Pages

Saturday, 1 August 2020

হঠাৎ পরিযায়ী!

তকমা নিয়ে হারিয়ে যাওয়া
সিদ্ধার্থ বসু

লকডাউন পর্বে একটা শব্দ সশব্দে উচ্চারিত হতে  শুরু  করে: পরিযায়ী। কারা পরিযায়ী?  না, যারা নিজ রাজ্যে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। ঘরে বসে তো মন্ত্রী সান্ত্রীদের ভাষণ শুনে পেট ভরবে না, তাই তারা কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। এতে অন্যায় কী? তবে সমস্যা দেখা দিল করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরই। করোনা আবহে সারা দেশ জানতে পারল, নিজ নিজ রাজ্য ছেড়ে কত শ্রমিক কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। যদিও তার সঠিক সংখ্যা যে ঠিক কত, এ কথা হলফ করে কেউ বলতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে সংখ্যাটা বিশাল। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে, রাজ্য জুড়ে ঢাক ঢোল পিটিয়ে কর্মসংস্থানের যে কথা বলা হয় তাতে কি এঁরা অংশীদার হতে পারেননি? কেন তাঁরা কাজ পাননি এই রাজ্যে? কাজ পাননি নাকি যে ঢাক বেজেছে সে কাজের ব্যবস্থা রাজ্যে আদৌ আছে কি? এ প্রশ্নই করোনা আবহে প্রকট হয়ে উঠেছে। যদি সত্যি নিজ রাজ্যে মানুষের হাতে কাজের সুযোগ থাকত তাহলে কি তাদের পরিবার পরিজনদের ঘরদোর ছেড়ে অন্য রাজ্যে ছুটে যেতে হত?

করোনা পরিস্থিতি এই সত্যের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাজ্যে কর্মহীন শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের পাশাপাশি অর্ধশিক্ষিতদের কাজের সন্ধানে অন্যত্র ছুটে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও যে বিপুল পরিমাণ তাও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই করোনা পরিস্থিতি। এটা স্বীকার করা যে খুব সহজ তেমনটা নয়। কারণ, যদি চোখে দলীয় মতাদর্শের ঠুলি পরানো থাকে তবে একমাত্র পথ হচ্ছে বাস্তব পরিস্থিতিকে অস্বীকার করে বলে  ওঠা- সব ঠিক হ্যায়, অন্য রাজ্যের চেয়ে ভালো ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন থেকেই যায়- সত্যিটা চাপা দিয়ে কার ভালো হবে, রাজ্যবাসীর না রাজ্যের?

করোনা পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে 'পরিযায়ী' কথাটা চালু হলেও এর আগে কি এ নজির দেশে ছিল না? এ প্রশ্নটা বারবার মনে উঁকি দেয়। কারণ, আজ যাদের পরিযায়ী বলে সম্বোধন করা হচ্ছে তাদের কি এর আগেও পরিযায়ী বলে সম্বোধন করা হয়েছে? কুয়েত যুদ্ধের সময়ে সেখানে কর্মরত শ্রমিক ও কর্মচারীদের আমরা সেই সময়ে কী বলে ডেকেছি? অবশ্যই পরিযায়ী বলে নয়। তখন মিডিয়াও তাদের পরিযায়ী বলে চিহ্নিত করেনি। তাহলে কী বলা হত সে সময়ে? অবশ্য অনেকেরই স্মরণে থাকবে সেই সম্বোধন: উপসাগরীয় যুদ্ধে আটকে পড়া 'ভারতীয়'। তাদের তৎকালীন সরকার প্লেনে করে দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়।

যদিও তারা কিন্তু সত্যিই পরিযায়ী বা প্রবাসী ছিলেন। কিন্তু বলা হত, কুয়েতে কর্মরত ও বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিক। আর করোনা আবহে দেশের শ্রমিকদের বিশাল অংশ অসীম কষ্ট ও লাঞ্ছনা ভোগের পর নিজ নিজ রাজ্যে যারা শেষ অবধি ফিরতে পারলেন, তাঁরা কর্মহীন হয়ে গেলেন। আর বাকী অনেকেই লাইনের উপর ও রাস্তায় প্রাণ হারালেন। আমরা এসব কথা এক সময় হয়তো ভুলে যাব। ভোটের বাদ্যি বাজবে তখন আরও ভুলে যাবে সকলে। কিন্তু ইতিহাস মনে রাখবে, করোনা আবহে আমাদের দেশের এই শ্রমিকশ্রেণির অসহায় করুণ অবস্থার কথা। ঘরে আর তাদের ফেরা হল না। ঘরের মানুষ তাদের আর চোখের দেখাও দেখতে পেলেন না। তারা চিরকালের মতো হারিয়ে গেলেন 'পরিযায়ী শ্রমিক' তকমা নিয়ে।     

No comments:

Post a Comment