্যে ১৮ জন কলকাতায়। পরবর্তীকালের রিপোর্ট অনুযায়ী, সারা রাজ্যে ১,৭৫,০০০ বাড়ি ধ্বংস হয় এবং আরও ২,৭০,০০০ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং প্রায় ২৩ লক্ষ মানুষ স্থানান্তরিত হয়। যেটা আরও ক্ষতিকারক ছিল, বহু নদীবাঁধ ভেঙে সমুদ্রের জল ঢুকে কৃষিজমি লবণাক্ত করে দেয়। হিসাব অনুযায়ী, ৫০,০০০ হেক্টর জমি নষ্ট হয়ে যায় এবং বহু কৃষিজীবী মানুষ তাঁদের বংশানুক্রমিক জীবিকা ছেড়ে শহরে মুটেমজুরের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন। 

পরের দশ বছরে বঙ্গোপসাগর থেকে উদ্ভুত ঝড় মূলত নিরীহ ছিল। এটা লক্ষ্যণীয় যে, তারপর ২০১৯ থেকে গত দু' বছরে অন্তত চারটে শক্তিশালী সাইক্লোন বাংলা, ওড়িশা, বাংলাদেশে আছড়ে পড়েছে। ২০১৯'এর এপ্রিল মাসের ‘ফণী’ মূলত ওড়িশায় আঘাত হানে, ৬৪ জন মারা যান। ওড়িশা লাগোয়া বাংলার কিছু জেলাতেও এর প্রভাব পড়ে। ঐ বছরই নভেম্বরের নয় তারিখে সাইক্লোন ‘বুলবুল’ ১৩৭ কিমি বেগে পশ্চিমবাংলায় আছড়ে পড়ে। প্রায় পাঁচ লক্ষ বাড়ি ধ্বংস হয় এবং প্রচুর জমি নষ্ট হয়। এর পাঁচ মাসের মধ্যে ১৯৯৯'র ওড়িশার সুপার সাইক্লোনের পর আরও একটি সুপার সাইক্লোন ‘আমফান’ ১৫৫ কিমি বেগে বকখালির কাছে ভূমি ছোঁয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আয়লার থেকেও ভয়ানক ছিল আমফান। অন্তত ৮৬ জন মারা যান। প্রবল জলোচ্ছ্বাসের কারণে সমুদ্রের জল সুন্দরবনের অন্তত ১৫ কিমি অবধি ভিতর ঢুকে যায়। ৮৮,০০০ হেক্টর ধান এবং ২,০০,০০০ হেক্টর আনাজ ও তিল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই ঝড় সরাসরি কলকাতায় আঘাত করে, ১৫ জন মারা যান। প্রায় ৫০০০ বিদ্যুতের খুঁটি, কেবল লাইন উপড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় ৭২ ঘণ্টা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে বিদ্যুৎ, জল, মোবাইলের কানেকশন ছাড়া থাকতে হয়। 

আগামীকাল দুপুর নাগাদ ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ ১৫৫-১৬৫ কিমি গতিতে বালেশ্বরে আছড়ে পড়বে। আবহাওয়া বিজ্ঞান অনেক আধুনিক হয়ে যাওয়ার কারণে এখন কয়েক দিন আগে থেকেই ঝড়ের গতি এবং গতিপথ আন্দাজ করা যায়। এর ফলে মৃত্যুর সংখ্যা সীমিত রাখা যায়, যদিও বারবার প্রচুর ঘরবাড়ি ধ্বংস হয় এবং শস্য ও জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়। 

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ এত ঘনঘন ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে কেন? দু' বছরে চারটি এবং প্রতিটি যথেষ্ট শক্তিশালী। মনে করা হয়, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও সমুদ্রের জলের উপরি স্তরের তাপ বৃদ্ধির কারণে সাইক্লোন সৃষ্টি হয়। এর ফলে সমুদ্রের নিকটবর্তী শহর সংকটাপন্ন হয়। যেমন, সুন্দরবন সমুদ্র ও কলকাতার মধ্যে বাফার হিসাবে কাজ করে। প্রলয়ের মূল ঝাপটাটা এই বনাঞ্চল আটকে দেয়। এতে সুন্দরবনের ভূমি ক্ষয় হয়, নোনা জল কৃষিজমিতে ঢুকে লবণাক্ত করে দেয়। মানুষ কৃষিকাজ ছাড়তে বাধ্য হয়, গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় করে। এর দুটি কুফল: 

এক, সুন্দরবনের পাড় ধীরে ধীরে ধসে যেতে থাকে যা সুন্দরবন এবং  শহর উভয়ের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। 

দুই, ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হতে থাকে, মানুষ নিঃস্ব হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরে এসে ভিড় করে এবং দিনে দিনে শহরের জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটে। জনসংখ্যা প্রবল বৃদ্ধির কারণে তথাকথিত উন্নয়ন লাগামছাড়া হয়ে যায়। ভোগবাদী জীবনযাপনের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যাপক হারে মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর্স, জিম, অত্যাধুনিক স্পা, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি নির্মিত হয়। পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতলে শহর ছেয়ে যায়। পানীয় জলের প্রয়োজনে বেলাগাম ভূ-জল নিষ্কাশন হয়, শহরের ভূ-জলের স্তর ধীরে ধীরে নামতে থাকে। 

শহর কলকাতা জলাভূমি ও পলিমাটির ওপর স্থাপিত। এর ভিত সূচনাকাল থেকেই নরম ও ঠুনকো। শহরটিকে বাঁচানোর জন্য আর একটি প্রাকৃতিক বাফার হচ্ছে পূর্ব কলকাতা জলাভূমি। শহরকে কল্লোলিনী করার তাগিদে সেই ষাটের দশক থেকে এই জলাভূমিতে বৈধ-অবৈধ নির্মাণ চলছে। পুরো সল্ট লেক উপনগরী বিভিন্ন লেক, জলা, বিল বুজিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে। সেটির ভিতও পলকা ও ঠুনকো। ইএম বাইপাস জলাভূমি এবং শহরের আরও সর্বনাশ করেছে। প্রথম কথা, তা জলাভূমিকে আরও সংকুচিত করেছে। দ্বিতীয়ত, শহরের বৃষ্টির জল আগে যেমন প্রাকৃতিক উপায়ে জলাভূমিতে গিয়ে পড়ত, তা এখন আর সম্ভব হয় না। কারণ, এই রাস্তা একটা বাঁধের মতো হয়ে গিয়ে সেটাকে আটকে দেয়। শহর হয়ে গিয়েছে একটা গামলার মতো, যেখানে অতিরিক্ত জল রুদ্ধ পয়ঃপ্রণালি এবং বাইপাসের কারণে বেরোনোর জায়গা পায় না, যার ফলে অল্প বৃষ্টিতেই শহর হয়ে পড়ে জলমগ্ন। 

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বিপন্ন- এটা বারবার পরিবেশবিদরা বলছেন, কিন্তু তবুও নিত্য নতুন প্রকল্পের শেষ নেই। চিংড়িঘাটা থেকে নিউ টাউন একটি ফ্লাইওভারের পরিকল্পনা গত তিন বছর ধরে চলছে যাতে নাকি মাত্র ১০-১২ কাঠা জলাভূমির জমি ব্যবহৃত হবে। কোর্ট কাছারি করে আপাতত সেটাকে আটকানো গেছে। আসলে বিপদ যে দোরগোড়ায়, এটাকে কেউ আমল দিচ্ছে না বা উপলব্ধি করছে না। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মিটলেই হল। বিভিন্ন দেশি ও বিদেশি সংস্থা কিন্তু বিপদ ঘন্টা বাজিয়েই যাচ্ছে। ‘ক্লাইমেট সেন্টার’ নামক একটি সংস্থা বলছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ নাগাদ মুম্বই, কলকাতা, চেন্নাই এবং সুরাটের প্রায় পুরোটাই জলমগ্ন হয়ে পড়বে কিংবা নিয়মিত সেখানে বন্যা হবে। আর একটি সংস্থা বলছে, এই শতাব্দী শেষ হওয়ার আগেই এই চারটি শহর ছাড়াও নিউ ইয়র্ক, মিয়ামি এবং জাকার্তা পুরোপুরি ডুবে যাবে। 

বলাই বাহুল্য, বিশ্ব উষ্ণায়ন কমবে যদি কার্বন নির্গতকরণ কমে। এর জন্য প্যারিস চুক্তি হয়েছে। কিন্তু যে সব দেশ কার্বন নির্গতকরণের জন্য সবচেয়ে দায়ী তারাই সেই চুক্তি মানছে না। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিকে চোখের মণির মতো রক্ষা করতে হবে। ওখানে নতুন কোনও প্রকল্প করা যাবে না। বঙ্গোপসাগরে নিয়মিত তুফান উঠবে। অমিতাভ ঘোষ বলছেন, সেই প্রাচীন কাল থেকে ঝড়বৃষ্টি আমাদের লোককথা, সাহিত্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মঙ্গলকাব্যে তো প্রলয়ের ছড়াছড়ি; চাঁদ সওদাগরকে ব্যাতিব্যস্ত রাখার জন্য মনসা দেবী একটার পর একটা ঝড় সৃষ্টি করেন। পরিবেশ ব্যাপারটা মারাত্মক কিছু নয়, আবার নিরীহও কিছু নয়। সেটা তার নিজের গতিতে চলে। প্রকৃতিতে হস্তক্ষেপ করা আমাদের বন্ধ করতে হবে। সুন্দরবনে উন্নয়নের ধুয়ো তুলে শিল্প গড়া চলবে না, পর্যটনের ধুয়ো তুলে হোটেল, রিসর্ট গড়া বন্ধ করতে হবে।    


3 comments:

  1. 👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼
    তথ্যভিত্তিক আর একটি সুন্দর লেখা সোমনাথদার । 😊

    ReplyDelete
  2. পূর্ব কলকাতা জলাভূমির প্রসঙ্গে সল্টলেক এর সাথে রাজারহাট উপনগরী নির্মাণ,এতদ অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র ও প্রাকৃতিক পরিবেশকেও ধ্বংস করেছে কিন্ত।

    ReplyDelete
  3. বিপর্যস্ত প্রকৃতি পরিবেশকে মেরামত করতে রাষ্ট্রের কাছে ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি করতে হবে- উন্নয়নের নামে ও খনিজ সম্পদ তুলে আনার দেশি বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থে বন ধ্বংস অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে স্যুনের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। Reproduction of nature র কথা ভাবতে হবে।

    ReplyDelete