Pages

Saturday, 1 May 2021

আমাদের যাপন

সংস্কৃতির সাতকাহন ২

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


ফের কিছু লিখতেই হচ্ছে পাঠকদের চাহিদা বা চাপ মনে রেখে। 

লেখা হয়নি এই রাজ্যের ভোট সংস্কৃতি নিয়ে। কী বা লিখি তা নিয়ে। দাদাঠাকুর এই সংস্কৃতির সরস বর্ণনা দিয়েছেন আগেই- আমরা তা মনে রাখিনি এবং তারপরেও তা নিয়ে মেতেছি ও নেচেছি। এর দায় কার? একজন পাঠক বলেছেন যে এর দায় অনেকটাই বামফ্রন্ট কুশাসনের। তাঁর ক্ষোভ ভিত্তিহীনও নয়। তবে সব দায় বামফ্রন্ট সরকার বা বাম দলগুলির এই কথা বলার যোগ্যতা কি আছে আমাদের?

এ কথা অবশ্য স্বীকার করতে হয় যে, বাঙালি স্বভাবত বামপন্থী। রসিদ আলি দিবস, ট্রামভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, তেভাগা এই বাংলা দেখেছে। সক্রিয় অংশ নিয়েছে। বামপন্থীরা সেই সব আন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন। তারপর? এই রাজ্যের স্বাধীনতা যোদ্ধারা বা সুভাষচন্দ্র তো বামপন্থীই ছিলেন।  

গান্ধী বা নেহেরু আমাদের বিপ্লবীদের এমনকি সুভাষচন্দ্রকেও  নাকি তেমন পছন্দ করতেন না। সবটাই গুজব? স্বাধীন ভারতে গণতন্ত্র পেয়ে আমরা যেন সে সব ভুলে গণতন্ত্রের উৎসবে নেহরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসকেই শাসন করার ক্ষমতা দিয়েছি, পরাস্ত হয়েছে (বলা যায় পর্যুদস্ত হয়েছে) বামপক্ষ। বিধান রায় নাকি নতুন বাংলার রূপকার। আমরাই বলেছি। আমরাই অবশ্য এও বলেছি: 'বাংলার আকাশে নলিনী-বিধান/ বাংলার পুর নারী হও সাবধান'। 

বামেরা শাসনের অধিকার পায় ১৯৬৭তে- স্বাধীনতার ২০ বছর পরে। তাও তা পায় কংগ্রেসি ঘরানার অজয় মুখার্জির হাত ধরে এবং দেশের অন্য অংশের সাথে তাল মিলিয়ে। 

বলতে হচ্ছেই যে প্রথম ২০ বছর আমরা যখন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছি তখন বামেদের দূরে ঠেলেছি। এ কালে, আমাদের ভোট সংস্কৃতিতে যা কিছু নিন্দার তা প্রথম কুড়ি বছরেই স্পষ্ট হয়েছে। (সবটা স্পষ্ট হয়েছে এমন নয়। হবে কেমন করে? এমন মিথ্যেবাদী প্রধানমন্ত্রী এই দেশ তো আগে পায়নি। তবে ভুললে চলবে কেন যে তিনিও  নির্বাচিত!) দেশের অন্য অংশের মতো এখানেও প্রশাসকরা আর যেন স্টিলফ্রেম রইলেন না, তারা অল্প অল্প করে ক্ষমতার ভাগ ও সুখ নিতে এগোলেন। কেরলে নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে অগণতান্ত্রিক পথ ধরে বিদায় করা হলেও আমরা ক্ষোভে ফেটে পড়িনি। কোনও ভেজাল-কারবারিকে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলানো হয়নি, এই রাজ্যের মানুষ তা মেনেছে। মেনেছে বিচারক নিয়োগে শাসক দলের পছন্দ। দলত্যাগী অশোক মেটাকে মন্ত্রীপদে বসানো হল, প্রতিবাদ করিনি। মেহেরচাদ খান্না হয়ে উঠলেন কেবল যেন পাঞ্জাবের নেতা, বাঙালি উদ্বাস্তুরা তাঁর হিসেবে ব্রাত্য হয়ে রইলেন। দোষ দেব কাকে? ক্ষিতীশ নিয়োগীর আমলে বা সুভাষ-সুহৃদ খান সাহেবের কাছেও আমরা পেলাম মাত্র কিছু আশ্বাস! 

কেশবদেও মালব্যর দুর্নীতির কথা সর্বজনবিদিত। আয়ারাম-গয়ারামদের প্রধান রাও বীরেন্দ্র সিংহকে মাথায় তুলেছি আমরা, এ দেশের ভোটাররাই। এসব সত্য স্মরণে রাখলে কেবল কী বামেদের দোষ দেওয়া যায়? এর অর্থ এই নয় যে তাদের বা বাম জমানার অবদান কিছু নেই। অবশ্যই আছে এবং তা অনেকটাই। দেওয়াল জুড়ে এঁরা লিখলেন শিক্ষা আনে চেতনা (লেনিন এমন কথা কবে বা কোথায় বলেছেন তা কেউ জানে না) এবং তাঁদের আমলেই আমরা শিক্ষায় ক্রমাগত পিছু হটেছি। তখন বুঝিনি বা বুঝতে চাইনি যে ওসব আসলে দেওয়াল দখলে রাখার কৌশল মাত্র। এরা আমাদের দীর্ঘকাল যেন 'রেখেছে ভোটার করে/ মানুষ(কম্যুনিষ্ট) করেনি'।  লিউসাওচি লিখেছিলেন How to be a Good Communist। বুঝিয়েছিলেন কেন কম্যুনিষ্ট হওয়া ভারি শক্ত কাজ। তাই তো এই সেদিনও কোনও কম্যুনিষ্ট দলের সদস্যপদ পাওয়া শক্ত ছিল। এরপর একছত্র মার্কস বা লেনিন চর্চা না করেই সব দলের সদস্য, এমনকি নেতাও হতে থাকলেন। ভোটের নেশায় ভুলে গেলেন ও ভুলিয়ে ছাড়লেন মার্কসবাদ। তাঁরা শাস্তি পেয়েছেন, ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। কিন্তু আমরা কি মুক্তি পেলাম? কেন তবে রামমন্দির নিয়ে এত নাচানাচি, সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানো, কোভিড সামলাতে ব্যর্থ নেতাদের এমন তর্জনগর্জন? 

এর দায় আমাদেরও। অসাম্য দেখেও মুখ খুলিনি, জিডিপি দিয়ে দেশের প্রগতি মাপার পদ্ধতির নিন্দায় মুখর হইনি আমরা। কৃষিপ্রধান এই দেশে আমরা আরও চাকরি, আরও ভারি শিল্পের দাবি তুলেছি। এসবে যে দক্ষিণপন্থীদের তথা এই দেশের সংকীর্ণ দলীয় নীতিগুলোই শক্ত হয়েছে কিনা (যার একমাত্র মহান লক্ষ্য ভোট কুড়োনো), তা কি ভেবে দেখেছি? প্রথম কৃষি বিপ্লব ব্যর্থ হতে কর্তাদের নজরে এল পূর্বাঞ্চলের জলসম্পদ। এক মহাপণ্ডিত অর্থমন্ত্রী ও ততোধিক জ্ঞানী রাষ্ট্রপ্রধান সায় দিলেন। আমরা প্রতিবাদ করেছি কী? আরও কৃষি-উৎপাদন বাড়াতে তাঁরা ঘেঁটে দিতে চান পরিবেশ। আমরা কি ভেবেছি পরিবেশের কথা! অথচ, তার কথা ভেবে দেখতেই হবে, আজ বা কাল বা পরশু। ভুলতে হবে ভোট রাজনীতির এই সংস্কৃতির শিকড় নেই এই বাংলায়, কদাচ ছিলও না। কানাইলাল, সূর্যসেন বা ক্ষুদিরাম কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে সমর্থন চাইতে যুদ্ধ করেননি। তাঁরা স্বাধীনতা চেয়ে, সম্মান চেয়ে, নীতি ও আদর্শে উদ্বেল হয়ে লড়াই করেছিলেন। তেমন আর একটা লড়াই শুরু হোক এই প্রার্থনা। ভোট সংস্কৃতি ছেড়ে সে সংস্কৃতির উপাসকদের চোখে স্পষ্ট করে দিতে হয় কানাইলালদের বাংলা কেমন ছিল, কেমন আছে।


No comments:

Post a Comment