Pages

Friday, 23 April 2021

কু-আশা

বাংলার ভোটই কি

ভারতের বুকে শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন?

শোভনলাল চক্রবর্তী


পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি'র আগ্রাসী প্রচার আমরা দেখছি। সেটা একটা ওপরের স্তর, যার ভেতরে রয়ে গেছে অনেক অভিসন্ধিমূলক অলিগলি। অনলাইন মার্কেটিং-এর সারাংশ থেকে শুরু করে বিহেভিয়ারাল সাইকোলজি-  কোনওটাই বাদ নেই এই প্রচারে। কীভাবে চলছে এই প্রচার? এবারের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি'র প্রার্থীদের বড় অংশ দুই ধরনের: এক) তৃণমূল কংগ্রেসের দলবদলুরা, দুই) তারকা প্রার্থী। এ ছাড়া রয়েছেন কয়েকজন নির্বাচিত সাংসদ, যাঁরা বিধানসভার ভোটেও দাঁড়িয়েছেন। এঁরা সবাই মানুষের কাছে গিয়ে বলছেন, আমাদের একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন আমরা কী করতে পারি। আর দিল্লির বড় নেতারা আকাশ বাতাস ভরিয়ে ফল প্রকাশের আগেই রোজ দিনে হাজারবার করে বলে চলেছেন বিজেপি জিতে গেছে, সঙ্গে উপরি হিসেবে বিলি করছেন প্রতিশ্রুতি আর বিজ্ঞাপন। 

জিতে গিয়েছি- এই প্রচারটা মানুষকে দ্বন্দ্বে ফেলার জন্য। মানুষের চিন্তাভাবনা যত গুলিয়ে যাবে ততই তাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বেশি সময় লাগবে; এই মাঝের সময়টা তাদের মন জয় করতে থাকবে বিজ্ঞাপন। এই যে মানুষ সর্বভারতীয় স্তরে একটা সময়ে বিশ্বাস করল নরেন্দ্র মোদিকে আনলেই 'অচ্ছে দিন'ও আসবে গুটি গুটি পায়ে, সেটা কি এমনি এমনি করল? এই বিশ্বাসটা এল বিজ্ঞাপন দেখে। এই বিজ্ঞাপনে একটা অন্তর্নিহিত প্রতিশ্রুতি ছিল যে ক্ষমতায় এলে যদি 'অচ্ছে দিন' না আসে তাহলে পাঁচ বছর পর সরকার পাল্টে ফেলা যাবে। অর্থাৎ, বিফলে মাল ফিরিয়ে নেওয়া হবে। নির্বাচনী গণতন্ত্রের যা নিয়ম। সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারে যে, একবার কাউকে ভোটে জিতিয়ে নিয়ে এলে তাকে আর পাল্টানোর উপায় থাকবে না, তা হলে লোকে নেতা বাছার ক্ষেত্রে আরও অনেক সাবধান হত। 

প্রচারের এই যে ভিত্তি এটা ধার করা হয়েছে অনলাইন রিটেল ব্যবসা থেকে। সেখানেও আমরা যে জিনিসটা কিনছি আসলে জিনিসটা কেমন, সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার উপায় নেই। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা ভরসা করবে কীসে? টাকা ফেরত দেওয়ার গ্যারান্টি হল সেই ভরসা। ফলে, অনেক সহজে আমরা জিনিসপত্র কিনে ফেলি। বিনা প্রশ্নে টাকা ফেরত দেয় বলেই অনলাইন রিটেলের এমন রমরমা ব্যবসা। এখানে পয়সা ফেরত দিয়ে জিনিস ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি আসলে যে জিনিস কিনছি তার গুণমান সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এইটাই বিহেভিয়ারাল মার্কেটিং'এর বেদবাক্য। মানুষ ক্ষতি স্বীকার করতে ভীষণ অপছন্দ করে। তার চেয়ে নিজেকে বুঝিয়ে ফেলা অনেক বেশি সহজ। গ্যারান্টি আমাদের মনকে এই বোঝানোর কাজেই সাহায্য করে- বলছে যখন পছন্দ না হলে টাকা ফেরত দেবে, তখন নিশ্চয়ই জিনিসটা ভালো। মানুষের এই মনস্তাত্ত্বিক আচরণের সদ্ব্যবহার করছে বিজেপি। 

এবার পশ্চিমবঙ্গে ভোটের বাজারে বিজেপির প্রতিশ্রুতি- সোনার বাংলা গড়ে দেব। 'সোনার বাংলা' বস্তুটা গানে ভালো, হোটেলের নামেও ভালো, কিন্তু সেটা খায় না মাথায় মাখে কেউ জানে না। ভোটারের দিকে সুবিধে হল, যে যার নিজের মতো করে সোনার বাংলা ব্যাপারটা কল্পনা করে নিতে পারে। আর রাজনৈতিক দল, যারা এই ধারণাটির বিক্রেতা, তাদের দিক থেকে সুবিধা হল, তারা যে ধারণাটি ফেরি করছে, তার গুণমান যাচাই করে দেখার কোনও উপায় যেহেতু নেই, ফলে ধারণাটি জনগণ একবার কিনে ফেললে জিনিসটায় বিশ্বাস করতেই হবে। এটা অবশ্যই ফ্যাসিস্ট, অথরিটারিয়ান রেজিমের স্বভাবধর্ম। 

এই যে অতীত গৌরবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি, বিংশ শতক এর অনেক উদাহরণ দেখেছে। হিটলার বলতেন, পিতৃভূমির হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন; মুসোলিনি বলতেন, তিনি নতুন করে রোমান সাম্রাজ্যের সূর্যোদয় ঘটাবেন। একেবারে হাল আমলের উদাহরণও আছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, 'মেক আমেরিকা গ্রেট এগেন'। মোদিও বলেছেন, অচ্ছে দিন এই এল বলে। এটা এমন একটা প্রতিশ্রুতি যা কখনও যাচাই করে নেওয়া যাবে না। সোনার বাংলায় কী হবে বিজেপি এখনও অবধি বলেনি। কখনও বলবে বলে মনেও হয় না। তবে গত প্রায় সাত বছরে কেন্দ্রীয় সরকারকে দেখেও, উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা, হরেক রাজ্য বিজেপির খেল দেখেও যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন বা দেবেন, তাঁদের বেশির ভাগই ভোট দেবেন বিজেপি এসে মুসলমানদের টাইট দেবে এই আশায়। যদি কেউ বিজেপিকে সোনার বাংলা'র নির্মাণের সুযোগ দেওয়ার জন্য ভোট দেন, তবে তাঁর সেই প্রত্যাশা পূরণ হল কি না তা মিলিয়ে দেখা অসম্ভব। এই ঘটনা গোটা দুনিয়া জুড়ে ঘটে চলেছে। ভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটার টানা এখন একটা রীতিমত বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। বহু সংস্থা আছে যারা বিপুল অর্থের বিনিময়ে রাজনৈতিক দলের হয়ে এই কাজটি করে দেয়। তবে এটাও একটা প্রশ্ন যে, স্রেফ একটা গ্যারান্টির ভরসায় ভোট লড়বে বিজেপি? সম্ভবত না। মানুষের আস্থার উপর যথেষ্ট ভরসা এই দলটির নেই, তাই জাতীয়তাবাদী আবেগ, তীব্র ধর্মীয় বিভাজন এই সব জাগিয়ে তোলা হবে, তাকে আরও সুতীব্র করা হবে। শীতলকুচির চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে যেতে পারে যে কোনও সময়ে। আসলে অনলাইন রিটেলারের কাছ থেকে কোনও জিনিস কিনে তা পছন্দ না হলে তা দশ দিন বা এক মাসের মধ্যে পাল্টে নেওয়া যায়। নির্বাচনী গণতন্ত্রে অপেক্ষা করতে হবে পাঁচ বছর। বিহেভিয়ারাল মার্কেটিং-এর নিয়ম অনুযায়ী ততদিনে অনেক মানুষের মন তাদের বুঝিয়ে দেবে যে জিনিসটা কিনতে ভুল হয়নি। ফলে, সেই ভুল আরও একবার করে ফেলতে পারে মানুষ। বিফলে মূল্য ফেরত- এই প্রতিশ্রুতি যে আমাদের দিয়ে কত ভুল, অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনিয়ে নেয়, আর কত ভুল জিনিসকে ঠিক বলে ভাবায় তার ইয়ত্তা নেই। 

এইবার বাংলায় ভুল জিনিস কিনলে তার কত মূল্য চুকোতে হবে সে হিসেব নেই। বাংলার এই নির্বাচন হতে পারে ভারতবর্ষের বুকে শেষ গণতান্ত্রিক নির্বাচন। চমকে উঠবেন না, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। বিজেপি'র বাংলা বিজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা আসলে এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। রাশি রাশি কেন্দ্রীয় বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, টাকা দিয়ে কিনে নেওয়া একদল সংবাদমাধ্যম, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলের এক ডজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিয়ে দিন রাত এক করে প্রচার করছে বিজেপি। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের সমস্ত বিজ্ঞাপন স্লট কিনে নিয়েছে তারা। যে পরিমাণ টাকা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে বিনিয়োগ করা হয়েছে, তাতে দেশে দু' চারটে করোনা হাসপাতাল হয়ে যেতে পারত। 

ভোট জেতার জন্য কেন এই বিপুল আয়োজন? এই নির্বাচনের শেষে যদি বিজেপি'র তরীখানি তীরে পৌঁছে যায়, তবে বিজেপি'র পরের পদক্ষেপ হবে লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিল এনে নির্বাচন রদ করে আগামী ১৫-২০ বছরের স্থায়ী সরকার গঠন। প্রশ্ন উঠতে পারে, এর জন্য বাংলার ভোট জিততে হবে কেন? কারণটা সংখ্যাগত আধিপত্যের। এই মুহূর্তে সারা ভারতে বিজেপি'র পক্ষে রয়েছেন দেশের ৩৩ শতাংশ মানুষ। বাংলা থেকে যদি বিজেপি ৩০ শতাংশ মানুষের ভোট আদায় করতে পারে, তবে কেল্লা ফতে! আর কোনও অবিজেপি রাজ্য সরকারের তোয়াক্কা করবে না এই দল। দিল্লি সরকারকে যেমন করে সংসদে বিল এনে ডানা ছেঁটে দেওয়া হল, সেই একই প্রকল্পে অন্য অ-বিজেপি রাজ্যগুলিকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখার ব্যবস্থা পাকা হবে। খেলাটা নতুন নয়। ইতিপূর্বে অনেক একনায়কতান্ত্রিক দেশে এমনটা ঘটেছে, যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ রাশিয়া। সেই পথেই পা বাড়িয়ে রেখেছে মোদি সরকার। তাই বাংলার এবারের ভোট ভারতবর্ষের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। বাংলার মানুষের সেই উপলব্ধি আছে তো? এমন অশনি সংকেতে সাধু সাবধান।


No comments:

Post a Comment