Pages

Monday, 15 June 2020

করোনা মাই!

অসহায় মানুষের উপায় কী!
সোমনাথ গুহ

লকডাউন শুরুর কয়েক দিন পরে এপ্রিলের দুই তারিখে ছিল রামনবমী। গত কয়েক বছর এই উৎসবটিকে ঘিরে বাংলায় তুলকালাম ঘটে গেছে। কে কত বড় রামভক্ত এই প্রতিযোগিতা দেখে মানুষ আতঙ্কিত হয়েছে আবার আমোদিতও হয়েছে। এবার কোভিড-১৯'এর প্রকোপের কারণে উৎসব অল্প কিছু জায়গায় সীমাবদ্ধ ও সংযত ছিল, লোকসমাগম কম, কোনও অস্ত্রের ঝনঝনানিও শোনা যায়নি। কিন্তু টিভিতে দেখা রামনবমীর টুকরো এক দৃশ্য মনের মধ্যে গেঁথে আছে। এক সাধারণ গৃহবধূ পুজো দিয়ে পুলিশের নজর এড়িয়ে ত্রস্তপদে ঘরে ফিরছেন। সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, এই লকডাউনের মধ্যে আপনি বাইরে বেরিয়েছেন? মহিলা নির্লিপ্ত ভাবে বলেন, লকডাউন আছে ঠিকই কিন্তু এই অসুখ থেকে মুক্তি পেতে ভগবানের কাছেও তো প্রার্থনা করতে হবে। মহিলা লকডাউন অস্বীকার করছেন না আবার ঈশ্বরে আস্থা রাখা জরুরি- এটাও মনে করছেন।

এই ছোট দৃশ্যটি বহুদিন আগে দেখা লুই বুনুয়েলের ‘নাজারিন’ ছবিটার কথা মনে পড়িয়ে দিল। চার্চ থেকে বিতাড়িত পাদরি নাজারিন এক জনপদ দিয়ে হাঁটছে। কয়েকজন শোকবিহ্বলা নারী তাকে এক কুটিরে নিয়ে যায় যেখানে এক মলিন শয্যায় শুয়ে আছে এক মুমূর্ষু শিশু। একে বাঁচাও পাদরি, যে ভাবে হোক একে বাঁচাও- তারা পাদরিকে কাতর অনুরোধ করে। পাদরি রুগিকে দেখেই বুঝতে পারে এখানে তার কিছু করার নেই, সে তার অক্ষমতা প্রকাশ করে। কিন্তু সেই নারীরা মানতে নারাজ- তুমি অলৌকিক কিছু কর, তোমার অলৌকিক কিছু করার ক্ষমতা আছে। নাজারিন তাদের হাত ছাড়িয়ে বাইরের দিকে প্রস্থান করে বলে, ওনলি গড অ্যান্ড সায়েন্স ক্যান হেল্প হার। একই সাথে ঈশ্বর ও বিজ্ঞানের এই অনায়াস উচ্চারণ তখন মনের মধ্যে নানা সংশয় তৈরি করেছিল।

এই বাংলা তো এক সময় বহু ব্যাধির পীঠস্থান ছিল- কলেরা, বসন্ত, কালাজ্বর, আমাশা, বিভিন্ন মশাবাহিত রোগ, আরও কত নাম না জানা জ্বর। কত মহামারি ঘটে গেছে যার খুব কমই ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয়েছে। একেকটা মারিতে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে, মানুষ সেটাকেই স্বাভাবিক জীবন হিসাবে মেনে নিয়েছে। কলেরা হলে মানুষ ওলাবিবি বা ওলাইচণ্ডির পুজো করত, বসন্ত রোগ হলে শীতলার, সাপে কামড়ালে মনসা, সন্তানের মঙ্গলের জন্য ষষ্ঠি। চব্বিশ পরগণায় জ্বরজারি হলে মানুষ জ্বরাসুরের পুজো করত। চিকিৎসাবিজ্ঞান তখন কোথায়? তার তখন কোনও ভূমিকাই ছিল না। সেবাই রোগ নিরাময়ের একমাত্র উপায় ছিল। মানুষ মনে করত, যে কোনও ব্যাধি ঈশ্বরের সৃষ্টি এবং একমাত্র ঈশ্বরই পারেন সবাইকে তা থেকে মুক্তি দিতে। বরং বেশির ভাগ মানুষ চিকিৎসা করার চেষ্টা করলে ভয়ে পালাত। ১৮৯৯'এর প্লেগের সময় সাহেবদের সাঙ্গোপাঙ্গোরা ছুঁচ ফোটাতে এলে লোকে ভেগে যেত, ভাবত ধর্মান্তকরণের চেষ্টা হচ্ছে। এটা শুধু বাংলা বা ভারতবর্ষের গল্প নয়।  ইংল্যান্ডে ১৬৬০'এর দশকের প্লেগ নিয়ে একটি দিনলিপি লিখেছিলেন ‘রবিনসন ক্রুসো’ খ্যাত ড্যানিয়েল ডিফো। বইটির নাম ‘জার্নাল অফ দ্য প্লেগ ইয়ারস’। এতে তিনি লিখছেন, যখন মারির প্রকোপে শহর (লন্ডন) প্রায় ধ্বংসের মুখে তখন ঈশ্বরের দয়া হল এবং তিনি যেন হাত বাড়িয়ে শত্রুকে নিরস্ত্র করলেন, হুল থেকে বিষ বার করে নিলেন, জনতা আনন্দে কেঁদে উঠল, ঈশ্বর করুণাময়!

য়ুভাল নোয়া হারারি বলছেন, করোনার প্রকোপের কারণে বিজ্ঞান আবার আলোচনায় ফিরে এসেছে; রাষ্ট্রনায়ক থেকে সাধারণ মানুষ সবাই আবার বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হচ্ছে। তিনি বলছেন, ইজরায়েলে সিনাগগ বন্ধ হয়ে গেছে, মুসলিমরা বাড়িতে নমাজ পড়ছেন, খ্রিশ্চানরা গীর্জায় না গিয়ে একান্তে প্রার্থনা করছেন। হারারি ভারতবর্ষ দেখেননি। সবাই নিশ্চয়ই অবগত আছেন এই রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ইদানিং করোনা পূজা হয়েছে। মহিলারা একদিন উপোস করেছেন, ফুল, মিষ্টি, শরবত দিয়ে দেবীর পুজো করেছেন, প্রসাদ বিতরণ করেছেন, শেষে সমস্ত পূজার সামগ্রী গর্ত করে পুঁতে দিয়েছেন। অসমের বিশ্বনাথ জেলায় নদীর পাড়ে করোনা দেবীর আরাধনা হয়েছে, ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ে হয়েছে। বিহারে প্রতি সোম, শুক্রবার করোনা মাইয়ের নিয়মিত পূজা হচ্ছে, ঝাড়খন্ডের রাঁচি, ধানবাদে হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশের কুশিনগরে মাটিতে গর্ত খুঁড়ে তাতে জল ভরে নয়টি লবঙ্গ ও লাড্ডু দিয়ে পূজা করা হচ্ছে। পাঠক আপনি হয়তো চোখ উল্টাচ্ছেন, গালি দিচ্ছেন যত্তসব কুসংস্কারের গপ্পো! মার্কস'এর ধর্ম নিয়ে মহা বিতর্কিত লেখা পড়াটড়া নেই এমনটা নয়, তবুও দুজন ভক্তের উক্তি ভাবায়। এক মহিলা বলছেন, ডাক্তার রুগীর চিকিৎসা করতে পারছে না, বৈজ্ঞানিকরা টিকা আবিষ্কার করতে পারছে না, তাহলে দেবীর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আর কী করার আছে? আরেকজন বলছেন, করোনা দেবী বাংলা, মহারাষ্ট্রে সাইক্লোন করে দিল, তাঁকে তো তুষ্ট করতেই হবে।

চিনের উহানে নভেল করোনাভাইরাস মানব শরীরে আক্রমণ করার খবর প্রকাশ্যে আসার পর ছয় মাস কেটে গেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও এই কীটাণুকীটের চালচলন বুঝে উঠতেই হিমশিম খাচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বহু আজেবাজে বকেন কিন্তু একটা কথা একদম ঠিক বলেছেন- হু নামক সংস্থাটির কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। আজ বলছে মাস্ক পরার কোনও প্রয়োজন নেই, কাল বলছে এটা আবশ্যিক। আজ বলছে উপসর্গহীন রুগীর থেকে সংক্রমণ বিরল, দুদিন বাদেই বলছে যা বলা হয়েছিল তা ঠিক নয়, বরং চল্লিশ শতাংশ সংক্রমণ এদের থেকেই ছড়ায়। বোঝো ঠ্যালা! হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে তো রীতিমতো নাটক হয়ে গেল। ট্রাম্প প্রবল উৎসাহ নিয়ে এই ট্যাবলেট ভারতের থেকে চাইলেন, না দিলে প্রত্যাঘাত করা হবে এমনটাও বলে বসলেন। সবাই ভাবল এটাই তবে সেই মহৌষধ যা করোনাকে মাত করবে! হু সম্মতি জানাল। কয়েক দিন বাদেই 'ল্যান্সেট' পত্রিকা, যার বিশ্বাসযোগ্যতা সর্বজনীন এবং সন্দেহাতীত, জানালো এই ট্যাবলেটের গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে। হু আবারও সম্মতি জানাল। অবিশ্বাস্য ভাবে 'ল্যান্সেট' আবার জানালো যে সমীক্ষার ভিত্তিতে তারা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, সেই সমীক্ষাটির অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল তাই সেই রিপোর্টটাই তারা বাতিল করেছে। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশ এর ব্যবহার বাতিল করেছে, কোথাও এটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে, কেউ আবার বলছে এটা রোগ প্রতিরোধের জন্য ভালো, নিরাময়ের জন্য নয়। কেউ বলছে, মলের মধ্যে দিয়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে, কেউ বলছে বীর্যর মাধ্যমেও ছড়াতে পারে।

টিকার জন্য সবাই হাপিত্যেশ করে বসে আছে। এইডস'এর প্রাদুর্ভাবের পর প্রায় চল্লিশ বছর হয়ে গেছে, সাড়ে তিন কোটি লোক মারা গেছে, এখনও তার কোনও টিকা বেরয়নি। করোনার তুতো ভাই সার্স, মার্সের কোনও টিকা বেরয়নি। ইবোলার একটা টিকা ইউরোপের একটি সংস্থার শংসাপত্র পেয়েছিল, কিন্তু এখনও সুদান, কঙ্গো, লাইবেরিয়াতে প্রতি বছর এই মারির প্রকোপে বহু লোক মারা যাচ্ছে। তাহলে করোনার টিকা পাওয়া যাবে এর কী নিশ্চয়তা আছে? একটা মতামত হচ্ছে, উহান থেকে বিশ্বভ্রমণের পথে এই ভাইরাসের চোদ্দবার পরিবর্তন (Mutation) হয়ে গেছে। আরেকটা মত হচ্ছে, এই ভাইরাসের উনত্রিশটি উপশ্রেণি (Genotype) আছে। সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় এই ধরনের ভ্যাকসিন কি আদৌ সম্ভব? কিন্তু তবুও তা বেরবে এবং লোকে হামলে পড়ে কিনবে। আদপে করোনা এখন অতিমুনাফার একটি ব্যবসা।

চূড়ান্ত বিভ্রান্তি এবং বিশৃঙ্খলা! এর ফলে মানুষ যদি দেবদেবীর শরণাপন্ন হয় তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। সবাই প্যানিক ছড়াতে আগ্রহী, সহজ কথাগুলো বলবে না। রোজ লেবু আর টম্যাটো খেলে শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে, সেটাই এই ভাইরাসকে আটকানোর সমাধান। প্রকৃতির ওপর প্রভুত্ব করা নয়, বুলডোজার চালানো নয়, প্রকৃতির সাথে বেঁধে বেঁধে থাকা- সেটাই এই গ্রহকে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করে তোলার একমাত্র উপায়।

No comments:

Post a Comment