Pages

Friday, 10 April 2020

জনস্বাস্থ্যের প্রারম্ভ

ঔপনিবেশিক ভারতে ম্যালেরিয়া মহামারীর ইতিহাস 
ও জনস্বাস্থ্যের প্রারম্ভ
সংগ্রহ সংকলন ও সম্পাদনায়: উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায় 

১.

ঔপনিবেশিক ভারতের চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে ম্যালেরিয়া একটি বহু আলোচিত ব্যাধি। তার কারণ প্রসঙ্গে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই পরিবেশের কথা খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। গোটা বঙ্গদেশে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরে কলেরা ও ম্যালেরিয়া অসুখ দুটি মহামারীর রূপ নিয়েছিল যা বাংলা সম্পর্কে ঔপনিবেশিক মহলে একটা নেতিবাচক ধারণা গড়ে তুলেছিল। ১৮৩০'এর দশকে F P Strong অসুখের সেই সময়ে প্রচলিত ব্যাখ্যা অর্থাৎ পচা জিনিস থেকে নির্গত বায়ু দায়ী (miasma) বলে ধরা হত। সে সময়ে এটি ম্যালেরিয়া রোগের ক্ষেত্রেও গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছিলেন অনেক চিন্তকই। ১৮৪০ সালে James Taylor'এর লেখা থেকেও পাওয়া যায় যে তখন ম্যালেরিয়ার পরিবেশগত কারণের উপর খুব জোর দেওয়া হয়েছিল। সেই বছরেই সেপ্টেম্বরে বাৎসরিক বন্যা যেই কমে যায় তখন ম্যালেরিয়া দেখা দেয় এবং নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত তার তীব্রতা বজায় থাকে। কিছু কিছু এলাকা খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেখানে জনসাধারণ বহুদিন ধরে জ্বরে ভোগে ।

Twining এর মতে, উত্তর ভারতের জনসাধারণ যথেষ্ট শক্তিশালী ও পরিশ্রমী জাতি এবং সেই তুলনায় বাঙালিরা দুর্বল যার কারণ অংশত তাদের প্রধান খাদ্য চাল, এছাড়াও অস্বাস্থ্যকর স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। ১৮৫০-এর দশকের মধ্যভাগ থেকে বাংলাদেশে দেখা দিল 'বর্ধমান জ্বর' যা সম্ভবত ম্যালেরিয়া মহামারী, যার প্রকোপে বহু জেলার অনেক জনসাধারণ মারা যায়। ম্যালেরিয়া অসুখের প্রকোপের একটি সমাজতাত্ত্বিক গুরুত্বের কথা তাই ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন।

বাংলার প্রাদেশিক স্যানিটারি কমিশনারদের রিপোর্টে ১৮৭১-১৮৭২ থেকে  প্রত্যেক দশকের আদমশুমারিতে ম্যালেরিয়ার ধ্বংসাত্মক প্রভাবের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হত। ম্যালেরিয়া যে শুধু মৃত্যু ডেকে এনেছিল তাই নয়, এটি ছিল অন্য অনেক অর্থে ক্ষতিকারক। এই অসুখে ভুগে রোগী হয়ে পড়ত খুব দুর্বল, কর্মক্ষমতা হ্রাস পেত এবং এর দ্বারা ঔপনিবেশিক আদর্শ ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের পুরুষ ও যুদ্ধবাজ জাতি এবং নারীসুলভ কমনীয় বাঙালি জাতির মধ্যে যে বিভাজন-মিথ আগেই করা হয়েছিল তা আরও সমর্থন অর্জন করেছিল। এই তত্ত্বের বিশ্লেষণ  থেকে বোঝা যেত ঔপনিবেশিক ভাবনায় চিকিৎসাবিজ্ঞান কিভাবে জাতিতত্ত্বকে প্রভাবিত করেছিল এবং বাঙালিরা নিজেদের শারীরিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার ব্যাখ্যায় এই ধরনের বিশ্লেষণের শরণাপন্ন হত। ১৮৮৯-এ  বাংলার স্যানিটারি কমিশনারের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশের সমগ্র মৃত্যুর তিন-চতুর্থাংশের কারণ ছিল ম্যালেরিয়া জ্বর যা বছরে প্রায় ১০ লক্ষ লোকের মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল।

২.

ম্যালেরিয়া রোগের ইতিহাসের অন্য একটি দিক ছিল ম্যালেরিয়ার কারণ নির্ণয় ও নিয়ন্ত্রণের উপায়ের  সন্ধানের জন্য গবেষণা। এই গবেষণালব্ধ ফলাফলকে কাজে লাগানোর প্রচেষ্টা ১৮৫০-এর দশকে
T E Dempster বলে একজন অফিসার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ম্যালেরিয়া সম্পর্কে বোঝেন যে, এই রোগটা আসে খালের মাধ্যমে যে জলসেচ ব্যবস্থা আছে, তার সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে। 'spleen index' অর্থাৎ প্লীহার অবস্থাকে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বোঝার নির্ভরযোগ্য সূচক বলে তিনিই কিন্তু প্রথম দেখিয়েছিলেন।

ম্যালেরিয়া মহামারীর কারণ অনুসন্ধানের জন্য সরকারের তরফ থেকে ১৮৬৩ সালে বাংলাদেশে একটি তদন্ত কমিটি স্থাপন করা হয়েছিল। এর ভারতীয় সদস্য রাজা দিগম্বর মিত্র রেলপথ নির্মাণ এবং রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ - এগুলির সাথে সাথেই  ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বা এর মধ্যে যোগাযোগ আছে বলে  দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

স্যার রোনাল্ড রস্ কর্তৃক ম্যালেরিয়া বাহক মশার বিষয়ে আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত ম্যালেরিয়া দমনের দুটি পন্থা ছিল - জলাভূমি প্রভৃতির ক্ষেত্রে উন্নতি গ্রহণ এবং প্রতিষেধক ওষুধ যেমন সিঙ্কোনা গাছের ছাল থেকে প্রস্তুত কুইনাইন প্রয়োগ। ১৯০০ সাল নাগাদ ভারতের বড় বড় শহরে নিকাশি ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল। কুইনাইন পাউডার সরকারি চিকিৎসা বিভাগে বন্টন করা হত ও সেখান থেকে অন্যান্যদের কাছে পৌঁছত। এটা খুব ইন্টারেস্টিং যে কুইনাইনকে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র (tool of Empire)মনে করা হত সেই সময়ে। অবশ্য এটি সবসময় খুব সফল অস্ত্র ছিল না এবং ওষুধ হিসেবে এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ছিল। আমাদের বর্তমানে কলকাতার পিজি হাসপাতালেই স্যার রোনাল্ড রস তাঁর পুরো গবেষণাটি চালিয়েছিলেন। রোনাল্ড রস অ্যানোফিলিস (anopheles) মশাকে  ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু বাহক বলে চিহ্নিত করার পরে জনস্বাস্থ্য নীতির ক্ষেত্রে একেবারে নতুন প্রতিক্রিয়া দেখা দিল । রোনাল্ড রস ও তার অনুগামীরা ম্যালেরিয়ার মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য 'mosquito brigade' গঠন ও 'নিকাশি ব্যবস্থা'র উন্নতি, জলাভূমি সাফাই ইত্যাদির ওপর জোর দিয়েছিলেন। অনেক ব্রিটিশ মেডিক্যাল অফিসার কুইনাইন প্রয়োগের ওপর বেশি জোর দিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে ভারত সরকারের স্যানিটারি কমিশনার নিযুক্ত হলেন C P Lukisd - তিনি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি বিধানের উপরেই জোর দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রোনাল্ড রসের ভক্ত ও তাঁর অনুসারী।

৩.

১৯০৯ সালের অক্টোবরে সিমলাতে ইম্পেরিয়াল ম্যালেরিয়া কনফারেন্স হয়। এরপরেই স্থাপিত হল সেন্ট্রাল ম্যালেরিয়া কমিটি। এছাড়া Pasudism নামে একটা নতুন জার্নাল ছাপানো শুরু হয়েছিল । কনফারেন্সের পরে ম্যালেরিয়া সম্পর্কে সুদুরপ্রসারী কোনও গবেষণাকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষামূলক ব্যবস্থার সঙ্গে মেডিকেল অফিসারদের পরিচিতি করানোর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের সুবিধা হয়েছিল।

১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান রিসার্চ ফান্ড এসোসিয়েশন-এর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাকর্ম ছিল ম্যালেরিয়াকে ঘিরে। এই সময়ে ঔপনিবেশিক সরকারের উন্নতির বাধাস্বরূপ ছিল ম্যালেরিয়া ব্যাধি। ঐ IRFA-এর তরফ থেকে ম্যালেরিয়া নিবারণ তদারকের জন্য প্রথম বছরে ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা স্থানীয় সরকারগুলিকে প্রদান করা হয়েছিল। বাংলাদেশে C A Bentley সাহেব তখন স্যানিটারি অধিকর্তা ও জনস্বাস্থ্য অধিকর্তা। তাঁর মতে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব-এর জন্য দায়ী ছিল নদী ব্যবস্থার অবনতি ও সেচ ব্যবস্থার প্রতিকূলতা । রেলপথ নির্মাণের জন্য যেখানে সেখানে বাঁধ দেওয়ার ফলে জলনিকাশি ব্যবস্থা মার খাচ্ছিল, ফলে জমা জলে ম্যালেরিয়ার জীবাণু বৃদ্ধি পাচ্ছিল।ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কৃষির, প্রচুর স্বাস্থ্যের অবনতি হত সাধারণ মানুষের। এবং, গ্রামগুলির জনসাধারণ প্রায়ই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হত। তাঁর মতে অবস্থার উন্নতির জন্য প্রয়োজন ইতালির অনুসরণে পরিকল্পনা গ্রহণ অর্থাৎ মাটির উপরিভাগের জমা জল নিষ্কাশন এর সুবন্দোবস্ত করা, মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করা স্থানীয় আবহাওয়ার উপযোগী চাষ ও কৃষকদের সমৃদ্ধি বৃদ্ধির মাধ্যমে একই সঙ্গে কৃষিব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি।

অনেকের মতে, ঔপনিবেশিক আমলের ম্যালেরিয়া ছিল মানুষের তৈরি করা ম্যালেরিয়া। অর্থাৎ, রাস্তাঘাট ও রেলপথ নির্মাণ এবং নদীপথে বাঁধ নির্মাণ প্রভৃতি তথাকথিত উন্নতিমূলক কার্যকলাপের ফলে প্রথাগত জল নিকাশি ব্যবস্থার শেষ অবস্থা ও কৃষি ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয় যার সঙ্গে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের অবনতি তথা ম্যালেরিয়া প্রকোপ বৃদ্ধি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অতএব এখনকার সমস্যার সঙ্গে তখনকার সমস্যাতে একটা ব্যাপার তো প্রায় একই। সেটি হল আধুনিক সভ্যতা যত এগোবে বা প্রকৃতিনিধন যত হবে ততই কিন্তু বীজাণু রোগের প্রাবল্য  বাড়বে এবং একইসঙ্গে প্রতিষেধক ওষুধও চালু হবে - ক্যাপিটালিজম সবটাকে ঢুকিয়ে নেবে তার আলেখ্যে আর মাঝখানে বেশ কিছু মানুষ মহামারীতে মারা যাবে। যে কোনও সমাজ ব্যবস্থাতেই।

৪.

ব্রিটিশ ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জনস্বাস্থ্য নীতির খুব সামান্য সূত্রপাত হয়েছিল বলা চলে বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ডিসপেনসারি ও হাসপাতালের স্থাপনের মধ্য দিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানগুলি বসন্তরোগ, ম্যালেরিয়া, কলেরা ও অন্যান্য ব্যাধির প্রতিষেধক টিকা প্রদানের কেন্দ্রস্থল ছিল। ১৮৫৭-র  পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের শাসন শুরু হবার পরে সেনাবাহিনীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ১৮৫৮ সালে 'Royal Commission on the Sanitary State of The Army in India' নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৮৬৩-র রিপোর্টে এই কমিশন ইউরোপিয়দের বাসস্থানের (সৈন্য ছাউনি ও বেসামরিক অঞ্চল) সুনির্দিষ্টকরণ, India Office Medical Board-এর সভাপতি এবং কমিশনের সদস্য J T Martin-এর নির্ধারিত ভূতাত্ত্বিক নীতিসমূহ অনুযায়ী তার সংগঠন এবং ব্রিটেনের স্বাস্থ্য আইন ও নির্দেশ অনুযায়ী এই অঞ্চলগুলির শাসনতান্ত্রিক পরিচালনার কথা বলা হয়েছিল। এই অনুযায়ী Military Cantonments Act,1864 অনুসারে নতুন নিয়োজিত ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ সেনাছাউনিগুলিকে আরও প্রশস্ত করে বানাতে শুরু করে।

সৈন্যদের মধ্যে সিফিলিস প্রভৃতি যৌনব্যাধির প্রকোপ ছিল খুব বেশি এবং তা দমনের উদ্দেশ্যে Cantonment Act এর বলে পতিতালয়গুলির নিয়মিত স্বাস্থ্য বিষয়ক তদন্ত ও দেখাশুনা করা হত। ১৮৬৮ তে প্রবর্তিত হলো Indian Contagious Diseases Act কিন্তু ১৮৮৮-তেই এই আইন রদ করা হয় তবে পতিতালয়ের অধিবাসীদের স্বাস্থ্য বিভাগীয় নজরদারি বন্ধ হয়নি এবং নতুন প্রবর্তিত Military Cantonment, 1864 দ্বারা তা চালু থাকে। ১৮৯৫-এ প্রবর্তিত আইনে স্বাস্থ্য বিভাগীয় নজরদারি ইত্যাদি বন্ধ থাকে কিন্তু ১৮৯৭'এ তার ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হয়। Epidemic Diseases Act ,1897 এমন একটি আইন ছিল যা প্রাদেশিক সরকারের হাতে বহু ক্ষমতা প্রদান করেছিল।

১৮৮০ সালের Compulsory Vaccination Act প্রাদেশিক সরকারগুলিকে কিছু শহর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে  ৬ বছরের চেয়ে বড় শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক টীকাপ্রদান চালু করেছিল । তবে অনেক জায়গায় এই আইন প্রবর্তন করা হয়নি এবং ১৯০৬ সালে শুধু ৪৪১টি শহর ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকাতে এটি চালু ছিল যা ব্রিটিশ ভারতের জনসংখ্যার শতকরা ৭ ভাগের উপস্থিতিকে প্রতিনিধিত্ব করত।
আগেই বলে বলেছি ডিসপেনসারির ভূমিকার কথা। ১৮৭০ সাল থেকে ব্যয় সংক্ষেপ করার জন্য ঔপনিবেশিক সরকার ডিসপেনসারির খরচ চালানোর থেকে দূরে সরে থাকছিল এবং স্থানীয়ভাবে এগুলির ব্যয় নির্বাহের ওপর জোর দিয়েছিল। বাংলার সরকারের মতে: 'the utility of dispensaries has now become so fully acknowledged that there is no necessity for the state to offer assistance to such an extent as when the movement was recent...  The accumulation of balances further shows that there is no difficulty in obtaining locally even mere money that suffices to meet the wants of there institutions as ar present conducted.'

১৮৬৭ সালে বাংলাদেশে ৬১টি ডিসপেনসারি চালু ছিল। ১৯০০ সালে তা বেড়ে হয়েছিল ৫০০। মহিলাদের প্রতিষেধক টীকাদান ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডিসপেনসারিগুলি ব্যর্থ হয়েছিল। ১৮৬৯ সালে বেরেলি জেলায় ডিসপেনসারির তত্ত্বাবধায়ক-এর মতে মহিলাদের সেখানে আসার জন্য রাজি করানোর ব্যাপারে তার এবং অন্যান্য কর্মচারীদের খুব অসুবিধে হয়েছে। ১৮৭১ সালে বাংলাদেশে যারা ডিসপেনসারিতে চিকিৎসার জন্য এসেছিল তাদের মধ্যে শতকরা ১৮ ভাগ ছিল মহিলা। ১৯০০ সালে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলি ইন্সপেক্টর জেনারেল বলেছিলেন যে বাংলাদেশের অধিকাংশ ডিসপেনসারি এখন 'been improved... in connection with the privacy of women. In all places the object has been to have a separate delivery window for females, which shall open, if possible, into a separate waiting room for that sex. Privacy for women has been held by me to be a most important condition of success.'

ডিসপেনসারির বাইরে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে সরকারের ভূমিকা প্রধানত সীমিত ছিল প্রাথমিক স্বাস্থ্যচর্চা বিষয়ক বইপত্র বিতরণের মধ্যে।  J M Cunningham এর 'Sanitary Primer' বইটি বহু ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছিল এবং ভারতীয় বিদ্যালয়গুলির নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ছিল। ১৮৮৭'তে এই বইটির পরিবর্তে খ্রীষ্টান মিশনারিদের সংগঠন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ 'The way to health' পাঠ্যপুস্তক নির্বাচিত হয়েছিল।


৫.

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে অথবা ১৮৫০ সালের পরে কিছুটা শিল্পায়ন আরম্ভ হলে শিল্পাঞ্চলগুলিকে কেন্দ্র করে জনবসতি বাড়তে থাকে এবং বহু রেললাইন, সড়ক, জলাধার, বাঁধ নির্মাণের ফলে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভীষণ অবনতি ঘটতে থাকে। ইতিমধ্যে সরকার কেবলমাত্র মিলিটারিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিয়ে কলেরার প্রকোপ কমাতে সক্ষম হলেও গ্রামাঞ্চলে ম্যালেরিয়া, কলেরা ও কালাজ্বরের প্রকোপ কমানো সম্ভব হয়নি। কারণ, তৎকালীন সমাজে বিভিন্ন ঘটনার তথ্যপঞ্জী হিসেব কষে তা অনুসারে ১৮৭১-৮১ সালের মধ্যে বাংলায় লক্ষ লক্ষ লোক প্রাণত্যাগ করে। এর মধ্যে মেদিনীপুর বর্ধমানের মৃতের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৮৫ হাজার ও দেড় লক্ষ। বাধ্য হয়ে সরকার ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে শহর ও শহরতলি, মেলা ও জনবহুল এলাকাগুলিতে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করে, সেগুলিতে পরিশ্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা, জলনিকাশির ব্যবস্থা করা,  স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করা, বিশোধক  রাসায়নিক সরবরাহ শুরু করে। কিন্তু পরিস্থিতির আদৌ বিশেষ উন্নতি ঘটেনি তেমন।
বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে(১৯২০ ও তারপর) জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত কাজকর্মের দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের হাতে চলে যায় এবং ১৯২০ সালে জনস্বাস্থ্য রক্ষার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জনস্বাস্থ্য বিভাগ খোলা হয়েছিল। এ কথা অনস্বীকার্য যে পশ্চিমী চিকিৎসাবিজ্ঞান নগর বা শহরের বিত্তশালীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, গ্রামের লোকজন বা শহরের দরিদ্র সম্প্রদায়ের কাছে ঔপনিবেশিক পর্বে তা পৌঁছে দেওয়ার পরিকাঠামো সম্প্রসারিত তেমন হয়ে ওঠেনি।


সহায়ক রেফারেন্স:
-------------------------
১) David Arnold, Colonizing the Body, State Medicine and Epidemic Disease in Nineteenth Century India, Oxford University Press, Delhi edn, 1993;
২) Poonam Bala, Imperialism and Medicine in Bengal : A Socio-Historical Perspective, Sage Publications, New Delhi, 1991;
৩) Mark Harrison. Public Health in British India: Anglo Indian Preventive Medicine 1859-1914, Cambridge University Press, Foundation Book, New Delhi, 1994;
৪) David Arnold, The New Cambridge History of India;  Science, Technology and Medicine in Colonial India, Cambridge University Press, 2000 (pdf copy).
 

No comments:

Post a Comment