Pages

Wednesday, 21 April 2021

'শুয়ে আছি শ্মশানে...'

ক্ষমা করো... ত্রিকালজ্ঞ 

অমৃতা ঘোষাল


'এখনো যে ও যুবক আছে প্রভু !' ( 'মাতাল ', শঙ্খ ঘোষ )।

কবিরা চিরযুবক। আসলে ত্রিকালজ্ঞরা যুবকই হন, আমরা জোর করে তাকে প্রৌঢ় কিংবা বৃদ্ধ বানাই। শঙ্খ ঘোষ (জন্ম: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২/ মৃত্যু: ২১ এপ্রিল ২০২১) ছিলেন সেই অ-নমনীয় প্রগলভ যুবক! লোকপুরাণ থেকে সহজপুরাণ পরিক্রমা করে গড়ে তুলেছিলেন এক স্বয়ংপুরাণ। কোথাও কোনও মূর্ছা কিংবা আত্মঘাত ছিল না। ছিল শুধু এক মহৎ মুদ্রাদোষ- শব্দের সূক্ষ্মপীড়ণে মুহুর্মুহু কম্পিত হওয়া। যন্ত্রণার অমরাবতীই যে কবির প্রাণভোমরা। 

তাঁর কবিতায় শব্দ-বর্ণগুলো আর গৌরচন্দ্রিকা কিংবা ক্ষমাহীন রাতের কথকতা হয়ে রইল না, কারণ ক্রমশ শোনা যেতে লাগল পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ।

কবির জীবনকে একটু ফিরে দেখি। প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মণীন্দ্রকুমার ঘোষ ও মাতা অমলাবালা ঘোষ। দেশ বরিশালের বাণারিপাড়া আর জন্ম চাঁদপুরে মাতুলালয়ে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর পাঠ গ্রহণ। তারপর অধ্যাপনার ক্ষেত্রে প্রবেশ। বেশ কিছু কলেজের পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের কর্মজীবন। এছাড়াও দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ প্রভৃতির সঙ্গে তাঁর নাম অধ্যাপনার সূত্রে জড়িয়ে আছে। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে 'রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য' উপাধি লাভ করেছেন। অর্জন করেছেন নরসিংহ দাস পুরস্কার, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, রবীন্দ্র পুরস্কার, দেশিকোত্তম পুরস্কার, পদ্মভূষণ পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার প্রভৃতি আরও অনেক উল্লেখযোগ্য সম্মান। প্রথম বই সম্ভবত ১৯৫৬'এর জানুয়ারিতে প্রকাশিত কিশোরপাঠ্য জীবনী 'বিদ্যাসাগর'। ওই একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর প্রথম কবিতার বই 'দিনগুলি রাতগুলি' তেত্রিশটি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। শঙ্খ ঘোষের কবিতা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার সমান্তরালে বিদেশি ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। জার্মান, ফরাসি, চেক ভাষায় রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছে তাঁর কবিতা। এছাড়াও আবৃত্তি, ভাষ্যরচনা, রেকর্ড পরিচিতি লেখা ইত্যাদি কাজেও তিনি বেশ দক্ষ ছিলেন। কিন্তু কবিরা মহোৎসবে মাতেন না, একাকীর বৈভবে দূরে চলে যান। 'রাঙামামিমার গৃহত্যাগ' মনে পড়বে। ঘর-বাড়ি-আঙিনা-খাল-সাঁকো পেরলেও পালকেরা ছড়িয়ে থাকে। সেভাবে কবি আত্ম-গভীরে অবগাহন করলেই  শব্দ-ব্রহ্মরা তাদের অস্তিত্ব জানান দেয়। যেমন শঙ্খ ঘোষের শ্রেষ্ঠ কবিতার প্রবাহে নিরন্তর জেগে থাকবে 'যমুনাবতী' কিংবা 'বাবরের প্রার্থনা'।

আসলে প্রত্যেক কবির অন্তরে 'দাইমন' বসত করেন। অজ্ঞাত সময়ে তাঁরা কবির নিজস্বতা আর মৌলিকতাকে প্রভাবিত করেন। কবিতায় 'এরস' আর 'থ্যানাটস'এর বিচিত্র গতি বুঝিয়ে দেয় সেই 'দাইমন'এর উচ্ছ্বাস। শঙ্খ ঘোষ খুব সহজেই বলতে পারতেন, তাঁর 'দাইমন' হল উদ্ভিদ। কিন্তু উদ্ভিদের শিকড় তো বহুগামী, আর ডাল তার বহুমুখী। আসলে কবি মাত্রেই জানেন যে জীবন মানেই মাটি-পাথর-আকাশ টপকানোর খেলা। আর পাহাড় টপকাতে গিয়ে হঠাৎই এসে পড়ে শুশুনিয়া। তাঁর 'শুশুনিয়া' কবিতায় এসে আর আমরা টপকাতে পারি না 'সাঁওতাল সঙ্ঘের আদিমানবীর চোখ' কিংবা 'খরা' কবিতার সেই অমোঘ প্রশ্ন 'পুরুলিয়া তোমার সংসার?'। পুরাণের আর্কেটাইপ নারীদের মুখোমুখি দাঁড় করান শ্মশান-শিব আর পথভিখারিদের। চুনবালির মতো খসে পড়ে তাদের আলগা পৌরুষ। কবিই পারেন লিঙ্গচেতনা নির্বিশেষে প্রতিভাময় মানবত্বকে জাগিয়ে তুলতে। তাই ঝরা বালিকে মন্থন করলেই ধমনীতে রক্তের স্রোত বাড়ে আর ঝলকে ঝলকে বিষ ওঠে। খুব লোভ হয়- শঙ্খ ঘোষকে একবার 'নীলকন্ঠ' অভিধা দিই!

শঙ্খ ঘোষ মহানগরের মহাপথিক, 'কইলকাত্তা'র কবি। শব্দ দিয়ে ছুঁয়েছেন শ্যাওলাপচা লাশ থেকে শ্যামবাজারের কাছাকাছি কোনও বোকার প্রত্যেকটা কোষ। রেড রোড কিংবা ময়দানে ভেসে চলা 'একলা অসামাজিক' আর তার চোখে জমে থাকা ঘোলা জলে ভিজতে থাকে শঙ্খ ঘোষের কবিতার শব্দেরা। তাঁর 'বাবুমশাই' কবিতায় মিলে যায় উনিশ শতকীয় আশ্রয়। এক কলকাতার মধ্যে সত্যি আরেকটা কলকাতা লুকিয়ে থাকে। তাকে গাড়ির জানলা দিয়ে নয়, হেঁটে অনুভব করতে হয়। হাঁটতে হাঁটতেই আমরা প্রত্যক্ষ করি 'এই শহরের রাখাল'-কে, যে দিব্যি সব ভুলে গরুর পিঠে দাঁড়িয়ে গর্বে ফেটে পড়ে। কিংবা কখনও তুলে ধরেন মহানগরের রাতের ছবি- শহরের পাঁচ মাথায় রিপুর ভিড় আর কেবিন-পর্দার আড়াল কিংবা গভীর ময়দানে নষ্ট-ত্রস্ত-শুষ্ক-তুখোড়-খুচরো-প্রখর চুম্বন। চোখের চাওয়া বিকিয়ে যাওয়ার আগে 'চোখের পাতা চায় চোখের চুম্বন।' কলকাতার সংবেদনার  সঙ্গে মিশেছে কখনও ঢাকা শহরেরও গন্ধ। যেমন 'ঢাকা ১৯৭৫' কবিতায় রয়েছে ধুলো আর কৃষ্ণচূড়াকে সাক্ষী রেখে এক মুক্তিকামী সত্তার দীপ্র অভিজ্ঞতা। কিংবা 'মনোহরপুকুর' কবিতায় ধরা পড়েছে নাগরিক ত্রাস আর সময়ের চোরাবাঁক।

কবি হতে গেলে 'ব্যক্তিগত আমি'র মার্জিন ভাঙতে হয়। অতীত-অভিসার তাঁর কবিতায় যেমন উঠে এসেছে, তেমনই প্রকট হয়েছে তাঁর রবীন্দ্র-জিজ্ঞাসাও। কবির ছাত্ররাই বলেন যে স্থিতপ্রজ্ঞ কবি তাঁর ইতিহাস-চেতনা আর রবীন্দ্র-ভাবনাকে সর্বদাই ক্লাসরুমের মার্জিন থেকে মুক্ত করতেন। তাঁর গদ্যগ্রন্থ 'এ আমির আবরণ', 'কবিতার মুহূর্ত' কিংবা 'কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক'এ দেখিয়েছেন রবীন্দ্ররচনার পদ্ধতি-প্রকরণ। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছেন রবীন্দ্র-বিরুদ্ধবাদীদের সমস্ত যুক্তিও। সহিষ্ণু ও দূরদর্শী শঙ্খ ঘোষ সমস্ত মিথ ভেঙে পাঠককে চিনিয়েছেন আধুনিক রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্র-গানের আলোচনায় তিনি মাথা নত করেছেন দুঃখতত্ত্বের গভীরে, যে দুঃখের গভীরে শুধুই প্রাপ্তির আনন্দ। ক্যাথারসিস্!

শঙ্খ ঘোষ ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনেরও কবি। 'কৃত্তিবাস' থেকে 'কবিতা', 'কৌরব' থেকে 'এক্ষণ' কিংবা 'বিভাব' থেকে 'প্রমা' প্রভৃতি তাঁর মননশীলতার স্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়নি। অনুবাদক হিসেবে কিন্তু শঙ্খ ঘোষ কখনও এতটুকু নিয়ম ভাঙেননি। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিই ছিল অনুবাদক নয়, মূল কবিকে পাঠকের কাছে বিম্বিত করার। সম্পাদক হিসেবেও যথাসম্ভব সূক্ষ্ম-দৃষ্টি বজায় রাখতেন শিল্পী শঙ্খ ঘোষ।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন আজীবন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হিসেবে কোনও বিজ্ঞাপনী প্রচারের অঙ্গ কখনওই হননি। মানুষকে প্রত্যক্ষ করিয়েছেন- দেশ আমাদের কোনও মাতৃভাষা দেয়নি। ক্ষিপ্ত জনতাকে দেখিয়েছেন- দেশকে আমরা একমাত্র পাথরেই ছুঁই। আমরা তাঁর লেখা পঙক্তি উচ্চারণ করে বুকে ভরে নিয়েছি অক্সিজেন। কিন্তু কবিকে কী দিয়েছি? একরাশ হতাশাই শুধু।

গৃহবন্দী কবি নিস্তার পেলেন না আর। করোনা শেষ শমন হয়ে ছিনিয়ে নিল তাঁর বিধ্বস্ত প্রাণটুকু। বেঁচে রইল তাঁর কাব্যভূমি, শব্দ-বিশ্ব। প্রণাম জানানোর আগেও আমরা যেন তাঁর আত্মার কাছে ক্ষমা চাই। আর ক্ষমা চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই  শান্ত কবি যেন এক্ষুনি বলে উঠলেন-

'শুয়ে আছি শ্মশানে। ওদের বলো/ চিতা সাজাবার সময়ে/ এত বেশি হল্লা ভালো নয়।' (ধর্ম)।

 

6 comments:

  1. ধন্যবাদ...

    ReplyDelete
  2. শোক কদাচিৎ শ্লোক হয়ে ওঠে। আপনার সংবেদী গদ্যে অন্তর্লীন কবিতার স্পর্শ পেলাম। লেখাটির তার প্রাসঙ্গিকতা ও উজ্জ্বল্যে অনেকদিন মনে থাকবে।💐💐

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ স্যার l অমৃতা

    ReplyDelete
  4. সুন্দর উপস্থাপন। নিটোল নিরবিচ্ছিন্ন নিরলস অতন্দ্র এক সৃষ্টিশীল সম্পৃক্ত জীবনকে ছোট্ট পরিসরে তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ। কিছু না জানা ও কিছু জানার মেল বন্ধনে সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete
  5. ভালো লাগলো। সুন্দর উপস্থাপনা।

    ReplyDelete