Pages

Saturday, 18 April 2020

করোনার তেতো কথা

সরকারি পদক্ষেপের সমালোচনাও একপ্রকারের সহযোগিতা
অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
,
শিল্পী: ক্ষীরোদ বিহারী ঘোষ

মালোচনা সদর্থক হোক বা নিরর্থক- এ কথা মেনে নিতেই হবে যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় চিন্তাভাবনা সংক্রান্ত-সমালোচকও শাসকের সহকর্মী। দুনিয়াতে এমন মানুষ নেই যিনি ভাবছেন করোনা থেকে যাক, এ সভ্যতা শেষ হয়ে যাক। আমি নিহিলিস্টদের এ তালিকায় রাখছি না, কেননা সংখ্যাটা বিচারের সাপেক্ষে নগণ্য। এ কথা সত্য যে, করোনা ভাইরাসের উৎস-সন্ধান এখনও চলছে, সে সম্বন্ধে যুক্তির পরাকাষ্ঠায় নতজানু হয়ে বলার মতো সত্য আমাদের কাছে নেই। ফলে, কী কারণে ও কীভাবে এর উদ্ভব সে সব বিশ্লেষণের প্রশ্নই নেই। কী আছে তবে? আছে দুটো নিহিত মর্মবস্তু: এক, যতদিন না চিকিৎসা (ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি) আবিষ্কার হচ্ছে ততদিন অবধি যতটা সম্ভব মানুষজনকে আক্রান্ত হতে না দেওয়া– উপায় লকডাউন, সামাজিক দূরত্বের বিধিনিষেধ আরোপ ও সর্বোপরি র‍্যাপিড টেস্টের মাধ্যমে শনাক্তকরণ; দুই, প্রথমটির কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির মোকাবিলা।

যে সব তথ্য আমাদের সামনে আসছে তার মধ্যে অন্যতম হল- ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সব থেকে কম পরিমাণে টেস্টের সংখ্যা। তাহলে লকডাউনের মানে কী? শুধুমাত্র রেশন বিলি করে মানুষজনকে ঘরে আটকে রাখা? সেখানেও তো উঠছে হাজারও অভিযোগ। সাংসদ জন বার্লা প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ করেছেন যে আমাদের রাজ্যে এই দুর্দিনেও নাকি রেশন বন্টন নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলছে। অন্যদিকে টেস্ট বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য হল, ভারতে প্রতি মিলিয়ন জনসংখ্যায় ২৪৩টি (সূত্র: ওয়ার্ল্ডোমিটার )। ভারতবর্ষের ওপরে-নিচে যে দেশগুলি আছে তাদের একটিরও টেস্ট সংখ্যা প্রতি মিলিয়নে ১৮০০০-এর কমে নয়, এমনকি জনস্বার্থে প্রচারিত সর্বাধিক শত্রুদেশ পাকিস্তানে অবধি ৪১৯। আর পশ্চিমবঙ্গে দেশের মধ্যে সবচেয়ে কম- ৩৩.৭টি প্রতি মিলিয়নে (সূত্র: দ্য ওয়্যার ও নিউ-ইয়র্ক টাইমস)। এর মধ্যে, ১৯,০০০ ডাক্তারদের প্রতিনিধিত্বকারী পশ্চিমবঙ্গ ডাক্তার ফোরাব'এর ডাঃ অর্জুন দাশগুপ্ত বলেছেন, 'যদি আপনি কোভিড বলে কাওকে সন্দেহ করেন এবং নমুনাগুলি প্রেরণ করেন তবে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, অথবা তিন থেকে চার দিন পরে রিপোর্টটি আসছে।' (সূত্র: নিউ-ইয়র্ক টাইমস)। তদুপরি তথ্য গোপনের অভিযোগ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আরেকটা অশনি সংকেত।

কলকাতার একজন নেফ্রোলজিস্ট ডাঃ প্রতীম সেনগুপ্ত ফেসবুকে লিখেছেন যে, করোনাভাইরাস রোগীরা যখন শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যর্থতার লক্ষণ নিয়ে মারা যাচ্ছিল, তখনও কমিটি কোভিড১৯-কে মৃত্যুর কারণ হিসাবে উল্লেখ করেনি। সেনগুপ্ত আরও লিখেছিলেন, 'এটি সত্যের সাথে নির্লজ্জভাবে মিথ্যা খেলা'– এ বিষয়ে ফুসফুসের এক্স-রে এবং করোনা ভাইরাস রোগীর একটি সিটি স্ক্যান করে রেনাল ব্যর্থ হয়ে মারা গেছে বলে ঘোষণা করার একটি তথ্য উনি শেয়ার করেছিলেন (সূত্র: নিউ-ইয়র্ক টাইমস ১৪ এপ্রিল ২০২০)।  এসব বিষয় কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে বৈকি!

লকডাউনের অর্থই হচ্ছে পুরো দেশকে একটা বাক্সের মধ্যে পুরে, কতকগুলো ছোট-ছোট বাক্সে ভাগ করে স্ট্যাটিস্টিক্যালি সিগ্নিফিক্যান্ট লেভেলে স্যাম্পেলিং-এর ভিত্তিতে র‍্যাপিড টেস্টিং চালিয়ে দেশের মধ্যে করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত বিস্তার ও তার আদল জেনে ফেলা। তবেই আসবে মোকাবিলার স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন। অথচ এইখানেই প্রশ্ন উঠে আসে সামর্থ্যের। কিট নেই, ভেন্টিলেটর কম, হাসপাতাল নেই, ডাক্তার নেই, ল্যাব নেই ইত্যাদি নাকেকান্না। তাহলে সে প্রসঙ্গে আসবেই- দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অর্থনৈতিক অব্যবস্থার কথা, লাগামছাড়া বঞ্চনার কথা, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পরিকাঠামো উন্নয়নে ছিটেফোঁটা বরাদ্দের কথা, লকডাউনের মধ্যে আটকে যাওয়া অসংখ্য ভুখা মানুষের মধ্যে সচেতনতার সাড়া না পাওয়ার কারণ ইত্যাদির কথা। সুতরাং, সমালোচনা তো হবেই । আর তা না হলে এই পরিস্থিতি থেকে ভবিষ্যতের জন্য আমরা কী শিক্ষা নেব!

শিক্ষা নেবার বালাই তো নেইই, বরং সেই কেঁচে-গন্ডুষ করে একই ভুলের পুনরাবৃত্তির পরিকল্পনা। লকডাউনের ফলে দুনিয়া জুড়ে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তা আর কিছুই নয়, মোদ্দা কথায়, পুঁজিবাদের টিকে থাকার সংকট। আইএমএফ বলেছে, গ্রেট ডিপ্রেশন নয়, গ্রেট লকডাউন। তাতে কী! আরে তাতেই তো পুঁজিবাদের ঢাল জিডিপির ভিত্তিতে শুরু হয়ে গেছে হেলিকপ্টার ইকোনমির প্রস্তাব, বেইল-আউটের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি; যাতে কোনওভাবে বেনিয়াতন্ত্রের বিপদ না ঘটে। বিখ্যাত কিছু অর্থনীতিবিদ মৃদুস্বরে যে ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছেন তার নাম ঠারেঠোরে বললে কমিউনিজম। সুতরাং, করোনা পরিস্থিতি সামলে গেলে যেন আবার বিদ্রোহ-আন্দোলনের উপক্রম না হয় সে জন্য এখন থেকেই ঘুঁটি  সাজিয়ে রাখছে শীর্ষমহল। সুতরাং, করোনা পরিস্থিতি যা জনমানসের চোখ কিছুটা হলেও খুলে দিয়েছে- যারা বুঝতে  শুরু করেছে ধর্ম-জাত-বর্ণ নয়, সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যে থাকতে হলেও নির্বাচনের ভিত্তি হবে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-সমতা। ফলে, সাধারণ্যে এই সমালোচনার ঢেউ একপক্ষের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের, অন্যপক্ষের কাছে আশার। কেননা জোড়াতাপ্পি দিয়ে আর কদিন মানুষ বাঁচবে, চুপ করে থাকবে, সেইটাই দেখার।

অন্তিমে, যে বিষয়টা করোনার সঙ্গে জড়িত হয়েও আলোচিত নয় তা হল পরিবেশ। করোনা মিটলেই কি দুনিয়া সুরক্ষিত? এই যে খনিজদ্রব্যের সন্ধানে পৃথিবীর ফুসফুসের (পড়ুন অরণ্যের) বিনষ্টিকরণ চলছে তা কি আমাদের আরও বড় বিপদের দিকে ঠেলছে না। শুধু তাই নয়, বিশ্ব উষ্ণায়ন, অরণ্যনাশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত যে জুনোটিক রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে, যা চলবে, সেও কি মানবসমাজের চিন্তার বিষয় নয়? নাকি আমরা আমল দেব না তাতে। সর্বনাশের সম্ভাবনাকে পাত্তা না দিলেই সর্বনাশ আটকে যাবে, এমনও তো নয়। সুতরাং, এ নিয়েও কি আমরা আলোচনা-সমালোচনা করব না !

অবশ্যই করব। আমরা আলোচনা যেমন করব, বেগতিক দেখলে কঠোর সমালোচনাও করব। দুনিয়াতে সবাই সব কিছু জানে না, যতটুকু জানে তাও অনেকাংশে সম্পূর্ণ নয়। তাই বোঝার ধরন, ভাবনার প্রকৃতি ও বলার ভাষা সবসময় যে সঠিক ও খাঁটি হবে তাও নয়। তথ্য ও তত্ত্বের মাপকাঠিতে শাসককে ঠিক করে নিতে হবে কোনটা গ্রহণ করা হবে কোনটা হবে না। তবেই সে প্রকৃত শাসক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তার গদিতে আসীন। কিন্তু তা না করে কাওকে চুপ করিয়ে দেওয়া যাবে না। আইন প্রয়োগ করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া যাবে না। ভয় দেখিয়ে পরোয়ানা শানিয়ে মগজে কার্ফিউ জারি করা যাবে না।  তাহলে সাধারণ সমালোচনা থেকে ঝড় উঠবেই– দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।

তখন আবার ব্যাপারটা রাজনৈতিক হয়ে যাবে ।

1 comment:

  1. অসাধারণ Sir...কোনো কথা হবে নাঃ..👌🏻

    ReplyDelete