Pages

Thursday, 29 April 2021

সত্যজিৎ ১০০

প্রান্তিক চরিত্রগুলিই তাঁর ছবির পরমাত্মা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 


সৃজনশীল মানবজনেরা প্রজন্ম ধরে ধরে ক্রমে ক্রমে স্পষ্টতর হন। তাঁদের রেখে যাওয়া কাজ ও বোধ সমূহকে বারবার অবলোকন করে তবেই ধীরে ধীরে তাঁদের নাগাল পাওয়া যায়; যে কাজ ব্যাপৃত তাঁদের সৃজন ও যাপনের প্রতিটি মুহূর্তে। আমরা এইভাবেই প্রতি প্রজন্মে ও সময়ের উজানে শনাক্ত করতে থাকি এ তাবৎ কাল অবধি সেই সব অজস্র অনুক্ত মূর্ছনাগুলি। সে এক আবিষ্কারের আনন্দ- বলা ভালো, ‘দৃষ্টি মোদের যায় যতদূর/ সৃষ্টি তোমার ছড়ানো’। আসলে, অনন্ত মহাকাশকে জানার জন্যই প্রতিনিয়ত দৃষ্টিকে প্রসারিত রাখতে হয়।

তাই, সত্যজিৎ কখনও ফুরোন না। তাঁকে বারবার দেখে, পড়ে, ভেবে, স্মরণে-বিস্মরণে নিয়েও, তিনি বহু আলোকবর্ষ দূর হতেও সতত পরিস্ফুটমান। তাঁর প্রায় প্রতিটি ছবির মধ্যে তিনি শুধু বর্তমানের হদিশ দেন না, এমন ভাবে সেগুলিকে গ্রথিত করেন যে তা ভবিষ্যতের গর্ভেও অম্লান হয়ে ওঠে। এই কাজটা তখনই সম্ভব যখন প্রধান চরিত্রগুলির আশেপাশে অন্যান্য কম সময়ের চরিত্রগুলিও সমান গুরুত্ব ও ওজন নিয়ে বিরাজ করে। বলাই বাহুল্য, তাঁর সৃজনশৈলীতে প্রধান চরিত্রের ওপর ফোকাসটাকে খানিক আলগা করতেই এই পার্শ্বচরিত্রগুলির অবস্থান; প্রধান চরিত্রের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে ভাঙতেই আরও এমন কিছু চরিত্রের সমাবেশ, যা গল্পের অভিকর্ষকে নিয়ে যায় বহমান সময়ের দিকে। আর সে ভাবেই তা হয়ে ওঠে এক অম্লান সৃজন।

অর্থাৎ, গল্প ও তার দৃশ্যায়নের এমন এক সাবলীল ছন্দ তৈরি হয় যে অপ্রধান বা প্রান্তিক চরিত্রগুলি সত্যজিতের গোটা ছবিতে খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও বেশ সমুজ্জ্বলে প্রতিভাত হয়ে এক নির্ণায়ক ছাপ রেখে যায়। এখানেই তাঁর ছবির অনন্যতা। কারণ, গল্পের একটি সমগ্রতা ও বুনোটকে তখনই আয়ত্বাধীন করা সম্ভব যখন তার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো বিচিত্র-কোলাহলে সপ্রাণ হয়ে ওঠে। কারণ, মনুষ্য-জীবন তো আর অমন নিপাট ভালোমানুষের মতো নয় যে সমীকরণগুলি খুব সহজেই মিলে যাবে, বরং, জনকোলাহলে পড়েই তার নানান অনিশ্চিত চলন-বলন তৈরি হয়।  

অতএব, তেমন তেমন প্রাসঙ্গিক জনকোলাহল-আবহ গড়ে তোলা ছিল সত্যজিতের ছবির মূল আকর্ষণ। তাই, গোটা ছবিকে ছাপিয়ে উঠে সেই তথাকথিত অপ্রধান টুকরোগুলিই কখনও কখনও যেন চোরাস্রোতের মতো কালের শরীরে চিরবহমান, যা বিনে ছবির নির্মাণ খানিক অস্ফূট হয়ে পড়ার কথা।



ধরা যাক, ‘পথের পাঁচালী’র প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের কথা। মুদির দোকানে পাঠশালা চালানো এই গুরুমশাই কিন্তু কচি ছাত্রদের প্রতি মোটে সদাশয় নন, বরং তাদের পেলব হাতে বেত্রাঘাতে বেশ তৎপর; তদুপরি, পাড়ার মাতব্বরদের হাতে রাখতে দস্তুরমতো সেয়ানা। গোটা ছবিতে এই পাঠশালা দৃশ্যের অবতারণা সম্ভবত অপু’র জীবনে লেখাপড়ার অনুষঙ্গকে বোঝাতে। কিন্তু সেটুকুও সবটা নয়। সে সময়ের গ্রামীণ জীবনের চলমান বৈচিত্র্যকে উপস্থিত করাটাও ছিল অবধারিত, না হলে বালক অপু’র চোখে বড়দের জগতের অজানা বিস্ময় ধরা দেবে কীভাবে? অধিকন্তু, পাঁচালী যখন পথের তখন এক পয়সার মুড়ি থেকে নাট্যশালার তামাশা, নিদেনপক্ষে যাত্রাপালার বায়নায় নিশ্চিন্দিপুরের বদ্যি মজুমদারের ক্ষমতা- সবই তো অপুর চোখে উন্মীলিত হওয়ার কথা!


অথবা, ‘মহানগর’ ছবিতে সুব্রত’র বাবা প্রিয়গোপালবাবুর নিম্ন-মধ্যবিত্ত গ্লানিটুকুকে না ধরে ছবিটিকে কি বহমান রাখা যেত? ইংরেজি স্কুল মাস্টারের চাকরি থেকে অবসর নেওয়া প্রিয়গোপালবাবু খবরের কাগজের ক্রসওয়ার্ড ধাঁধাঁ সমাধান করে নিজ প্রতিবেশীর কাছে সুপ্ত অহং’এর বড়াই দেখান বটে, কিন্তু তাঁর চশমাটি দীর্ঘদিন ধরে ছেলের ‘অবহেলায়’ অচল হয়ে থাকায় তার বিরুদ্ধে জমে ওঠা মনের সুপ্ত জ্বালাটিও মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর পুরনো ছাত্রদের দোরে দোরে ঘুরে তিনি অসহায়ের মতো জানাতে থাকেন তাঁর প্রতি ছেলের অবহেলার কথা। ভঙ্গুর সময়ের এই মাত্রা ব্যতীত ষাটের দশকের নব-নির্মিত ‘মহানগর’ সম্পূর্ণ হয় না। এক ঝটকায় সত্যজিৎ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সাজানো আত্ম-অহঙ্কারকে চূর্ণ করে দেন।

 

‘অপুর সংসার’এ অপু’র বন্ধু পুলু ছাড়া ছবিটি কি আদৌ এগোতে পারে? অপুর অনিশ্চিত সাবেকি জীবনে হঠাৎ করে কলেজ-বন্ধু পুলুর উদয়, তার সঙ্গে অপর্ণার বিয়েতে যাত্রা, কিছুটা পুলুর ধমকেই নিরুপায় অপর্ণাকে বিয়ে তারপর অপর্ণার মৃত্যু ও অপু’র হারিয়ে যাওয়া। অবশেষে সেই সুদূর অরণ্যপ্রান্তর থেকে অপর্ণা-শোকে বিধ্বস্ত অপুকে পুলুর ফিরিয়ে আনা। কাজলের সঙ্গে মোলাকাত। বলা যায়, পুলুই এ ছবির গাড়োয়ান। এক অত্যাশ্চর্য মানুষ। সে সময়ে এমন মানুষের দেখাও মিলত আর তাঁদের বেশ কদরও ছিল। তাই, এ ছবি শুধু নিছক এক ট্র্যাজিক গল্প বলে না, সে সময়ের মূল্যবোধকে এনেও হাজির করে। রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে অপু আর পুলুর বাক্যালাপ এ ছবির অন্যতম শ্রেষ্ঠ দৃশ্য ও অনবদ্য নির্মাণ। গোটা ছবির সঙ্গে এ দৃশ্যের যোগ হয়তো অপু’র সংবেদনশীলতাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু পুলুর মতো কারও উপস্থিতি ছাড়া অপু’র সে আত্মপ্রকাশ আর কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না।

 

‘World Wide Will Workers’ (wwww)’এর কর্ণধার জনৈক স্বামীজী ‘নায়ক’ ছবির একদম শেষে গিয়ে মুখ খুললেন। ছবি তখন আগের দৃশ্যেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গেছে। নেশাগ্রস্ত অরিন্দম তাঁর ভালো লাগা অদিতিকে অকপটে যা বলার বলতে চেয়েছেন। পারেননি। অদিতি শুনতে চাননি। পরের দিন সকালে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন যখন দিল্লি স্টেশনে পৌঁছবে, ছবির গতিও স্তিমিত হয়ে এসেছে, ঠিক তখনই আত্মপ্রকাশ তাঁর। তথাকথিত একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তিনি, নীরব অবলোকনে তাঁর সহযাত্রী প্রীতিশ সরকারের পেশাগত পরিচয় পেয়ে গেছেন, এবার তাঁর কাছে বিজ্ঞাপন বানিয়ে দেবার আর্জি। এ দৃশ্যে মজা আছে, আবার অসহায়তাও। অসহায়তা দু’ পক্ষেরই- একদিকে রাতের সফরে স্ত্রী ও এক শাঁসালো খদ্দেরের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে গিয়ে নাজেহাল বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্তা প্রীতিশবাবু, অন্যদিকে, ধর্মীয় বাবাজীর শখ তাঁদের সংগঠনের ব্র্যান্ড ‘উইল পাওয়ার’ টোটকার বিজ্ঞাপন বানাবার; কিন্তু সে সব যেন ততটা বিজ্ঞাপনের জগতে আদৃত নয়। গোটা ছবিতে স্বামীজীর স্বল্প উপস্থিতি একেবারে নীরব, কিছুটা আলগোছে ও নিভৃতে। হঠাৎ করে ছবির গুমোট ভাবটা কাটাতেই যেন চরিত্রটির বাক্য নিঃসরণ। এক অতুলনীয় দৃশ্যপট। রসিকতার এই মাত্রাযোগটি ট্রেনের গতি ও সময়ের চলার সঙ্গে কী নিবিড় আয়েসে ছন্দোময়। যেন বিধ্বস্ত ‘নায়ক’কে ঘুম থেকে তোলার এক হাল্কা প্রাক-মুহূর্ত।

 

বলাই বাহুল্য, ‘জনঅরণ্য’ ছবিতে বিশুদা ছাড়া ছবিটির গতিমুখই তৈরি হয় না। মুক্তির দশকের রাজনৈতিক আবহে উত্তপ্ত বাংলায় এক মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক সোমনাথ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের গোলকধাঁধায় যখন হাতড়ে বেড়াচ্ছে বেঁচে থাকার রসদ, তখন কলকাতার জনপদে কলার খোসায় আছাড় খেয়ে খেলার মাঠের দোসর বিশুদার সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা: সোমনাথের সামনে আচম্বিতে জীবনের এক সম্পূর্ণ নতুন পাঠ, কিছুটা দ্বিধাচিত্তে কল্পনাতীত সে জগতে নিঃশব্দ প্রবেশ। তারপর অর্ডার সাপ্লাই, নতুন মানুষজন, অচেনা পরিসর; চাকুরি মানসিকতায় অভ্যস্ত ভেতো বাঙালির ‘বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী’তে সুমতি। সে এক বিচিত্র সংঘাত ও দ্বন্দ্বাকীর্ণ আকস্মিক মোড়। কিন্তু বিশুদা তো এলেন, বললেন, চলে গেলেন। হাতে ফোলিও ব্যাগ, আঙুল মুঠোকৃত সিগারেট-পায়ী, ধুতি-পরিহিত রসিক মানুষটি বাঙালের হাইকোর্ট দর্শন সমাপন করে ডালহৌসি পাড়ায় তখন জাঁকিয়ে বসেছেন। তিনিই সোমনাথের পথ-প্রদর্শক। যে সোমনাথ এক কোম্পানির বড় ‘অর্ডার’ পেতে নিজের প্রিয় বন্ধুর বোনের শরীর নিয়ে বেসাতি করতে গোড়ায় দ্বিধান্বিত থাকলেও পরে মনের কালিমা ধুয়ে বাড়ি ফিরে বিভ্রান্ত পিতাকে বলতে কসুর করেনি যে ‘অর্ডার’টা সে পেয়ে গেছে।

 

আর উত্তর কলকাতার বনেদী পরিবারের উড়ুক্কে মানুষ রমেন মল্লিক ছাড়া তো 'চিড়িয়াখানা' ছবিতে একাধারে রহস্যের জট খোলা আর রস আস্বাদন- একই অঙ্গে দুই রূপ- সম্ভবই ছিল না। পয়সার জোর ও দিলদরিয়া মন- রমেন মল্লিকের এই দুই রসায়ন যোগে ছবিটি এগিয়েছে তাঁর কাঁধে চেপেই। সে সময়ের কলকাতার চরিত্র-চিত্রণেও এই মানুষটির উপস্থিতি সার্থক। শুষ্ক সমালোচক ব্যতীত অমন নিপাট চলচ্চিত্র রসিকই বা আজকাল আর তেমন মেলে কোথায়?

এইভাবে সত্যজিতের আরও অজস্র ছোট ছোট চরিত্রগুলিকে সময়ের বিচিত্র-সম্ভারে এনে উপস্থিত করা যায়। এমত প্রান্তিক চরিত্রের সমাগম তাঁর ছবিকে এক কালিক অনন্যতায় পৌঁছে দিয়েছে। তারাই ধরে থাকে ছবির রাশ। ফলে, ছবিগুলি কখনও পুরনো হয় না, মনে হয় না যে তাদের বুঝি আজ কোনও দায় নেই আর। বরং, বলতে ইচ্ছে করে, তাঁর ২০০ বছরেও একই ভাবে সমকালীন থেকে যাবে তাঁর প্রায় সমস্ত ছবি। কারণ, তিনি অমরত্বের যাদু জানতেন- কীভাবে স্বল্প সময়ের নানান চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে ছবিকে নিয়ে যেতে হয় সময়ের কন্দরে, যেখানে অন্তর্লীন থাকে মানুষের সর্বজনীন আশা-আকাঙ্ক্ষা, বোধ ও পরমাত্মা; জানতেন, যে এই অনন্ত ভুবনে সময়ের কোনও পরিমাপ নেই। তাই, তিনি তাঁর ছবির মতোই চিরভাস্বর, চিরন্তন। আলোকবর্তিকা।

     

5 comments:

  1. আহা বড্ড ভালো লাগলো🙏🏻
    আর ইন্দির ঠাকরুন তো কিছু বলার অপেক্ষা রাখেন না🤗

    ReplyDelete
  2. 🎬💥
    বাহ্, খুব সুন্দর আলোচনা করেছেন, অনিন্দ্যদা । সত্যজিৎ রায়ের যেরকম মুনশিয়ানা ছিল ছোটখাটো চরিত্রগুলোকে জহুরীর চোখ দিয়ে দেখে সকলের কাছে সহজ সরলভাবে তুলে ধরা, সেইরকম আপনিও তার সিনেমাগুলির এই সমস্ত প্রাণবন্ত প্রান্তিক চরিত্রগুলি সম্পর্কে এত সুন্দর আলোচনা করে আমাদেরকেও একটা দারুণ লেখা উপহার দিলেন । আসলে ছোটখাটো জিনিসের মধ্যেই জীবনের আসল মানে, প্রাণ লুকিয়ে রয়েছে । সাধারণেরা সেইসব জিনিসের মূল্য দিতে চান না, কিন্তু যারা প্রকৃত শিল্পী তারা সবসময়ই এদের মূল্যায়ন করেন । 🌹🙏🏼

    ReplyDelete
  3. যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা৷ অল্প সময়ের যে বা যাঁরা মঞ্চ কিংবা স্ক্রীন শেয়ার করেন৷ লাইমলাইট তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে না৷ তাঁদের প্রত্যেককেই সত্যিই "বিচিত্র সম্ভারে" আপনার এই দেখাকে সেলাম জানাই

    ReplyDelete
  4. দারুন বিশ্লেষণ।সমাজ জীবনের ছোটখাটো ঘটনা যে বৃহৎ ঘটনার অঙ্গাঙ্গি অনুসঙ্গ,এ লেখা সেটাই মনে পরিয়ে দায়।

    ReplyDelete
  5. খুব সুন্দর লাগল। সত‍্যজিৎ রায়ের ছোটখাটো Detailing এর ওপর এই কাজ রীতিমতো মন ছুঁয়ে যায়।👌👌

    ReplyDelete