Pages

Wednesday, 12 May 2021

কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই

একটি মুশকিল আসান তথ্যভাণ্ডার

সোমনাথ গুহ


দেশে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। দৈনিক প্রায় চার লাখ মানুষ সংক্রামিত এবং চার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। মহামারির এই সুনামির ধাক্কায় দেশের ন্যূনতম যে স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো তা বিধ্বস্ত। বেড, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, ওষুধ প্রায় সব কিছুই অপ্রতুল। টিকার অভাবে টিকাকরণ থমকে গেছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার হাত তুলে নিয়েছে। রাজ্যগুলির ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা খালাস। 

প্রধানমন্ত্রী যিনি ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’এ হিরো সাজার চেষ্টা করেছিলেন, বুক বাজিয়ে বলেছিলেন ভারত করোনা নিয়ন্ত্রণে বিশ্বকে পথ দেখাচ্ছে, তিনি হঠাৎ মৌনবাবা হয়ে গেছেন। সর্বসমক্ষে তাঁকে আর দেখাই যাচ্ছে না। তাঁর স্যাঙাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি কিছুদিন আগেও বাংলায় নিয়মিত ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করছিলেন, তিনিও লা পতা। মানুষ দিশাহারা। 

বাংলায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবস্থা এতই করুণ এবং চিকিৎসা সামগ্রীর চূড়ান্ত অভাব যে সদ্য গঠিত সরকার চাইলেও প্রায় কিছুই করে উঠতে পারছে না। এই অবস্থায় রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী, ক্লাব, সাংস্কৃতিক সংগঠন বিপন্ন মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। প্রচুর ব্যক্তিগত উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায় এই ধরনের প্রচেষ্টা এতই বিপুল যে তা একটি লেখায় সমাবেশিত করা অসম্ভব। এখানে আমরা এই ধরনের কিছু উদ্যোগের কথা উল্লেখ করব যাতে মানুষ প্রয়োজনে এদের কাছ থেকে সাহায্য পেতে পারে। 

(১) পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিষেবা:

(ক) কোভিড রিসোর্সেস নামে সরকার একটি ওয়েবসাইট খুলেছে (http://covidresourceswestbengal.carrd.co/) যেখানে হাসপাতালের শয্যা, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন, প্লাজমা, রক্ত, অ্যাম্বুলেন্স, কোভিড টেস্ট, টেলিমেডিসিন ইত্যাদি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। 

(খ) স্বাস্থ্য ভবন হেল্পলাইন-১৮০০৩১৩৪৪৪২২২। রাজ্য সরকার বিভিন্ন হাসপাতালে যে ১৩৬৭ শয্যার (৩৭০টি ICU) ব্যবস্থা করেছে, তা সম্পর্কে ওপরের হেল্পলাইনে ফোন করলে জানা যাবে। 

(গ) SARI (Severe Acute Respiratory Infections) রুগী যাঁদের কোভিড পজিটিভ রিপোর্ট নেই তাঁদের হাসপাতালে ভর্তির জন্য একটা সার্কুলার জারি হয়েছে। কিন্তু এই ধরনের রুগীর জন্য সরকারি হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা মাত্র ২০-২৫। তাই বেড না পাওয়া অবধি, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসাবে অক্সিজেন দিয়ে রিলিফ দিতে হবে। 

(ঘ) কলকাতা কর্পোরেশন বাড়ি বাড়ি গিয়ে কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা করেছে- সকাল সাড়ে নটা থেকে দুপুর তিনটে। ফোন নাম্বার- ৯৮৩১০৩৬৫৭২ (অমিতাভ চক্রবর্তী)। লাইন প্রায়শই ব্যস্ত থাকে।  

২) রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ:

(ক) সর্বাগ্রে রেড ভলেন্টিয়ার্সদের কথা বলতে হয়। এটা মূলত ডিওয়াইএফ এবং এসএফআই'এর ছাত্রছাত্রী এবং যুবদের উদ্যোগ, যদিও সংগঠকরা দাবি করছেন যে অনেক সাধারণ ছেলেমেয়েও এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। সারা রাজ্য জুড়ে এঁদের কয়েক হাজার কর্মী কাজ করছেন। কলকাতার প্রতিটি ওয়ার্ডে এঁরা স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করেছেন। কোভিড রুগীদের সব রকমের সহায়তা করছেন। কিন্তু যুবশক্তি'র কলতান দাশগুপ্ত'র বক্তব্য অনুযায়ী, সমস্যা বিপুল। তিনি নিজেই দৈনিক ২৫-৩০টা শয্যা এবং অক্সিজেনের জন্য ফোন পাচ্ছেন। তাঁরা নিজেরা কিছু সিলিন্ডার যোগাড় করে রেখেছেন এবং ব্যক্তিগত ও সাংগঠনিক প্রভাব খাটিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছেন। সরকারি হেল্পলাইনের মাধ্যমেও কিছু মানুষের সমস্যার সুরাহা করতে পেরেছেন। হাসপাতালে শয্যা জোগাড় করা অতি দুষ্কর। কলতানের কথায় কোনও হাসপাতালই ফোন ধরে না, তাই নিজেরা গিয়ে কটা বেড খালি আছে তা জেনে আসতে হচ্ছে। দাহ করার জন্যও রুগীর পরিবার জেরবার হচ্ছেন। রুগীর মৃত্যু হয়েছে হয়তো বিকেল পাঁচটায়, কর্পোরেশনের লরি আসছে পরের দিন সকাল দশটায়। কলতান জানাচ্ছেন, এরই মাঝে পরিকাঠামোর সার্বিক উন্নতির জন্য তাঁরা ছোটখাটো দাবি তুলে ধরছেন। যোগাযোগ: কলতান দাশগুপ্ত- ৯৯০৩৮ ১৯৫২৯। 

(খ) গত ২৩ এপ্রিল থেকে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) সকাল নটা থেকে রাত এগারোটা অবধি টেলিমেডিসিন চালু করেছে। এই পরিষেবায় মাঝে এক-দুই ঘন্টা করে বিরতি আছে। পরিষেবা পাওয়ার জন্য বারোটি ফোন নাম্বার দেওয়া আছে। সংগঠনের কর্মী আকাশ দেশমুখ জানাচ্ছেন যে রোজ অন্তত ১৫০টি ফোন আসছে। এঁদেরও নিজেদের অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে। কেউ বেড চাইলে সেটা দিতে ২৪-৪৮ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ভবনে নাম নথিভুক্ত করতে রুগীরা নাজেহাল হয়ে যাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের সাহায্য করতে হচ্ছে। কিছু অ্যাম্বুলেন্স এবং শববাহী গাড়ির সংস্থাও পরিষেবা দিচ্ছে। অবস্থার সুযোগ নিয়ে কেউ কেউ প্রচুর পয়সা দাবি করছে। সে ক্ষেত্রে রুগীর পরিবার সচ্ছল হলে তাঁরা নিচ্ছেন, না হলে অন্যত্র দেখতে হচ্ছে। এঁদের পরিষেবা মূলত যাদবপুর, ঢাকুরিয়া, নেতাজিনগর, মুকুন্দপুর অঞ্চলে সীমাবদ্ধ। যোগাযোগ: আকাশ- ৯৮৩০৪ ৫১৭৬৭/ ৮৯৮১২ ৬০৯৩৯। 

(গ) আকাশ 'বোকাবুড়ো' নামক সংগঠনের সাথেও যুক্ত। এটি মূলত ছাত্রছাত্রী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দ্বারা পরিচালিত। গত ৫ মে এঁরা 8B বাস স্ট্যান্ডে একটি রক্তদান শিবির করেন। 

(৩) ডাক্তারদের উদ্যোগ:

(ক) পশ্চিমবঙ্গ ডক্টরস ফোরাম'এর টেলিমেডিসিনের পরিষেবা পেতে ফোন করুন: ৮৯২৯৪ ০৮২৮২।

(খ) লিভার ফাউন্ডেশন কলকাতার ১৪০ কিমি ব্যাসার্ধের মধ্যে ‘অক্সিজেন অন হুইলস’ পরিষেবা চালু করেছে। ফোন: ০৩৩-৪০৯১৮১৮১। 

(গ) যাঁরা বাড়িতে নিভৃতবাসে আছেন তাঁদের জন্য ডঃ কুণাল সরকার ফোনে পরিষেবা দিচ্ছেন: ৯৮৩০০ ৮০০০৬। একই উদ্দেশ্যে উনি একটা অ্যাপও চালু করেছেন। 

(৪) অন্যান্য ‘সামারিটান্স’:

(ক) ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’ গড়িয়ার কাছে পাটুলিতে 'সিটিজেনস রেসপন্স' নামে একটি কোভিড১৯ রিলিফ সেন্টার খুলেছে। মুমূর্ষু রুগীদের জন্য অক্সিজেন আর প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা এখানে আছে। হাসপাতালে বেড না পাওয়া পর্যন্ত অসুস্থদের পরিষেবা দেওয়া হবে। আপাতত পাঁচটি বেড আছে। এই উদ্যোগে বিভিন্ন চলচ্চিত্র শিল্পীরা যুক্ত আছেন। দুটি হেল্পলাইনের নাম্বার দেওয়া হল: ৯০৭৩১ ৩৯৬৬৬/ ৮৩৩৫৯ ৩০৯২৫।  

(খ) সাউথ পয়েন্ট এক্স-স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন এবং সিআইআই ইয়ং ইন্ডিয়ান্স, কলকাতা, থায়রোকেয়ার'এর সাহায্যে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে RTPCR টেস্টের ব্যবস্থা করেছে। এখানে নিজে এসে টেস্ট করাতে হবে। সময় সকাল সাড়ে নটা থেকে বিকেল তিনটে অবধি। মূল্য- ৫০০ টাকা।

(৫) রুগীদের খাদ্য সরবরাহ:

(ক) শ্রমজীবী ক্যান্টিন এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। গত বছরের ৩ এপ্রিল থেকে তাঁরা যাদবপুরে দুঃস্থ ও মেহনতী মানুষদের জন্য মাত্র কুড়ি টাকায় খাবারের প্যাকেট বিলি করছে। এতে ভাত, সবজি, ডিম/মাছ/মাংস থাকছে। সৌম্য মজুমদার জানাচ্ছেন, এখন গড়ে তাঁরা ৭০০ প্যাকেট বিতরণ করছেন। তাঁরা কোভিড রুগীদের বাড়িতেও পরিষেবা দিচ্ছেন। ডেলিভারি চার্জ অতিরিক্ত দশ টাকা। আপাতত ৯৬ ও ৯৯ নং ওয়ার্ডে এই পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। ফোন: সৌম্য মজুমদার- ৯৭৪৮৪ ৩৪৩০৯।

(খ) নাকতলা অরবিন্দ সংঘ কোভিড আক্রান্ত পরিবারে বিনামূল্যে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে। যোগাযোগ: সঞ্জু দেব- ৯৮৩০১ ২৮২০৮।

(গ) এছাড়া আনারি (৯৮৩১০ ০২১১০) এবং গড়িয়ায় কাবেরী ঘোষ (৯৪৭৭৯ ৮৩৯৬১) এই পরিষেবা দিচ্ছেন। তবে তা খরচসাপেক্ষ- নিরামিষ ও আমিষ গড়ে ১১৫ থেকে ২০০ টাকা। সমস্ত রকম কোভিড বিধি মেনেই খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। 

বোঝাই যাচ্ছে, আমাদের এই সীমিত তথ্যসম্ভার কলকাতা শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জেলাগুলিতে বহু নিবেদিত মানুষ নিঃস্বার্থ ভাবে রুগীদের জন্য কাজ করে চলেছেন। রাষ্ট্র যখন অন্তরালে চলে গেছে, পরিকাঠামোর অভাবে রাজ্য সরকার প্রায় অসহায়, তখন বিপন্ন মানুষদের এই সব অক্লান্ত, উদ্যমী সৈনিকদের ওপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। 

'আয় আরও হাতে হাত রেখে

আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।'


2 comments:

  1. সোমনাথ দা'র লেখার আমি বরাবরই ভক্ত । খুব ভালো লাগে ওনার লেখা । এত সুন্দর তথ্যবহুল ঝরঝরে গদ্যতে তিনি তাঁর লেখা সাজিয়ে তোলেন যে পড়তে এবং বুঝতে খুবই সুবিধা হয় । এই লেখাটিও সেই রকমই দুর্দান্ত এবং একটি লেখার মধ্যে অনেক কিছুর সন্ধান রয়েছে । খুবই উপকারী সময়োচিত লেখা । ❤️🌹🤘🏼

    ReplyDelete
  2. খুব ই ভাল লেখা। খুব ই সময়োচিত এবং প্রয়োজনীয় তথ্য বহুল লেখা। মানুষ কে সাহায্য করবে। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete