Pages

Monday, 28 December 2020

দেশ জাগছে

প্রতিবাদ মুখর ২০২০

সোমনাথ গুহ


বছরটা শুরু হয়েছি ঐতিহাসিক শাহিন বাগ জমায়েত দিয়ে, শেষ হচ্ছে রাজধানী দিল্লির সীমান্তে উত্তাল কৃষক সমাবেশে। ইতিমধ্যে মহামারি নামক একটি বিস্মৃতপ্রায় শব্দ যা শুধু ইতিহাসের বইয়েই পাওয়া যায় বলে মানুষ নিশ্চিন্ত ছিল, তা এক শতাব্দী বাদে অমিত বিক্রমে ফিরে এসে বিশ্ব জুড়ে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দিল। আট কোটির ওপর মানুষ সংক্রামিত, মৃত প্রায় ১৮ লক্ষ; আমাদের দেশে যা যথাক্রমে এক কোটি দেড় লক্ষ। সহস্র লক্ষ মানুষের জীবিকা চলে গে, অধিকাংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হল। মারির প্রকোপের সুযোগ নিয়ে বাড়ল স্বৈরাচারের দাপট। আবার সংকটের সময়ে একই সাথে গড়ে উঠ সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতার আবহ, শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জোয়ার। 

সংক্রমণের ভ্রূকুটিকে অগ্রাহ্য করে যে আন্দোলন গড়ে তোলা যায় তা প্রথম দেখা গে আমেরিকায়। মহামতি ট্রাম্পের খামখেয়ালিপনা, অবিজ্ঞানমনস্কতার কারণে মারি তখন সেখানে লাগামছাড়া রূপ নিয়েছে। তাঁর এই চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতার খেসারত দিতে হল প্রান্তিক কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী মানুষদের। পুলিশি নৃশংসতায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু তাঁদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দি এবং সারা আমেরিকা জুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন উল্কার বেগে ছড়িয়ে পড়ল। এই আন্দোলন ট্রাম্পের টলোমলো শাসনে অন্তিম পেরেকটা পুঁতে দি যার প্রতিফলন ঘট নভেম্বরের নির্বাচনে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় হল বটে কিন্তু দক্ষিণপন্থার অবসান ঘটল এমনটা বলা যাবে না, বরং পরাজিত প্রার্থীর পক্ষে জনসমর্থন বুঝিয়ে দি যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই হবে দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী। রিপাব্লিকানদের হাত থেকে ক্ষমতার ব্যাটন ডেমোক্র্যাটদের হাতে হস্তান্তরের ফলে মার্কিনি নীতিতে বিরাট কোন পরিবর্তন আসবে তাও নয়, কিন্তু এটা প্রমাণিত হল যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’এর মতো দুর্নিবার আন্দোলন ধাপে ধাপে জমানা বদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।

করোনার আগমনের আগেই আমাদের দেশে সিএএ-এনআরসি-এনপিআর বিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৫ ডিসেম্বর জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দিল্লি পুলিশ নৃশংস আক্রমণ করে, লাইব্রেরি ভাঙচুর করে, পাঠরত পড়ুয়ারাও রেহাই পায় না। সেই রাত থেকেই ছাত্রছাত্রীদের উদ্বিগ্ন স্বজন, পড়শিরা অনতিদূরে একটা রাস্তায় ভিড় করে- যে জমায়েত পরের দিন থেকে ১০০ দিনব্যাপী শাহিন বাগ ধর্ণায় রূপান্তরিত হয়। এর কয়েকদিন বাদেই আক্রমণ নেমে আসে জেএনইউ'তে ফি-বৃদ্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মুখোশধারী গুণ্ডারা বেছে বেছে বামপন্থী ইউনিনের সদস্য/সদস্যাদের ওপর হামলা করে। পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। শাসক ভেবেছি দমনপীড়নের ভয়ে প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে যাবে। উল্টে শাহিন বাগের জমায়েত একটা সর্বজনীন রূপ পেয়ে যায়। নাগরিক সমাজ ও ছাত্রযুবদের একটা অংশ মুসলিম মহিলাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিবাদে শামিল হলেন। শুধু দিল্লিতেই একই ধরনের আরও অনেক ধর্ণামঞ্চ গড়ে উঠল। কলকাতা, জয়পুর, নাগপুর, পুনে, এলাহাবাদ সহ আরও বহু শহরে নানা শাহিন বাগ পল্লবিত হল।

যে কোন গণআন্দোলনের মোকাবিলায় বিজেপির ধরাবাঁধা প্রতিক্রিয়া হল কুৎসা, অপপ্রচার এবং তাতে কাজ না হলে হুমকি, সিবিআই, ইডি লেলিয়ে দেওয়া, এনআইএর ভয় দেখানো। বৈষম্যমূলক সিএএর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে এই প্রতিবাদকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই মুসলিম সম্প্রদায়ের আন্দোলন বলে তকমা সেঁটে দেন যখন তিনি তাঁদের বিশেষ পোশাকের কথা উল্লেখ করেন। এরপর লাগামছাড়া কুৎসা-- পাকিস্তানি, টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং, সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী-- শুরু হয়ে গেল। প্রচার হল আন্দোলনকারীরা ধর্ণামঞ্চে হাজিরার জন্য ৫০০ টাকা পাচ্ছেন। ইসলাম ধর্মগুরু জাকির হোসেন নাকি বিদেশ থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য করছেন। এমনকি দিল্লিতে ধর্ণামঞ্চের সামনে গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটে গেল। উত্তরপ্রদেশে দমনপীড়ন ভয়াবহ আকার ধারণ করল। অন্তত কুড়ি জন পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন, সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস করার অজুহাতে বহু আন্দোলনকারীকে জরিমানা করা হল। আদালতের আদেশ অমান্য করে তাঁদের ছবি শহরের রাস্তায় টাঙিয়ে দেওয়া হল, যেন তাঁরা দাগী আসামী। দিল্লি নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজেপি শাহিন বাগকে ব্যবহার করে মেরুকরণের চেষ্টায় লাগামছাড়া মুসলিম বিরোধী প্রচার করল। বিজেপি নেতা মন্ত্রীদের সেই সব কুখ্যাত উক্তি ইতিমধ্যেই লোকগাথায় পরিণত হয়েছে। তবুও নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হল যা তাঁদের আরও ক্ষিপ্ত করে তুলল। একটি ধর্ণামঞ্চের সামনে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়ে তাঁরা পূর্ব দিল্লিতে হিংসা ছড়িয়ে দিল। মুসলিম জীবন-জীবিকা আক্রান্ত হল, ৫৩ জন মারা গেলেন যাঁর মধ্যে ৪০ জন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। তবুও শাহিন বাগের সমাবেশ অটুট রইল। প্রতিবাদকারীরা সদর্পে ঘোষণা করলেন, আমরা শাহিন বাগকে পূর্ব দিল্লি হতে দেব না। সরকারের প্রতিহিংসা, দমনপীড়ন সব কিছু উপেক্ষা করে ১০০ দিনের ওপর টিকে থাকার পর মহামারির আগমনের কারণে সংগঠকরা নিজেরাই সমাবেশ তুলে নিলেন।

কিন্তু নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ এমনটা বলা যাবে না। সিএএ কিন্তু এখনও চালু হয়নি। আইন পাস হওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত, সরকার এখনও এর বিধি প্রণয়নই করে উঠতে পারেনি। সরকার ফ্যাসাদে, নিজেদের কলে নিজেরাই আটকা পড়ে গেছে। তারা এখন পালিয়ে কূল পাচ্ছে না। একই সময়ে বাংলা, অসম দুটি রাজ্যে নির্বাচন; সিএএ লাগু করলে অসমে তার মারাত্মক ফল হবে, না লাগু করলে বাংলায় বিশেষত মতুয়া সম্প্রদায় বিরূপ হবে। এখন তারা পিছু হটছে বলছে, টীকাকরণ হলে, করোনার আতঙ্ক দূর হলে তবেই এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা হবে। ১৩০ কোটি মানুষের টীকাকরণ কবে হবে, করোনা কবে স্তিমিত হবে তা স্বয়ং ঈশ্বর স্বর্গ থেকে নেমে এলেও বলতে পারবেন না। অমিত শাহ বুঝে গেছেন বিধি বাম! মতুয়াদের ঘাঁটি বনগাঁয় নির্ধারিত সভা বাতিল করে দিয়েছেন এবং অসমে নির্বাচনী প্রচারের সূচনা করতে গিয়ে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি। অসমে এই আইনের বিরোধিতা এটাই যে একে কেন্দ্র করে দুটি আঞ্চলিক দল তৈরি হয়ে গেছে। বাংলায়ও মতুয়াদের মধ্যে বিজেপির জনসমর্থনে ফাটল ধরেছে, এই দলের ধাপ্পাবাজি তাঁরা ধরে ফেলেছেন।

একই ভাবে কৃষি আইন নিয়েও সরকার ল্যাজেগোবরে। এখানেও বিজেপির আইটি সেল কুৎসার বন্যা বইয়ে দিয়েছে-- খালিস্তানি, পাকিস্তানি, নকশাল, মাওবাদী, এঁদের আন্দোলন নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এঁরা ধনী, এঁদের সর্বাঙ্গে আভিজাত্য উপচে পড়ছে। এঁরা জিনস পড়ে, মেসিন দিয়ে পা মালিশ করে, পিজ্জা খায়, স্করপিও নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ইত্যাদি। সংঘীরা কৃষকদের একশো বছর আগে নিরন্ন, ছন্নছাড়া, হতদরিদ্র, ল্যাঙ্গট পরিহিত কাঁধে লাঙল নেওয়া শীর্ণকায় চেহারার মানুষ হিসাবেই দেখতে চায়। আরে! চাষাভূষো লোকগুলোর এ পয়সা, এ দাপট! সরকারি অনুদান, সুযোগ-সুবিধা পেয়ে এঁরা ফুলেফেঁপে উঠেছে, এঁদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বলীয়ান দেমাকি সরকারের ধারণা নেই যে ভারতবর্ষের কৃষক যুগ যুগ ধরে বহু কঠিন লড়াই ও অভিজ্ঞতার কারণে ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা, মনোবল আত্মত্যাগের ক্ষমতা অর্জন করেছেন। তাঁদের হেলাফেলা করা অ সহজ নয়। গুরুদ্বোয়ারে দেখনদারি দর্শন দিয়ে, কিছু তাঁবেদার কৃষকের সামনে ভাষণ মেরে, ২০০০ টাকা ছড়িয়ে দিয়ে তাঁদেরকে তোষামোদ করা যায় না। কৃষকরা কাঙাল নয়। ইতিমধ্যেই ৩৩ জন কৃষক শহীদ হয়েছেন, এক সন্ত আত্মবলিদান দিয়েছেন, বয়স এবং প্রবল শৈত্যপ্রবাহের কারণে অনেকে সংকটে তবুও তাঁরা সিংঘু, টিকরি, গাজিয়াবাদ ইত্যাদি সীমান্ত থেকে নড়বেন না। 

আর শুধু কৃষকরা কেন, গত মাসেই তো দেশ জুড়ে শিল্প ধর্মঘট হয়ে গেছে। বিহারের নির্বাচনে বামপন্থীরা- বিশেষ করে সিপিআইএমএল (লিবারেশন) দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা পালন করেছে- মাত্র ২৯টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ১৬টি সিট জিতে নিয়েছে। দেশ জাগছে। শাহিন বাগ পথ দেখিয়েছিল, বর্ষ শেষে কৃষক সংগ্রাম সেই রুপোলী ঝিলিককে আরও উজ্জ্বল করেছে।

 

Friday, 25 December 2020

যত গর্জায় তত বর্ষায় কী!

দলবদলের হিসেব নিকেশ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’ – যদিও এই শীতে উত্তুরে হাওয়ায় রাজ্যবাসী জবুথবু, তবুও খোলা দখিন দরজা দিয়েই পিল পিল করে স্বঘোষিত ‘মর্যাদাহীন’ এক প্রকারের মনুষ্য-দঙ্গল চেতনার বিলম্বিত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ‘জয়শ্রীরাম’ কলরবে নতুন ঘরে ঢুকে পড়ছে। কোথায় এসে ঢুকল, সেখানে আলো-বাতাস কতখানি, কোণে হলেও বসিবার ঠাইটুকুন আছে কিনা- সে সব ভাবনার সময় নাইকো এখন। আগে যান পরে দাম। বঙ্গ দেশে এ কেমন রঙ্গ গা! যদিও এই তামাশা গত কয়েক বছরে এ রাজ্যে সে রাজ্যে বেশ দেখা গেছে। যেমন, দিল্লিতে বিধানসভা ভোটের আগে আপ’এর ২৩ জন বিধায়ক দল ছেড়ে ‘জয়শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে চলে গেলেন বিজেপি’র কোটরে। ত্রিপুরায় গোটা প্রদেশ কংগ্রেস কর্পূরের মতো উবে গেল- তাদেরও সদলবলে পাওয়া গেল রামের ঘরে। এ রাজ্যেও গত লোকসভা নির্বাচনের সময় প্রধান বামপন্থী দল ফিসফিস করে তার ভোটারদের পদ্মফুলেই ভোট দেওয়ার কথা বললে। শুধু কি তাই! ভোটের পরেও নানা রাজ্যে নানা দলের বিধায়কেরা শিবির পরিবর্তন করে গুষ্টিকে গুষ্টি রামভক্ত হয়ে পড়ছেন, এও তো ড্যাবড্যাব করে দেখতে হচ্ছে। এ তো আচ্ছা কল বানিয়েছে চণ্ডীদাসের খুড়ো- যে রঙেরই যা হোক না কেন, অন্তিমে গেরুয়াই গেরুয়া!

বোঝাই যাচ্ছে, গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় এবং বঙ্গ রাজনীতি এক নতুন দুয়ারে এসে পৌঁছেছে। এই যে দলে দলে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ভাঙ্গিয়ে নেওয়া- এর পিছনে রহস্যটা কী? অথবা, এই রণকৌশলটাকেই সাব্যস্ত করা হল কেন? আর এও তো দেখা গেল, জনপ্রতিনিধি ভাঙ্গিয়ে নিয়ে যে সব সময় জনসমর্থন আদায় করা যাচ্ছে, তেমনটাও তো নয়। তবুও এটা আপাতত একটা পথ। নতুন পথ। ভেবে চিন্তে এই পথে খেলতে নামা।

প্রথমত, দল ভাঙ্গিয়ে খেলতে নামার মধ্যে একটা শোরগোল আছে। খেলাধুলোর ভাষায় একে বলা যেতে পারে, ওয়ার্ম-আপ। এটা কাজে দেয় যেখানে বিরোধী পক্ষ বেশ সবল বা শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত এবং বিজেপির সাংগঠনিক শক্তি তেমন মজবুত ও ব্যাপ্ত নয়। দল ভাঙ্গানোর খেলায় টার্গেট করা হয় দু’ ধরনের নেতাদের: এক, যাদের অর্থলোভ আছে ও দুই, যাদের জামায় কিছু দাগ আছে। ঘোড়া কেনাবেচায় তাদেরই কেনা হয় যাদের এলাকায় কিছু প্রভাব বা প্রতিপত্তি আছে, অন্তত হাতে কিছু বাহুবলী আছে। আর যাদের জামায় কালির ছিটে, তাদের দেখানো হয় এজেন্সির ভয়। রফা হয়, দল পালটে নিলে এজেন্সি আর তাদের ঘাঁটাবে না। গত চার-পাঁচ বছরে ভারতীয় রাজনীতিকে বিজেপি এই ভয়ঙ্কর স্তরে নামিয়ে এনেছে। যদিও দলবদলের এমনতর ঘটনা এ রাজ্যে তৃণমূলের হাত ধরেও ২০১১ সালের পর অনেকগুলিই হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, দলবদলের এই শোরগোলে, যা গোদি মিডিয়ার হাতে পড়ে আরও শত গুণ বিস্ফারিত হয়ে এমন এক ধামাকা তৈরি করতে থাকে যে, সব যেন গেল গেল; ফলে বিজেপি’র জয় সুনিশ্চিত। ঠিক এমনই বাওয়াল দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনেও করা হয়েছিল। সেখানে তো অনুরাগ ঠাকুর ‘গদ্দারো কো গোলি মারো’ রব তুলে দাঙ্গাও লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তবুও শেষরক্ষা হয়নি।   

তৃতীয়ত, এর পরের ধাপে আসে আইটি সেলের নির্মিত হরেকরকম্বা পোস্ট, ভিডিও, বয়ান, মিম, ইতিহাস-বিকৃতি ইত্যাকার নানাবিধ এত মালমশলা যে তা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রাঙ্গণকে জবরদখল করে বিষিয়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট। এই আইটি সেলের কার্যাবলী ও কাজের বিষয় সম্পূর্ণ পেশাগত ভাবে গড়ে তোলা হয় এবং মাইনে করা, চুক্তিবদ্ধ, ক্ষণস্থায়ী এবম্বিধ হাজার হাজার কর্মী নিয়োগ করে ও তাদের পেছনে যথেচ্ছ অর্থব্যয় করেই এই কাজের নির্বাপণ। ২০১৩-১৪ থেকে ২০১৭-১৮ সাল অবধি এই কাজে বিজেপি প্রভূত ডিভিডেন্ড ঘরে তুলেছে। কিন্তু তাদের এ প্রয়াস এখন অনেকটাই দুর্বল। সেটা কেন, তা পরে অন্য কোনও নিবন্ধে না হয় বলা যাবে। তবু আজও তারা এ অনুশীলন সগৌরবে অটুট রেখেছে। প্রতি নির্বাচনেই এই ক্ষেত্র থেকে তারা ফায়দা তোলার চেষ্টা চালায়। ধারণা, তাদের প্রচারের উদ্দিষ্ট বিভাজন (সামাজিক-ধর্মীয়) যত প্রকট হবে লাভের কড়ি তত তাদের ঘরে আসবে।

চতুর্থত, এ প্রসঙ্গে গোদি মিডিয়ার ভূমিকাকেও মাথায় রাখতে হবে। যদিও গোদি মিডিয়ার ওপরে মানুষের ভরসা আজকাল অনেক কমে এসেছে, তবুও এদের প্রভাব এখনও অনস্বীকার্য। দেখাই যাচ্ছে, দু-তিনটি টিভি চ্যানেল বাদ দিলে গোদি মিডিয়া বেশ গদগদ হয়ে এক তরফা ভাবে এবং একটা নির্দিষ্ট ধাঁচে ও বিষয়বস্তুতে তাদের সম্প্রচার সংগঠিত করে চলে। দিল্লির সীমান্ত ঘিরে লক্ষ লক্ষ কৃষকদের অবরোধ ততটা তাদের খবরের বিষয় হয় না, যতটা হয় দেশের শাসকের এজেন্ডা ধরে খবর বানানোর প্রয়াস। এ রাজ্যেও সে প্রবণতা ইদানীং বেশ স্পষ্ট। এরই বিপ্রতীপে এখন তাই গড়ে উঠছে জনমিডিয়া: ইউটিউব চ্যানেল-কেন্দ্রিক ও সোশ্যাল মিডিয়া-নির্ভর নানাবিধ বিকল্প সম্প্রচার ব্যবস্থা। আর তা বেশ জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে।

পঞ্চমত, দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে থেকেই এ রাজ্যে প্রচার, সভা, মিটিং-মিছিলের সাজো সাজো রব। এতে উত্তেজনা ও চমকের নির্মাণ হয় আর তাতে মিডিয়াগুলির টিআরপি বাড়ে ও তাদের বাণিজ্যেরও পোয়াবারো। তাই তারাও এমত সভা-সমাবেশকে ব্যাপক প্রচার করে উত্তেজনাকে চরমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেকে এই জনসমাবেশগুলি দেখেই ভাবতে শুরু করেন যে এবার কি তাহলে পরিবর্তন আসন্ন? যে দলটি এবার এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে বেপরোয়া, যাদের সর্বভারতীয় নেতারা প্রায় হত্যে দিয়ে এখানে পড়ে আছেন, তাদের সভায় লোকসমাগম দেখে অনেকেই হয়তো প্রমাদও গুনতে শুরু করেছেন! কিন্তু যে সব অঞ্চলে এই সভাগুলি হচ্ছে সেখানকার স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, কিছু ব্যতিক্রমী অঞ্চল বাদ দিলে, এই লোকসমাগম কিন্তু সে অর্থে স্বতঃস্ফূর্ত বা স্থানীয় নয়। অল্প কিছু স্থানীয় মানুষজন সেখানে আসেন বটে কিন্তু মাঠ ভরানোর জন্য এক সেট তৈরি থাকা লোককে বাইরে থেকে এনেই সভাগুলিকে পূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়। এর জন্য প্রভূত অর্থ ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্ককে সম্পূর্ণ ভাবে কাজে লাগানো হয়।

তার মানে কি, এ রাজ্যে যা চলছিল তা ঠিকই ছিল? মানুষের মধ্যে কি কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ সে ভাবে নেই? যারা ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে এতটা আগে থেকে কোমর বেঁধে নেমেছে তারা কি শেষমেশ মূষিক প্রসব করেই ক্ষান্ত দেবে? একেবারেই তা নয়। বলার কথা এই, আগামী নির্বাচনের কোনও সন্দর্ভই এখনও তৈরি হয়নি। এখনও বলার সময় আসেনি, কী হতে পারে বা কী হতে চলেছে। অভিজ্ঞতা বলে, মানুষ নির্বাচনী যুদ্ধে খুব সচেতন ভাবে অংশ নেয়। এই সচেতনতা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও পরিণত হয়েছে। মানুষকে বুরবাক ভাবার কোনও কারণ নেই। এই মানুষই ২০১৯ সালে, খেয়াল করে দেখুন, উড়িষ্যায় অনুষ্ঠিত একই সময়ে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে যথাক্রমে বিজেপি ও বিজেডি’কে আলাদা আলাদা করে জয়ী করেছে। যে দিল্লি, ঝাড়খণ্ড বা বিহারে গত লোকসভায় মানুষ উজাড় করে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে তারাই আবার কয়েক মাস পরে বিধানসভায় হাত খুলে যথাক্রমে আপ, জেএমএম ও মহাগঠবন্ধনকে তাদের সমর্থন জানিয়েছে। সম্ভবত সব রাজনৈতিক দলই জনতার এই অভিজ্ঞানকে সম্যক উপলব্ধি করেছে। তাই, পশ্চিমবঙ্গে গত লোকসভা নির্বাচনের প্রবণতাই যে বিধানসভাতেও বহাল থাকবে সে কথা কি জোর দিয়ে আজই বলে দেওয়া যায়?

অতএব, সাধু সাবধান। রাজনৈতিক দলগুলি ও বিবিধ মিডিয়া যতই লাফালাফি করুক না কেন, জনগণ কিন্তু নীরব অথবা মুচকি হাসছে। এই আপাত নীরবতা দরকষাকষির ইঙ্গিত। যে কারণে কিনা এখন ‘দুয়ারে সরকার’ এসে দাঁড়িয়েছে। দিল্লির আন্দোলনরত কৃষকদের উপেক্ষা করে প্রাধানমন্ত্রীও এ রাজ্যের কৃষকের প্রতি অতি-দরদ দেখাচ্ছেন। তাই, নেতাদের দলবদল ব্যক্তিস্বার্থের হিসেবনিকেশ মাত্র। এর সঙ্গে আমজনতার সার্বিক কোনও সম্পর্ক নেই। কোনও মতাদর্শ বা নীতিমালার ওপর দলবদলুদের গতায়াত হচ্ছে না, হচ্ছে নিজ স্বার্থকে ভারী করার অভিপ্রায়ে। তা নিয়ে সাধারণের মাথাব্যথা তো কিছু নেই!

Tuesday, 22 December 2020

সার্বিক পরিবেশ সমস্যা

সম্মিলিত ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন

বিধান চন্দ্র পাল

এই বছর (২০২০) মে মাসে বাংলাদেশে গত ১০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হেনেছিল। তাতে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। এরপর জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকেই শুরু হয় দেশের ইতিহাসের অন্যতম বন্যা। বন্যায় দেশের অর্ধেকের বেশি জেলা সমূহ প্লাবিত হয় এবং লাখ লাখ লোক দীর্ঘ সময় (দেড় মাসেরও বেশি) ধরে পানিবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটায়। সেই বন্যা চলাকালেই আবার মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে সাগরে অস্বাভাবিক জোয়ারের সৃষ্টি হয়। ফলে, উপকূলীয় জেলাগুলোতে জোয়ারের পানি গ্রাম ছাপিয়ে শহরের অলি-গলি, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঢুকে যায়। এটা সুস্পষ্ট যে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেই এমনটা হচ্ছে। আগে কিন্তু অনেক বছর পর পর বন্যা হত এখন তা প্রায় প্রত্যেক বছরই লক্ষ করা যাচ্ছে। এছাড়া বন্যা দীর্ঘায়িত হতেও আমরা দেখছি। যা মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে এবং একইসাথে একটি দুর্বিষহ অবস্থার সৃষ্টি করছে। এ সকল পরিবর্তন যে হঠাৎ করেই হচ্ছে তা নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মক ভাবে বিনষ্ট হওয়ার ফলশ্রুতিতেই এগুলো ঘটছে বলেই বিজ্ঞানীদের অভিমত। শুধু তাই নয়, এ সব সমস্যা ক্রমেই আরও জটিল ও ভয়াবহ হচ্ছে।

ধারণা করা হয়ে থাকে যে, পরিবেশ ও প্রকৃতিকে অবমাননা করার ফলে পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হবে কিংবা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। কারণ, একদিকে বাংলাদেশের ওপর রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের বিশেষত শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিশেষ প্রভাব, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরেও রয়েছে জনসংখ্যার আধিক্য, মানুষের ভোগের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়া, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি সমস্যা। যা প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখছে। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও দেন-দরবার করার পাশাপাশি আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ করাও আমাদের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাকৃতিক পরিবেশের বিষয়টি আজ সারা পৃথিবী জুড়েই সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত একটি বিষয়। সাম্প্রতিককালে আমাদের দেশের গড় তাপমাত্রা গ্রীষ্মকালে দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, আবার অন্যদিকে শীতকালে ক্রমান্বয়ে তাপমাত্রা কমে যাচ্ছে, ঢাকা সহ অনেক এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির অভাব দেখা দিচ্ছে, বিজ্ঞানীদের নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনে জলবায়ু সম্পর্কযুক্ত দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বজ্রপাত ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতি বছরই প্রাণ দিতে হচ্ছে শত শত মানুষকে। বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজারো পরিবার। বিনষ্ট হচ্ছে মূল্যবান সম্পদ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা বেড়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা করা হয়েছিল তা যেন ক্রমেই দৃশ্যমান হচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও বাড়তে পারে বলেই অনেক পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি আমারও আশঙ্কা হয়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায় যে, একসময় প্রাকৃতিক পরিবেশে যে সকল পরিবর্তন লক্ষ করা যেত সেগুলো প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটত। মানুষের ক্রিয়ার ফল ছিল নিতান্তই নগণ্য। কিন্তু এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৯ সালের ১৭ জুন প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যা ৭৭০ কোটি। আগামী ৩০ বছরে আরও ২০০ কোটি যোগ হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে মোট জনসংখ্যা হবে ৯৭০ কোটি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৭৪ লাখ। এর মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ৩৮ লাখ এবং নারী ৮ কোটি ৩৬ লাখ। কেউ কেউ অভিমত প্রকাশ করেন যে, পৃথিবীর যা সম্পদ রয়েছে তা সর্বোচ্চ ২০০ থেকে ৩০০ কোটি মানুষের জন্য যথাযথ।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের অভাব একসময় পরোক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যদিকে জনসংখ্যা তাড়াতাড়ি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে কৃষি বিপ্লব। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে সব মানুষের খাদ্যের সংস্থান তেমন একটা সমস্যা নয়। তবে সমস্যা হল বিদ্যমান বৈষম্যমূলক ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যার ফলে অনেক সময়ই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য মজুদের অভাবে নষ্ট হবার কথা শোনা যায়।

দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হল, খাদ্যের অভাবগ্রস্থ মানুষদের কাছে যথাযথভাবে উদ্বৃত্ত খাদ্যও অনেক সময় পৌঁছয় না। অন্যদিকে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা ক্রমশই বাড়ছে। সেই সঙ্গে বিশ্ব জুড়ে জাতিগত দ্বন্দ্ব, বিবাদ, জোরপূর্বক অভিবাসন ও প্রভাব বিস্তারের ফলে নতুন নতুন সমস্যারও সৃষ্টি হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রকৃতির ওপরও নানামুখি নির্যাতন বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে করোনা দুর্যোগও আমাদের ভেতরে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন ও চিন্তার সৃষ্টি করেছে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় ধীরে ধীরে জনসংখ্যা কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। কারণ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য দারুণভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে এই ভারসাম্য এমনভাবে বিঘ্নিত হয়েছে যে, তা প্রকৃতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত প্রদান করছে।

বলা হয়ে থাকে, প্রকৃতি হল ‘মা’এর মতো। ‘মা’ তার সন্তানকে পূর্ণ ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে আগলে রাখেন। আবার সন্তান দৃর্বৃত্ত হলে, সীমাহীনভাবে অন্যায় শুরু করলে মা’য়ের পক্ষে তা সামলানো যেমন কঠিন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমনিভাবে প্রকৃতির এ সকল পরিবর্তন যদি কম মাত্রার হত তাহলে বোধহয় সে তার আপন নিয়মেই সব কিছু সামলে নিতে পারত। তাতে হয়তো খুব বেশি প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হত না। কিন্তু এখন প্রকৃতির প্রতি অন্যায়, অবিচারের এক মহোৎসব চলছে যেন প্রায় সবখানেই। যেমন: বন-জঙ্গল কমে যাবার বিষয়টি এখন আমরা একেবারেই চোখের সামনে লক্ষ করছি।

বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যাপী বনভূমি ও বনজ সম্পদ দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, রোহিঙ্গাদের বসতির কথা। বসতি স্থাপনের কারণে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকার বন ধ্বংস হয়ে গেছে। হুমকির মুখে পড়েছে সেখানকার পরিবেশ, বনভূমি ও জীববৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়েছে ৬ হাজার ১৬৩ হাজার একর বনও। এছাড়া বসতি স্থাপন করতে গিয়ে এশিয়ান হাতির আবাসস্থল ও বিচরণ ক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চল সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে গত ২০১৯ সালের মার্চ মাসে বন বিভাগ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল।

শুধু পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাই নয়, কোনও দেশের অর্থনীতিতে বনজ সম্পদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও এই সম্পদ এক অনন্য ভূমিকা পালন করে থাকে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বন অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারেই মোট বনভূমির পরিমাণ এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে প্রকৃত বনের পরিমাণ আরও কম। যেখানে ১৯৭১ সালে ১৮ ভাগের বেশি বনভূমি ছিল আমাদের, যা বৃদ্ধি তো দূরের কথা ক্রমেই আরও হ্রাস পাচ্ছে। প্রসঙ্গত একটি বিষয় এখানে উল্লেখ্য যে, এখন পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় কোনও রাষ্ট্রীয় বনভূমি গড়ে ওঠেনি। ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের বনভূমির পুরোপুরি মূল্যায়ন করা ছাড়া কোনও বনভূমি ইজারা না দেওয়া এবং বেদখল হওয়া বনভূমি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দিয়ে উদ্ধার করার জন্য সরকারের দিক থেকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ থাকাটা খুবই জরুরি হবে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, বন-জঙ্গল কমে যাওয়ায় তার বিরূপ প্রভাব মানুষ, পশু-পাখি ও আবহাওয়ার ওপর পড়ছে। অন্যদিকে মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি অনেকটা একইতালে কল-কারখানা বাড়ার ফলে পৃথিবীতে জীবাশ্ম জ্বালানি (যেমন: কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি) পোড়ানোর পরিমাণও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। আর বেশি পরিমাণে জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বায়ুমণ্ডলে দুষণ খুব তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ও তাপমাত্রা। এছাড়া ভূমি ব্যবহারে পরিবর্তন, সংশ্লেষী পণ্যের ব্যবহার (যেমন: তরল কার্বন ডাই অক্সাইড), নির্দিষ্ট জীবনধারা এবং ভোগের স্বভাব প্রাকৃতিক পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়াকে আরও তরান্বিত করছে।

প্রকৃতপক্ষে, আমাদের প্রকৃতিতে যদি ধীরে ধীরে পরিবর্তনগুলো ঘটত তাহলে গাছপালা, মানুষ, পশুপাখি সে সব পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের অনেকটাই খাপ খাইয়ে নিতে পারত। কিন্তু এসব পরিবর্তন বর্তমানে দ্রুতগতিতে ঘটার কারণে এগুলো ‘মেনে নেওয়া’ ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় থাকে না- ফলে বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অনেক নদী-নালা শুকিয়ে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ও কৃষি কাজের সেচের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রাকৃতিক এ সকল পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে ভূগর্ভস্থ পানির বিশেষত সুপেয় পানির অভাব ঘটবে এবং কৃষি কাজে সেচে মারাত্মক সমস্যা দেখা যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সমুদ্রের উচ্চতা বাড়ার কারণে নিম্ন সমভূমিগুলো বা সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে উচ্চতা কম যে সব অঞ্চলে সেগুলো জলমগ্ন হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। উপরন্তু শুষ্ক মৌসুমে আর্দ্রতা বাড়ার ফলে বাড়বে খরার তীব্রতা ও হার। এ ধরনের সমস্যা বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত (এলডিসি) ও উন্নয়নশীল দেশেই যে শুধু দেখা দিচ্ছে তাই নয়, উন্নত দেশগুলিতেও দেখা দিচ্ছে। নানা দেশে সমস্যার ধরনে হয়তো কিছুটা বৈচিত্র্য এবং একটু বেশ-কম আছে। যেমন: সাম্প্রতিক সময়ে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, কানাডা সহ বিভিন্ন উন্নত দেশে অস্বাভাবিক তুষার ঝড়, আকস্মিক বন্যা, জলোচ্ছ্বাস এবং তাপদহের ঘটনা বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসছে। যদিও ওইসব দেশগুলোকেই বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা হয়ে থাকে।

যাই হোক, বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রকৃতিতে আর পরিবেশে যে সকল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে, সেগুলো অনেকটাই মানুষের সৃষ্ট এবং যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এমন একটি সময় ছিল যখন- বিভিন্ন দুর্যোগের যেমন: সিডরের তীব্রতা কেন বাড়ল? বন্যায় বেশি এলাকা কেন প্লাবিত হচ্ছে? এ সকল বিষয় সাধারণ মানুষের জানার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থা পাল্টেছে, এর ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হচ্ছে। আজ তাই বিষয়টি সম্পর্কে সকলেরই গভীরভাবে উপলব্ধি করার প্রয়োজন রয়েছে।

আমাদের দেশের আবহাওয়া বদলে যাবার খুব সহজ কারণ যদি খুঁজতে যাই তাহলে দেখতে পাব: বিভিন্ন কলকারখানা থেকে নির্গত বর্জ্য, বিশেষ করে ট্যানারি ও রাসায়নিক কারখানার বর্জ্য থেকে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দুষিত হচ্ছে। ফলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু, কর্ণফুলি থেকে শুরু করে সারা দেশের নদীগুলো আজ ভয়ংকর রকমের দুষণের শিকার। ইটের ভাটার ধোঁয়ায় অনেক গ্রামের বাতাস ও মাঠের মাটি দুষিত হচ্ছে। এছাড়া অনুন্নত যানবাহন ও অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার দরুণ ঢাকার বাতাসে প্রতিনিয়ত দুষণ বাড়ছে, সেই সাথে যানবাহনের হর্ন ও মাইকের বিকট শব্দের কারণে শব্দদুষণও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। নিষিদ্ধ পলিথিন পচনশীল নয়, তাই পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ফলে যত্রতত্র ফেলে দেওয়ায় ড্রেন, ম্যানহোল বন্ধ হয়ে যাওয়া সহ বিভিন্ন ভাবে পরিবেশকে দুষিত করছে, চাষাবাদের ক্ষেত্রে সাময়িক ফলন বাড়ানোর তাগিদে জমিতে ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক সার এবং সেইসাথে রয়েছে কৃত্রিম কীটনাশকের ব্যাপক প্রয়োগ। এই বিষাক্ত কীটনাশকের ফলে ভূমি ও খাল-বিল-নদীর পানি মারাত্মকভাবে দুষিত হচ্ছে। এছাড়া মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছপালা কেটে ফেলা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমির সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাওয়া দেশের আবহাওয়া বদলে যাবার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অবদান রাখছে বলেই অনেকের ধারণা। প্রকৃতির অকৃপণ দান যেন মানুষ দু’ হাত ভরে লুট করে নিচ্ছে আর ফলশ্রুতিতে প্রকৃতিও রিক্ত ও বিকৃত হয়ে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে বাধ্য হচ্ছে।

যাই হোক, আমি পূর্বেই বলেছি যে, এ সকল সমস্যা ধীরে ধীরে আরও বাড়ছে। ফলে, এসব সমস্যার সমাধানের কথা সবাই মিলে ভাবতে হবে। জানতে হবে ও জানাতে হবে সবাইকে। একইসাথে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে পৃথিবীব্যাপী একযোগে। দূষক ও দূষণ সংক্রান্ত সমস্যা আজ একটি ট্রান্স বাউন্ডারি সমস্যা- অর্থাৎ, আজ এটি কোনও দেশের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ নেই। কাজেই সারা পৃথিবীর মানুষকে এ সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

আমরা দেখতে পাই, দেশের যে কোনও সংকটের মুহূর্তে তরুণ-তরুণীরাই এগিয়ে গেছে সর্বাগ্রে, রচনা করেছে রক্তিম ইতিহাস। তাই আজ সময় এসেছে ‘প্রকৃতির বন্ধু’ খুঁজে বের করার, অর্থাৎ মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাবার। এছাড়া গ্রাম থেকে শহরে সকলকে প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষেত্রে সৃষ্ট পরিবর্তন ও করণীয় সম্পর্কে জানাবার। এ ক্ষেত্রে সারা বছর ও দেশব্যাপী একটি ক্যাম্পেইন পরিচালিত হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে কেবল তরুণ-তরুণীরাই পারে এগিয়ে এসে, দায়িত্ব নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে।

প্রকৃতির ক্ষতি করে সুন্দর জীবনধারণ কখনই সম্ভব নয়। তাই সার্বিক বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে, পরিবেশ সম্পর্কিত বিভিন্ন আইন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করার ক্ষেত্রে ও সারা বিশ্বব্যাপী গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি সকলকে জানাতে মিডিয়াকে আরও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি সংগঠন সমূহকে কার্যকর ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। গণ্যমান্য ব্যক্তিত্ব সহ সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে- সম্পদ হিসেবে পরিবেশকে যে কোনও মূল্যে রক্ষা করার জন্য। একইসাথে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও বিষয়টির প্রতি আরও গুরুত্ব দিতে হবে।


Thursday, 10 December 2020

অবরুদ্ধ কৃষক

এ লড়াই সকলের লড়াই

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


লড়াইটা সামনে এসে গেছে, এতদিন যা ছিল আড়ালে: এ দেশের সামন্ত পুঁজির সঙ্গে কর্পোরেট পুঁজির। এ দেশের কৃষি ক্ষেত্রে এবার অশ্বমেধ ছোটাতে চায় আন্তর্জাতিক পুঁজি। এতদিন যে ক্ষেত্রটি ছিল সামন্ত পুঁজির শক্ত নিয়ন্ত্রণে সেটাই ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। ভেঙে দেওয়া হচ্ছে কৃষি উৎপাদন বিপণন মজুতদারির এতদিনকার চালু ব্যবস্থা। উদ্দেশ্য একটাই, বিপন্ন চাষিকে কর্পোরেট চুক্তির আওতায় এনে কর্পোরেট ফার্মিং'এর সুবিধা নিয়ে ফসলের উৎপাদন যতটা সম্ভব কম করে ফেলা এবং তারপর যথেচ্ছ মজুতদারির মাধ্যমে মুনাফা সর্বাধিক করা। সরকার ক্রমশ মান্ডি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর ধীরে ধীরে সেটিকে অকার্যকর করে তোলার মতো পদক্ষেপ নেওয়া হবে; যাতে কেউ বলতে না পারে যে সরকার সে ব্যবস্থা তুলে দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে উল্টোটাই হবে। সমস্ত ক্ষেত্রে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে খোলাবাজারে দামের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। আর তার জন্যই একই সঙ্গে চালু হল চুক্তি চাষের সঙ্গে যথেচ্ছ মজুতদারি করে মুনাফা সর্বাধিক করে নেওয়ার ক্ষমতা। 

মনমোহিনী সংস্কারে নয়া উদারনীতি কৃষিকে কোণঠাসা করে ধীরে ধীরে চাষিকে বাধ্য করছিল চাষের কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে। এতে ছোট ও মাঝারি চাষির দম বন্ধ হওয়ার অবস্থা তৈরি হচ্ছিল। প্রতি বছরই চাষের নানা খরচ বাড়ছিল, একই সঙ্গে সরকার নিজেও ভর্তুকি কমাচ্ছিল। অতএব, বিদ্যুৎ, জল, সার ক্রমশ মহার্ঘ্য হচ্ছে, চাষির আয় কমছে। এমন অবস্থায় চাষিদের বোঝানো হয়েছিল যে মোদিকে ক্ষমতায় আনা হলে তিনি তাদের আয় দ্বিগুণ করে দেবেন। সরল বিশ্বাসে সেটাই ভেবে নিয়েছিল এ দেশের চাষি। তাই আজ তারা এই হাড়-কাঁপানো শীতে দিল্লির পথে বসে আছে। সরকার দেখছে, কতদিন ধৈর্য ধরে থাকে দেখি? সরকার এখন ক্ষেতে ক্ষেতে কর্পোরেট ফার্মিং শুরুর দামামা বাজিয়ে দিয়েছে। ছোট চাষিকে কোণঠাসা করে বড় চাষির হাতে জমি তুলে দেওয়া নয়, এবার গোটা কৃষি ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে উদ্যোগী মোদি সরকার। 

পরিবর্তন কতটা হচ্ছে সেটা বুঝতে গেলে প্রথমে জানা দরকার যে এ দেশের কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে এক  এক রাজ্যের পরিস্থিতি এক এক রকম। যেহেতু কৃষি ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাজ্য তালিকার অন্তর্গত তাই স্থানীয় কৃষির প্রয়োজন, চাষীদের অবস্থা বুঝে এক এক রাজ্য এক এক রকম আইন তৈরি করেছে। অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয় রাজনীতি এবং রাজনীতির সমীকরণে কৃষকের ভূমিকা ও গুরুত্ব। ঠিক সেই কারণেই বিহার বা ছত্তিশগড়ে কৃষকের যা পরিস্থিতি, পাঞ্জাব হরিয়ানা উত্তরাখণ্ডে তা নয়। বিভিন্ন রাজ্যে কৃষি ব্যবস্থার চরিত্র তৈরি হয়েছে এভাবেই। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে গড়ে ওঠা পুঁজি স্থানীয় চাহিদা পূরণ করার পর উদ্বৃত্ত হিসেবেই রয়ে গেছে সম্পন্ন ও ধনী কৃষকের কাছে। গ্রামীণ অর্থনীতির প্রকরণে তাই কোনও পরিবর্তন আসেনি।

মোদি সরকার কার্যত কৃষির এই তিন আইন এনে শুধু কৃষি ক্ষেত্র নয়, স্বাভাবিকভাবেই গ্রামীণ উন্নয়নের ধারাটাও বদলে দিতে চাইছে। তাঁর বক্তব্য, পুরনো আইনে আর আগামীর উন্নয়ন হবে না। গ্রাম উন্নয়নের জন্য কর্পোরেট লগ্নি চাই। চুক্তি চাষ মানে পাশাপাশি ছোট ছোট চাষের জমির মালিককে একজোট করে চুক্তি করতে পারলে এলাকা জুড়ে বড় মাপের 'কর্পোরেট মেকানাইজড ফার্ম অ্যাকটিভিটি' সম্ভব হবে। এই ইংরেজি শব্দবন্ধ- 'কর্পোরেট মেকানাইজড ফার্ম অ্যাকটিভিটি' এখন মোদির স্বপ্ন। অর্থাৎ, জমি নিরানি থেকে লাঙ্গল দেওয়া, বীজ বপন, সার দেওয়া, বিষ তেল দেওয়া, ফসল কাটা, ঝাড়া, রাখা সমস্ত কাজে যন্ত্র লাগানো যাবে। ভাবুন একবার। ড্রোন উড়ছে ক্ষেতে বিষ তেল দিতে! এরকম একটা কৃষিক্ষেত্র চাইলে তো ছোট চাষির ক্ষেত রাখা যায় না। আর ভারতীয় কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে তো এই পথই দরকার। পুঁজিবাদী কৃষিবিদদের এই আপ্তবাক্য মেনে যদি কৃষির কর্পোরেটকরণ ঘটানো যায় তাহলে গ্রামে প্রচুর অর্থ লগ্নি হবে। রাস্তা, হিমঘর, বেসরকারি কৃষি বাজার তৈরি হবে। আর এটা ক্রমশ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে যখন এই কৃষি ফসলটাই আদানি আম্বানিদের ব্যবসার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছে। এর সঙ্গেই রয়েছে বিশ্বজোড়া পুঁজি অধিপতি গুগল, অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট।

তবে সেই অর্থ লগ্নির ফলে গ্রামের কৃষিজীবী মানুষের অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে না, বরং বিপন্ন হতে পারে এমন আশঙ্কা প্রবল। কীভাবে সেটা সরকার জানে, তাই আইনে সুরক্ষার পাশাপাশি চটজলদি প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার আওতায় কৃষকদের রাখাটা যে জরুরি, এটা তারা ভুলে গেছে। চুক্তি চাষের আওতায় এনে কর্পোরেট যদি কৃষকের সঙ্গে কথার খেলাপ করে, যথাযথ চুক্তিমতো দাম না দেয়, তাহলে কৃষকের সঙ্গে দানবীয় কর্পোরেটের লড়াইতে কে জিতবে? চোখ বন্ধ করে বলা যায়, সেই মামলার রায় দেওয়ার আগেই ছোট ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষক শুকিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনও হস্তক্ষেপ করার ব্যবস্থা রাখা হয়নি নতুন আইনে।

লাগাতার বিক্ষোভ আন্দোলন ধর্ণা এবং কৃষক সংগঠনগুলির সঙ্গে বারংবার বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর সরকার কতকগুলো সংশোধনী আনতে চাইল। যেমন, চুক্তি আইন নিয়ে সংশোধনী আনতে চেয়েছে এই মর্মে যে চুক্তি শর্ত অনুযায়ী কোনও বিতর্ক দেখা দিলে সমাধানের জন্য চাষি দায়রা আদালতে যেতে পারবে। ভাবুন, দায়রা আদালতে গেলে কী হবে! যতকাল মামলার মীমাংসা না হবে, ততদিন ওই জমিতে চাষ বন্ধ থাকবে। তাহলে চাষি খাবে কী? সরকার এটা বুঝেও সংশোধনীর নামে ঘুরপথে আরেকটা এমন প্রস্তাব দিল যেটা গ্রহণ করা মানে নিজের শর্তেই নিজের মৃত্যুবরণ করা। জমি থেকে উৎপাটিত হতে হবে শুধু নয়, ঘটি মাটি যাবে চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরিমাণ ও গুণমান অনুযায়ী ফসল না দিতে পারলে। আবার চুক্তিকারী কোম্পানি যদি নিজেই লাটে ওঠে, কম দাম ধরে দিয়ে বলে পরে মেটানো হবে, তখন চাষি কোথায় যাবে? সমস্যা এরকম আরও আছে নতুন আইনের ফাঁকে ফাঁকে। যেমন ধরা যাক, কেউ একজন বেসরকারি মান্ডিতে এসে তার ফসল বেচতে চাইল না। সে যদি সরকার নির্ধারিত দাম নিয়ে সরকারি মান্ডিতে বিক্রি করতে চায় সেই দাম কখনই কর্পোরেটের স্বার্থে কর্পোরেট নির্ধারিত দামের চাইতে বেশি হবে না। তা যদি কখনও হয়ে পড়ে, তাহলে মাথা নিচু করতে হবে রাষ্ট্রকে। এরই নাম কি উন্নয়ন? তাহলে এই উন্নয়নের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য একটাই- আম্বানি আদানিদের মতো দেশিয় পুঁজি বা অ্যামাজন, ওয়ালমার্ট'এর মতো খুচরো ব্যবসায় বৃহত্তম দুই আগ্রাসী আন্তর্জাতিক পুঁজির হাতে এ দেশের কৃষকরা মশা-মাছির মতো মারা যাবে। চাষিরা এটা বুঝে গেছে। তাই তারা আর এই সরকারকে বিশ্বাস করতে চায় না।

কিন্তু বিশ্বাস করা না করার চাইতে বড় কথা কৃষকদের নিজেদের শক্তি। এই আন্দোলন সারা দেশে যত ছড়িয়ে পড়বে, বিভিন্ন রাজ্যের কৃষক এসে মিলিত হবে, এই আন্দোলন তত সর্বব্যাপ্ত হবে এবং একটি জাতীয় শক্তি হিসেবে এই দেশকে কর্পোরেট খাদ্য বানিয়ে তোলার খুল্লাম খুল্লা রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের জোরালো বিরোধী স্বর হিসেবে দেখা দেবে। কৃষক সমাজের এই লড়াই তাই বাঁচার লড়াই। শুধু তাই নয়। মজুরি আইন বদলের সাথে চুক্তি চাষের আইন জুড়ে দিলে যে কী সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া খুচরো বাজারে পড়তে পারে, তা একবার যদি কেউ বিশ্লেষণ করে দেখে তাহলে দেখা যাবে, শুধু কৃষক বা খুচরো ব্যবসায়ী দোকানদার নয়, এই আইনের ফলে প্রতিটা মানুষ আক্ষরিক অর্থে প্রতিদিন বেশি গুনাগার দিয়ে জিনিস কিনে নিজের সঞ্চয় কমিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে। চুক্তি চাষে যদি দেখা যায়, খাদ্যশস্য ফলানোর চাইতে রেশম গুটি চাষ করা অনেক বেশি লাভজনক, তখন খাদ্যশস্যের জোগান বাজারে কমে যাবে। ফলে, দাম বাড়তে থাকবে বাজারে। 

তাই এই লড়াই শুধু কৃষকের নয়। কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের। এখনও যদি মানুষ সেটা না বুঝে নিজেকে দূরে দূরে রাখে তাহলে এই মোদি সরকার সুকৌশলে আরও কিছুদিন ধৈর্য ধরে কৃষকদের রাস্তার ঠান্ডায় দম ফুরিয়ে ফেলানোর অপেক্ষায় থাকবে। তাই কৃষকরা যতই 'ইয়েস অর নো' বলে মন্ত্রীর মুখের সামনে প্ল্যাকার্ড ধরুক, এবার তাদের লড়াই তাদের নিজেদের সঙ্গে। সামন্ততন্ত্রের শক্তি দিয়ে কি আর কর্পোরেট দৈত্যকে প্রতিহত করতে পারা যায়? সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে গেলে তাই সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিতে হবে এই লড়াইয়ে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। না হলে, এ দেশের ফসল বিদেশে রফতানি করেই হোক বা লাগামহীন মজুতদারি করে, পুড়তে হবে আপামর জনগণকে। এটা অবশ্যম্ভাবী। তাই এখনই সর্বস্তরের কৃষক আন্দোলনের প্রতি সমবেদনা নয়, সর্বস্তরে সদর্থক সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি।

Thursday, 3 December 2020

ভোটের বাজার

জীবন-জীবিকার লড়াই’ই মূল কথা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

এ কথা বারবার বলার চেষ্টা করেছি, আমরা এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। পুরনো জমানার বহু কিছুকে পিছনে ফেলে আমরা এমন এক দুর্লভ ও নতুন জগতে প্রবেশ করছি যেখানে পদে পদে বিস্ময় আমাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। তা যেমন আমাদের কর্মজগতে, তেমনি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও।

এই মুহূর্তে আমাদের দেশে এক বিপুল সংখ্যক কৃষক দিল্লির চারপাশে অবরোধ তুলে দণ্ডায়মান। এই অবরোধের সামনে সরকার আপাতত ভীত ও বিব্রত। কারণ, করোনার সুযোগে দিল্লিশ্বর যে তিনটি কৃষি বিলকে তাড়াহুড়োয় আইনে পরিণত করেছে, আশঙ্কা, তার জন্য তাকে কঠিন মূল্য চুকোতে হবে। কৃষকেরা লম্বা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে সমবেত হয়েছেন। এ এক অনন্য নজির। এরই পাশাপাশি আগামী বছর বাংলা ও অসমে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়ে গেছে তোড়জোড়। এখন পর্যন্ত যতটা না এই নির্বাচন নিয়ে সাধারণজনের মধ্যে হৈচৈ দেখছি, ঠিক ততটাই মিডিয়াগুলি একেবারে সাজোসাজো রব শুরু করে দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ বোধহয়, শকিং নিউজ তৈরি না করতে পারলে আজকাল বাজারে কদর ও বাণিজ্য দুইই রসাতলে; পাশেই দাঁড়িয়ে সোশ্যাল মিডিয়া- যাদের দাপটে ও বহরে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ক্রমেই সংকুচিত। জনমত নির্মাণ ও তার হদিশ পাওয়ার রীতিনীতিই গেছে আমূল বদলে।

যখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়া দিল্লির বুকে কৃষক আন্দোলন নিয়ে ততটা উচ্চকিত ছিল না, বরং তার মধ্যে নানাবিধ ছিদ্র অন্বেষণে সদা ব্যগ্র, তখন সোশ্যাল মিডিয়ার হাত ধরে কৃষক জনতার আওয়াজ সারা দেশে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ফলে, এখন উপায়ন্তর না পেয়ে বড় মিডিয়াও কিছু কিছু বাস্তবতা দেখাতে বাধ্য হচ্ছে। সচেতন কৃষক জানেন এই বড় মিডিয়ার (তাঁদের ভাষায় ‘গোদি মিডিয়া’) পক্ষপাতদুষ্টতা ও কর্পোরেট হাউজের কাছে তাদের বাঁধা থাকার কথা, তাই কোনও কোনও মিডিয়াকে কোনওরকম বাইট দিতেও তাঁরা অপারগ। কিছু ক্ষেত্রে তো তাঁদের ‘গোদি মিডিয়া দূর হঠো’ বলে তাড়িয়ে দিতেও দেখা গেল। এই সবটা মিলিয়ে আগত কনকনে শীতে উত্তর ভারত এখন কৃষক অভ্যুত্থানের কলরবে সরগরম।

সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যখন এক সাংঘাতিক রাজনৈতিক আগ্রাসনে দেশিয় স্তরে বিরোধী রাজনীতির স্বর ক্রমেই বিলীয়মান ও কংগ্রেস নামক তথাকথিত জাতীয় দলটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত, তখন কিছু কিছু রাজ্যে অবশ্য নতুন মুদ্দা নিয়ে উঠে আসা কোনও কোনও শক্তি আশার আলো জাগাচ্ছে। যেমন, গত বিহার নির্বাচনে আমরা বলিষ্ঠ কিছু অন্যতর উদ্যোগ ও সফলতা প্রত্যক্ষ করলাম। তা ব্যতিরেকে কৃষকদের এই মহাজাগরণ এক নতুন রাজনৈতিক অভিঘাতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। কথাই ছিল, যদি শ্রমজীবী মানুষ সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ না হন তাহলে কোনও পরিবর্তনই সার্থক হতে পারে না। শুধু পরিবর্তন বা সার্থকতা বলি কেন, বলা ভাল, কোনও সদর্থক অভিমুখ বা অর্থপূর্ণ আলোড়নও তৈরি হয় না।

এই আবহেই এ রাজ্যে আগামী ছ’ মাসের মধ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে এক বাড়াবাড়ি রকমের সোরগোল পড়ে গেছে। সোরগোলটা যতটা না রাজনৈতিক দলগুলি ও তাদের অনুগামী এবং মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার মধ্যে ততটা আমজনতার মধ্যে এখনও নয়। তার কারণও আছে। ‘চালাকচতুর’ বা ‘সেয়ানা’ পদবাচ্যটি এখন অনেকেই জনসাধারণের মতিগতি বোঝাতে আকছার ব্যবহার করে ফেলেন। তা মন্দ করেন না। এটা বাস্তব, দশ ঘাটের জল খেয়ে আমার-আপনার মতো নিতান্তই সাধারণ মানুষেরা রাজনৈতিক দলগুলিকে পালটা ব্যবহারের কৌশলও বেশ রপ্ত করে ফেলেছেন। নির্বাচন যত এগিয়ে আসে, ততই যেন রাজনৈতিক দলগুলির আশঙ্কা ও টেনশন বাড়ে এবং সেই সুযোগে জনতাও একটা বাড়তি (মেকি হলেও) কদর পেতে থাকেন। এই রীতি এখন বেশ উপভোগ্য একটি ঘরানা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করেছে। আর তাই, ভাবেসাবে মনে হবে, জনতার যেন নির্বাচন নিয়ে তেমন কোনও মাথাব্যথা নেই আপাতত। হয়তো মাথাব্যথা আছে, কিন্তু তার প্রকাশ নেই তেমন। কারণ, আগেভাগে পক্ষপাতিত্ব বুঝিয়ে দিলে দরকষাকষির জোরটা কমে আসে যে! তাই নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই জনতা আরও নীরব (যা আসলে সরবতার ভাষা) ও ‘সেয়ানা’ হয়ে উঠবেন। ভারতীয় সংসদীয় ব্যবস্থায় এই রেওয়াজটি এখন বেশ পরিপক্ক।

অতএব, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে জনগণ খুব মোহগ্রস্ত হয়ে বা ভুল বুঝে নির্বাচনী যুদ্ধে আজকাল এমন এক রাজনৈতিক শক্তির পক্ষ নিচ্ছে যা অতি-বিপর্যয়ের সমার্থক। রাজনৈতিক শক্তি চয়নের প্রশ্নে জনগণ অতীব সজাগ এবং যা হচ্ছে, আমি অন্তত তার মধ্যে জনগণের দিক থেকে তেমন কোনও মূঢ়তার চিহ্ন দেখি না। অবশ্য, এই চয়নের মধ্য দিয়ে যে ভয়ঙ্কর বিপদ ও পশ্চাদপদতার রাজনীতি ও অর্থনীতি ক্রমেই জীবন-জীবিকার অঙ্গনকে চেপে ধরছে, সে কথাও ধীরে ধীরে জনগণ বুঝছেন। কিন্তু এমন এক চয়নে তাঁরা প্ররোচিত হয়েছেন মূলত দুটি কারণে: ১) পুরনো জমানার তথাকথিত উদারবাদের কালে মানুষের বেঁচেবর্তে থাকার শর্তগুলি এতটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল যে অন্য এক পথ, মত বা রাজনৈতিক আধারকে চয়ন করার এক ধরনের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছিল; ২) রক্ষণশীল শক্তির উত্থাপিত নতুন বিচার-বিশ্লেষণগুলি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে স্পর্শ করেছিল। এই দুই মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বের অন্যত্র বিপজ্জনক রক্ষণশীলেরা ও এ দেশে হিন্দুত্ববাদী শক্তি একটা বড় পরিসর জুড়ে ক্ষমতাকে বিস্তৃত করতে পেরেছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে এই ক্ষমতা অটুট ও স্থায়ী। ইতিমধ্যেই তার জানান পাওয়া যাচ্ছে এবং অবস্থা ও পরিস্থিতির নিরিখে মানুষও উপযুক্ত জবাব দিচ্ছেন। আদপে বিষয়টি নির্ভর করছে- আপাত ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে এবং জনতার চাপে ও তার প্রতি দায়বদ্ধতার গুরুত্ব বুঝে এমন কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি নিজেকে ইতিবাচক অর্থে তুলে ধরতে পারে তাহলে তার দিকে চয়নের অভিমুখ অবশ্যই ঘুরছে। এটাই তো গণতন্ত্রের বনিয়াদ, সে যত আংশিকই হোক না কেন! অর্থাৎ, ইভিএমে কারচুপি বা জনতার নির্বুদ্ধিতা- এইসবকে কারণ না ভেবে নিজেদের গাফিলতি ও ভ্রান্তির দিকে তাকানোটাই প্রাজ্ঞজনের কাজ। যদি কংগ্রেস মনে করে থাকে, তার সর্বোচ্চ নেতার নিছক কিছু ট্যুইটে জনতা আশ্বস্ত হয়ে তাদের দিকে ঝুঁকবে, তা শুধু রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক নয়, চরম আত্মঘাতী। আর সে আত্মঘাতের পরিচয় আমরা পাচ্ছিও। কথায় বলে, ‘চোরায় না শোনে ধর্মের বাণী’।

ফলত, পশ্চিমবঙ্গে আপাত যে আবহ তৈরি হয়েছে, সেখানে এই মুহূর্তে মিডিয়ার দাপাদাপি ও রাজনৈতিক দলগুলির অতি-সক্রিয়তা প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তারই এক অন্যতম অভিব্যক্তি ‘দুয়ারে প্রশাসন’ মারফত জনতার দরবারে পৌঁছনোর প্রয়াস। এ তো ভাল কথা। ভোটের ভয়ে যদি সরকারগুলি আরও বেশি বেশি সদর্থক হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, সে তো মন্দের হলেও ভাল। গণতন্ত্রের পোয়াবারো। বিপরীত দিকে বিরোধী দলগুলিও অভাব-অভিযোগের কথা তুলে সরগরম। মিডিয়াও এই আবহের উত্তেজনা ধরতে, দেখা গেল, এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের চাওয়া-পাওয়া, তাঁর দলবদলের টানাপোড়েন, এই আছি এই নেইয়ের অতি-নাটকীয়তায় একেবারে স্বপনকুমারের রহস্য-রোমাঞ্চের মশলা নিয়ে আসরে হাজির। হয়তো উপভোগ্যতার বিচারে তার কদর জুটছে, টিভিওয়ালাদের টিআরপি’ও উঠছে, কিন্তু জনতা আসলে কী ভাবছেন, তার নাগাল পাওয়া অত সহজ নয় আর। তাই কি এত নাচনকুদন!

কিন্তু জনতারও নানারকম ভাবনা আছে। সকলেই জানি, সবটা পেরিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যে দল বা জোটকে ভোট দেবেন তাদেরই জয়। কোন মুদ্দাগুলি এবারে প্রধান হবে, কোন বিষয়গুলিকে মানুষ অগ্রাধিকারে রাখতে চাইবেন- রক্ষণশীলদের হিন্দু-মুসলমান বাইনারি নাকি উদারবাদী ও বামপন্থীদের অর্থনৈতিক-সামাজিক দাবি-দাওয়া- তা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নানান ওঠাপড়ার পর এ রাজ্যে দ্বন্দ্বটা আজ অনেকটা এসে দাঁড়িয়েছে দুই বিপরীত ধারণার মধ্যে: একদিকে গত ছ’ বছরে রক্ষণশীলদের শাসনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জাতীয় বিপর্যয় আর অন্যদিকে বিরুদ্ধবাদী এখানকার স্থানীয় শক্তিগুলি কী সমস্যা-সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়িয়ে। এই পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিতে জমায়েত হওয়া কৃষকেরা অবিচারের বিপক্ষে যে দুর্দমনীয় প্রতিরোধের দেওয়াল তুলেছেন তা এক অন্য মৌলিক তাৎপর্যের দিকে ভারতীয় রাজনীতিকে আকর্ষিত করছে। ক্রমেই অর্থনৈতিক মুদ্দাগুলি আবারও আলোচনার প্রাণকেন্দ্রে ফিরে আসছে। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনগুলি আরও জোরদার হচ্ছে। এই সম্ভাবনাগুলি থেকে মুখ ফিরিয়ে যে সমস্ত চিন্তাবিদেরা (ডান-বাম যাই হোক) এখুনি এ রাজ্যে এ জোট সে জোটের আঙ্কিক বিশ্লেষণে মুখ গুঁজে আছেন ও হঠাৎ হঠাৎ নানারকম নিদান হাঁকছেন, তাঁদের দিনও সমাগত প্রায়। কারণ, জনতা নানাবিধ জোটের ম্যাজিকে ভরসা রাখছেন না, খুঁজছেন নিজেদের রুটি, রুজি ও আশ্রয়ের বাস্তবস্থল। এই পরিসরেই এবারে রাজনৈতিক দলগুলিকে নিদারুণ পরীক্ষা দিতে হবে।    

Tuesday, 1 December 2020

দেশ যখন বিপন্ন

কৃষি ও কৃষক বনাম সরকার ও কর্পোরেট

সোমনাথ গুহ


রাজধানী দিল্লির চারপাশ এখন এক আন্তর্জাতিক সীমান্তের রূপ নিয়েছে। হাজারো কৃষক শহরের বাইরে অপেক্ষায়। রাজধানীতে ঢোকার প্রবেশপথ ব্যারিকেড করে রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হরিয়ানা সরকারের যাবতীয় দমনমূলক পদক্ষেপ-- জলকামান, কাঁদানে গ্যাস, ব্যারিকেড, কাঁটাতার, পুলিশি নিপীড়ন, হাইওয়ের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে ট্র্যাফিক জ্যাম করা-- কোনও কিছুই কিষাণদের দিল্লি অভিযান বন্ধ করতে পারেনি। পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকদের কাছে এ এক মরণপণ লড়াই। কয়েক দশক ধরে কৃষিতে আয় ক্রমাগত নিম্নমুখি সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে প্রণয়ন করা তিনটি নতুন কৃষি আইন এই সংকটকে আরও ঘনীভুত করেছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় কৃষিতে ক্রয়বিক্রয়, বিলিবন্টন এবং সামগ্রিক পরিকাঠামোয় অনেক গলদ ছিল কিন্তু সেটাকে সংস্কারের নামে পুরো ব্যবস্থাটাই বাতিল করে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বিপুল, বিশাল কৃষিক্ষেত্রকে বাজার ও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া মনস্থ করেছে।

বাস্তবে এই তিনটি কৃষি আইন শুধু কৃষিজীবী নয় সমগ্র সমাজের জন্য অতি বিপজ্জনক। একটি আইনে বলা হচ্ছে ‘এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটিং কমিটি’ (APMC) চালিত যে কয়েক হাজার মান্ডি ছিল সেগুলি ব্যতিত রাজ্যের মধ্যে বা বাইরে সর্বত্র কৃষক ফসল বিক্রি করতে পারবেসরকারের যুক্তি, এর ফলে একজন কৃষককে নিকটবর্তী মান্ডিতেই যেতে হবে এরকম কোনও বাধ্যবাধকতা থাকবে নাতিনি স্বাধীন, তাঁর পছন্দমতো যে কোনও জায়গায় তিনি ফসল বিক্রি করতে পারবেনদ্বিতীয় যুক্তি, ফড়েদের দাপট থেকে চাষিরা মুক্তি পাবেনএছাড়া প্রধানমন্ত্রী বলছেন, সারা দেশই এখন একটা মান্ডি হয়ে যাবে- এক দেশ, এক মান্ডি। 

কৃষকদের বক্তব্য, ১৯৭৬ সাল থেকেই চাষিরা ভৌগোলিক বিধিনিষেধ থেকে মুক্ত, বিজেপি সরকার নতুন কিছু করেনি এই বিধিনিষেধ বাতিল করার লক্ষ্যে ঐ বছর ব্যাপক আন্দোলন হয় যা আদালত অবধি গড়ায়। নভেম্বর মাসে হাইকোর্ট রায় দেয় যে দেশের যে কোনও অঞ্চলে কৃষক তাঁর ফসল বিক্রি করতে পারেন, সরকার তাঁকে বাধা দিতে পারে না। পাঞ্জাবের চাষিরা ফড়ে বা ‘বিচোরিয়া’র অস্তিত্ব স্বীকার করছেন। কিন্তু তাঁরা বলছেন, এঁরা পরিষেবা প্রদানকারী (service provider), যাঁরা চাষিকে ট্র্যাকটারে ফসল তুলতে, নামাতে, গাড়ি পরিষ্কার করতে, মান্ডিতে দরাদরি ইত্যাদি বহুবিধ ভাবে সাহায্য করে। এই পরিষেবা প্রদান করতে তাঁরা পারিশ্রমিক নেন, যেটা অযৌক্তিক কিছু নয়। কিন্তু এটা একটা দৃষ্টিভঙ্গি। একই সাথে এটা অনস্বীকার্য যে ফড়েদের দৌরাত্ম্য আছে। চাষিদের নানা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁরা তাঁদের নিম্নমূল্যে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য করেনভালো দাম পাওয়ার জন্য ছোট, মধ্য চাষি ফড়ের ওপর নির্ভরশীল। তাই চাষি আর ফড়ের মধ্যে একটা টানাপোড়েনের সম্পর্ক তৈরি হয়। ফড়ে তাঁকে বঞ্চিত করছে এটা জানা সত্ত্বেও চাষি চায় না যে তাঁর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হোক। কৃষি বাজার কর্পোরেটদের হাতে চলে গেলেও ফড়ে থাকবে কারণ এটা ভাবাই যায় না যে একজন ছোট চাষি দূরদূরান্তের একটি গ্রাম থেকে কোম্পানির ঝাঁ চকচকে অফিসে নিজে ফসল বিক্রি করতে যাবেন। তখন হয়তো ফড়ের নামকরণ হবে এজেন্ট যে চাষির ঘরে গিয়ে তাঁর ফসল কিনে নেবে। সরাসরি বিক্রি করতে পারলে চাষি হয়তো পেতেন ১৫০০ টাকা, এজেন্টকে দিলে পাবেন ১২০০ টাকা। ফড়ে/এজেন্ট আগেও ছিল, নতুন ব্যবস্থাতেও থাকবে। ফড়েরাজ তুলে দিলাম এটা বুক ঠুকে না বলে এই ব্যবস্থাটাকেই কৃষকের পক্ষে কী করে আরও সহায়ক করে তোলা যায় সেটা ভাবতে হবে, পুরোটাই বাতিল করে দেওয়া কোনও কাজের কথা নয়। আর ‘এক দেশ এক মান্ডি’র জায়গায় এখন তৈরি হবে ‘এক দেশ দুই মান্ডি’। দ্বিতীয়টি হবে কর্পোরেট চালিত, যা তাদের বিশাল ধনরাশির জোর, বিপুল প্রতিপত্তি, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে পুরো কৃষি বাজার দখল নিয়ে নেবে; সরকারি মান্ডিগুলি গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে, যেভাবে বেসরকারি প্রতিদ্বন্দ্বীদের একচেটিয়া সুবিধা, সরকারি আনুকূল্যের ফলে বিএসএনএল, এয়ার ইন্ডিয়া প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। মান্ডি ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে এফসিআই'এর গুদামে আর শস্য উপচে পড়বে না, রেশন ব্যবস্থা, মিড-ডে-মিল বিঘ্নিত হবে, খাদ্য নিরাপত্তা বিপন্ন হবে। অদূর ভবিষ্যতে ভারত হয়তো একটি খাদ্য আমদানিকারি দেশে পরিণত হবে। তাই আবারও বলা দরকার, এটা শুধুমাত্র কৃষকের সমস্যা নয়, সমগ্র সমাজের সমস্যা।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যর (এমএসপি) ওপর স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্ট গত ২০০৬ সাল থেকে সংসদে পড়ে আছে। এতে প্রস্তাব আছে যে ফসল উৎপাদনের খরচের ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করে এমএসপি নির্ধারণ করা প্রয়োজন। গত চোদ্দ বছরে কোনও সরকারই এটি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি, এদিকে ইউএপিএ'র মতো দানবীয় আইন কয়েক মিনিটে সংসদে পাস হয়ে গেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ক্ষমতায় এলেই তারা কমিটির সুপারিশ কার্যকর করবে। ২০১৫ সালে তারা বলল, খরচার ওপর ৫০ শতাংশ যোগ করলে তা বাজার দরের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। সেই ক্ষতিকর প্রভাবটি যে কী তার কোনও ব্যাখ্যা নেই২০১৬তে কৃষিমন্ত্রী সরাসরি অস্বীকার করেন যে এই ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ২০১৮ সালে এমনটাও দাবি করা হয় যে সুপারিশ কার্যকর করা হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ২০১৭র অক্টোবরে মধ্যপ্রদেশের চাষিরা এমএসপির দাবিতে বিক্ষোভ শুরু করলেন। মন্দাসোরে পাঁচজন কৃষক পুলিশের গুলিতে নিহত হলেন। চাষিদের ক্ষোভ প্রশমিত করতে এমপি সরকার ‘ভাবান্তর ভারপাই যোজনা’ নামক একটা স্কিম আনল যাতে চাষি যে দামে ফসল বিক্রি করছেন তার সাথে এমএসপি'র যা ফারাক সেই টাকাটা সরকার চাষিকে দিয়ে দেবে। কেন্দ্রীয় সরকার স্বামীনাথন কমিটির রিপোর্টের পরিবর্তে এই যোজনার গুণগান শুরু করল। কয়েক মাস বাদেই নাসিক থেকে মুম্বাই সেই বিখ্যাত পদযাত্রা দেশ প্রত্যক্ষ করল যখন মুম্বাই শহরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ-- চিকিৎসক, আইনজীবী, ছাত্র-যুব-- কৃষকদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়ালসেখানেও এমএসপি কার্যকর করা ছিল অন্যতম দাবি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এমএসপি নিয়ে কৃষক সমাজ বারবার সরব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলছেন এমএসপি থাকবে, কিন্তু আইনে কোথাও তার উল্লেখ নেই। কৃষকদের ন্যায্য দাবি এমএসপি যে থাকবে এটা আইনে লিপিবদ্ধ করতে হবে।

একটি সংবাদপত্র লিখছে যে চতুর্থ একটি আইন করে দাও যাতে এমএসপি যে বহাল থাকবে এটা নির্দিষ্ট ভাবে বলে দেওয়া হবে, এতেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেনা, শুধুমাত্র এটুকুতেই যদি আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে সেটা মস্ত ভুল হবে। কৃষি রাজ্য ও কেন্দ্রের সম্পর্কে যৌথ তালিকায় পড়ে। রাজ্য সরকারগুলির সাথে কোনওরকম আলোচনা না করেই বিজেপি সরকার এই আইন প্রণয়ন করে ফেডারাল ব্যবস্থাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। এদের সাথে কোনও আলোচনা না করে অত্যাবশ্যক পণ্য আইন তারা বাতিল করেছে। ২৩টা পণ্যের দাম (চাল, ডাল, গম, দানাশস্য, ভোজ্য তেল, আলু, পেঁয়াজ ইত্যাদি) এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত যার অন্যথা হলে রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করতে পারত। এখন সরকার নিজেই ব্যবসায়ীদের বলে দিচ্ছে যে তারা ৫০ শতাংশ অবধি দাম বাড়াতে পারে, সরকার কোনও হস্তক্ষেপ করবে না। এর অর্থ, সরকার ব্যবসায়ীদের অনুকূলে আইন প্রণয়ন করছে। আমরা অধিক মূল্যে আলু পেঁয়াজ কিনতেই থাকব যতদিন না তার যা মূল্য হওয়া উচিত তার ৫০ শতাংশ তা না বাড়ছে।

এই আইনের ফলে চুক্তি চাষ মান্যতা পেল। যে চাষি কয়েক পুরুষ ধরে জমিতে ধান চাষ করতেন তিনি এখন কোনও ধনকুবেরের উস্কানিতে লোভে পড়ে তামাক চাষে নেমে পড়বেন। প্রথম কয়েক বছর তাঁর তিন চার গুণ লাভ হতে থাকবেচাষি বেজায় খুশি হবেন, সংসার দিনে দিনে সচ্ছল হবেএক দশক বাদেই দেখা যাবে ফলন ক্রমশ কম হচ্ছে, যথেচ্ছ সার, কীটনাশক দিয়েও উর্বরতা বাড়ানো যাচ্ছে না। সবুজ বিপ্লবের খোয়াব কেটে যাওয়ার পর পরবর্তী কয়েক দশকে এইরকম বহু উদাহরণ দেখা গেছে এবং এখনও দেখা যাচ্ছে। সেই কুফলের কারণে ভারতের কৃষি এখনও ধুঁকছে। পরম্পরাগত চাষ থেকে বিচ্যুত হয়ে অর্থকরী ফসলে ঝুঁকে পড়ার কারণে বহু জায়গায় কয়েক শতাব্দী ধরে গড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে, পরিবেশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। নতুন শস্য চাষ করার ফলে জলসংকট দেখা গেছে, মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ অঞ্চল তুলা চাষের কারণে এই সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, বহু কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। চাষের উপকরণের প্রায় সব কিছুই বহুজাতিক সংস্থাগুলি নিয়ন্ত্রণ করে। তাই এটা আশ্চর্য হওয়ার কিছু নয় যে চাষের খরচ গত এক দশকে ৩০০ শতাংশ থেকে ৫০০ শতাংশ বেড়ে গেছে, কৃষি অলাভজনক হয়ে পড়েছে। চাষি চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কারণে বা ঋণগ্রস্ত হওয়ার ফলে তুলো বা সয়াবিন ছেড়ে অন্য কোনও শস্য চাষে সরতে পারছে না। এর ফলে গ্রাম শহর থেকে ব্যাপক মানুষ পুনে, মুম্বাই এবং অন্যান্য শহরে আশ্রয় নিচ্ছে। সমাজ, পরিবার ভেঙে পড়ছে।

এটাই তো লক্ষ্য! কৃষিকে অলাভজনক করে দাও যাতে তারা অন্য পেশায় চলে যায়। কৃষির ওপর নির্ভরশীল মানুষ কমিয়ে আনো যাতে পুরো কৃষিব্যবস্থা কর্পোরেটদের মৃগয়াক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে অন্য পেশা আর কোথায়? তাই অনিবার্যভাবে দরিদ্র থেকে সচ্ছল, সব ধরনের কৃষক এই ব্যবস্থায় গ্রাম-শহরে বিশাল বিপুল বাইবেলিয় এক অদৃশ্যপ্রায় মজুর বাহিনী হয়ে বিচরণ করবে।