Pages

Saturday, 30 January 2021

গাজীপুর: ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট

কৃষকেরা হেরে গেলে আমরাও হেরে যাব

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


দিল্লিতে ২৬ জানুয়ারি লাখো মানুষের ট্রাকটর মিছিলের একটা অংশকে পরিকল্পিত ভাবে ঈষৎ ঘেঁটে দিয়ে বিজেপি-আরএসএস ভেবেছিল, এবারে দেশপ্রেমের ধ্বজা তুলে দেশবাসীকে খেপিয়ে কৃষক আন্দোলনকে ভেস্তে দেওয়া যাবে। এই একই পদ্ধতি তারা শাহিনবাগ আন্দোলনের সময়েও নিয়েছিল। এবারে তাদের ধারণা ছিল, সহজ-সরল মনের কৃষকদের মধ্যে যদি এই সুযোগে কিঞ্চিৎ অপরাধ-বোধ জারিত করা যায়, তাহলে তারা নিজেরাই মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে ঘরে ফিরে যাবে। সেই মতো ছক কষে, পেইড দালাল দিয়ে কাজটি তারা করে ফেলতে পারবে বলে নিশ্চিত ছিল। কিন্তু কথায় আছে, অতি চালাকের গলায় দড়ি।

অবশ্য, জনৈক দীপ সিধু ও তার দলবলকে দিয়ে লালকেল্লায় একেবারে চিত্রনাট্য অনুসরণ করে একটা নাটক বিজেপি-আরএসএস করিয়ে ফেলল। সে নাটকের অন্তে ছিল গোদি মিডিয়া এসে হৈ রৈ করে ব্যাটনটা নিজের হাতে নিয়ে রসালো গল্প বলে শেষ ল্যাপটায় একবারে কেল্লা ফতে করে দেবে। ঠিক যেমন যেমন ভাবা গিয়েছিল, তেমন তেমনই সব এগিয়েছে। ২৬ জানুয়ারি দিনের শেষে কৃষকদের একটা অংশের মধ্যে অপরাধ-বোধও দেখা দিয়েছে এবং তাঁরা যে দোষে দুষ্ট নন, তার জন্য তাঁরা নিজেরা আগ বাড়িয়ে ক্ষমাও চেয়েছেন (যদিও বা যেটুকু যা ঘটেছে তা সেদিনের গোটা আন্দোলনের বড়জোর শতকরা ১ ভাগ মাত্র ছিল)। ধীরে ধীরে এবার একটা হতাশার ভাব যেন মোচড় দিয়ে ওই সহজ-সরল মনগুলিকে খেয়ে ফেলতে লাগল। এতটাই ইতস্ততা বোধ তাঁদের ওপর চেপে বসল যে ১ ফেব্রুয়ারির পূর্বঘোষিত সংসদ অভিযানের কর্মসূচিকেও তাঁরা স্থগিত রাখলেন। ২৭ জানুয়ারি দেখা গেল, পরিকল্পিত ভাবে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে কৃষক আন্দোলনের বিরুদ্ধে ট্রোল ও ঘৃণা বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। কৃষকদের কোনও কোনও নেতা একটু যেন বেশি কাতর হয়ে পড়লেন এবং অযাচিত ভাবে ২৬ জানুয়ারি যা কিছু ‘অন্যায়’ ঘটেছে (যদিও তার জন্য তাঁরা এতটুকু দায়ী নন এবং যা ঘটেছে তা তেমন কিছু বড় ব্যাপারও ছিল না) তার জন্য একটু বেশিই ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে পড়লেন। ধূর্ত ও নৃশংস বিজেপি বাহিনী সরল মনের কৃষকদের এই স্বঘোষিত অপরাধী ভাবনাকে সুযোগ বুঝে ষোলআনা উশুল করতে মাঠে নেমে পড়ল।

২৮ জানুয়ারি সিঙ্ঘু সীমান্তে হঠাৎ করে উদিত হল একদল ‘স্থানীয়’ মানুষ যারা নাকি কৃষকদের দ্বারা জাতীয় পতাকার অবমাননায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং ‘অতএব’ জানান দিল যে এই জায়গা ছেড়ে কৃষকেরা তোমরা তল্পিতল্পা গুটিয়ে মানে মানে কেটে পড়ো। গাজিপুর সীমান্তে বিকেল থেকে হাজির হতে থাকল শয়ে শয়ে পুলিশ বাহিনী এবং কৃষকদের বলা হল রাতের মধ্যেই সীমানা খালি করে দিতে। নিভিয়ে দেওয়া হল আলো, জলের বন্দোবস্তকে তছনছ করা হল এবং শৌচাগারগুলিকে পর্যন্ত ভেঙে দিল। ইতিমধ্যে দু-একটি ছোটখাটো কৃষক সংগঠন আন্দোলন থেকে সরে গেছে, এর পরের পদক্ষেপ কী হবে তা নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, কৃষক নেতাদের নামে এফআইআর হয়েছে, মনেও কিছু শঙ্কা এসেছে- সবটা মিলিয়ে কিছুটা যেন ছন্নছাড়া ভাব।

কৃষকদের এই দুর্বল মুহূর্তকে উগড়ে নিতে শাসক বাহিনী যখন এইভাবে কদম কদম এগিয়ে আসছে তখনই যেন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কৃষকেরা বেপরোয়া হয়ে আরও একবার রুখে দাঁড়ালেন। নিজেদের ভালমানুষীর সুযোগ যে ধূর্ত শিয়ালেরা আষ্টেপৃষ্টে আদায় করে নিচ্ছে তা তাঁরা এবারে প্রকৃত প্রস্তাবে ভাল মতো বুঝলেন। বলিষ্ঠ কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েতের কন্ঠে এবার অন্য সুর শোনা গেল। সমগ্র কৃষক সমাজের বেদনা ও অঙ্গার যেন তাঁর বাচন ও আহ্বানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেল। বললেন, তাঁর নিজ বাসভূমি থেকে কৃষকভাইয়েরা জল না এনে দিলে তিনি আর জলস্পর্শ করবেন না। মরমী কৃষকের হৃদয়-যন্ত্রণায় যেন মৃত্তিকা উর্বরা হয়ে উঠল। সমস্ত কৃষকদের টিকায়েত ডাক দিলেন গাজীপুরে আক্রান্ত কৃষকদের পাশে সেই মুহূর্তে যেন সকলে চলে আসেন। এ শুধুমাত্র আহ্বান ছিল না, ছিল কনকনে শীতের রাতে এক উদ্দাম লহর। টিকায়েতের ডাক শুনে হরিয়ানার প্রতি ঘর থেকে দলে দলে মানুষ তৎক্ষণাৎ ওই মধ্যরাতেই বাসে, ট্রাকে, ট্রাকটরে, বাইকে, গাড়িতে, সাইকেলে, হেঁটে- যে যেভাবে পেরেছেন এসে পৌঁছতে শুরু করলেন গাজীপুর সীমান্তে। গাজীপুর এক অনন্য ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেল। যেন, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট। পুলিশ বাধ্য হল পিছু হঠতে।

সেই মুহূর্তেই বদলে গেল আন্দোলনের চিত্রটাও। নিমেষের মধ্যে ধ্বস্ত হয়ে গেল শাসকের যাবতীয় প্ল্যান ও ছলছাতুরি। ২৯ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের মুজফফরপুরনগরে লক্ষাধিক কৃষকের মহাপঞ্চায়েত বসল। এই জনপ্লাবন কেউ কস্মিনকালেও দেখেননি। ঘোষিত হল কৃষক আন্দোলনে আরও উদ্দাম লহর তোলার অঙ্গীকার। তবুও ২৯ জানুয়ারি সকালে টিকরি ও সিঙ্ঘু সীমান্তে ‘স্থানীয়’ অধিবাসী সেজে আরএসএস’এর দুষ্কৃতীরা পুলিশের সহযোগিতায় ইট-পাটকেল ছুঁড়ে কৃষকদের আহত করল ও তাঁদের কিছু তাঁবুও ভেঙে দিল। পুলিশ দিল্লি সরকারের পাঠানো জলের ট্যাঙ্ক কৃষকদের কাছে পৌঁছনোর অনুমতি দিল না। তবে বলাই বাহুল্য, কৃষকদের বাড়তে থাকা জমায়েত ও মেজাজের কাছে শাসকের এই সমস্ত প্রয়াস খুড়খুটোর মতো তুচ্ছাতিতুচ্ছ হয়ে গেল। আওয়াজ উঠল: কৃষক টিকায়েত বনাম মোদি ডাকায়েত। ২৮ জানুয়ারি সারা দেশে বহু মানুষ রাত জাগলেন। দিল্লিতে মধ্যরাতে কৃষকদের সমর্থনে মিছিল বেরল।    

ইতিমধ্যে ৬০ দিনের বেশি অবস্থান চলেছে। ১৫০’র ওপর কৃষক অবস্থানস্থলে মারা গেছেন। রাতের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবুও অন্নদাতারা স্থিতধী রয়েছেন। চোখে স্বপ্ন ও হৃদয়ে মমতা নিয়ে। দেশ জুড়ে আত্মহত্যায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছেন কৃষকেরা। অধিকাংশের ঋণের বোঝা বওয়ার ক্ষমতা আর নেই। বিপর্যস্ত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সন্তানেরা সস্তার মজুর হয়ে শহরের বুকে দুঃসহ জীবন অতিক্রম করছেন। বার বার শাসক, মিডিয়া ও গবেষকেরা বোঝাতে চাইছেন কৃষিতে কোনও ভবিষ্যৎ নেই। কর্পোরেটদের হাতে কৃষি ব্যবস্থাকে তুলে দাও। বলা হচ্ছে, বাজারে গিয়ে ফসল বেচো, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কথা ভুলে যাও। সস্তায় নিজের ফসল বেচে সেই ফসলই আবার বাজার থেকে বেশি দামে কিনে খাও। সমস্ত দেশবাসীকে কর্পোরেট বাজার ব্যবস্থার ইচ্ছে-অনিচ্ছের সওয়ার করে দাও। আর সে লক্ষ্যেই তিন কৃষি আইন। তাই, অন্নদাতারা জীবন বাজী রেখে নিজেদের ও আপামর দেশবাসীকেও আজ রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন। এই লড়াই কর্পোরেট শক্তির সঙ্গে কৃষক সমাজের লড়াই। যদি আমরা আজ কৃষকদের পাশে থেকে এই মরণপণ লড়াইয়ে সামান্য সাহায্যটুকুও না করি, ইতিহাস আমাদের কোনওদিন ক্ষমা করবে না। কৃষক সমাজ শেষ হয়ে গেলে ধরিত্রীর মাটিও শুকিয়ে কালো হয়ে যাবে।

আশার কথা, কিছুটা আচম্বিত ধাক্কা খেয়ে আবারও কৃষকেরা এ লড়াইয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। গান্ধীজী স্মরণে ৩০ জানুয়ারি তাঁরা দেশবাসীকে অনশনের ডাক দিয়েছেন। সীমান্ত ঘিরে আবারও জনজমায়েতে কল-কলরবে সকলে গেয়ে উঠবেন। গোদি মিডিয়া নতুন নতুন মিথ্যার ডালি সাজাবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কৃষকেরা নিজেদের হক বয়ান রেখে যাবেন। সে বয়ান আমাদের পড়ে নিতে হবে। বুঝে নিতে হবে যে, কৃষকেরা এক নতুন রাজনৈতিক-অর্থনীতির জগতে আমাদের নিয়ে চলেছেন। এক নতুন উজ্জ্বল দিনের দিকে আমাদের যাত্রা। কৃষকদের জিততেই হবে। না হলে আমরা বাঁচব না।

জয় কিষাণ।

Thursday, 28 January 2021

পরিস্থিতি যখন ঘোরতর

নতুন পরিসর কি গড়ে তোলা সম্ভব?

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


এখন থেকে প্রায় একশ' বছর আগে (বৈশাখ, ১৩২৮) আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় যার শুরুতে আচার্য দেব লিখেছেন- 'এই যে সমস্যা আজ আপনারা আমার সম্মুখে উপস্থাপিত করেছেন এর মীমাংসা করা, বিশেষত এইরকম অল্প সময়ে, অত্যন্ত দুরূহ।'

দুঃখের হলেও সত্য এই যে, এখনও সমস্যাটির মীমাংসা হয়নি। হয়তো নয়, নিশ্চিতভাবেই সমস্যাটি গুরুতর আকার নিয়েছে। ওদিকে, মীমাংসার জন্য সময় কমেছে।

সমস্যাটা কী?

আচার্যদেব লিখেছেন, 'আমরা চিন্তাশীল হিন্দু, আমরা অত্যন্ত আধ্যাত্মিক' বলে গর্বস্ফীত ভাব একটা  রয়েছে। সেটাই সমস্যা। সে ভাবটা দেশের প্রায় প্রতিটি অংশে আজও আছে শুধু তাই নয়, তা অবশ্যই দৈর্ঘে-প্রস্থে  বেড়েছে। বলতেই হচ্ছে যে সমস্যাটি এ কালে গুরুতর আকার নিয়েছে। এ কালের কুচিন্তা-মগ্ন কিছু হিন্দু আধ্যাত্মিকতার নামে নৈরাজ্য বিস্তারে মন দিয়েছে। তারা হয়ে উঠতে চলেছে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি। কেন এমন হল?

সে কালে যারা ছিল শাসক সেই ব্রিটিশ শক্তির প্রয়োজন ছিল তাই তারা সাম্প্রদায়িকতায় উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু এ কালে ব্রিটিশ রাজশক্তির সেই গৌরবদিন আর নেই। এ কালে তার জায়গা নিয়েছে কর্পোরেট শক্তি। তার সাথে সারা বিশ্ব জুড়েই হাত মিলিয়েছে রাষ্ট্র- দুয়ে মিলে (বাজার ও রাষ্ট্র)  গড়ে তুলেছে নয়া ফ্যাসিজম। ধর্মের উপস্থিতিতে মীমাংসা বুঝি আরও দূরে সরেছে। এমনকি  সমস্যাটি ভেঙ্গে ছোট ভূখন্ডে দেখতে গেলেও দেখি মীমাংসা দূরে থাকে।

চিন্তাশীল বলে বাঙালির গর্ব খুব। তাই এই ভূখন্ড নিয়েই আলোচনা সীমাবদ্ধ করি।

বাংলার বহু সমস্যা- অর্থনৈতিক, সামাজিক, প্রাকৃতিক। তাতে যুক্ত হয়েছে শিক্ষার সমস্যা, সংস্কৃতির সমস্যা। দোষ দেব কাকে? রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা আছে তাদের দোষ বা দায় তো মানতেই হয়, তবে যারা শাসক নয়, বর্তমানে যারা শাসক-বিরোধী তারাও সমভাবে দায়ী নিশ্চয়। শাসকের অপরাধ কেবল এই নয় যে আত্মম্ভরিতায় সুড়সুড়ি দিতে দিতে সে আমাদের এক মোহময় মিথ্যার জগতে টেনে এনেছে। এই কথা ভারতবর্ষ বিষয়ে যতখানি সত্য বাংলা সম্পর্কে ততোধিক  সত্য।

একজন বলেছিলেন: What Bengal thinks today...। আমরা সেই কথাতে নেচে উঠি। ভারতীয় রাষ্ট্রনায়ক তথা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কলকাতা সম্পর্কে বলেছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী। গর্বে আমাদের যেন আর মাটিতে পা পড়ে না। শাসক দলের প্রধান কর্তারা তারই সুযোগে যেন, আমাদের বাঙালিয়ানায় সুড়সুড়ি দিতে, কখনও রবীন্দ্রনাথ সাজছেন, কখনও বিচিত্র বাংলায় কথা বলছেন, কখনও গরিব আদিবাসী মানুষের আপনজন হতে তার বাড়িতে পাত পাড়ছেন। অথচ, আজ এ কথা স্পষ্ট যে, বঞ্চনায়, অবহেলায় বাংলা ও বাঙালি ক্রমে কোণঠাসা (অন্তত, সেই দেশভাগের সময় থেকে)। এদিকে, আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে, আমাদের তেজ ও তারুণ্য, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি, আমাদের ভয়হীনতা ও প্রত্যুতপন্নতা দেশের সেরা, কালের সেরা। শুধু কি তাই? আমাদের কবি বিশ্বকবি, আমরা শান্তির পূজারী হলেও আমাদের বিবেকানন্দ, আমাদের সুভাষচন্দ্র প্রয়োজনে হিংসার পক্ষে দাঁড়াতে মানা করেননি এবং তাই আমরা এক বীরোত্তম ও সংস্কৃতিবান জাতি। 

নেতাজি জন্মদিনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের অনুষ্ঠানের পর বাঙালির এমন ভাবনা যে অসার তা আর একবার স্পষ্ট হল। নেতাজির জন্মদিন জাতীয় ছুটির দিন হল না, পেলাম এক 'পরাক্রম দিবস' নামের 'দিল্লিকা লাড্ডু'। তাতেই উল্লসিত একদল নেতাজির নামে জয়ধ্বনি দিতে ভুলে গিয়ে মেতে উঠলেন 'জয় শ্রীরাম' ধ্বনিতে। এভাবে আমার মতো বাঙালির দুশ্চিন্তা নিশ্চয় অনেক গুণ বেড়ে গেল।

ওদের অপরাধ কেবল এই নয় যে ওরা আমাদের গর্বে আঘাত হানতে চায় বা ওরা আমাদের গরিমায় ভাগ বসিয়ে রবীন্দ্রনাথের বদলে মনমোহন বসুকে বাংলার সেরা কবি রূপে প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত, ব্যস্ত 'গদ্দার' শ্যামাপ্রসাদকে জাতীয় নেতারূপে প্রতিষ্ঠা করতে বা বিবেকানন্দের অন্যতম নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা ভুলিয়ে দিতে। সে সব তো আছেই, তবে আরও আছে। ওরা জাতীয়তাবাদের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের দেশপ্রেম ভোলাতে চায়। তারা নেতাজি নামাঙ্কিত নদী-বন্দরের নাম বদলায়, নতুন এক শিক্ষানীতি দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বিলোপ ঘটাতে চায়, জাতীয় পরিকল্পনা পর্ষদ ভেঙ্গে নীতি-আয়োগের বিস্তার চায়। এমন আরও অনেক চাওয়া আছে তাদের। সেই সব চাওয়া পূর্ণ করতে তারা এই রাজ্যের শাসনক্ষমতা হাতে পেতে চায়।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সে চাওয়াও দোষের নয়, কিন্তু যে পদ্ধতিতে তারা সবের দখল চায় তা যে গণতন্ত্রের মূল আদর্শের পরিপন্থী তা যেন তারা ভুলেছে ও আমাদের ভোলাতে চায়। এই ফ্যাসিস্ট শক্তিকে রুখতে বাংলা ও বাঙালির কিছু করতেই হয়। কী করা যায়? রাজ্যের-শাসক-বিরোধী শক্তি যা করছে তেমন কিছু?

এখানে শাসক বিরোধী শক্তির দুটো প্রধান স্রোত। একটি রাজনৈতিক, অন্যটি মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী। দুটো স্রোতই একসঙ্গে যেন শাসকের বানানো খেলায় বা ছকে অথবা ন্যারেটিভে মেতেছে। মূলত বামমনস্ক (বাঙালি যে স্বভাবত বামপন্থী) প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি ভুলেই রয়েছেন 'প্রিন্সিপাল এনিমি' তত্ত্ব, তাঁরা খোয়াব দেখছেন 'এবার রাম, পরের বার বাম'। আর বর্তমান শাসক দল গান ধরেছে- হরে কৃষ্ণ হরে রাম/ দূর হঠো মেকি বাম।

ওদিকে, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী কেবল যেন জেগে বা মেতে রয়েছে ‘সোস্যাল মিডিয়া’য় যখন দেশের কৃষকরা শ্রমিক ঐক্যের ডাক দিয়ে দিল্লী অভিযানে নেমেছেন। আর কি উদাসীন বা নিরপেক্ষ থাকা উচিত?    

সব দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাকে মুক্তির পথ দেখাতে, প্রকৃত বহুস্বর গণতন্ত্রের স্বাদ পেতে, নিরামিষ পথ ছেড়ে প্রতিরোধের আগুন জ্বালাতে তৃতীয় শক্তির উত্থান আসন্ন ও বিশেষ প্রয়োজন। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’।


Tuesday, 26 January 2021

অভূতপূর্ব কিষাণ প্যারেড

এত বড় গণ অভ্যুত্থান কি এ দেশ আগে দেখেছে?

নীলকন্ঠ আচার্য


সরকারকে নিজ শক্তি বুঝিয়ে দিতে দিল্লি সীমান্তে আজ হয়ে গেল অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক কিষাণ ট্রাক্টর মিছিল। মিছিলে সামিল দেশের প্রায় সমস্ত প্রান্ত থেকে আসা দশ লক্ষাধিক কৃষক জনতা সহ সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষ। কৃষি ও কৃষক বিরোধী এবং জন ও দেশ বিরোধী তিনটি কৃষি আইন বাতিল, স্বামীনাথন কমিশনের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যকে আইনে পরিণত করার দাবিতে গত দু' মাস ধরে দিল্লি সীমান্তে কয়েক লক্ষ কৃষক জনতার চলমান ধর্না অবস্হান এবং এই সময়কালে সরকারের সাথে ১১ দফা নিষ্ফল আলোচনার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে গোটা দেশ ও বিশ্বব্যাপী এই ঐতিহাসিক মিছিল আজ শুরু হয় দিল্লির নয়টি প্রান্ত থেকে: সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজীপুর, ঢাঁসা, চিল্লা, শাহজাঁপুর, মসিনাবরিজ,  পলবল এবং মাসানি-সুনেড়া প্রান্ত।

মহা মিছিল তো শুরু হল। কিন্তু শেষ হবে কখন? এ ছিল এক বড় প্রশ্ন। কিষাণ নেতৃত্বের অনুমান ছিল, কমপক্ষে প্রায় দেড় দিন লেগে যেতে পারে। প্রায় ৬০ দিন ধরে দিল্লির সীমান্তগুলিতে কভার করতে থাকা গণমিডিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় সাংবাদিক অজিত অন্জুম বা 'ন্যাশনাল দস্তক'এর শম্ভুর মতে এই মিছিল শেষ হতে আড়াই দিনও লাগতে পারে। এই নয়টি প্রান্ত থেকে শুরু হওয়া মিছিল কোথাও ১০০ কিমি, ৮২ কিমি, ৭২ কিমি বা ৬৮ কিমি পথ অতিক্ৰম করার কথা। 

সকাল থেকেই বোঝা গিয়েছিল, সারা দিনে কিষাণ মিছিলে নানা ধরনের গুরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটতে চলেছে। প্রথমেই সকাল আটটার দিকে কৃষকদের একটা অতি বিশাল মিছিল মুকারবা প্রান্তে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি চার্জ অতিক্রম করে আউটার রিং রোডের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এই সুবিশাল জনস্রোতের মুখে পুলিশ বাহিনীকে কার্যত অসহায় দেখায়। কৃষক জনতা সকলকে আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা দিল্লি দখল করতে নয় বরং দিল্লির অধিবাসীদের মন জয় করতে যাচ্ছেন। শুরুর এই মিছিলটি ছিল আজকের সমস্ত মিছিলের ১০-১৫ শতাংশ মাত্র।

সব মিলিয়ে আজকের এই ঐতিহাসিক কিষাণ ট্রাক্টর মিছিলে আগত জনজোয়ারকে এক শক্তিশালী গণ উত্থান বললেও কম বলা হয়। যেহেতু এই জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে শাসক ও তার পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে আপামর মানুষের চরম ঘৃণা আর আক্রোশের স্বতঃস্ফুর্ত বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে, তাই জনজোয়ারের এই মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ততার একটা আচরণ থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। যে মিছিল শুরু হবার কথা ছিল বেলা ১২টা থেকে, স্বতঃস্ফূর্ততার আবেশে তা শুরু হয়ে গেল সকাল ৮-৯টা থেকেই। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের বুকের মধ্যে এতদিন ধরে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভের আগুনে জর্জরিত ছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই এই বিশাল বিক্ষুব্ধ জনজোয়ারের মধ্যে এক স্বতঃস্ফূর্ততার বহিঃপ্রকাশ আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ছিল। তাই এই মহামিছিল স্বতঃস্ফুর্তভাবেই নির্ধারিত সময় ও পথকে অনুসরণ করার বদলে দিল্লির রাজপথের অভিমুখে যাত্ৰা শুরু করল। নেতৃত্ব, রণনীতি, রণকৌশল ইত্যাদির নিরিখে এটা কাম্য না হলেও এইরকম বিরল শ্রেণির জনজোয়ারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ও আঙ্কিক পদ্ধতির অনিবার্য অনুসরণ প্রত্যাশা করাটা বোধহয় বিশুদ্ধতাবাদী চিন্তার শিকার হয়ে পড়ার নামান্তর!

উচ্ছ্বাসে ভরপুর মিছিল পুলিশের যথাসাধ্য ব্যারিকেড, লাঠিচার্জ, কাদাঁনে গ্যাসের আক্রমণ অতিক্রম করে এগিয়ে গেল। কিন্তু প্রশাসনের তরফে মিছিলকে শান্তিপুর্ণ ভাবে যেতে না দিয়ে তাকে উত্যক্ত করা হল। মিছিলের একটা অংশ আরও শক্তিশালী হয়ে লালকেল্লার দিকে এগিয়ে গেল। এরপর যা হল তা ইতিহাসের পাতায় স্হান করে নেবে। হাজার হাজার কৃষক জনতা দিল্লির লালকেল্লায় প্রবেশ করলেন, জাতীয় পতাকাকে তুলে ধরে জাতীয় সংগীত গেয়ে অত্যাচারিত শাসকের বিরুদ্ধে নিজের অভিনব প্রতিবাদ জ্ঞাপন করলেন।

অন্যদিকে, দিল্লির বাকি ৮টি সীমান্ত থেকেও ট্রাক্টর মিছিল অব্যাহত ছিল। যদিও সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার নেতৃত্ব এই মহামিছিলের একাংশের নির্ধারিত যাত্রাপথের বাইরে গিয়ে লালকেল্লার দিকে চলে যাওয়াকে সমালোচনা করেছে। পরে অন্যতম কৃষক নেতা রাকেশ টিকায়েত জানিয়েছেন, যে রাস্তাগুলো খোলা রাখার চুক্তি হয়েছিল, দিল্লি পুলিশ সেগুলো অন্যায় ভাবে ব্যারিকেড করে দিয়েছিল। তারপর কৃষকদের অন্য রুট ধরতে জোরজবরদস্তি করা হয়। সেখান থেকেই অরাজকতার শুরু। টিকায়েত স্বীকার করেছেন যে কিছু হিংসা হয়েছে এবং কারা করেছে তা চিহ্নিত করা হবে। আবার এও বলেছেন, এত বড় একটা জমায়েতে পুলিশের উশকানিতে কিছু কিছু বিশৃংখলা এড়ানো হয়তো অসম্ভব ছিল। ইতিমধ্যে দুর্ভাগ্যজনকভাবে একজন শিখ যুবকের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশের সাথে কৃষক জনতার সংঘর্ষে উভয়পক্ষের হতাহতের খবরও পাওয়া গেছে।

 

দিনের শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক দেড় হাজার আধাসামরিক বাহিনী বিভিন্ন সংবেদনশীল এলাকায় পাঠানোর নির্দেশ জারি করেছে। বেশ কিছু এলাকায় ১৪৪ ধারা লাগু করা হয়েছে। দিল্লির কিছু এলাকা ও সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ইন্টারনেট পরিষেবা মাঝরাত পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। কৃষক নেতৃত্ব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, এই আন্দোলনকে আরও জোরালো ভাবে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং যতক্ষণ না তিন কৃষি আইন বাতিল ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য গ্যারান্টি আইন লাগু হচ্ছে তাঁরা থামবেন না। ইতিমধ্যেই আজকের মহামিছিলের পর্যালোচনা ও আগামী দিনে আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কৃষক নেতৃত্ব নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরা তাকিয়ে আছি কৃষক জনতার জয়‌ কবে অর্জিত হয় সেই দিনটির দিকে। দেখা যাক, ‌জনগণের ভোটে নির্বাচিত এই সরকার কৃষক আন্দোলনের কাছে মাথা নত করে কিনা।


Sunday, 24 January 2021

চীনা পণ্য বয়কটের বুজরুকি!

'মেক ইন ইন্ডিয়া' থেকে 'মেড ইন চায়না'

পি জে জেম্‌স

 


গত ৪৫ বছরে চীনের সাথে ভারতের তুমুল সংঘাতের পরে গৈরিক কেন্দ্রগুলির তরফ থেকে দেশ রক্ষার্থে যে সব কঠিন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নেহাত কম কিছু নয় বলে মনে হতে পারেযদিও এদিকে ভারতের ভূখণ্ডে চীনের  অনধিকার প্রবেশ দিন দিন আরও বেশি স্বতঃসিদ্ধ বলে প্রমাণিত হচ্ছে এই চীন বিরোধিতার অংশ হিসেবে অর্থনৈতিক ভাবে চীনকে প্রত্যাঘাত করার একটা প্রচার কর্মসূচি পুরোদমে চলছেএই প্রচার কর্মসূচি মূলত চীনা দ্রব্য বয়কটের ডাক দিচ্ছেযেমন, আরএসএস প্রভাবিত কনফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (সিএআইআইটি) মূলত ৪৫০ ধরনের চীনা পণ্য সোজাসুজি বর্জন করার ডাক দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রসাধন সামগ্রী, খেলনা, ফার্নিচার, জুতো, ঘড়ি ইত্যাদি সবশুদ্ধ ৩৫০০ ধরনের পণ্য। চীনা পণ্য বর্জন করার উদ্দেশ্য হল ওদের আমদানি ২০২১'এর ডিসেম্বরের মধ্যেই ১৩ বিলিয়ান ডলার বা এক লক্ষ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা, যেখানে ২০১৯-২০'তে ভারতে চীনা পণ্যের আমদানির পরিমাণ ৭০ বিলিয়ান ডলার বা ৫২৫,০০০ কোটি টাকা। তবে এ কথা সবার  আগেই বলা যায় যে এই সব পদক্ষেপ শুধুই বাক্‌সর্বস্ব, কারণ, চীনের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা এবং একাত্মতা এতটাই সুদূরপ্রসারী এবং জটিল যে 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র ঢক্কানিনাদ বা আরও সম্প্রতি 'আত্মনির্ভর ভারত'এর কথা হওয়া সত্ত্বেও চীনা বিনিয়োগ এবং পণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ভারতের পক্ষে একরকম অসম্ভব        

ভারতের পক্ষে চীন দেশিয় জিনিসের বাজারে পরিণত হওয়া এবং চীনের বিনিয়োগের মূল লক্ষ্যস্থল হয়ে ওঠা একবিংশ শতাব্দীর এক অসামান্য ঘটনা। এই ঘটনা নব্য উদার বিশ্বায়নের অধীনে চীনের সমগ্র বিশ্বের কর্মশালা হয়ে ওঠার সঙ্গে জড়িত১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং আরও বিভিন্ন বিরোধ, যেমন বলা যায় ১৯৬৭-র চোলার ঘটনা, সিকিম ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে ওঠার সময় ১৯৭৫ সালে চরম পরীক্ষা, আর ১৯৮৭-র ভারত-চীন লড়াইয়ের মতো ঘটনার কারণে বিংশ শতাব্দীতে ভারত-চীন অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারেই আশাপ্রদ ছিল না ২০০১ সালে ডব্ল্যুটিও’তে চীনের আনুষ্ঠানিক প্রবেশই চীনকে অন্য সব দেশের সঙ্গে এক হতে সাহায্য করেছে, চীনেরই 'কম্প্যারিটিভ অ্যাডভান্টেজের (অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক  অবস্থানের)' ভিত্তিতেএর ফলেই চীন তার প্রতিবেশী দেশ ভারতের বাজারের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার উৎসাহ পেয়েছে। ফলত, চীনের প্রিমিয়ার জু রংজি’র ভারত সফরের বিনিময়ে ২০০৩ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী গেলেন চীন সফরে তার পরবর্তী সময়ে ভারত এবং  চীন দু দেশের প্রতিনিধিরা একে অপরকে অনুসরণ করার জন্য এবং অসংখ্য দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের চুক্তি স্বাক্ষর করার উদ্দেশ্যে একে অপরের দেশে নিয়মিত সফরে গেছেন           

এর ফলে, ২০০০ সাল থেকেই ভারত এবং চীনের মধ্যে বাণিজ্যের গতি, অন্যান্য দেশের গোটা পৃথিবীর সঙ্গে বাণিজ্যের থেকে দ্বিগুণ মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে২০০৮ সালেই মার্কিন দেশকে ছাপিয়ে চীন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য ক্ষেত্রে অংশীদার (বিজনেস পার্টনার) হয়ে উঠল। ইতিমধ্যে ভারত-চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ২০০০-০১'এ ২ বিলিয়ান ডলার থেকে ২০১৩-১৪'এ ৬৫ বিলিয়ান ডলারে গিয়ে পৌঁছেছিলএই সময়ে চীন আর ভারতের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য (আমদানি-রফতানি সহ) চীন-মার্কিন বাণিজ্যের থেকে তিন গুণ বেশি দ্রুত এগোচ্ছিল২০১৪ সাল থেকে মোদি শাসনের সূচনা  হওয়ায় বাণিজ্য ক্ষেত্র আরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৭-১৮তে চীনের সাথে ভারতের বাণিজ্যের পরিমাণ, শুধুমাত্র হংকং (৩৪ বিলিয়ান ডলার)'কে বাদ দিলে, বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৯.৭৬ ডলারে। ২০১৮-১৯'এ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য কিছুটা হ্রাস পেয়ে ৮৭.০৭ ডলার হলেও ঐ বছরেই ভারতের সাথে চীনের বাণিজ্যিক ঘাটতি ৫৩.৫৭ বিলিয়ান ডলার (মোটামুটি ৪০১,৭০০ কোটি)। তার কারণ, চীন থেকে ভারতের আমদানির মূল্য যেখানে ৭০.৩২ বিলিয়ান ডলার, সেখানে ভারত থেকে চীনে রফতানি মোটে ১৬.৭৫ বিলিয়ান ইউএস ডলার। এমনকি আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ভারতের সঙ্গে চীনের বড় রকমের বাণিজ্যিক ঘাটতিতে সামান্যই পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। সেভাবে দেখতে গেলে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান সত্যিই প্রতিকূল।    

আইএমএফ'এর হিসেব (২০১৯ সালের তথ্যের ভিত্তিতে) অনুযায়ী চীন থেকে ভারতবর্ষে রফতানি ও ভারতবর্ষ থেকে চীনের আমদানি যথাক্রমে তার মোট রফতানি এবং আমদানির  ৩ শতাংশ ও ০.৯ শতাংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেই মতোই ভারতের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ হল ৫.১ এবং ১৩.৭ শতাংশ (সংখ্যাগুলো ২০২০'র ফেব্রুয়ারিতে ৫.৩৩ শতাংশ এবং ১৪.০৯ শতাংশ)। স্পষ্টভাবে দেখতে গেলে, ২০২০ ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুযায়ী, ভারতের মোট আমদানি ৭৫.৮ শতাংশের মধ্যে ইউএস থেকে ভারতের আমদানি হল চীনের থেকে ভারতের আমদানির অর্ধেক। এর থেকেই বেশ বোঝা যায় যে চীনের ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা মার্কিন দেশের তুলনায় বেশি, যার সাথে জুনিয়র অংশীদার হিসেবে ভারতের রণনীতি সংক্রান্ত সামরিক সম্পর্ক আছে। চীনের থেকে ভারতের আমদানির দ্রব্যাদি অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে এই অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার গুরুত্বকে বোঝা যায়। যেমন ৭৬.৩ শতাংশ জীবাণুনাশক এবং ওষুধপত্র ভারত চীন থেকে আমদানি করে। চীনের ওপর ভারতের এই নির্ভরশীলতা যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে ৮৪ শতাংশ, নাইট্রোজেন কম্পাউন্ডের ক্ষেত্রে ৬৮ শতাংশ, ডায়োড এবং ট্রানজিস্টরের ক্ষেত্রে ৬৪ শতাংশ, লোহা ও স্টিলের পাইপ এবং টিউবের ক্ষেত্রে ৬৩ শতাংশ, বিদ্যুৎ পুঞ্জীভবনকারী যন্ত্রের (ইলেক্ট্রিক অ্যাকিউমুলেটর) ক্ষেত্রে ৫৮ শতাংশ, টিভি'র এলসিডি, এলইডি ও এলইডি প্যানেলের ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশ, কীটনাশকের ক্ষেত্রে ৫২ শতাংশ, ডেটা প্রসেসিং মেশিন, এসি ও ফ্যান'এর ক্ষেত্রে ৪৬ শতাংশএভাবেই আরও বিভিন্ন ধরনের জিনিসের কথা বলা যায়। ভারতবর্ষের এই সব আমদানির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই যে, অনেক কাঁচামাল এবং মধ্যবর্তী জিনিসপত্রও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত, যা কিনা উৎপাদনের জন্য এবং অন্যান্য বাজারে জিনিস রফতানি করার জন্য জরুরি। অন্য ভাবে বোঝাতে গেলে, ভারত যেখানে চীন দেশের থেকে আমদানির ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল, চীনের কিন্তু ভারতের ওপরে সেরকম কোনও নির্ভরশীলতা নেই। সুতরাং, অর্থনৈতিক ভাবে চীনকে বয়কট করা অদূর ভবিষ্যতে কোনওভাবেই সম্ভবপর নয়, বিশেষ করে এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে যখন দেখা যাচ্ছে ভারতের বৃদ্ধির হার ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে ৫ শতাংশে নেমেছে ভারতের অনেক অটো, ফার্মা এবং বৈদ্যুতিন জিনিসের কোম্পানি আছে, যারা চীনের থেকে আমদানি করা জিনিসের ওপর ভীষণভাবে নির্ভর করে। বিকল্প ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে তারা এরকম একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিরুদ্ধে বিপদসংকেত দিয়ে দিয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, চীন থেকে আসা কাঁচামালের ওপর নির্ভর করে থাকা যে সব মার্কিন কোম্পানি ভারতে কাজ করে, তারা চীনা দ্রব্য বর্জন করার এই প্রস্তাবিত পদক্ষেপের ব্যপারে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে ।       

শুরুর থেকেই অতি দক্ষিণপন্থী অর্থনৈতিক অবস্থান, সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের প্রতি আরএসএস’এর চাটুকারিতা বা দাসসুলভ মনোভাব; ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশদের প্রতি, আর যুদ্ধ পরবর্তী নব্য ঔপনিবেশিক যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আরএসএস'এর মনোভাব একেবারেই বিতর্কের অপেক্ষা রাখে না সুতরাং, আরএসএস-চালিত মোদি সরকারের মার্কিন দেশের প্রতি আনুগত্য, এই সরকারের অত্যন্ত  স্বাভাবিক আচরণ বলে ধরে নেওয়া যায় তবে এ কথা সত্যি যে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দীর্ঘমেয়াদী শাসনকালে তিনি বেসরকারিকরণ/ কর্পোরেটাইজেশনের অতি দক্ষিণপন্থী মডেলের জন্য স্বীকৃতি পেয়েছেন। কিন্তু গুজরাট কাণ্ডের পরে, আমেরিকার ভিসা অনুমোদিত না হওয়ায় মোদি মার্কিন দেশের মাটিতে পা রাখতে পারেননি এ ব্যপারটাই হয়তো তাকে চীনের শাসকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য উৎসাহিত করেছে, যার জন্যে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চার বার এবং ফের ২০১৫-১৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বার চীন সফরে গেছেন।          

২০১১ সালের নভেম্বরে মোদির ৫-দিনের চীন সফর একটি ঐতিহাসিক ঘটনা, কারণ এই সফর তার চীনে যাওয়ার ওপর মনমোহন সরকারের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে ছিলমোদি চীনে যান হংকং হয়ে রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে চরম অস্বস্তিতে ফেলে বেইজিং'য়ে ভারতীয় দূতাবাসে গিয়ে পৌঁছলেন আর এই সফরের দরুণ তিনি এমন অনেক চীনা কোম্পানির সাথে সাক্ষাৎ করলেন, যারা কিনা গুজরাটে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। এর পরে এল ২০১৩ সালের ভাইব্র্যান্ট গুজরাট আর ২০১৪ সালেই রাজ্যে চীন দেশীয় বিনিয়োগের ব্যাপারে ৯,০০০ কোটি টাকার চুক্তিতে পৌঁছলেন মোদিগ্রেট ওয়াল মোটর্‌স কোম্পানি লিমিটেড এবং সাংহাই অটোমোটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন রাজ্যে যানবাহন তৈরির অনেক বড় কারখানা স্থাপন করতে রাজি হয়, আর তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল আদানির মুদ্রা পোর্টে কৌশলগত চীনের বিনিয়োগযেখানে মুম্বই এবং তুতিকোরিনের মতো পোর্টগুলো নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়ের কারণে চীনা বিনিয়োগের অনুমতি পায়নি, মুদ্রা পোর্টের ওপর চীনের বিনিয়োগ একটি ব্যতিক্রমী বিষয়সত্যি বলতে কি, চীনা বিনিয়োগের জন্য ব্যাপক হারে রেড কার্পেট বিছিয়ে দেওয়াও কিন্তু কেন্দ্রে তৎকালীন ইউপিএ সরকারের বিরোধ উপেক্ষা করেই। আর গুজরাটকে চীনা বিনিয়োগের হটস্পট বানানোর অংশ হিসেবেই মোদি মান্দারিন (চীনের রাষ্ট্রভাষা) কোচিং ইন্সটিটিউট এবং গুজরাটের বিশ্ববিদ্যালয়ে মান্দারিনের পাঠ্যক্রম চালু করারও সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন।     

কোনও সন্দেহ নেই যে এই 'গুজরাটি চীনি ভাই ভাই' প্রোজেক্টের গতি মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়াতে আরও বেড়ে গেল আর তার নির্বাচনে চীনের মিডিয়া ‘গুজরাট মডেল’কে সাধুবাদ জানাতে থাকল। এরপর ২০১৪ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি আহমেদাবাদে এলেন, যার ফলে গুজরাটে চীন দেশীয় বিনিয়োগ অগ্রগতির মুখ দেখল আর ভারত চীনা পণ্যের একটি আস্তাকুঁড়ে পরিণত হল। ২০১৯ সালের ভাইব্র্যান্ট গুজরাট সামিটে এসে হুয়াওয়েই সহ চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর চুক্তিবদ্ধ বিনিয়োগের পেছনে কিন্তু ছিল ১৭০০০ কোটি টাকার প্রতিশ্রুতিএছাড়া, ২১,৪০০ কোটি টাকার বিনিয়োগের প্রস্তাব তো ছিলই, যা কিনা ঢোলেরা স্পেশাল ইনভেস্টমেন্ট জোনে চিনের সোলার জায়ান্ট ইস্ট হোপ গ্রুপ এবং ঝাড়খণ্ডের গোড্ডায় আদানির পাওয়ার প্লান্টের সম্মিলিত বিনিয়োগএটা ২০১৭ সালের সেই ২২৫০ কোটি টাকার সেই চুক্তিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল, যে চুক্তি আদানির সাথে চীনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়েছিল চীনের সাথে এই যোগাযোগের আরও অন্য দিকও নিশ্চয়ই ছিল        

ইতিমধ্যে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা পাওয়ার পরেই মোদি যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা হল তার অতি দক্ষিণপন্থী গুজরাট মডেলের ভারত-সংক্রান্ত ভাবনাচিন্তা, যা মনমোহনমিক্স থেকে মোদিনমিক্সে অবস্থান্তরের একটি পূর্বাবস্থাএকই সাথে এটাও সত্যি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আরএসএস'এর ঐতিহাসিক আনুগত্যের রীতি মেনেছেন মোদি, এমনকি অর্থনীতি সংক্রান্ত বিষয়ে শি’র সঙ্গে সৌহার্দ্য এবং চীনের সাথে সুযোগ-সন্ধানী সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারেও তা সত্যিআর এভাবেই বিগত ৬ বছরে মোদি মার্কিন দেশের কৌশলগত জুনিয়ার অংশীদার হিসেবে দেশের অবস্থান পোক্ত করেছেন, চীনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক মতান্তরের ব্যপারে ওয়াশিংটনের সাথে অনেক সামরিক পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করার মাধ্যমেঅতঃপর ৬৪ বছরের পুরনো যোজনা আয়োগ তুলে দেওয়া সহ নেহেরুপন্থী রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের নকশার পড়ে থাকা যা কিছু অংশ, সব একটু একটু করে সরিয়ে ফেলে রাষ্ট্রকে ‘কর্পোরেট সহায়ক’এ রূপান্তরিত করা হল। এর পরে ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে প্রবল ঢক্কানিনাদের মাধ্যমে মোদি তার আকর্ষণীয় পরিকল্পনা 'মেক ইন ইণ্ডিয়া' নিয়ে এলেনএই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের স্বল্পমূল্যের কর্মশালা হিসেবে চীনের অভিজ্ঞতাকে অনুসরণ করে ভারতকে বিশ্বের এমন একটি কারখানায় পরিণত করা, যেখানে নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিকদের দিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করানো হয়এর লক্ষ্য ছিল 'সহজে ব্যবসা করার' বিষয়টাকে আরও উন্নত করে, বিদেশি পুঁজির প্রবেশ এবং প্রস্থানের পথে সমস্ত বাধা সরিয়ে ফেলে, আর বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নানান পদক্ষেপ গ্রহণ করে ভারতকে স্বল্প মূল্যের শ্রমিক তৈরি করার কারখানা হিসেবে দেখানোবিনিয়োগকারীদের স্বার্থে নেওয়া সে সব পদক্ষেপ হিসেবে, শ্রমের ব্যাপক উদারীকরণ, বিভিন্ন বহুজাতীয় কোম্পানি ও তাদের ভারতীয় জুনিয়ার অংশীদারদের জন্যে পরিবেশ এবং শ্রমের অবাধ শোষণের সুবিধার্থে নিয়ে আসা কিছু পরিবেশ সংক্রান্ত আইনের কথা বলা যায় নব্য উদারনৈতিক কেন্দ্রগুলোতে মোদির উঁচুদরের সফরগুলোর সঙ্গে সঙ্গে 'মেক ইন ইণ্ডিয়া'র যে পূর্বাভাস, তা শাসক দলের এই মেকি জাতীয়তাবাদের মাঝে আন্তর্জাতিক পুঁজির ওপর ভারতের ভয়াবহ রকমের নির্ভরশীলতার একটি পথনির্দেশিকা তৈরি করে দিয়েছে।                         

এই পরিপ্রেক্ষিতেই চীন একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হওয়ার সুবাদে, আর জিডিপিতে তাদের উৎপাদনের ৩০ শতাংশ (যেখানে ইউএস'এর ক্ষেত্রে সেই পরিমাণটা হল ১১ শতাংশ) অবদান রাখার সুবাদে, মোদির 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র সুবিধা নেওয়ার মতো অবস্থানে আছে এর পটভূমিকা ইতিমধ্যেই মোদি আর শি’র বন্ধুত্বের মাধ্যমে তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে মোট ১৮টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মোদির সাথে হওয়া শি’র মিটিংগুলির কথাও উল্লেখযোগ্য! পশ্চিমি দেশের তুলনায় আরও কম দামের এবং বেশি কর্মদক্ষ প্রযুক্তি চীনকে ভারতবর্ষে বাজার দখল করতে সাহায্য করেছে। খুব সম্ভবত, এ ক্ষেত্রে একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে ২০১৭ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে বেইজিং প্রোটেক লিমিটেড সায়েন্স কোম্পানির চুক্তির কথা বলা যেতে পারে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হল বুলেট প্রুফ জ্যাকেট বানানোর জন্য মেটিরিয়াল ফ্যাব্রিক এবং বোরন-কার্বন হোয়াইট পাউডার আমদানি করা (www.thepolicytimes.com) আগে এইসব কাঁচামাল/মধ্যবর্তী জিনিসপত্র নেদারল্যান্ডস বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থেকে আমদানি করা হত। কিন্তু এই পরিবর্তন অপরিহার্য করে তোলা হয়েছিল, কারণ চীনের জিনিসপত্র ৬০-৭০ শতাংশ বেশি সস্তা। আর ব্যুরো অফ ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস'এর তৈরি করা গুণের মাপকাঠি অনুযায়ী জিনিসের গুণমান নির্ধারণ করার জন্য নানান পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাবার পরেই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো গিয়েছিলযখন চীনের এই চুক্তির ব্যাপারে যথারীতি সেই নিরাপত্তার প্রশ্ন উঠল, ভি কে সারস্বত (নীতি আয়োগের সদস্য এবং ডিআরডিও’র প্রাক্তন প্রধান) সরকারের ‘অসহায়তা’কে এভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন: 'এটা একটা বাজারগত শক্তি, এ ক্ষেত্রে আমাদের বিশেষ কিছুই করার নেই। শুধুমাত্র, যদি আমরা দেখি যে এই বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটগুলো খুব একটা ভালো নয়, তবেই আমাদের কিছু বলার আছে। তবে এখনও পর্যন্ত সেরকম কোনও পরিস্থিতি আসেনি।' চীনের দ্বারা ব্রাজিল, পোল্যান্ড, থাইল্যান্ড, মালেশিয়া, শ্রীলঙ্কার পাশাপাশি ভারতের নোট ছাপানোর খবর (চীন হল একমাত্র দেশ, যে কিনা ব্যাঙ্ক নোটের দুদিকেই নোট ছাপানোর ইন্ট্যাগ্লিও স্টাইল কালার ডান্সের মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারে নোটের নিরাপত্তার জন্যে) মিডিয়ায় এসেছিল (ডেকান ক্রনিক্‌ল, ১৮ই এপ্রিল ২০১৮)। কিন্তু একজন কর্তাব্যক্তি, তার নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে, পরে বিষয়টাকে অস্বীকার করেছেন।          

সেই বাজারের আইন, যা কিনা এখন নব্য উদারপন্থী বিশ্বায়নকে নিয়ন্ত্রণ করে, তা শেষ অবধি 'মেক ইন ইন্ডিয়া'র আবরণ সরিয়ে তাকে 'মেড ইন চায়না' হিসেবে প্রকাশ করে দেওয়ার পক্ষে চূড়ান্ত নির্ণায়ক হয়ে উঠেছে। মোদির শাসনব্যবস্থা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক আরও মজবুত করে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ইন্দো-প্যাসিফিক ষড়যন্ত্রের কৌশলগত বুনিয়াদে পরিণত করেছিল। কিন্তু মার্কিন দেশ অনেক অতিপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছিল, আর সেই সাথে ছিল বেশি দামের সমস্যা। এই বিষয়টাই বিভিন্ন বিনিয়োগের ক্ষেত্র থেকে বাস্তবসম্মত ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে দেওয়াতে চীনকে সক্ষম করেছিলসেই মতোই, ভারতে মোট চীনের বিনিয়োগ ২০১৪ সালে ১.৬ বিলিয়ান ডলার থেকে ২০২০ সালে ৮ বিলিয়ান ডলারে গিয়ে পৌঁছেছিল। যদি পরিকল্পিত এবং প্রস্তাবিত বিনিয়োগ এর সাথে যোগ করা হয়, তাহলে সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ২৬ বিলিয়ান ডলারে (এ হল প্রায় ২ লক্ষ কোটি টাকা, আর ওদিকে হিসেব মতো ভারতীয় বিনিয়োগ মোটে ৭০০০ কোটি টাকা)তবে এ কথা ঠিক যে, কোনও কোনও পর্যবেক্ষকদের মতে, চীনের পুঁজিবাদী বিনিয়োগের একটা বড় অংশ অনেক সময়েই অন্য পথে নিয়ে যাওয়া হয়, মানে তা করা হয় সিঙ্গাপুরের মতো কোনও তৃতীয় দেশ থেকে। প্রকৃত অর্থে সিঙ্গাপুর এখন ভারতের জন্য বিদেশি বিনিয়োগের বৃহত্তম উৎসস্থল। ইউপিএ’র শাসনকালে মরিশাস ছিল ভারতের জন্য এফডিআই'এর সব থেকে বড় উৎস, যাকে কিনা ভারতে মার্কিন পুঁজি রফতানি হিসেবে ছদ্ম আবরণ দেওয়া হয়েছিল (এটা করা হয়েছিল ভারত এবং মরিশাসের মধ্যে ট্যাক্স অ্যাভয়ড্যান্স ট্রিটির সুযোগ নিয়ে)। এখন মোদির শাসনে সিঙ্গাপুরের দ্বারা ভারতে সব থেকে বড় পুঁজি রফতানিকারী দেশ হিসেবে মরিশাসের স্থান দখল করে নেওয়ার বিষয়টা চীনের ওপর ভারতের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতার পাশাপাশি পাঠযোগ্য যদিও এ বিষয়ের ওপর নির্ভরযোগ্য তথ্য খুবই কম এবং বিরল।       

এখন মূলত প্রযুক্তির খাতে জোর দেওয়া চীনের বিনিয়োগের বিষয়ে নজর দিলে বলা যায় যে এই চিত্রটা খুবই জটিল। ২০০৮ সালের মধ্যেই ১০০০ কর্মচারী-সমন্বিত ভারত (ব্যাঙ্গালোর) শেনজেন-ভিত্তিক হুয়াওয়েই টেকনোলজিস কোম্পানি লিমিটেডের কাছে সব থেকে বড় বিদেশি গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠেফাইভ জি’র ক্ষেত্রে বিশ্বে অগ্রগণ্য হুয়াওয়েই টেকনোলজিস কোম্পানি লিমিটেড'কে সব থেকে বড় কৌশলগত ফ্রণ্টিয়ার প্রযুক্তি হিসেবে ধরা হয়। ইতিমধ্যেই ভারতে এই কোম্পানির ফাইভ জি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার খবর পাওয়া গেছে, যা অনেকটাই ট্রাম্প প্রশাসনের পরামর্শের পরিপন্থী। তবে সীমান্ত নিয়ে মতবিরোধের আবহে এর ভবিষ্যৎ কার্যক্রম অনিশ্চিত। মোদি ক্ষমতায় আসার পরে গেটওয়ে হাউসের হিসেব অনুযায়ী, চীনের প্রথম সারির টেক বহুজাতিক সংস্থাগুলি ভারতে স্টার্ট আপ'এর ক্ষেত্রে ৪ বিলিয়ান ডলার (৩০,০০০ কোটি টাকা) লগ্নি করেছেমোদি শাসনের পাঁচ বছর পার করে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের মার্চে ভারতের ৩০টি ইউনিকর্ন কোম্পানির (ইউনিকর্ন কোম্পানি এমন একটি স্টার্ট আপ কোম্পানি যার মূল্য ১ বিলিয়ান ডলারের বেশি) মধ্যে ১৮টিই চীনের অর্থ সাহায্যে চলেআরও ৯২টি কম বিনিয়োগের স্টার্ট আপ কোম্পানিকেও অর্থ সাহায্য করে চীন। 

চীনের সফটওয়ার কোম্পানিগুলো যেমন, আলিবাবা, বাইটডান্স, টেনসেন্ট হুয়াওয়েই, জেডটিই; মোবাইল কোম্পানিগুলো যেমন, অপ্পো, ভিভো, ওয়ান প্লাস, কুলপ্যাড, মোটোরোলা, লইকো, লেনোভো, মিজু, অনার, জিওনি, জিফাইভ, হেয়ার, টিসিএল এবং অটোমোবাইল জায়ান্টগুলো যেমন, ভলভো, এসএআইসি, নিপ্পন, সাংহাই ইলেক্ট্রিক, বেইজিং অটোমোটিভ, ওইসকো, চায়না ডংফ্যাং, ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে গভীর শিকড় বিস্তার করেছে। ডিডি, চান্‌ক্সিং, শানওয়েই ক্যাপিটাল, ফসান ক্যাপিটাল, চায়না ইউরেশিয়া ইকনমিক কর্পোরেশন ফান্ড হল চীনের কিছু বিখ্যাত বহুজাতিক কোম্পানি যারা ইন্ডিয়ান স্টার্ট আপ কোম্পানিদের অর্থ সাহায্য করে থাকে। সেই সব ইন্ডিয়ান স্টার্ট আপ কোম্পানির উদাহরণ হিসেবে পেটিএম, ওলা, স্ন্যাপডিল, সুইগি, ফ্লিপকার্ট, মাই ডর্মাসি, হাইক মেসেঞ্জার, আইবিবো আর মেক মাই ট্রিপ, ড্রিম ১১, বাইজু’স অ্যাপ, বিগ বাস্কেট, ডেলহিভারি, ওয়ো, পলিসি বাজার, কুইক্‌র, রিভিগো, উড্ডান, জোমাটো ইত্যাদির কথা বলা যায়। চীনের ভিডিও অ্যাপ টিকটকের ২০০ মিলিয়ন ভারতীয় গ্রাহক আছে। ভারতে এই ভিডিও অ্যাপ ইউএস-ভিত্তিক ইউটিউবকে ছাড়িয়ে গেছে। আলিবাবা, টেনসেন্ট, বাইটড্যান্স, ভারতে ফেসবুক, অ্যামাজন, গুগ্‌লদের মতো ইউএস জায়ান্টকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছেঅপো আর জিয়াওমির মতো চীনের স্মার্টফোন ভারতের স্মার্টফোনের বাজার ৭২ শতাংশ দখল করে নিয়েছে, আর দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং এবং মার্কিন অ্যাপ্‌লের মতো ব্র্যান্ডকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছেআর ভারতে ৫টি সেরা মোবাইল ফোন ব্র্যান্ডের মধ্যে চারটেই হল চীনের কোম্পানিঅন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সমতুল্য বিনিয়োগের ধারা না মেনে যেহেতু চীন দেশিয় বিনিয়োগ জটিল সংযোগ সহ দ্রুতগামী ফ্রন্টিয়ার প্রযুক্তির এলাকায় (ফাস্ট মুভিং ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি এরিয়া) হয়ে থাকে, সেই কারণেই তাদের প্রভাবকে এই ধরনের বিনিয়োগের আয়তনের তুলনায় সামঞ্জস্যহীন বলে মনে করা হয়এখন, এটা পাঠকরাই ভাল করে ভেবে দেখুক যে, চীনকে বয়কট করার সামর্থ্য আদৌ ভারতের আছে কিনা ।      

এর সাথে সাথে শিল্প এবং কারিগরির বিভিন্ন ক্ষেত্রে চীনের পুঁজির প্রবেশ ঘটছেএর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে,  সৌরশক্তি উৎপাদনকারী সরঞ্জাম, কেমিকাল, অ্যালুমিনিয়াম, পশুখাদ্য, অটোমোবাইল, ধাতুবিদ্যা, নির্মাণকার্য, রেল এবং বন্দরের নির্মাণ ইত্যাদির কথা। ব্যাঙ্কিংয়ের ক্ষেত্রেও পিপ্‌ল্‌স ব্যাঙ্ক অফ চায়না (পিবিওসি) ভারতে বিভিন্ন ঘুঁটি সাজিয়েছেখুব সম্প্রতি পিবিওসি ভারতে হাউজিং ডেভেলপমেন্ট ফিনান্স কর্পোরেশন লিমিটেডের (এইচডিএফসি) ওপর অংশীদারিত্বের জন্য আরও টাকা লগ্নি করেছে। এমনকি এখানে প্যাটেলের ৬০০ ফিট উঁচু মূর্তির কথাও বলতে হয়, যা কিনা তাঁর প্রতি মোদির উঁচু মাপের শ্রদ্ধাঞ্জলী। ২৯৯০ কোটি টাকায় তৈরি সেই স্ট্যাচু অফ ইউনিটিও মেড ইন চায়নার শিলমোহর বিরহিত নয়। ২০১০ সালে মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন এই মূর্তির কথা ঘোষণা করা হলেও এই স্ট্যাচু অফ ইউনিটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছিল মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। ১৭০০ মেট্রিক টন ওজনের ৬৫০০টি ব্রোঞ্জ প্যানেলের গোটাটাই জিয়াংক্সি টঙ্কিং মেটাল হ্যান্ডিক্রাফ্‌ট্‌স লিমিটেড কোম্পানিতে ঢালাই হয়েছিল, কারণ ভারতবর্ষে সেরকম সুযোগ-সুবিধা নেই       

ওদিকে ভারতের যে সব পিএসইউ'গুলো উন্নত সেমিকন্ডাক্টারে গবেষণাতে রাজি হয়েছিল, তাদের অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ভেঙে ফেলা বা দুর্বল করে দেওয়া হল পাশাপাশি, ঝুঁকি সাপেক্ষ কর্পোরেটাইজেশনের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করা ক্রোনি ক্যাপিটালিস্টরা ভারী শিল্প বা প্রযুক্তির উন্নয়নের ব্যপারে বড় একটা আগ্রহী নয় ইতিমধ্যে, 'মেক ইন ইন্ডিয়া' এবং আত্মনির্ভর ভারতের পোস্ট ট্রুথ পূর্বাভাসের প্রভাবে ভারতের বেসরকারি কর্পোরেট সেক্টরকে বিদেশি সহযোগিতা বা যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রযুক্তি আমদানি করতে উৎসাহিত করা হচ্ছিল। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান এবং অন্যান্য দেশের সেই বহুজাতিক সংস্থাগুলো যারা কিনা আইটি, জৈব প্রযুক্তি (তবে ভারি শিল্পের ক্ষেত্রে নয়) আর অন্যান্য ক্ষেত্রে উদার আবহাওয়ার প্রভাবে ছুটে আসছে, তারা প্রযুক্তি হস্তান্তর এবং উন্নতিকরণের জন্যে একেবারেই ইচ্ছুক নয়। কোভিড-১৯ এসে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে যথেষ্ট বিনিয়োগ না হলে কোনও দেশই আত্মনির্ভরশীলতার দিকে যেতে পারে নাভারতের মতো এক বিশাল এবং বৈচিত্রপূর্ণ দেশের কাছে বাইরের দেশ থেকে অনুকরণ করার মতো কোনও মডেল নেইবেসরকারি কর্পোরেট ক্ষেত্রের ওপর  নির্ভরশীলতা, বহিরাগত উৎস থেকে অর্থের যোগান এবং মানুষের যোগদান সহ পরিকল্পিত সরকারি হস্তক্ষেপের বিনিময়ে অফশোর ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের ক্ষেত্র (স্বল্পমূল্যে শ্রম পাবার জন্য অন্য দেশে বাণিজ্য স্থানান্তরিতকরণ)- এসবই ভারতের পক্ষে আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। চীনের সঙ্গে চলতে থাকা সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ভারতের নিরাপত্তাহীনতাকে আরও বেশি করে প্রকট করে দিয়েছে এখন প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর জন্যে, এরকম খারাপ পরিস্থিতিতে সঠিক রাজনৈতিক বিকল্পের কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবার চূড়ান্ত সময়।  

অনুবাদ: মঞ্জিস রায়


Saturday, 23 January 2021

গোদি মিডিয়ার মাফিয়াগিরি

কারা চালাচ্ছে দেশ? 

সোমনাথ গুহ

 


সীমাহীন গলাবাজি, হিস্টিরিয়া-গ্রস্ত, তাক লাগানো খবর, দিনের মোক্ষম সময়ের ‘বিতর্কসভায়’ মৌখিক হামলাবাজি করে যিনি বক্তাদের ভেড়ায় পরিণত করতে অভ্যস্ত, শাসক দলের নির্লজ্জ তাঁবেদারি করে যে ব্যক্তিটি টিভি চ্যানেলের স্টুডিওকে বিরোধীদের বধ্যভূমি করে তুলেছেন, রিপাবলিক টিভির কর্ণধার সেই অর্ণব গোস্বামী আজ নিজেই খবর। অর্ণব এবং BARC (ব্রডকাস্ট অডিয়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল)'এর ভূতপুর্ব সিইও পার্থ দাশগুপ্ত'র ৩৪০০ পাতা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ মুম্বাই পুলিশের হস্তগত। 

অর্ণব ও পার্থ টাইমস গ্রুপে সহকর্মী ছিলেন মে ২০১৭তে অর্ণব রিপাবলিক টিভি শুরু করেন। এর আগেই অন্য একটি চ্যানেলে তিনি টিভি সাংবাদিকতার এক নতুন স্টাইল উন্মোচিত করেন। এই স্টাইল উৎকর্ষতার পরোয়া করে না, এ হচ্ছে পাতি ঢক্কানিনাদ, যেখানে খবর নয় খবরদারি, নিউজ নয় নয়েজ হচ্ছে নির্ণায়ক। পরিশীলিত অফিস কর্মী বাড়ি ফিরে রাত নটার প্রাইম টাইমে এই ধরনের শালীনতাহীন ধুন্ধুমার বাকযুদ্ধ দেখতে অস্বস্তি বোধ করেনতাঁরা রিমোটের সুইচ টিপে অন্য চ্যানেলে চলে যান যেখানে যুক্তিতর্কের একটা রেওয়াজ আছে। তথ্যের বিকৃতি, লাগামছাড়া আগ্রাসন, চিলচিৎকার করে পরস্পরের প্রতি দোষারোপ এই ধরনের তামাশা দেখবার জন্য প্রয়োজন হয় ভিড়, MOB, এবং সেটা করার একটিই উপায় টিআরপি বাড়ানো। যত বেশি মানুষ রিপাবলিক টিভি দেখবে তত সেটার টিআরপি বাড়বে, যত টিআরপি বাড়বে তত বিজ্ঞাপন আসবে।   

এখানেই শুরু হয় অর্ণব ও পার্থর যোগসাজশ। অর্ণবের প্রয়োজন টিআরপি বাড়ানো এবং বার্কের প্রধান হিসাবে পার্থ সেটা অনায়াসে করতে পারেন। অর্ণবকে সাহায্য করে পার্থ'র নিজের স্বার্থসিদ্ধি কী ভাবে হবে? অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে মিডিয়া অ্যাডভাইসার হিসাবে নিযুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এমনও অভিযোগ যে পার্থ দাশগুপ্ত'র এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করা অর্ণবের বাঁ হাতের খেল কারণ সমস্ত মন্ত্রীরাই তাঁর হাতের মুঠোয় এবং উচ্চতম দুই ব্যক্তির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ। মুম্বাই পুলিশের চার্জশিটে উল্লিখিত কথোপকথন অনুযায়ী পার্থ তাঁর অফিসিয়াল পদের সুযোগ নিয়ে ‘রিপাবলিক ভারত ইন্ডিয়া’ এবং ‘রিপাবলিক ইন্ডিয়া’ (ইংলিশ)'র টিআরপি (টেলিভিশন রেটিং পয়েন্ট) নানা ফন্দি করে বাড়িয়ে দেন, প্রতিদ্বন্দ্বী চ্যানেলগুলিকে চেপে দেন যার ফলে রাতারাতি ঐ দুটি চ্যানেলেরই দর্শক সংখ্যা চড়চড় করে বাড়ে। এতে অন্য চ্যানেলের গাত্রদাহ হয়, যদিও এদের মধ্যে বেশির ভাগই কৃত্রিম উপায়ে টিআরপি বাড়ানোর দোষে দুষ্ট। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে অন্তত কিছু তো একটা করে দেখাতে হয়। TRAI (টেলেকম রেগুলেটারি অথরিটি অফ ইন্ডিয়া) ঠিক করে যে কেবল অপারেটর গ্রাহকের টিভিতে একটা চিপ লাগিয়ে দেবে যেটা কে কোন চ্যানেল কতক্ষণ দেখছে তার হিসাব রাখবে। অর্থাৎ, ব্যাপারটা ডিজিটাল হয়ে গেল, অফিসে বসে আমার কাছের লোকের রেটিং বাড়াব, প্রতিযোগীদেরটা কমিয়ে দেব, এটা করা অসুবিধা হয়ে গেল। পার্থ জানায়, যে কোনও উপায়ে এই নতুন পদ্ধতি বন্ধ করতে হবে। হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ অনুযায়ী এখানে এএস (AS)'এর সাহায্য নেওয়ার প্রসঙ্গ আসে যে এটা অনায়াসে ধামাচাপা দিয়ে দিতে পারে। রহস্যজনক কে এই এএস? 

রিপাবলিক টিভির বিরুদ্ধে এর আগেও সরকারি আনুকূল্য কাজে লাগিয়ে শ্রোতা-দর্শক সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টার অভিযোগ এসেছে। দূরদর্শনের DTH সার্ভিস ব্যবহার করার জন্য সময়সীমা নিলাম করা হয়। কোটি কোটি টাকার মূল্যে বিভিন্ন সংস্থাকে সময় প্রদান করা হয়। অভিযোগ- রিপাবলিক টিভি নিলামে অংশগ্রহণ না করেও DTH সার্ভিস ব্যবহার করেছে যার ফলে প্রসার ভারতীর প্রায় ৫৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। ঐ সময়েও এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয় যা মন্ত্রীসভার কোনও এক ‘রাঠোর’ ধামাচাপা দিতে সাহায্য করে।  

হোয়াটসঅ্যাপ'এর ঐ কথোপকথনে বিস্ফোরক সব তথ্য পাওয়া গেছে। পুলওয়ামায় সিআরপিএফ'এর ওপরে বিধ্বংসী আক্রমণের পর অর্ণব নাকি উল্লসিত হয়ে বলে উঠেন, এই হামলা আমাদের পক্ষে উন্মাদের মতো সহায়ক হবে। চল্লিশ জন সেনার মর্মান্তিক মৃত্যুর কারণে সারা দেশ যখন শোকস্তব্ধ তখন এই ধরনের প্রতিক্রিয়া বিস্ময়কর। ‘আমাদের’ বলতে উনি কাদের বোঝাচ্ছেন, কাদের পক্ষে ‘সহায়ক’ হবে বলছেন? এই হামলার প্রত্যুত্তরে ভারতীয় বায়ু সেনা ২৬ ফেব্রুয়ারি বালাকোটে এয়ার স্ট্রাইক করে। অভিযোগ, অর্ণব এর তিন দিন আগে পার্থকে বলেন, বড় কিছু একটা হবে। পার্থ'র জিজ্ঞাসা, দাউদ? অর্ণব জানান আরও বড় কিছু, মানুষ উল্লসিত হয়ে যাবে। এতদিন অবধি আমরা জেনে এসেছি প্রধানমন্ত্রী এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা ছাড়া এই স্ট্রাইকের কথা আর কেউ জানতেন না। টিভির একজন সঞ্চালক এত বড় একটা খবর কী করে পেয়ে গেলেন? এ তো দেশের নিরাপত্তা নিয়ে ছেলেখেলা করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ করার দায়ে ওনাকে ১৯২৩'এর ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ অনুযায়ী গ্রেফতার করা যেতে পারে। 

আরও চমকপ্রদ তথ্য উন্মোচিত হয়েছে। ধারা ৩৭০ যে রদ হবে এটা নাকি তিনি দু' দিন আগেই জানতেন, যে কারণে অন্য সব সংবাদ মাধ্যমের আগেই তিনি রিপাবলিক টিভি'র ৫০ জন কর্মীকে জম্মু-কাশ্মীরে মোতায়েন করতে পেরেছিলেন। অভিযোগ, তখন তিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। দুই বছরের অধিক সময় ধরে চলা তাঁদের এই কথোপকথনে অর্ণব এবং পার্থ কাউকেই রেয়াত করেননি। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি'র দক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন এমনকি তাঁর মৃত্যু বিলম্বিত হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট টিভি সাংবাদিকদের সম্পর্কে তীর্যক, অপমানজনক মন্তব্য করেছেন, যে তালিকায় তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীরাও আছেন। পার্থ যখন বলেছেন তিনি আদালতের একটি কেসে ফেঁসে আছেন, তখন বিচারককে কিনে ফেলার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।

রিপাবলিক টিভি শীঘ্রই বাংলায় পদার্পণ করছে। ইউটিউবের একটি বাংলা চ্যানেল জানাচ্ছে যে পার্থ দাশগুপ্ত পশ্চিমবাংলার ওপরে কিছু করার জন্য বারবার জোর দিয়েছেন। অর্ণব নাকি তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন এবং বলেছেন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া এবং বসিরহাটের ‘দাঙ্গা’র কথা উল্লেখ করেন। টিভি সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ছলেবলে কৌশলে করায়ত্ত করে, ফেসবুকের ওপর নিজেদের প্রতাপ কায়েম করে নিজেদের পক্ষে জনমত গঠন করাতে বিজেপি সিদ্ধহস্ত। এটা আজ পরিষ্কার, দু' দুটি লোকসভা নির্বাচন জিততে, সারা দেশ জুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়াতে, জাতপাতের বিভাজন, নারী ও দলিতদের প্রতি বিদ্বেষ বাড়িয়ে তুলতে এই সব চাটুকার সংবাদমাধ্যম নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

সাংবাদিকতায় নিরপেক্ষতা বলে কিছু হয় না। নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা কথার কথা ছিল মাত্র। কিন্তু পক্ষপাতহীনতার একটা ভড়ং ছিল, কোনও বিশেষ পক্ষের হলেও নিজের বা সংস্থার মতামতকে লুকোছাপা করার একটা প্রয়াস ছিল। রাজনীতি যত উগ্র হয়েছে, সাংবাদিকতাও তাল মিলিয়ে উগ্র হয়েছে। নেতানেত্রীদের মুখের ভাষা যত অশালীন হয়েছে, সাংবাদিকের ভাষ্যেরও ততোধিক অবনমন ঘটেছে। সমস্ত মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বহু সাংবাদিক, বিশেষ করে টিভির সঙ্গে যুক্ত যাঁরা, একটা বিশেষ দলের হয়ে সরাসরি প্রচার করতে শুরু করে। এই প্রক্রিয়ার শুরু নতুন শতাব্দীর গোড়া থেকে যা ২০১৪ সালে প্রাক-নির্বাচনের সময় ত্বরান্বিত হয় এবং যা এখন অভুতপূর্ব পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অর্ণবের সাফল্যের ফরমুলা অনুসরণ করে প্রায় সব টিভি চ্যানেল সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে উঠেছে, গোদি মিডিয়ার জন্ম হয়েছে। ভিড়তন্ত্র, মবোক্রেসি আজ টিভি স্টুডিওতেও পৌঁছে গেছে। প্রত্যহ সন্ধ্যায় সেখানে আজ মার মার কাট কাট রব! মিডিয়া এখন বিচারব্যবস্থার কাজও নিজের হাতে তুলে নেয়। প্রাইম টাইমের টিভি স্টুডিও আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিভিন্ন ঘটনার বিচারকক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। মিডিয়া ট্রায়ালে সঞ্চালক ও তাঁর আজ্ঞাবহ বক্তারা ঠিক করে দেন রিয়া চক্রবর্তী সুশান্ত সিং রাজপুতকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছেন। তাঁরাই রায় দেন জাকির নায়েকের পয়সা দিয়ে শাহিনবাগের সংগঠকরা দিল্লিতে দাঙ্গা করেছেন। চিলচিৎকার করে তাঁরাই দেশকে বারবার জানান যে খালিস্তানিরা কৃষক আন্দোলন পরিচালনা করছেন, জেএনইউ'র নেতানেত্রীরা দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চাইছেন। তাঁরাই সত্যান্বেষী পুলিশ অফিসারকে মুসলিমদের দালাল বলে দেগে দেন, ফ্রিজে মাংসটা পাঁঠা নয় গরু ছিল জানিয়ে দেন, চমকপ্রদ প্রচার করেন যে মহিলার মৃত্যুকালীন জবানবন্দী ভুল, আসলে কোনও ধর্ষণই হয়নি।

এই পঙ্কিল পরিস্থিতিতে অর্ণব গোস্বামীরা রাজ করবেন না তো কে করবে। হোয়াটসঅ্যাপ'এর মেসেজের ওপর ভিত্তি করে যদি উমর খালিদকে গ্রেফতার করা যায়, তাঁকে যদি ইউএপিএ'তে অভিযুক্ত করা যায় তাহলে অন্যদের কেন নয়? রাজপথে, অলিতে গলিতে গলা ফাটিয়ে আজ বলার দরকার: দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো।


Friday, 22 January 2021

'পরাক্রম দিবস'এর ভাঁওতাবাজি

নেতাজীর স্বপ্ন: ইত্তেহাদ-ইতমদ-কুরবানি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


এ বছরের ২৩ জানুয়ারি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু’র ১২৫তম জন্মবার্ষিকীর প্রারম্ভে দিল্লির সরকার দিনটিকে ‘পরাক্রম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ‘পরাক্রম’ শব্দটি শুনলেই কেমন যেন বীর-বিক্রমে যুদ্ধে যাওয়ার আবহ তৈরি হয়ে যায়! ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’। হয়তো সেটাই উদ্দেশ্য। নেতাজীর চিন্তাধারা, জীবনাদর্শ ও রাজনীতিকে যদি নিছক পরাক্রমের বাহুল্যে মুড়ে ফেলার প্রচেষ্টা থাকে তাহলে এ ব্যতীত আর কিইবা নামকরণ মাথায় আসে। বলাই বাহুল্য, দিবসের এই নামকরণটি বিজেপি’র রাজনীতির সঙ্গে যথেষ্ট সাযুজ্যপূর্ণ কিন্তু নেতাজীর সঙ্গে নয়। কারণ, বিজেপি’র রাজনীতির সঙ্গে পুরুষালি রণংদেহী লম্ফঝম্ফের যে যোগসূত্রটি বর্তমান, যেখানে আরাধ্য ভগবানের নামশরণ’ও (‘জয়শ্রীরাম’) হয়ে ওঠে এমন এক রণধ্বনি যা অপর বিশ্বাসীকে অনায়াসে কোতল করতে দ্বিধা করে না, তা নেতাজীর রাজনীতি, দর্শন ও মানবিকতাবোধের সঙ্গে একেবারেই মেলে না।

দিল্লির সরকারে আসীন উগ্র জাতীয়তাবাদীদের রাজনীতি বিকৃত পরাক্রমের রাজনীতি, তাই তা ধ্বংস ও বিভাজনের রাজনীতি। নেতাজীর রাজনীতি ভালোবাসা ও ঐক্যের রাজনীতি, যেখানে পরাক্রম কোনও জীবনদর্শন নয়, যুদ্ধের ময়দানে ন্যায় ও দেশপ্রেমের প্রকাশ মাত্র। নেতাজীর জীবন আলেখ্য ও বিশ্বাসে শান্তি, দেশপ্রেম ও সহাবস্থানই মূল অন্তর্বস্তু, পরাক্রম নয়। তাই, আজকের দিল্লির সরকার ও নেতাজীর ভাবধারার মধ্যে দুস্তর ব্যবধান। রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজী নেতাজীকে আখ্যায়িত করেছিলেন যথাক্রমে ‘দেশনায়ক’ ও ‘দেশপ্রেমিকদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট দেশপ্রেমিক’ বলে। সেই শিরোপাদ্বয়েই তাঁর যথার্থ পরিচয়।

তাই বলে নেতাজীর সাহস ও বীরত্বকে কি আমরা স্বীকার করব না? অবশ্যই করব। কিন্তু সেটা তাঁর রাজনীতির মতাদর্শ ও প্রজ্ঞাকে আড়ালে ঠেলে নয়। বুঝতে হবে, নেতাজীর সুগভীর রাজনৈতিক মর্মবস্তুকে বাদ দিয়ে তাঁর যে সামরিক পরাক্রমকে বিচ্ছিন্ন ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে তা ছিল তাঁর দেশপ্রেমিক মতাদর্শের অভিব্যক্তি মাত্র; সেখানেও তিনি অদ্বিতীয়। কিন্তু তাঁকে শুধুমাত্র পরাক্রমশীলতার রজ্জুতে বাঁধলে তাঁর ধী ও চৈতন্যকে আমরা হারিয়ে ফেলব। দিল্লির অধীশ্বরদের সেটাই আসল উদ্দেশ্য। মাথায় ফেট্টি বেঁধে, হাতে অস্ত্র নিয়ে, কপালে তিলক কেটে, মুখে ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনি তুলে রাষ্ট্রের সহায়তায় অন্য আরেক দল মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে দৈন্য, বীভৎসতা ও হিংস্রতা, তাতে এক বিকৃত ও ভীরু পরাক্রমশীলতা আছে বটে কিন্তু দেশপ্রেম ও মানবিক চৈতন্যের ছিটেফোঁটাও নেই। তাই চেষ্টা, নিজ রাজনীতির সেই উগ্র মতান্ধতাকে নেতাজীর ওপর আরোপিত পরাক্রমের অভিধা দিয়ে যথার্থ করে তোলা। তাতে এই দাঁড়ায়- তথাকথিত বীরত্বই সব, বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়াই উদ্দেশ্য, পরাক্রমের রণহুঙ্কারে উল্লাসে মেতে ওঠাই মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও বিধেয় সেখানে গৌণ মাত্র। এক অর্থে, বীরত্বকে রাজনীতি-বিচ্ছিন্ন করে দেখানো যেখানে নিজেদের গায়ের-জোয়ারিকে বাহবা ও যাথার্থ্য দেওয়া যায়। এর বেশি এগোলে যে কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়বে! কারণ, নেতাজীর দেশপ্রেম এবং উগ্র রক্ষণশীলদের তথাকথিত দেশপ্রেমের মধ্যে যে কয়েক কোটি যোজনের দূরত্ব।

যে মোগল আমলকে ‘মুসলমান’দের হাতে পরাধীনতার কাল বলে আরএসএস-বিজেপি সোচ্চারে চীৎকার করে, সেই মোগল আমলের শেষ সম্রাট ও ১৮৫৭ সালের ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিদ্রোহী জনগণ কর্তৃক স্বাধীন ভারতের সম্রাট হিসেবে স্বীকৃত বাহাদুর শাহ জাফরের রেঙ্গুন সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে নেতাজী আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়কের কার্যাবলী শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেই তিনি ডাক দিয়েছিলেন: দিল্লি চলো। নেতাজীর এই অনুশীলন ও প্রজ্ঞাকে মানলে দিল্লির আজকের অধীশ্বররা কীভাবে মোগল আমলকে আর পরাধীনতার কাল বলতে পারেন? তাই নেতাজী নয়, তাদের অভিসন্ধি নেতাজীর নামে এক মিথ্যা পরাক্রমের আবরণ নির্মাণ করে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করা।

সবচেয়ে বড় কথা, নেতাজী কখনই ধর্ম, বর্ণ, জাতপাত, জাতি, লিঙ্গ- কোনও বিভাজনের ভিত্তিকেই মানেননি। তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ ছিল এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রতীক। এই প্রথম কোনও সেনাবাহিনীতে তৈরি করা হয় সম্পূর্ণ এক মহিলা ব্রিগেড: ঝাঁসির রাণী ব্রিগেড। বোঝাই যায়, এমন এক আধুনিক মানুষের চিন্তার পরিসর ও গভীরতা স্বভাবতই ছিল তাঁর সময়ের থেকেও কয়েক শতক এগিয়ে। তিনি জানতেন, ভারতের মতো বহু ভাষী, বহু জাতি, বহু ধর্মের দেশের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন এমন এক উদার ভ্রাতৃত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের আদর্শ যা বিবিধের মাঝে মিলনকে মহান করে তুলতে পারে। সেই জটিল অথচ জরুরি কাজটিকেই তিনি শিরোধার্য করেছিলেন। কারণ, সেই মিলনই ছিল স্বাধীন ভারতের যাত্রাশুরুর বিন্দু। আর সে কাজে তিনি সফলও হয়েছিলেন। সফল হয়েছিলেন বলেই ব্রিটিশের ধূর্ত রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতা অর্জনের মূল লগ্নে হিন্দু-মুসলমানের বীভৎসতম দাঙ্গার পরেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এ দেশে দীর্ঘদিন তার বিষদাঁত বের করতে পারেনি। হয়তো নেতাজী সে সময় দেশে থাকলে আজও সেই সাম্প্রদায়িক ও বিভাজনের বিষমানবগুলিকে দেখা যেত না। এই আক্ষেপ গান্ধীজীরও ছিল যখন দাঙ্গাদীর্ণ স্বাধীনতা লগ্নে তিনি বারবার তাঁর প্রিয় সুভাষের প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন দেখেছেন।

এ হেন উদার মানবজীবনকে নিছক ‘পরাক্রম’এর মুখোশে ঢেকে দিলে, বলাই বাহুল্য, আজকের নিকৃষ্টতম বিভাজনের রাজনীতি তার পরাক্রমী বাহুবলকে যাথার্থ্য করে তোলার অজুহাত পেয়ে যায়। অথচ খেয়াল করে দেখুন, কী অদ্ভুত বৈপরীত্যে অবস্থিত নেতাজীর দেশপ্রেম-পরাক্রমের আজাদ হিন্দ ফৌজ ও সংঘ পরিবারের বিভাজন-পরাক্রমের হিন্দু রাষ্ট্রের খোয়াব।

‘আর্জি হকুমৎ-ই-আজাদ হিন্দ’ বা সংক্ষেপে ‘আজাদ হিন্দ’ ছিল সিঙ্গাপুরে ২১ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে নেতাজী প্রতিষ্ঠিত ভারতের অস্থায়ী সরকার। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন স্বয়ং নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। জাতীয় পতাকা হিসেবে সেই সরকার যা গ্রহণ করে তার সঙ্গে আজকের জাতীয় পতাকার একটিই পার্থক্য: মধ্যিখানে অশোক চক্রের বদলে সেদিন ছিল চরকা। এই সরকারের ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল: ইত্তেহাদ, ইতমদ ও কুরবানি (বাংলায়: ঐক্য, বিশ্বাস ও আত্মত্যাগ)। শ্লোগান ছিল: ইনকিলাব জিন্দাবাদ। আজাদ হিন্দ সরকারের সামরিক বাহিনী আজাদ হিন্দ ফৌজের একেকটি ব্রিগেডের তিনি নাম রেখেছিলেন: গান্ধী, নেহেরু, মৌলানা আজাদকে স্মরণ করে। এঁদের সঙ্গে তাঁর রাজনৈতিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও তাঁদের স্মরণ করতে তাঁর উদার মন বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেনি। আর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনাধ্যক্ষদের নামগুলি শুনলে আজকের মোদি শাসিত ভারত চমকে উঠতে পারে। তাঁরা ছিলেন: গুরুবক্স সিং ধীলো, লক্ষ্মী স্বামীনাথন, শাহনওয়াজ খান, হবিবুর রহমান, প্রেম সেহগল ও আরও অনেকে। এই কথা বলার কারণ, আজ এমন এক ভারতবর্ষ নির্মাণের চেষ্টা চলছে যেখানে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তথাকথিত বৃহত্তর হিন্দু সমাজকে এক ছাতার তলায় এনে অন্তত এক হাজার বছর পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে নেতাজী ছিলেন এই উদগ্র বিভাজন ও কুসংস্কারের বিপক্ষে। তাঁর আজাদ হিন্দ সরকার ও ফৌজ ছিল বিবিধের মাঝে এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের মহান মিলন। যেখানে হিন্দু-শিখ-মুসলমান-পার্সি-খ্রিস্টান, বাঙালি-তামিল-পাঞ্জাবী-মালয়লি সহ সমস্ত মানুষ তাঁদের শতধা বৈচিত্র্যের মধ্যে এক নিবিড় ঐক্য সাধন করেছিলেন।

আর আজকের বিজেপি’র পূর্বসুরী হিন্দু মহাসভার সঙ্গে নেতাজীর যে তীব্র বিরোধ তা তো ইতিহাসের পাতায় ছত্রে ছত্রে নথিবদ্ধ হয়ে আছে। নেতাজী যখন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখন ১৯৪১ সালে ভাগলপুর হিন্দু মহাসভার ২৩তম সম্মেলনে সাভারকার নির্দ্বিধায় হিন্দুদের কাছে আহ্বান জানাচ্ছেন যুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তিকে সাহায্য করার জন্য হিন্দুরা যেন দলে দলে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়। তাঁরই উদ্যোগে সে সময় প্রায় এক লক্ষ হিন্দু ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় এবং পরবর্তীকালে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে গ্রেফতার হওয়া আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনানীদের বিরুদ্ধে তারা নৃশংস আচরণ করে।

এই ইতিহাসকে আড়ালে রেখে আজ বাংলা দখল করতে মরীয়া দলটি নেতাজীকে আশ্রয় করেছে। নেতাজীর কোনও আদর্শ, বাচন, অঙ্গীকারে তাদের বিশ্বাস নেই। তারা তাই ‘পরাক্রম’কেই শিখণ্ডী করেছে তাদের উন্মত্ত বিভাজনের ধ্বজাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে। বাংলার মানুষ সজাগ আছেন- তাঁদের বাচনে আজাদ হিন্দ সরকারের পরাক্রমী নিনাদ: ইনকিলাব জিন্দবাদ। তাঁদের উদ্দেশ্যও ‘আর্জি হকুমৎ-ই-আজাদ হিন্দ’এর সেই সঙ্কল্প: ইত্তেহাদ-ইতমদ-কুরবানি।

জয় হিন্দ। জয় বাংলা।

       

Tuesday, 19 January 2021

২৬ জানুয়ারি দিল্লি চলো

আগুয়ান কৃষক বিভ্রান্ত সরকার

অতনু চক্রবর্তী


পঞ্চাশ দিন পার করে আন্দোলন ও সরকারের সাথে  আট-আটটা আলাপ-আলোচনায় কোনও সমাধানের ঠিকানা না পাওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আসরে নামল অনেকটা রবাহূত অনাহুতের মতো। আন্দোলনরত কৃষক সংগঠনগুলো প্রথম থেকেই জানিয়েছিল, তারা শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হবে না। কিন্তু রহস্যজনক তৎপরতার সাথে সুপ্রিম কোর্ট নিজের গণ্ডি ভেঙে এমন একটা সীমানায় ঢুকে পড়ল, যা নজীরবিহীন। সম্ভবত আজ পর্যন্ত ভারতের বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে যার নজীর খুঁজে পাওয়া ভার। 

কেন? 

এই প্রশ্নে যাওয়ার আগে বলতেই হয়, কৃষক আন্দোলনের অভিঘাত যে দেরিতে হলেও শীর্ষ আদালত কিছুটা টের পেয়েছে তা বোঝা গেল যখন তারা ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্রাকটর র‍্যালি নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পিছপা হয়ে বলটা ঠেলে দিল কেন্দ্রীয় সরকারের ঘাড়ে। অন্তত গণতন্ত্রের ওপর সরাসরি আঘাতের নির্দেশ দিতে তাদের বিবেকে হয়তো বিঁধেছে। অথবা লাখ লাখ কৃষকের মুখোমুখি বিরোধিতায় দাঁড়াতে তাদের অস্বস্তি হয়েছে। 

তবে, কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইনের সাংবিধানিক বা আইনগত বৈধতাকে ধর্তব্যের মধ্যে না এনেই তার রূপায়নের উপর দু' মাসের জন্য যে স্থগিতাদেশ শীর্ষ আদালতের তরফে জারি করা হল, তা নিয়ে নানা মহল রীতিমতো প্রশ্ন তুলেছে। বলাই বাহুল্য, যে সুপ্রিম কোর্ট সিএএ, নির্বাচনী বন্ড, জম্মু কাশ্মীর রি-অর্গানাইজেশন অ্যাক্ট, বা সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখন্ড সরকারের 'লাভ জিহাদ' সংক্রান্ত অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আনা আবেদনগুলো নিয়ে মামলা শুরু করলই না নানা বাহানা দেখিয়ে, সেই আদালতই অত্যন্ত দ্রুততার সাথে কৃষি বিষয়ে নাক গলিয়ে ফেলল। সংবিধানে কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত। সংবিধানের লিস্ট (ii)'র সপ্তম শিডিউলে তা অন্তর্ভুক্ত। তাই, সংসদ তা নিয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারে না। এই সাংবিধনিক অন্যায্যতা, অবৈধতাকে বিন্দুমাত্র আমল দিল না শীর্ষ  আদালত। আর, সাংবিধানিক আদালতের কাজই হল প্রশাসন বা আইনসভার কোনও বিচ্যুতি, আইনি সীমানা লঙ্ঘনকে বিচার করা, তার উপর নিজের রায় ঘোষণা করা। কিন্তু এই প্রথম সাংবিধানিক শীর্ষ আদালত তা বাছবিচার না করে এমন একটা ক্ষেত্রে ঢুকে পড়ল যা প্রশাসনের জন্য বরাদ্দ। 

আদালত তার রায়দানের সময় জানায়, 'আমরা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে হয়তো দমন করব না। আমরা আশাকরি কৃষি আইনগুলোকে স্থগিতাদেশ দেওয়ার এই নজীরবিহীন রায় আন্দোলনকারীদের ভেতরে একটা সফলতা হিসাবে বিবেচিত হবে আর তাঁরা তাঁদের কর্মীদের স্ব স্ব স্থানে, নিজ নিজ  জীবিকায় ফিরে নিজেদের জীবন ও অন্যদের সম্পত্তি রক্ষা করতে উৎসাহিত বোধ করবেন।' প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি  প্রতিবাদকে দমন করাটা সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার মধ্যে রয়েছে? তাহলে কি সর্বোচ্চ  আদালতের উদ্দেশ্যই ছিল চলমান প্রতিবাদী আন্দোলনের ইতি টানার জন্য এক বিকল্প পদ্ধতির রাস্তা দেখানো, যা অনেক সময় প্রশাসন করে থাকে?  আদালতের এই রায়ই স্পষ্ট করে দেখাল যে সমাধান খুঁজতে ব্যর্থ হওয়া সরকারের কাজটাকেই সুপ্রিম কোর্ট নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রশাসনিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হল, যা শুধু তার এক্তিয়ার বহির্ভূতই নয়, আদালতের মর্যাদাকে একই সঙ্গে নামানো হল অনেক নীচুতে। 

চার সদস্য নিয়ে যে কমিটি শীর্ষ আদালত গঠন করল, ইতিমধ্যে তার একজন সদস্য পদত্যাগ করে বসলেন। আরও বিস্ময়কর হল, তাঁদের নিয়োগ করার আগে কারুরই সম্মতি নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের পেটোয়া, কৃষি আইনের উদ্বাহু সমর্থক এই টিম সদস্যরা যে নিরপেক্ষ হয়ে বিক্ষুব্ধ, আন্দোলনরত কৃষকদের আস্থাভাজন হবেন না, তা কি আদালত জানত না?  

আরও একটা ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ নিল আদালত। ১১ তারিখে শুনানি পর শীর্ষ আদালত তার পরের দিনের জন্য যে তালিকা প্রকাশ করে তাতে জানায় যে ১২ তারিখ অমুক অমুখ মামলাগুলোর শুধুমাত্র রায় ঘোষিত হবে, শুনানি হবে না। কিন্তু অদ্ভুতভাবে দেখা গেল, এতদিনকার সমস্ত রীতিনীতি, আচার বা প্রচলিত পদ্ধতিকে তোয়াক্কা না করে ফের শুনানি হল। বেশ কিছু আইনজীবী, যারা কৃষক আন্দোলনের সমর্থক, তারা ওই দিন আদালতে হাজির হননি এই কারণে যে লিস্টেই বলা হয় ১২ তারিখে শুনানি হবে না বলে। অথচ দেখা গেল সেদিন সংক্ষিপ্ত শুনানির শেষে ঘোষিত হল রায়। ভারত সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন যে এই আন্দোলনে শিখ উগ্রপন্থী খালিস্তানিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে, আর কেন্দ্রীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ সে সম্পর্কে খবরাখবর দিয়েছে। আদালত সে বিষয়টা খারিজ না করে হলফনামা জমা দিতে বলেছে। প্রশ্ন জাগে, কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং সরকারি ভাবেই জানিয়েছেন যে আন্দোলনকারী ও শিখদের সম্পর্কে যে সমস্ত অপবাদ দেওয়া হচ্ছে তা অনুচিত। শিখদের দেশপ্রেম প্রশ্নাতীত। আজ অ্যাটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্য শুনে অনেকেই প্রশ্ন করছেন, তাহলে সরকারের আসল মুখ কোনটা?  প্রধানমন্ত্রী নীরব কেন? সন্ত্রাসীদের অনুপ্রবেশের গল্প ছড়িয়ে পরাভূত কেন্দ্রীয় সরকার কি গোপনে আন্দোলনকে বলপূর্বক দমন করার ফন্দি আঁটছে?

আরও একটি আপত্তিকর মন্তব্য সুপ্রিম কোর্ট করেছে, যা নিয়ে এমনকি নারী সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়েছে। প্রধান বিচারপতি খুবই বিরক্তি নিয়ে বলেছেন যে মহিলাদের কেন এখানে আটকে রাখা হয়েছে?  তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। ভারতের নাগরিক হিসাবে, সংবিধানে বিধৃত শান্তিপূর্ণ  আন্দোলনে অংশ নেওয়ার অধিকার কি মহিলাদের নেই?  মহিলাদের 'আটকে' রাখার শব্দবন্ধও আপত্তিকর। 

সুপ্রিম কোর্ট আরও জানিয়েছে, এই পর্যায়ে (অর্থাৎ দু' মাসের মধ্যে) এমএসপি পদ্ধতি অব্যাহত থাকবে, কৃষকেরা তাদের অধিকারের জমি হারাবে না! এতদিন সরকার যে সব কথা বলে আসছিল, তাহলে কি সেই সব মিথ্যে? দু' মাস পর আবার যে বিরাট অনিশ্চয়তা ও বিপন্নতা নেমে আসবে, এটা কি তারই ইঙ্গিতবাহী? 

শুধু সরকারই নয়, গোটা ভারতীয় রাষ্ট্র আজ যুদ্ধে নেমেছে কৃষকদের বিরুদ্ধে। প্রায় ৬০ জন কৃষক মারা যাওয়া সত্ত্বেও, আজ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী একটা ট্যুইট করেও তাঁদের প্রতি কোনও সহানুভূতি দেখাননি। আইনসভা তার আগেই এই মারাত্মক আইনটাকে গা-জোয়ারি করে পাশ করালো দু' দুটি কক্ষে। গোটা সংঘ ব্রিগেড নেমেছে কৃষকদের বিরুদ্ধে। আর, রাষ্ট্রের শেষ স্তম্ভ বিচারালয় এবার আসল মূর্তি ধারণ করল। 

চলমান এই আন্দোলন কিন্তু শুধুমাত্র এমএসপি'র মতো আর্থিক দাবি-দাওয়ার উপর কেন্দ্রীভূত নয়। এর মর্মবস্তুতে রয়েছে এক রাজনৈতিক, দেশপ্রেমিক, ফ্যাসিবাদ বিরোধী দাবি: ফিরিয়ে দাও আমাদের প্রজাতন্ত্র!  রিক্লেইম আওয়ার রিপাবলিক। মোদী রাজ আজ কর্পোরেট ক্রোনিদের স্বার্থে সব কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে- গণতন্ত্র, জনগণের সাংবিধানিক অধিকার, রুটি রুজি, যুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামো। এর বিরুদ্ধে কৃষকেরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, পাশে আছে গোটা দেশ, আসমুদ্রহিমাচলের আবালবৃদ্ধবনিতা। সমস্ত স্তরের জনতা। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজারে হাজারে কৃষক রোজ এসে যোগ দিচ্ছেন এই ঐতিহাসিক আন্দোলনে। সারা বিশ্বের কাছে এই আন্দোলন নানা অর্থে এক যুগান্তকারী স্মারক হয়ে উঠছে। ২০ জানুয়ারি আবারও সরকারের সঙ্গে কৃষকদের বৈঠকের কথা। ২৬ জানুয়ারি দিল্লিতে ট্রাকটর র‍্যালির সমস্ত প্রস্তুতি কৃষকেরা নিয়ে রেখেছেন। গত ১৮ জানুয়ারি মহিলা কৃষকেরা ব্যাপক সংখ্যায় জমায়েত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাঁরা এই আন্দোলনে সমানে সমানে আছেন ও সম-শরিক। দেশব্যাপী এমন অভূতপূর্ব  অভ্যুত্থান আগে কখনও দেখা যায়নি। সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য। ২৬ জানুয়ারি কি সরকার দিল্লিতে কৃষকদের ট্রাকটর র‍্যালি বন্ধ করতে দমন-পীড়ন নামাবে?

দেখা যাক, কে জেতে। কোথায় এর শেষ।


Sunday, 17 January 2021

সুধীর চক্রবর্তী

আমার জীবনের ধ্রুবতারা

আনসারউদ্দিন


সুধীর চক্রবর্তীর সঙ্গে আমার পরিচয় নব্বইয়ের দশকের প্রথম ভাগে। তখন সবেমাত্র আমি লিখতে এসেছি। বয়সের তুলনায় লেখালেখি শুরু করেছি অনেক দেরিতে। বেথুয়াডহরি থেকে প্রকাশিত 'বনামি' পত্রিকায় 'আবাদ' নামে আমার একটি গল্প প্রকাশ পায়। এটিই আমার প্রথম গল্প। গল্পটি পড়ে কবি কনক ঠাকুর আমাকে একটি হাতচিঠি লিখে দেন কৃষ্ণনগরের গল্পকার সুবোধ দাসের উদ্দেশ্যে। সুবোধ দাস থাকতেন হাতার পাড়ায়। ওখানে দেখেছিলাম সুধীর চক্রবর্তীকে। প্রতি রবিবার সুবোধ দাসের বাড়িতে সাহিত্যের আড্ডা বসত। আমিও গিয়ে পড়েছিলাম ওইদিনেই। তখন বেলা ১১'টা মতো হবে। জমে ওঠা আড্ডার মাঝে আমি এক আগন্তুক। চাষি মানুষ। মাথায় উস্কোখুসকো চুল। বোশেখ মাস। মলিন পোশাক। ধূলি ধূসরিত হয়ে চিঠি হাতে দাঁড়িয়ে। আমি যাঁকে গল্পকার সুবোধ দাস ভাবছি তিনি বলে উঠলেন- আমি সুবোধ নই, আমি সুধীর চক্রবর্তী। ওই যে সুবোধ।

সুধীরবাবুর নামটার সঙ্গে তেমনভাবে পরিচিত ছিলাম না। যদিও আমি কৃষ্ণনগর কলেজে পড়াশুনা করেছি। এ আমার দুর্ভাগ্য। সবই সময়ের ফের। সময়ের ফের বলছি এ কারণেই, আমি যে বছর কৃষ্ণনগর কলেজে ভর্তি হই তার আগের বছর তিনি চন্দননগর কলেজে চলে যান। আবার যে বছর স্নাতক হয়ে চলে আসি ঠিক তার পরের বছর উনি কৃষ্ণনগর কলেজে বহাল হন। সুধীরবাবুর সঙ্গে এরকম একটা কাকতালীয় ব্যাপার ঘটে গিয়েছে ছাত্র জীবনে। এখনও অনেকে বলেন, কৃষ্ণনগর কলেজে পড়েছ অথচ সুধীরবাবুর ছাত্র ছিলে না, বিশ্বাস হয় না। মানুষ যখন আশ্চর্য চোখে আমার দিকে তাকায় তখন আমার কষ্ট হয়। আমি তো আর জনে জনে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করতে পারি না। 

অন্যদের দেখাদেখি আমিও তাঁকে স্যার বলতাম। কৃষ্ণনগরের স্যার বলতে ঐ একজনই। তা সে হোক, আলু-পটলের খুচরো বিক্রেতা থেকে বড় গদির ব্যবসাদার কিংবা কোনও সরকারি আমলা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। পরে জেনেছি এঁদের অনেকেই ওঁর ছাত্র ছিলেন না। সুবোধ দাসের হাতার পাড়ার বাড়িতে কনক ঠাকুরের হাতচিঠির দৌলতে সুধীরবাবুর ছাত্র হয়ে গেলাম। সেদিনের রবিবাসরীয় সাহিত্যের আড্ডায় পেয়েছিলাম আনন্দবাজারের সংবাদকর্মী অধীর বিশ্বাস, শৈবাল সরকার, কুন্তল মিত্র ও কবি সঞ্জীব প্রামাণিককে। এদের মধ্যে শৈবাল সরকার ছিলেন 'প্রজ্ঞা' প্রকাশনার অন্যতম প্রকাশক। প্রজ্ঞা থেকেই সুধীর চক্রবর্তীর 'সদর-মফস্বল' গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। আমি ওইদিন 'বনামি' পত্রিকাটি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কবি সঞ্জীব  প্রামাণিক সর্বসমক্ষে তা পাঠ করে শোনালেন। ঐ একটা গল্প লিখে সবার মন জয় করে নিলাম। সুধীরবাবু বললেন- আনসার তুমি লেখ। ভবিষ্যতে তুমি বড় মাপের লেখক হবে, সে গুণ তোমার মধ্যে আছে। 

যেদিন তিনি আমাকে এ কথা বললেন সেদিন তিনি আমার মধ্যে বীজমন্ত্র  বপন করে দিলেন। এটা আমার কাছে যেমন চাপের তেমনি আবার শপথেরও। তবে শুধু চাপ আর শপথ নিয়ে তো লেখক হওয়া যায় না। আশীর্বাদেও না। আশীর্বাদ থেকে কারও আয়ু বা পরমায়ু হয়তো বাড়ানো যেতে পারে, কাউকে রোগ ব্যাধি থেকে সাময়িক মুক্তি বা স্বস্তি দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লেখক হওয়া? নৈব নৈব চ। 

সাংসারিক বা পারিবারিক কাজে কৃষ্ণনগর গেলেই স্যারের সঙ্গে দেখা হত কখনও সখনও। জিজ্ঞাসা করতেন- কী লিখলে? তখনও হয়তো কিছুই লেখা হয়নি। তবুও স্যারকে খুশি করার জন্য বলতাম, একটা গল্প লিখছি স্যার।

'লেখা হলে গল্পটা আমাকে দিয়ে যেও।'

হ্যাঁ স্যার, সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতাম। এই চাপটা না নিলে আমার লেখা এগোয় না। স্যারকে দিতে হবে, যে কারণে লেখার প্রতি আরও যত্নবান হওয়া। এভাবে বেশ কিছু লেখা প্রকাশ পেয়েছে। লেখা বলতে গল্প। আমি নিজে থেকে ওঁকে কখনও লেখা বা গল্প প্রকাশের অনুরোধ করিনি। আসলে অতি লিখিয়ে নই আমি। যা লিখতাম ভাবতাম অনেক বেশি। ভাবতে ভাবতে আগের লেখার বিষয় আশয় মাথার মধ্যে থেকে ফৌত হয়ে যেত। কমবেশি যাই-ই লিখেছি পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছি। পাঠকের ভালোবাসা পাওয়ার ক্ষেত্রে সুধীরবাবু অনুঘটকের কাজ করেছেন। আমার বিভিন্ন বইপত্র যোগ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যাঁদের কাছে পৌঁছে দিতে পারেননি তাঁদের কাছে আমার লেখালিখির ব্যাপারে আলোচনা করতেন। উনি কোথায় কী বলতেন আমি জানতাম না। জানার কথাও নয়। চন্দননগর, কলকাতা, বহরমপুর, মালদা যেখানেই সাহিত্যানুষ্ঠানে গিয়েছি কেউ না কেউ বলে উঠত- আপনার কথা সুধীরবাবু আমায় বলেছেন।

কী বলেছেন না বলেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানতে চাইনি। তিনি আমার কথা অন্যদের বলেছেন এটাই অনেক। কখনও সখনও মনে হয়েছে স্যার আমার কথা জনে জনে এত বলেন কেন? উনি না বললে আমি কি লেখক হতে পারতাম না। এ ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কোনও আলোচনা করিনি। আমি জানি আমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। আমার পেশাকে সম্মান করেন। আর আমার গল্পের অনুরাগী। তিনিই আমার মূল অনুপ্রেরণা। আমার ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের সদাসর্বদা খোঁজখবর নিতেন। বদলে যাওয়া গ্রাম নিয়ে তাঁর কৌতূহলের সীমা পরিসীমা ছিল না। এক সময় মাইলের পর মাইল হেঁটে গ্রাম পরিক্রমা করেছেন। বর্ষার কর্দমাক্ত আর চোত বোশেখের ধূলিধূসর পথ। পথেরও নানান অলিগলি। সে সব পেরিয়ে প্রান্তিক মানুষের সন্ধানে ফিরেছেন। রাত কাটিয়েছেন আউল বাউল দরবেশ সাঁই ফকিরদের কুটিরে আশ্রমে। সংগ্রহ করেছেন লোকগান আর লোকসংস্কৃতির নানান বিষয়। একজন শহুরে ভদ্রজন, অধ্যাপক মানুষ কীসের টানে দশকের পর দশক শীত গ্রীষ্ম বর্ষা উপেক্ষা করে ব্রাত্য মানুষের জীবনযাপন ও লোকায়ত ধর্মের হালহদিস করেছেন এটাও একটা গবেষণার বিষয়। 

মূলত গানের টানে বিভিন্ন গ্রাম পরিক্রমা করেছেন।  লালন সাঁই কুবির গোঁসাইয়ের গান যেমন তিনি সংগ্রহ করেছেন তেমনি আরও অনেক বাউল ও মুর্শিদি গানকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। অন্তজনের রচনা হলেও এই গানের মধ্যেই বিশ্বমানবের কথা তুলে ধরা হয়েছে। দীর্ঘদিন ব্যাপী গ্রাম গ্রামান্তরের নানান মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে গিয়ে তিনি একটি আশ্চর্য জগৎ খুঁজে পেয়েছেন।

সুধীরবাবুর সবচেয়ে বড় গুণ, যে কোনও ধরনের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যাবার ক্ষমতা। যত সহজে প্রান্ত ধর্মের মানুষের সাধন ভজনের গূঢ় কথা টেনে বের করতে পারেন তা তাঁর বইগুলো পড়লেই সচেতন পাঠক বুঝে নিতে পারেন। স্যারের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর পরই পড়ে ফেলি 'প্রজ্ঞা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত 'সদর-মফস্বল' বইটি। গ্রামে বসবাস করা সত্ত্বেও চরিত্রগুলোকে একেবারেই অচেনা লাগে। আসলে তারিফ করতে হয় তাঁর দেখার চোখকে আর মানুষ সম্পর্কে গভীর জীবনবোধকে। অধিকাংশ রচনাতে লেখক হিসাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ রচনাগুলোকে জীবন্ত করে রেখেছে। যখন তাঁর বই পড়ি তখন মনে হয় আমরাও গ্রাম পরিক্রমার সাক্ষী হয়ে যাচ্ছি। পাঠকের মানসভ্রমণ কোনও রচনার ক্ষেত্রে একটা ডকুমেন্টারি ভ্যালুর মর্যাদা পেয়ে যায়। আর সব চাইতে বড় গুণ হল অসম্ভব রকমের রসবোধ। সেই রসবোধ তাঁর প্রতিটি লেখাকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে।

একটা বিষয়ে ভিন্নমত লক্ষ করি তাঁর লেখালেখি নিয়ে। আজও সঠিক ভাবে সংজ্ঞায়িত করা গেল না তাঁর লেখনীর কুল-গোত্র, জাত-ধর্ম। তাঁর রচনাগুলোকে গল্প, উপন্যাসে আখ্যায়িত করা যায় না। প্রবন্ধ বলতে অনেকের কুণ্ঠা রয়েছে। কেউ বলেন রচনা, কেউ বলেন বিশেষ রচনা, কেউ বলেন আখ্যান-কথন। তিনিও নির্দিষ্ট  করে আমাদের বলে যাননি। আমার মনে হয় তাঁর রচনাকে সবরকম ভাবে আখ্যায়িত করা যায়। এক একটি কথনে বা রচনায় অসম্ভব রকমের গল্পের সুখ তৈরি হয়। পূর্ণাঙ্গ গল্পও উঠে আসে। যে গল্পের জন্য আমাদের মতো গল্পকাররা হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকে। আমাদের স্যার কত সহজে সে সব পদদলিত করে বৃহত্তর আখ্যানের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন।

সুধীরবাবুর লেখা যত পড়েছি তত বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছি। আমাদের চেনাজানা বৃত্তের বাইরেও যে একটা জীবন আছে, একটা আলাদা জগৎ আছে, সেই অচেনা অজানা জগৎ'কে আবিষ্কার করেছেন তিনি। সেখানে ফুটে উঠেছে সম্প্রীতির পরম্পরা, সহজিয়ার ধারাভাষ্য। সেই ধারাভাষ্য রচিত হয়েছে গানে ও পদে। গানের প্রতি তাঁর আলাদা রকমের ঝোঁক আছে তা ধরা পড়ে বিভিন্ন আখ্যান-কথনে। গান বিষয়ক অনেক গ্রন্থের তালিকা এই মুহূর্তে দেওয়া যেতে পারে। যেমন, সাহেবধনী সম্প্রদায় ও  তাহাদের গান, গানের লীলার সেই কিনারে, বলাহাড়ি সম্প্রদায় ও তাহাদের গান, বাংলা গানের সন্ধানে, নির্জন এককের গান, বাংলা গানের চার দিগন্ত, বাংলা ফিল্মের গান ও সত্যজিৎ রায়। আরও অনেক গান বিষয়ক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা যায়।

সুধীরবাবুর 'সদর-মফস্বল' বইটি পড়ার পর আরও অনেক বই পড়েছি পর্যায়ক্রমে। নতুন বই প্রকাশ পেলেই আমি তা সংগ্রহ করতাম। তাঁর 'গভীর নির্জন পথে' বইটি প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৮৯ সালে। আমি পাঠ করি ১৯৯২-তে। বইটি পড়ে নিজের মধ্যে একটা ঘোর তৈরি হয়েছিল। একটি কঠিন বিষয় কত সহজে গল্পে ও কথায় ছবির মতো তুলে ধরা যায়, তা পাঠের মাধ্যমে বোঝা যায়। 'ব্রাত্য ও লোকায়ত লালন' বইটির জন্য ১৯৯৩ সালে পেয়েছেন 'শিরোমণি' পুরস্কার। 'পঞ্চ গ্রামের কড়চা' গ্রন্থের জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ সালে পেয়েছেন 'নরসিংহ দাস' পুরস্কার। 'বাউল ফকির কথা' বইটির জন্য দু-দুটি 'কুলীন' পুরস্কার পেয়েছেন। একটি আনন্দ পুরস্কার ২০০২ সালে অন্যটি সর্বভারতীয় সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৪ সালে। সারা জীবনের সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত 'বিদ্যাসাগর' পুরস্কার লাভ করেছেন ২০১৮ সালে। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় তাঁর প্রাপ্তির ঝোলা পূর্ণতা পেয়েছে।

সুধীরবাবু সম্পর্কে আর যে কথাগুলো না বললে আলোচনা অপূর্ণ থেকে যায় তা হল সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মনিষ্ঠা। এর সঙ্গে সাংসারিক দায়-দায়িত্ব, এসো কুটুম বসো কুটুম তো আছেই। আর আছে আমাদের মতো বেশ কিছু গুণগ্রাহী। অধিকাংশ সময় তার বাড়ির দরজা হাট করে খোলা থাকত। প্রতিদিন নিয়ম করে লেখা, সকালে নিজ হাতে থলে ঝুলিয়ে বাজার করা। বাজার করতে করতে বিক্রেতার সঙ্গে আলাপ জমানো। আলু, কপি, ফুলকপি, বেগুন, টম্যাটোর মধ্যে ভেসে উঠত কৃষক খেতমজুরদের মুখ। স্যার আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করে তাঁর রামচন্দ্র মুখার্জী লেনের বাড়ি ডেকে নিতেন। আসলে তিনি গ্রামীণ ধারাভাষ্য আমার কাছ থেকে জানতে চাইতেন। গ্রামীণ রাজনীতি, পঞ্চায়েত ভোট, একশো দিনের কর্মনিশ্চয়তা প্রকল্প, ধর্মীয় জলসা থেকে বার্ড ফ্লু রোগ। গ্রামের কত হাঁস মুরগি পাখ পাখালি মারা গিয়েছে সে খবরও জানাতে হত তাঁকে। আমার কথা শোনার জন্য স্যারের স্ত্রী নিবেদিতা চক্রবর্তী এসে বসতেন। অন্যদের দেখাদেখি বউদি বললেও তাঁকে মা ডাকতে ইচ্ছে করত। তিনিও ভীষণ ভালোবাসতেন আমাকে। সত্যি বলতে কি আমার প্রতি তাঁদের ছিল অপত্য স্নেহ। আমার সাহিত্যের সাধনায় তাঁদের অটুট বিশ্বাস ছিল। কোনও পত্র-পত্রিকায় লেখা পেলেই সর্বাগ্রে পড়ে নিতেন ওঁরা। আমার নতুন কোনও বই বেরলে আমি নিজ হাতে দিয়ে আসতাম। পাঠক হিসাবেও তুলনাহীন। এরকম নিষ্ঠাবান পাঠক কখনও দেখিনি। সীমিত সময়ের মধ্যে পাঠ শেষ করে আমাকে জানাতেন। আলোচনা করতেন পঠিত গল্প বা উপন্যাস নিয়ে। আমার ‘জনমুনিষ’ উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছিল ২০১৮ সালে। দিয়ে এসেছি দিনের ভাগে। শীতকাল, তখনও লেপ ছেড়ে উঠতে পারিনি। হঠাৎ স্যারের ফোন, আনসার তোমার বই পড়লাম। আমার অবাক হওয়ার পালা। কখন পড়লেন! নাতিদীর্ঘ উপন্যাস হলেও বুঝতে পারলাম স্যার বাকি রাত না ঘুমিয়ে আমার বইটি পড়ে ফেলেছেন। আর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে জানিয়ে দিলেন। এই তো গতবার ‘অভিযান’ থেকে আমার প্রকাশিত উপন্যাস ‘হেঁসেল জীবন’ তাঁর হাতে পৌঁছে দেওয়ামাত্র তেমনই বিনিদ্র শীতের রাতে পড়ে ফেললেন। আমি আগের বছরের মতো লেপ-কম্বলের ওম নিচ্ছি। ওম নিতে নিতে পঁচাশি বছরের গলা ভেসে এল মোবাইলে- ‘আনসার তোমার হেঁসেল জীবন শেষ করলাম।'

আমি বই পড়ার জন্য অনেককেই দিয়েছি। মতামতের জন্য প্রহর গুনেছি। কেউ কেউ ভালোমন্দ নিয়ে আলোচনা করেছেন। কারও কারও মতামতের আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো সাতবার ভাবতে হয় কাকে বই দেব আর কাকে দেব না। দেখেছি, যাঁরা পয়সা খরচ করে কিনে পড়েন তেমন অচেনা অজানা পাঠকেরা হঠাৎ হঠাৎ ফোন করে জানান। বুঝি এটাই লেখক জীবনের প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগ সুধীরবাবুই তৈরি করে দিয়েছেন। আমার প্রথম গল্পের বই তাঁর ধ্রুবপদ প্রকাশনী থেকেই প্রকাশ করেছিলেন ১৯৯৪ সালে। বইয়ের নাম ‘আনসারউদ্দিনের গল্প’। দ্বিতীয় বই প্রকাশের ক্ষেত্রেও তিনি উদ্যোগী হয়ে 'প্রতিক্ষণ' থেকে 'আনসারউদ্দিনের ছোটগল্প' প্রকাশে সহযোগিতা করেছিলেন। তখন ছোট গল্পকারদের গল্প সংকলনের সিরিজ চলছিল। সেই সিরিজে এই অধম লেখকের অন্তর্ভুক্তির সুযোগ হল। স্যারের সক্রিয় উদ্যোগে আমার আরও দুটি বই প্রকাশ পেল। প্রকাশক হলেন স্যারের প্রিয় ছাত্র ও অনুগামী শিবনাথ ভদ্র। বই দুটির নাম যথাক্রমে ‘আনসারউদ্দিনের গল্প সংগ্রহ’ (২০০৩) এবং অন্যটি ‘শোকতাপের কথামালা’।

সুধীরবাবুর কাছে আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তিযোগ হল তাঁর পত্রিকা ‘ধ্রুবপদ'এ লেখার আমন্ত্রণ। দু-দুটো সংখ্যায় উনি আমাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। শুধু লিখিয়েছেন বললে ভুল হবে, উনি আমাকে ওঁর পত্রিকায় গদ্য লেখা শিখিয়েছেন। তার আগে আমি কখনও গদ্য লিখিনি। স্যার বললেন, সরল গদ্যে লিখবে, প্রথমে বুঝতে দেরি হলেও পরে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলেন সরল গদ্য কাকে বলে, মুক্ত গদ্য কাকে বলে। 'অভিজ্ঞতা' সংখ্যায় লেখার পরপরই ‘নারীবিশ্ব’ সংখ্যায় আবার সুযোগ দিলেন। লিখলাম ‘গ্রামীণ নারীজীবন’ নামক আখ্যান। পত্রিকায় অনেক অনেক জ্ঞানীগুণী লেখকদের মধ্যে আমার লেখাটি সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছিলেন। স্যারকে আড়ষ্ট গলায় বলেছিলাম- স্যার আমার লেখাটি প্রথমেই জায়গা পেল দেখছি।

স্যার বললেন, আমি গ্রামকেই প্রাধান্য দিই।

স্যার শুধু গ্রামকেই প্রাধান্য দেননি। আমার মতো একজন গ্রামীণ মেঠো ছেলেকে সাহিত্যের পাতায় প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁকে শতকোটি প্রণাম।