Pages

Friday, 25 December 2020

যত গর্জায় তত বর্ষায় কী!

দলবদলের হিসেব নিকেশ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’ – যদিও এই শীতে উত্তুরে হাওয়ায় রাজ্যবাসী জবুথবু, তবুও খোলা দখিন দরজা দিয়েই পিল পিল করে স্বঘোষিত ‘মর্যাদাহীন’ এক প্রকারের মনুষ্য-দঙ্গল চেতনার বিলম্বিত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ‘জয়শ্রীরাম’ কলরবে নতুন ঘরে ঢুকে পড়ছে। কোথায় এসে ঢুকল, সেখানে আলো-বাতাস কতখানি, কোণে হলেও বসিবার ঠাইটুকুন আছে কিনা- সে সব ভাবনার সময় নাইকো এখন। আগে যান পরে দাম। বঙ্গ দেশে এ কেমন রঙ্গ গা! যদিও এই তামাশা গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে সে রাজ্যে বেশ দেখা গেছে। যেমন, দিল্লিতে বিধানসভা ভোটের আগে আপ’এর ২৩ জন বিধায়ক দল ছেড়ে ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে চলে গেলেন বিজেপি’র কোটরে। ত্রিপুরায় গোটা প্রদেশ কংগ্রেস কর্পূরের মতো উবে গেল- তাদেরও সদলবলে পাওয়া গেল রামের ঘরে। এ রাজ্যেও গত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধান বামপন্থী দল ফিসফিস করে তার ভোটারদের পদ্মফুলেই ভোট দেওয়ার কথা বললে। শুধু কি তাই! ভোটের পরেও নানা রাজ্যে নানা দলের বিধায়কেরা শিবির পরিবর্তন করে গুষ্টিকে গুষ্টি রামভক্ত হয়ে পড়ছেন, এও তো ড্যাবড্যাব করে দেখতে হচ্ছে। এ তো আচ্ছা কল বানিয়েছে চণ্ডীদাসের খুড়ো- যে রঙেরই যা হোক না কেন, অন্তিমে গেরুয়াই গেরুয়া!

বোঝাই যাচ্ছে, গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় এবং বঙ্গ রাজনীতি এক নতুন দুয়ারে এসে পৌঁছেছে। এই যে দলে দলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাঙ্গিয়ে নেওয়া- এর পিছনে রহস্যটা কী? অথবা, এই রণকৌশলটাকেই সাব্যস্ত করা হল কেন? আর এও তো দেখা গেল, জনপ্রতিনিধি ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যে সব সময় জনসমর্থন আদায় করা যাচ্ছে, তেমনটাও তো নয়। তবুও এটা আপাতত একটা পথ। নতুন পথ। ভেবে চিন্তে এই পথে খেলতে নামা।

প্রথমত, দল ভাঙ্গিয়ে খেলতে নামার মধ্যে একটা শোরগোল আছে। খেলাধুলোর ভাষায় একে বলা যেতে পারে, ওয়ার্ম-আপ। এটা কাজে দেয় যেখানে বিরোধী পক্ষ বেশ সবল বা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি তেমন মজবুত ও ব্যাপ্ত নয়। দল ভাঙ্গানোর খেলায় টার্গেট করা হয় দু’ ধরনের নেতাদের: এক, যাদের অর্থলোভ আছে ও দুই, যাদের জামায় কিছু দাগ আছে। ঘোড়া কেনাবেচায় তাদেরই কেনা হয় যাদের এলাকায় কিছু প্রভাব বা প্রতিপত্তি আছে, অন্তত হাতে কিছু বাহুবলী আছে। আর যাদের জামায় কালির ছিটে, তাদের দেখানো হয় এজেন্সির ভয়। রফা হয়, দল পালটে নিলে এজেন্সি আর তাদের ঘাঁটাবে না। গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় রাজনীতিকে বিজেপি এই ভয়ঙ্কর স্তরে নামিয়ে এনেছে। যদিও দলবদলের এমনতর ঘটনা এ রাজ্যে তৃণমূলের হাত ধরেও ২০১১ সালের পর অনেকগুলিই হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দলবদলের এই শোরগোলে, যা গোদি মিডিয়ার হাতে পড়ে আরও শত গুণ বিস্ফারিত হয়ে এমন এক ধামাকা তৈরি করতে থাকে যে, সব যেন গেল গেল; ফলে বিজেপি’র জয় সুনিশ্চিত। ঠিক এমনই বাওয়াল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনেও করা হয়েছিল। সেখানে তো অনুরাগ ঠাকুর ‘গদ্দারো কো গোলি মারো’ রব তুলে দাঙ্গাও লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তবুও শেষরক্ষা হয়নি।   

তৃতীয়ত, এর পরের ধাপে আসে আইটি সেলের নির্মিত হরেকরকম্বা পোস্ট, ভিডিও, বয়ান, মিম, ইতিহাস-বিকৃতি ইত্যাকার নানাবিধ এত মালমশলা যে তা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাঙ্গণকে জবরদখল করে বিষিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। এই আইটি সেলের কার্যাবলী ও কাজের বিষয় সম্পূর্ণ পেশাগত ভাবে গড়ে তোলা হয় এবং মাইনে করা, চুক্তিবদ্ধ, ক্ষণস্থায়ী এবম্বিধ হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ করে ও তাদের পেছনে যথেচ্ছ অর্থব্যয় করেই এই কাজের নির্বাপণ। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ সাল অবধি এই কাজে বিজেপি প্রভূত ডিভিডেন্ড ঘরে তুলেছে। কিন্তু তাদের এ প্রয়াস এখন অনেকটাই দুর্বল। সেটা কেন, তা পরে অন্য কোনও নিবন্ধে না হয় বলা যাবে। তবু আজও তারা এ অনুশীলন সগৌরবে অটুট রেখেছে। প্রতি নির্বাচনেই এই ক্ষেত্র থেকে তারা ফায়দা তোলার চেষ্টা চালায়। ধারণা, তাদের প্রচারের উদ্দিষ্ট বিভাজন (সামাজিক-ধর্মীয়) যত প্রকট হবে লাভের কড়ি তত তাদের ঘরে আসবে।

চতুর্থত, এ প্রসঙ্গে গোদি মিডিয়ার ভূমিকাকেও মাথায় রাখতে হবে। যদিও গোদি মিডিয়ার ওপরে মানুষের ভরসা আজকাল অনেক কমে এসেছে, তবুও এদের প্রভাব এখনও অনস্বীকার্য। দেখাই যাচ্ছে, দু-তিনটি টিভি চ্যানেল বাদ দিলে গোদি মিডিয়া বেশ গদগদ হয়ে এক তরফা ভাবে এবং একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে ও বিষয়বস্তুতে তাদের সম্প্রচার সংগঠিত করে চলে। দিল্লির সীমান্ত ঘিরে লক্ষ লক্ষ কৃষকদের অবরোধ ততটা তাদের খবরের বিষয় হয় না, যতটা হয় দেশের শাসকের এজেন্ডা ধরে খবর বানানোর প্রয়াস। এ রাজ্যেও সে প্রবণতা ইদানীং বেশ স্পষ্ট। এরই বিপ্রতীপে এখন তাই গড়ে উঠছে জনমিডিয়া: ইউটিউব চ্যানেল-কেন্দ্রিক ও সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর নানাবিধ বিকল্প সম্প্রচার ব্যবস্থা। আর তা বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।

পঞ্চমত, দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে থেকেই এ রাজ্যে প্রচার, সভা, মিটিং-মিছিলের সাজো সাজো রব। এতে উত্তেজনা ও চমকের নির্মাণ হয় আর তাতে মিডিয়াগুলির টিআরপি বাড়ে ও তাদের বাণিজ্যেরও পোয়াবারো। তাই তারাও এমত সভা-সমাবেশকে ব্যাপক প্রচার করে উত্তেজনাকে চরমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেকে এই জনসমাবেশগুলি দেখেই ভাবতে শুরু করেন যে এবার কি তাহলে পরিবর্তন আসন্ন? যে দলটি এবার এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে বেপরোয়া, যাদের সর্বভারতীয় নেতারা প্রায় হত্যে দিয়ে এখানে পড়ে আছেন, তাদের সভায় লোকসমাগম দেখে অনেকেই হয়তো প্রমাদও গুনতে শুরু করেছেন! কিন্তু যে সব অঞ্চলে এই সভাগুলি হচ্ছে সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, কিছু ব্যতিক্রমী অঞ্চল বাদ দিলে, এই লোকসমাগম কিন্তু সে অর্থে স্বতঃস্ফূর্ত বা স্থানীয় নয়। অল্প কিছু স্থানীয় মানুষজন সেখানে আসেন বটে কিন্তু মাঠ ভরানোর জন্য এক সেট তৈরি থাকা লোককে বাইরে থেকে এনেই সভাগুলিকে পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়। এর জন্য প্রভূত অর্থ ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ককে সম্পূর্ণ ভাবে কাজে লাগানো হয়।

তার মানে কি, এ রাজ্যে যা চলছিল তা ঠিকই ছিল? মানুষের মধ্যে কি কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ সে ভাবে নেই? যারা ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে এতটা আগে থেকে কোমর বেঁধে নেমেছে তারা কি শেষমেশ মূষিক প্রসব করেই ক্ষান্ত দেবে? একেবারেই তা নয়। বলার কথা এই, আগামী নির্বাচনের কোনও সন্দর্ভই এখনও তৈরি হয়নি। এখনও বলার সময় আসেনি, কী হতে পারে বা কী হতে চলেছে। অভিজ্ঞতা বলে, মানুষ নির্বাচনী যুদ্ধে খুব সচেতন ভাবে অংশ নেয়। এই সচেতনতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিণত হয়েছে। মানুষকে বুরবাক ভাবার কোনও কারণ নেই। এই মানুষই ২০১৯ সালে, খেয়াল করে দেখুন, উড়িষ্যায় অনুষ্ঠিত একই সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে যথাক্রমে বিজেপি ও বিজেডি’কে আলাদা আলাদা করে জয়ী করেছে। যে দিল্লি, ঝাড়খণ্ড বা বিহারে গত লোকসভায় মানুষ উজাড় করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে তারাই আবার কয়েক মাস পরে বিধানসভায় হাত খুলে যথাক্রমে আপ, জেএমএম ও মহাগঠবন্ধনকে তাদের সমর্থন জানিয়েছে। সম্ভবত সব রাজনৈতিক দলই জনতার এই অভিজ্ঞানকে সম্যক উপলব্ধি করেছে। তাই, পশ্চিমবঙ্গে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রবণতাই যে বিধানসভাতেও বহাল থাকবে সে কথা কি জোর দিয়ে আজই বলে দেওয়া যায়?

অতএব, সাধু সাবধান। রাজনৈতিক দলগুলি ও বিবিধ মিডিয়া যতই লাফালাফি করুক না কেন, জনগণ কিন্তু নীরব অথবা মুচকি হাসছে। এই আপাত নীরবতা দরকষাকষির ইঙ্গিত। যে কারণে কিনা এখন ‘দুয়ারে সরকার’ এসে দাঁড়িয়েছে। দিল্লির আন্দোলনরত কৃষকদের উপেক্ষা করে প্রাধানমন্ত্রীও এ রাজ্যের কৃষকের প্রতি অতি-দরদ দেখাচ্ছেন। তাই, নেতাদের দলবদল ব্যক্তিস্বার্থের হিসেবনিকেশ মাত্র। এর সঙ্গে আমজনতার সার্বিক কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও মতাদর্শ বা নীতিমালার ওপর দলবদলুদের গতায়াত হচ্ছে না, হচ্ছে নিজ স্বার্থকে ভারী করার অভিপ্রায়ে। তা নিয়ে সাধারণের মাথাব্যথা তো কিছু নেই!

2 comments:

  1. এই কথাগুলো প্রচারে অবশ্যই আসা উচিত। hype তৈরির process খুব সুন্দর লিখেছেন।

    কিন্তু এই 'জনগণ' এর সঙ্গে যোগসূত্র রাজনৈতিক সংগঠনগুলির মাধ্যমে না পৌঁছালে পৌঁছবে কে?
    সে রকম প্রতিষ্ঠানের অভাব।

    ReplyDelete
  2. আমার চারপাশের যারা নিতান্তই গ্রামের মানুষ, তারা কিন্তু - "কংগ্রেস কে দেখলেন, সিপিএম কে দেখলেন, তৃণমূল কে দেখলেন, এবার বিজেপি কে এনে দেখুন" এ বেশ মজেছে। এবং একুশে রাম, ছাব্বিশে বাম এই ধারণা নিয়ে অধিকাংশ সিপিএম কাজ করছে। ফলে বোঝা খুব মুস্কিল!

    ReplyDelete