Pages

Wednesday, 19 August 2020

প্রবঞ্চনার রাজনীতি

ফেসবুকের ছলচাতুরি

সোমনাথ গুহ

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না ফেসবুকের। গত কয়েক বছর ধরে পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ জমা হয়ে রয়েছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে। ভুয়ো খবর ছড়ানো, হিংসা উদ্রেক করা পোস্ট না সরানো, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ ইত্যাদি নানা নালিশ বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে। কয়েক দিন আগে আমেরিকার ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’এর একটি প্রতিবেদন সাড়া ফেলে দিয়েছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক মহলে। অভিযোগ গুরুতর। ফেসবুক নাকি ব্যবসায়িক সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে শাসক দল বিজেপির প্রতি গত কয়েক বছর ধরে পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করছে। সংস্থার কর্মীদের অভিযোগ, শাসক দলের তিনজন নেতার হিংসাত্মক ঘৃণা-প্রচার সত্ত্বেও ফেসবুক থেকে তাঁদের বহিষ্কারের কোনও পদক্ষেপ নেওয়া দূরের কথা, তাঁদের বক্তব্য ভিডিও প্ল্যাটফর্ম থেকে সরিয়েও ফেলা হয়নি। রোহিঙ্গা মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে অত্যন্ত বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করার জন্য তেলেঙ্গানার একজন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এই কর্মীরা মনে করেন, এই ধরনের মন্তব্য বিস্ফোরক যা বাস্তব জীবনে হিংসা সৃষ্টি করতে পারে। একই অভিযোগের কারণে আমেরিকায় রেডিও উপস্থাপক অ্যালেক্স জোন্স, ‘নেশন অফ ইসলাম’এর নেতা লুই ফারাখান, শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠীর সদস্য রিচার্ড স্পেন্সার এবং কতিপয় উগ্র শ্বেতাঙ্গ সংগঠনকে ফেসবুক থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে।

আরেক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ‘করোনা-জিহাদ’, ‘লাভ-জিহাদ’ ইত্যাদি উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত শব্দবন্ধ প্রচার করার জন্য ধারাবাহিক ভাবে ফেসবুককে ব্যবহার করেছেন। দিল্লি দাঙ্গার নেপথ্যের কারণ হিসাবে একজন বিজেপি নেতার উস্কানিমূলক বক্তব্য ও হুমকিকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ, পূর্ব দিল্লিতে আয়োজিত ওনার সভার পরেই অঞ্চলে ব্যাপক হিংসা ও লুঠতরাজ ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ফেসবুক এঁদের কারও বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এছাড়াও অভিযোগ, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইন সংশোধন করতে ফেসবুক উল্লেখজনক ভূমিকা নিয়েছে। সংস্থার এক প্রাক্তনী ও কর্মীরা এর জন্য ভারতে ফেসবুকের পাবলিক পলিসির উচ্চতম আধিকারিক আঁখি দাসের দিকে আঙুল তুলেছেন। ওনার সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতা সুবিদিত। তিনি নাকি এই নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণের বিরোধিতা করেছেন কারণ শাসক দলের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ ভারতে ফেসবুকের ব্যবসা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে হানিকর হবে। মনে রাখা ভালো, ব্যবহারকারীর সংখ্যার হিসাবে (৩০ কোটি) ভারত ফেসবুকের সবচেয়ে বড় বাজার। সম্প্রতি এই সংস্থা জিও নেটওয়ার্কে ৫.৭ বিলিয়ান ডলার বিনিয়োগ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে হোয়াটস অ্যাপ পেমেন্ট চালু করার প্রস্তাব দু' বছর ধরে পড়ে আছে। সুতরাং, ব্যবসায়িক স্বার্থ যে ফেসবুকের পায়ে বেড়ি পড়িয়ে দিয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।   

ফেসবুকের বদনাম শুরু মূলত ২০১৬ সালে আমেরিকার নির্বাচনের পর থেকে। অভিযোগ ‘ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা’ নামক সংস্থা ফেসবুকে বহু লক্ষ ভুয়ো প্রতিকৃতি তৈরি করে নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিততে সাহায্য করে। ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার মালিক রবার্ট মার্সার ট্রাম্পের নির্বাচন তহবিলে অন্যতম বিনিয়োগকারী। আমেরিকার সেনেটের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতানোর এই পরিকল্পনায় রাশিয়ারও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বলাই বাহুল্য, ফেসবুক ট্রাম্পের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট এটা প্রমাণিত হয়েছে। সংস্থার কর্মীরা যখন বিভাজনকারী মন্তব্যে রাশ টানার চেষ্টা করেছে, ফেসবুকের স্বয়ংক্রিয় অ্যালগরিদম তাতে বাধা দিয়েছে। ট্রাম্প যখন হুমকি দিয়েছেন প্রতিবাদে অংশগ্রহণকারীদের গুলি করা হতে পারে তখন সমালোচনার ঝড় ওঠা সত্ত্বেও ফেসবুক সেই মন্তব্য সরিয়ে দেয়নি। একই ভাবে আমাদের দেশে ফেসবুকের অ্যালগরিদম বিজেপি বিরোধী পোস্ট বাতিল করেছে। এই সব কারণে কিছু বিখ্যাত কোম্পানি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করেছে।

বিভিন্ন দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী ফেসবুক তার নীতি নিয়মাবলী ঠিক করে। যেমন জার্মানিতে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের ক্ষেত্রে সংস্থার মনোভাব আমেরিকার থেকে অনেক কড়া। সিঙ্গাপুরে সেখানকার সরকার যদি কোনও ভুয়ো খবর নজরে আনে তাহলে সংস্থা সঙ্গে সঙ্গে সংশোধনী প্রচারের ব্যবস্থা করে। ভিয়েতনামে সরকারের চাপে বিক্ষুব্ধদের রাজনৈতিক প্রচারে বাধা সৃষ্টি করে আবার তার পরিবর্তে ফেসবুকের স্থানীয় সার্ভারে যে বিঘ্ন ঘটানো হত সেটার মোকাবিলা করে

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’এ ভারত সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর তেলেঙ্গানার জনপ্রতিনিধির কিছু মন্তব্য সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফেসবুক দ্বারা অনুমোদিত কোনও একাউন্ট তিনি খুলতে পারবেন না। করোনা-জিহাদ নিয়ে যিনি প্রচার করেছিলেন তাঁর টুইটার একাউন্ট মুলতুবি রাখা হয়েছিল। ফেসবুকে তাঁর একাউন্ট এখনও চালু যদিও কিছু মন্তব্য মুছে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির নেতা যাঁর বক্তব্যের ফলে দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছিল বলে অভিযোগ, তাঁকে নিয়ে ফেসবুকের কর্ণধার মার্ক জাকেরবার্গ নিজে একটি সভায় উষ্মা প্রকাশ করেন যার ফলে সেই পোস্ট এবং ভিডিও মুছে ফেলা হয়। কিন্তু ততদিনে যা ক্ষতি হবার হয়ে গেছে। উল্লেখযোগ্য যে, শুধু ওই মন্তব্যের কারণে ওই নেতার ফেসবুক পাতায় অংশগ্রহণ লাখ দুয়েক থেকে এক লাফে পঁচিশ লাখ পেরিয়ে যায়।  

মার্ক জাকারবার্গ ধোয়া তুলসিপাতা নন। আর সব ধনকুবের, অতিকায় কর্পোরেটের মতো তাঁরও লক্ষ্য মুনাফা, আরও মুনাফা। ঠিক এই কারণেই তাঁর সংস্থা ইদানিং যে সব কলঙ্কে জর্জরিত হয়েছে তা 'তিনি প্রশমিত করতে চান'। ২০১৯'এর এপ্রিল মাসে য়ুভাল নোয়া হারারির সঙ্গে একটি কথোপকথনে তিনি কর্তৃত্ববাদী সরকারের সাথে ব্যবসা করার নানা অসুবিধার কথা ব্যক্ত করেছেন। এই সব সরকার তাদের দেশের মানুষের তথ্যসম্ভারের নাগাল পেতে চায়; তারা গোপনীয়তা সংক্রান্ত নিয়মাবলী একেবারেই মানতে চায় না; কিছু দেশে অত্যন্ত কড়া সেন্সরশিপ আইন। সম্প্রতি মার্কিন হাউস জুডিসিয়ারি কমিটির অ্যান্টি-ট্রাস্ট সাব-কমিটির শুনানিতে তিনি স্বীকার করেছেন, ভুয়ো খবর আটকানোর জন্য তাদের নিয়মকানুনে অনেক ফাঁক আছে। তিনি বলেন, ভুয়ো খবর, ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা, ঘৃণা-প্রচার, হিংসা-উদ্রেককারী মন্তব্য এইসব রোধ করার জন্য তাঁর সংস্থা অবিরাম চেষ্টা চালাচ্ছে। জাকারবার্গ মনে করেন যে হিংসা, উগ্রবাদী মন্তব্য, কার্যকলাপ এই সব রোধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। তাই তিনি বড়াই করেন তাঁর সংস্থার বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ ছোট উদ্যোগপতিদের তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। হারারি তাঁকে মনে করিয়ে দেন, নাৎসি জার্মানিতে শিক্ষিত জার্মানরাই হিটলারকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর নিজের দেশ ইজরায়েলে নাগরিকদের যে ভাবে নজরবন্দি রাখা হয় তার জুড়ি মেলা ভার। তারা এই প্রযুক্তি অন্যান্য দেশে রফতানি করে অথচ ইজরায়েল বিশ্বের একটি অন্যতম উন্নত দেশ।

বলাই বাহুল্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এমন একটা তরবারি যা দু দিকেই কাটে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূর-দূরান্তের মানুষের সঙ্গে সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য গড়ে তোলা যেমন সহজ ঠিক তেমনই হিংসা, বিদ্বেষ, বিভাজন ছড়ানোও একই ভাবে সহজ। ঘটনা হচ্ছে, যারা হিংসা, অরাজকতা ছড়াতে চায় তারা অনেক বেশি সংঘটিত, তাদের বিপুল কর্মী বাহিনী আছে যারা ভুয়ো খবর, ফটোশপ করা ছবি, ভিডিও ইত্যাদি প্রচার করাতে অনেক বেশি দক্ষ। তাদের নেতানেত্রী, সংগঠনের অনুসরণকারীর সংখ্যা বিরোধীদের চেয়ে বহু গুণ বেশি। এই অবস্থায় গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ নির্বাচনও আজ বিপন্ন। নব্য প্রযুক্তির সাহায্যে ভোটদান প্রক্রিয়ায় অন্তর্ঘাত করা সম্ভব, যা ফলাফল নির্ধারণে প্রভাব ফেলতে পারে। প্রযুক্তির এই অভাবনীয় উল্লম্ফন যেমন মানব সভ্যতার কাছে এক আশীর্বাদ তেমনই এই একই প্রযুক্তি বিশ্ব জুড়ে কর্তৃত্ববাদের আগমনকেও ত্বরান্বিত করতে পারে। এই পরিস্থিতিতে ফেসবুক, টুইটার, গুগল, অ্যাপেলের মতো তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের মহারথীদের ভূমিকা অপরিসীম। ইতিহাস তাঁদের কী ভাবে মনে রাখবে: তাঁরা যে প্রযুক্তিকে বিশ্বব্যাপী বিচ্ছুরণে সাহায্য করেছে তা কি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে কর্তৃত্ববাদের ধাত্রী হিসাবে প্রতিপন্ন হবে? 

 

No comments:

Post a Comment