এত বড় গণ অভ্যুত্থান কি এ দেশ আগে দেখেছে?
নীলকন্ঠ আচার্য
সরকারকে নিজ শক্তি বুঝিয়ে দিতে দিল্লি সীমান্তে আজ হয়ে গেল অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক কিষাণ ট্রাক্টর মিছিল। মিছিলে সামিল দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্ত থেকে আসা দশ লক্ষাধিক কৃষক জনতা সহ সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ। কৃষি ও কৃষক বিরোধী এবং জন ও দেশ বিরোধী তিনটি কৃষি আইন বাতিল, স্বামীনাথন কমিশনের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনে পরিণত করার দাবিতে গত দু' মাস ধরে দিল্লি সীমান্তে কয়েক লক্ষ কৃষক জনতার চলমান ধর্না অবস্হান এবং এই সময়কালে সরকারের সাথে ১১ দফা নিষ্ফল আলোচনার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে গোটা দেশ ও বিশ্বব্যাপী এই ঐতিহাসিক মিছিল আজ শুরু হয় দিল্লির নয়টি প্রান্ত থেকে: সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজীপুর, ঢাঁসা, চিল্লা, শাহজাঁপুর, মসিনাবরিজ, পলবল এবং মাসানি-সুনেড়া প্রান্ত।
মহা মিছিল তো শুরু হল। কিন্তু শেষ হবে কখন? এ ছিল এক বড় প্রশ্ন। কিষাণ নেতৃত্বের অনুমান ছিল, কমপক্ষে প্রায় দেড় দিন লেগে যেতে পারে। প্রায় ৬০ দিন ধরে দিল্লির সীমান্তগুলিতে কভার করতে থাকা গণমিডিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় সাংবাদিক অজিত অন্জুম বা 'ন্যাশনাল দস্তক'এর শম্ভুর মতে এই মিছিল শেষ হতে আড়াই দিনও লাগতে পারে। এই নয়টি প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া মিছিল কোথাও ১০০ কিমি, ৮২ কিমি, ৭২ কিমি বা ৬৮ কিমি পথ অতিক্ৰম করার কথা।
সকাল থেকেই বোঝা গিয়েছিল, সারা দিনে কিষাণ মিছিলে নানা ধরনের গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে চলেছে। প্রথমেই সকাল আটটার দিকে কৃষকদের একটা অতি বিশাল মিছিল মুকারবা প্রান্তে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি চার্জ অতিক্রম করে আউটার রিং রোডের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এই সুবিশাল জনস্রোতের মুখে পুলিশ বাহিনীকে কার্যত অসহায় দেখায়। কৃষক জনতা সকলকে আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা দিল্লি দখল করতে নয় বরং দিল্লির অধিবাসীদের মন জয় করতে যাচ্ছেন। শুরুর এই মিছিলটি ছিল আজকের সমস্ত মিছিলের ১০-১৫ শতাংশ মাত্র।
সব মিলিয়ে আজকের এই ঐতিহাসিক কিষাণ ট্রাক্টর মিছিলে আগত জনজোয়ারকে এক শক্তিশালী গণ উত্থান বললেও কম বলা হয়। যেহেতু এই জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে শাসক ও তার পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে আপামর মানুষের চরম ঘৃণা আর আক্রোশের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে, তাই জনজোয়ারের এই মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ততার একটা আচরণ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। যে মিছিল শুরু হবার কথা ছিল বেলা ১২টা থেকে, স্বতঃস্ফূর্ততার আবেশে তা শুরু হয়ে গেল সকাল ৮-৯টা থেকেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের বুকের মধ্যে এতদিন ধরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের আগুনে জর্জরিত ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল বিক্ষুব্ধ জনজোয়ারের মধ্যে এক স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ছিল। তাই এই মহামিছিল স্বতঃস্ফুর্তভাবেই নির্ধারিত সময় ও পথকে অনুসরণ করার বদলে দিল্লির রাজপথের অভিমুখে যাত্ৰা শুরু করল। নেতৃত্ব, রণনীতি, রণকৌশল ইত্যাদির নিরিখে এটা কাম্য না হলেও এইরকম বিরল শ্রেণির জনজোয়ারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও আঙ্কিক পদ্ধতির অনিবার্য অনুসরণ প্রত্যাশা করাটা বোধহয় বিশুদ্ধতাবাদী চিন্তার শিকার হয়ে পড়ার নামান্তর!
উচ্ছ্বাসে ভরপুর মিছিল পুলিশের যথাসাধ্য ব্যারিকেড, লাঠিচার্জ, কাদাঁনে গ্যাসের আক্রমণ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। কিন্তু প্রশাসনের তরফে মিছিলকে শান্তিপুর্ণ ভাবে যেতে না দিয়ে তাকে উত্যক্ত করা হল। মিছিলের একটা অংশ আরও শক্তিশালী হয়ে লালকেল্লার দিকে এগিয়ে গেল। এরপর যা হল তা ইতিহাসের পাতায় স্হান করে নেবে। হাজার হাজার কৃষক জনতা দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করলেন, জাতীয় পতাকাকে তুলে ধরে জাতীয় সংগীত গেয়ে অত্যাচারিত শাসকের বিরুদ্ধে নিজের অভিনব প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলেন।
অন্যদিকে, দিল্লির বাকি ৮টি সীমান্ত থেকেও ট্রাক্টর মিছিল অব্যাহত ছিল। যদিও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্ব এই মহামিছিলের একাংশের নির্ধারিত যাত্রাপথের বাইরে গিয়ে লালকেল্লার দিকে চলে যাওয়াকে সমালোচনা করেছে। পরে অন্যতম কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, যে রাস্তাগুলো খোলা রাখার চুক্তি হয়েছিল, দিল্লি পুলিশ সেগুলো অন্যায় ভাবে ব্যারিকেড করে দিয়েছিল। তারপর কৃষকদের অন্য রুট ধরতে জোরজবরদস্তি করা হয়। সেখান থেকেই অরাজকতার শুরু। টিকায়েত স্বীকার করেছেন যে কিছু হিংসা হয়েছে এবং কারা করেছে তা চিহ্নিত করা হবে। আবার এও বলেছেন, এত বড় একটা জমায়েতে পুলিশের উশকানিতে কিছু কিছু বিশৃংখলা এড়ানো হয়তো অসম্ভব ছিল। ইতিমধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন শিখ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের সাথে কৃষক জনতার সংঘর্ষে উভয়পক্ষের হতাহতের খবরও পাওয়া গেছে।
দিনের শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দেড় হাজার আধাসামরিক বাহিনী বিভিন্ন সংবেদনশীল এলাকায় পাঠানোর নির্দেশ জারি করেছে। বেশ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা লাগু করা হয়েছে। দিল্লির কিছু এলাকা ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা মাঝরাত পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। কৃষক নেতৃত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, এই আন্দোলনকে আরও জোরালো ভাবে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং যতক্ষণ না তিন কৃষি আইন বাতিল ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন লাগু হচ্ছে তাঁরা থামবেন না। ইতিমধ্যেই আজকের মহামিছিলের পর্যালোচনা ও আগামী দিনে আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষক নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা তাকিয়ে আছি কৃষক জনতার জয় কবে অর্জিত হয় সেই দিনটির দিকে। দেখা যাক, জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই সরকার কৃষক আন্দোলনের কাছে মাথা নত করে কিনা।


দীপ সিঁধু মোদি শাহের দালাল আন্দোলনকে কলঙ্কিত করতে লালকেল্লায় ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন করে। কিষাণ নেতারা পরিষ্কার জানিয়েছেন এটা কৃষক আন্দোলন, কোন ধৰ্মীয় আন্দোলন নয়। সংঘ পরিবার এর ঘৃণ্য চক্রান্তকে ধিক্কার।
ReplyDeleteহ্যা,এখন এটা পরিষ্কার যে দীপ সিঁধু মোদী-শাহের ব্যবস্হাপিত বিশেষ বিভাগ থেকে সুপরিকল্পিতভাবে পাঠানো একজন লোক। ওরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য চলমান কৃষক আন্দোলনে নানারকমের অন্তর্ঘাতমূলক অপচেষ্টা গ্রহণ করেছে এবং করবে। উদ্দেশ্য,এই আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থকে নষ্ট করা এবং ধীরে ধীরে দমন পীড়নের জমি প্রস্ত্তত করে তাকে ধ্বংশ করা। গতকালের ঘটনায় দীপ সিঁধুকে বাদ দিয়ে ভাবলে বাকি যে কৃষক জনতার লাল কেল্লায় অনুপ্রবেশের মাধ্যমে দীপ্ত উচ্ছাসের অভিব্যাক্তি ঘটতে দেখা গেল তা গণ আন্দোলনে এরূপ চরম পর্যায়ের মুহূর্তে সময়ের সংবেদনশীল সাক্ষী হিসেবে আমাদের শুধু স্বীকার করাই নয় বরং অভিনন্দন জানানো উচিত। শাসক-ঘাতকের দল তার প্রচার মাধ্যম ও অন্যান্য আয়োজনের মাধ্যমে এখন বিশৃংখলা, হিংসা, অরাজকতা, দেশ ও 'জাতির' উপর অমর্যাদা ইত্যাদি নানা রকম অভিযোগ আন্দোলনকারীদের উপর চাপানোর মাধ্যমে মানসিক ও নৈতিকভাবে তাদের দুর্বল করতে চাইবে। কিন্তু এই ফন্দিও তো আমাদের অজানা নয়। এই গণ অন্দোলনের মেজাজকে যেভাবেই হোক থামিয়ে দেওয়া ওদের কাছে ভীষণভাবে প্রয়োজনীয়। তাই বিভ্রান্তি নয়,সরকারের প্রতিটি চক্রান্তকে জনসম্মুখে উদ্ঘাটিত হয়ে চলমান কৃষক আন্দোলন আরও আরও শক্তিশালী হোক, এটাই সময়ের দাবী।
Delete