সোমনাথ রায়
পার্লামেন্টে সাম্প্রতিক জেএনইউ বিতর্কের শুরুর দিন স্মৃতি ইরানি জেএনইউর ছাত্রদের প্রচারিত একটি লিফলেট থেকে পড়ছিলেন, যেখানে দুর্গাকে একজন বেশ্যা হিসেবে দেখানো হয়েছে যিনি মূলবাসী রাজা মহিষাসুরকে ছলনা করে বধ করেন। স্মৃতিজি পড়ছেন যখন সংসদ জুড়ে শেম শেম ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এরপর তিনি বলেন যে, এই কী বাক্ স্বাধীনতা, কলকাতার রাস্তায় কেউ এরকম বলতে পারবে? পুরাণেতিহাসের এই ভিন্নতর ভার্সন নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। একটি মত শুনছি কোনো জনজাতির মধ্যে নাকি এইরকম লোকগাথা আছে। দুর্গাপ্রতিমা গড়তে বাংলায় বেশ্যাদ্বারমৃত্তিকা ব্যবহার হয়; কিম্বা দেবীমাহাত্ম্যে যেভাবে বিভিন্নদেবতার তেজ বা অগ্নি (যা এক অর্থে, বীর্য) নিয়ে দুর্গার সৃষ্টি বর্ণনা আছে, তা থেকে এই আলোচনার সূত্র পাওয়াও যেতে পারে হয়ত। আবার এরকম মতও শুনছি, যে লিফলেটটি নাকি ভুয়া। তো এইসব ডিসকোর্সের বাইরে যেটা আমাকে প্রভূত খটকা দিল, তা হল, এই কথাগুলো নাকি কলকাতার রাস্তায় বলা যাবে না। হয়ত আমি এবং মন্ত্রী মহোদয়া পৃথক কলকাতা চিনি। কিন্তু, প্রথমেই মনে হল, কলকাতার রাস্তায় তো আমরা কলেজকাল থেকে মহায়ন আবৃত্তি করে বড় হয়েছি। মহায়ন প্রসঙ্গ পরে আবার আসবে বলে এখন দু কথায় ভূমিকা সেরে নিই। মহাভারত এবং রামায়ণের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে যৌনসংসর্গের এক শহরপাঁচালি মহায়ন। মহায়নের সাহিত্যগুণ হয়ত একটা পৃথক লেখার দাবি রাখে, যেখানে এইসব পদগুলি পাওয়া যায়-
‘আকাশের প্রেক্ষাপটে সারিসারি নুনু/ তাহাতে দোলায় পাছা মহাবীর হনু’—পাঠক চিত্রকল্প, জাস্ট চিত্রকল্পটি ভাবুন। কিম্বা ‘কলিযুগে ব্যাভিচার বিচিত্র রকম/ গান্ধারীর বিছানায় অঙ্গদের লোম’। বা এই ‘অন্ধমুনি গন্ধে চেনে চোখেতে দেখেনা’
অনুপ্রাসে অন্ধত্বের এই বর্ণনা লিখতে পারলে যেকোনও কবি গর্ববোধ করতেন। তো নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে দেখেছি গুণকর্মবিভাগসহ কলকাতা ও আশেপাশের প্রায় সব কলেজের ছেলেদেরই মহায়ন আউড়ে যেতে। এবার কলকাতার রাস্তার এই সহনশীলতা নেই যে সে দুর্গানামের ব্ল্যাসফেমি সইতে পারবে না এ বিশ্বাস হয় না। তাও একবার ভাবলাম, যেমন আজকাল অনেকে বলে, যে এসব শহুরে এলিটপনা, মাটির গল্প আলাদা। কিন্তু, আমাদের ঐতিহ্য বলে যে সাংস্কৃতিক চর্চার কথা আসে, তাতে তো এধরণের প্রয়োগ অজস্র। মনসামঙ্গলে সবচেয়ে বেশি খিস্তি তো মনসাকেই করা হয়েছে, রূপ নিয়ে, অন্ধত্ব নিয়ে। কিম্বা আমাদের গ্রামবাংলার কবি পদ বাঁধছেন- কদমগাছে উঠিয়া আছে কানু হারামজাদা! শুধু লোকশিল্পই বা কেন, স্বয়ং মহাভারত কৃষ্ণকে স্থানে স্থানে কী খিস্তিমন্দই না করেছে। এইখানে, আমার একটা হাইপোথিসিস লিখে ফেলি। হিন্দুধর্ম বলে আমরা যেটাকে আজ দেখি, সেটা অতটা খারাপও নয়, যতটা আরএসএস-সংঘপরিবার পোর্ট্রে করে। আমার খানিকটা মনে হয় মারাঠারাজের একটা ক্ষয়িত চেহারা এই আরএসএস এর রাজনীতি। ফলে কিছু বিশেষ মতবাদকে হিন্দুত্বের নামে এগিয়ে দ্যায় এরা, যেগুলো আগ্রাসী এবং অসহিষ্ণু, আর হ্যাঁ, তুমুলভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী, পেশওয়াপন্থের মতন। ফলে এই ভার্সন, এই যে দুর্গাকে বেশ্যা বললে লোকে পার্লামেন্টে ‘শেমশেম’ করবে, এর বাইরে বাংলা তো বটেই সম্ভবতঃ বাকি ভারতেও সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের এবং মূলস্রোতী সমাজের আসল স্পেসটা পড়ে আছে। মনসামঙ্গলের কথায় আসি, মনসার জন্ম বর্ণনা করতে গিয়ে কবি লিখছেন শিবের হস্তমৈথুন, বাঁহাতে আঁজলা করে নিজের বীর্য নেওয়া এবং জল ভেবে পাখি এসে সেই বীর্য খেয়ে নিচ্ছে- এরকম বর্ণনা, যা আজকের দিনে পড়লে সুকুমারমতি ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার বমনের উদ্রেক হবে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধাকৃষ্ণের পারস্পরিক উক্তি, দূতীর বক্তব্য কিম্বা শাক্ত/তান্ত্রিক ধারার সাধক কবিদের কালীবর্ণনা এইসব গায়ে মেখে যে ধর্ম গড়ে উঠেছে, সেখানে আর যাইহোক বাকস্বাধীনতার চোখ রাঙানোটা অধর্মাচরণ। আর, অন্যান্য দেবতাদের, যাদের হ্যাটা করা হত, বাংলা সংস্কৃত দুইভাষার সাহিত্য জুড়ে তাদের নিয়ে কী লেখা হত সে না হয় এখন তোলাই থাকুক।
এইবার মারাঠারাজের পরে আরেক যুদ্ধবাজ রাজ ভারতে আছড়ে পড়ে, খুবই প্রবলভাবে পড়ে। এবং ব্রিটিশরাজের পিঠে ছিল আরও বড় আগ্রাসী ধর্মের বোঝা। সুচতুরভাবে সাবাথ ডে হয়ে যায় সেকুলার দেশের ছুটির দিন। এভাবে সেই ধর্ম আমাদের চারদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে যায়, বিদ্যুৎ মেঘে যেমন লুকালে না পাই অন্বেষণ। ফলে আমরা ব্ল্যাসফেমি শিখি। যে শ্রীরামকৃষ্ণ নিজের গুরুকে ন্যাংটা বলে মেনশন করতেন, তাঁর ঔপনিবেশিক শিষ্যেরা লেখেন- ‘ভৈরবী কীরূপে তাঁহাকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, তাহা আমরা আলোচনায় আনিতে চাহি না’।
তো আমরা দেখতে পাই, বাক্স্বাধীনতা এবং বিভিন্ন অদ্ভুত মত, বিরোধীমত, অশ্লীল গা গুলিয়ে দেওয়া কথাবার্তা চালানোর এক চর্চা আমাদের প্রচলিত ধর্মের মধ্যে দিব্যি চলে আসছিল, ঔপনিবেশিক শিক্ষা যার মধ্যে পুরোটা দাঁত বসাতে পারে নি।
কিন্তু, এইখানে ধর্ম বলতে এতক্ষণ আমরা একটা ধর্মের কথাই বলছি, এখানে সংখ্যাগুরুর ধর্ম যেটা। আর, তার পাশাপাশিই প্রচুর আদানপ্রদান ও প্রচুর পাঁচিলসহ প্রায় হাজার বছর আরো কিছু ধর্ম এখানে এক্সিস্ট করে গ্যাছে। তাদের মধ্যে অবশ্যি প্রবলতম ইসলাম। এইখানে এসে অস্বস্তির জায়গাটা শুরু হয়। সম্প্রতি ইলমবাজারে সুজন মুখার্জি নামে এক তরুণ ইসলামি মহায়ন লেখে। মানে মহম্মদ, আল্লাহ, খাদিজা, আমিনা,আয়েশা, আলি প্রমুখের মধ্যে যৌনসম্পর্ক বিষয়ক ছড়া। এর ফলশ্রুতিতে সেখানে প্রায় দাঙ্গা হয়ে যায়, সুজন ঘরছাড়া হয়। অসমর্থিত সূত্রে একজনের মৃত্যু অবধি হয় সেই দাঙ্গায়। এইধরণের ঘটনা এর আগে তসলিমা নিয়ে কলকাতায় হয়েছে এবং বাংলাদেশে সম্প্রতি অনেক মুক্তমনা লেখককে আহত ও নিহত হতে হয়েছে এই কারণে। এখানে আমাদের অস্বস্তির জায়গা দুভাবে আসে। একদিকে বাক্স্বাধীনতায় বিশ্বাস থেকে ইসলামের নামে স্বাধীনভাবে বলাকে সমর্থন করতে হয়, আর করতে গেলেই দেখি সেই স্বাধীনতার বিনিময়ে হত্যা এমন কী দাঙ্গা অবধি হয়ে যাচ্ছে। একজনের একটা ফেসবুক পোস্টের দায় মেটাচ্ছে সহস্র জনতা। আমরা ঘেঁটে যাই, মানবিক অবস্থান থেকে বাকস্বাধীনতার বিরুদ্ধে যাব না কি নিজের প্রতি বিশ্বাস্ত থেকে দাঙ্গার বিনিময়েও একজনের ইচ্ছেমতন লেখা/বলার অধিকারকে সমর্থন জানাব। আরেকদিকে, আরএসএস পন্থীদের দিক থেকে টিপ্পনী আসে যে ফ্রিডম অফ স্পিচের ধ্বজাধারীদের ক্ষমতা শুধু নির্বিবাদী হিন্দুধর্মকে আক্রমণ করার। ইসলাম নিয়ে মুখ খোলার ঔকাদ তাদের নেই।
অবশ্য বাংলাদেশ ইরান এমন কী পাকিস্তানেও আমরা দেখছি ইসলামিক দুনিয়ার মধ্যে জঙ্গির চাপাতি উপেক্ষা করে লোকে বাক্স্বাধীনতার লড়াই লড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু, ভারতে কাজটা হয়ত আরেকটু অন্যরকম। আমাদের হাতে অলরেডি একটা মডেল আছে যেখানে ধর্মের অঙ্গ হিসেবেই দেবতা অবতার-আদিকে নিয়ে যথেচ্ছ খিল্লির চর্চা আছে। চারদিকে প্রবলতররা যদি ব্ল্যাসফেমি চাপাতে আসে, আমি আমার লৌকিক হিন্দুধর্মের মধ্যে থেকে উল্টো মডেলটাকে তুলে ধরব। আর সবার আগে সেটা বিজেপিবাহিনীর উল্টোদিকে তুলে ধরব, কারণ তারা আমাদের ঐতিহ্যের নিজস্ব অর্জনগুলির ওপর আগ্রাসী একরোখা ধর্মমত চাপিয়ে দিচ্ছে। আর তার পাশেই কাজটা হবে পাঁচিলের ফোকরগুলো দেখার। ইসলামের যে ভার্সনটা আমি জানি, তাতে আল্লাহ,কোরাণ,নবি কারুর নামেই কিছু বলা নিতান্ত নাজায়েজ। কিন্তু সেই একটাই কি ভার্সন? এক হাজার বছরের আদান প্রদানের ইতিহাসে ভারতের বিভিন্ন লৌকিক মত আর ইসলামের অজস্র সংমিশ্রণ হয়েছে, সেখানে কি নির্মিত হয়েছে স্বাধীনতার কোনও সূত্র? এখানে চর্চার দরকার, লোকের মাঝে গিয়ে জানার দরকার। কেঁদুলির মেলায় দেখেছি নাকে তিলক বোষ্টম পরিবার মুসলমানের দোকানে রাতের ভাত খাচ্ছেন। এইসূত্র বাদ দেব কেন? বোষ্টম কানুকে হারামজাদা বলে দিতে পারেন গানে, তার পাশের ঝুপড়ির ফকির আলি-ফতিমার প্রেম কী ভাষায় গান?
সব থেকে বড়কথা, হিন্দুধর্মের মোড়কে যত লোকায়ত ধর্ম আছে, তারা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কালিকে ল্যাংটোমাগী বলার কৃষ্ণকে ছুঁকছুঁকে কামার্ত বলার স্পৃহা ও সাহস বহন করছে। যে দুর্গাকে বেশ্যা বলতে চায় তাকে পিটিয়ে মারার কথা বলার জায়গা সেখানে থাকে না। বরং কেন বলছে দেখার, তার বলা ভুল কীনা তা নিয়ে বাহাসের আয়োজন থাকে। যে আজ চ্যাং মুড়ি কানি কাল তাকে ফুল দিয়ে পুজো দিতে হবে এই সম্ভাবনা নাকচ হয় না। আমার মনে হয়, অন্ততঃ এই ঐতিহ্যটুকুকে তুলে ধরাও সভ্যতার একটা বড় লড়াইয়ের অংশই।
No comments:
Post a Comment