Pages

Thursday, 20 August 2015

স্বাস্থ্যের বাণিজ্য



স্বাস্থ্য পরিষেবায় কদর্য বাণিজ্য  
অভিজিৎ রায়

স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রটির সঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের জীবন জড়িত। সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে স্ব-স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ। অতএব, এই ক্ষেএটিতে রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা ও অংশগ্রহণ একান্ত কাম্য। অথচ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রটির প্রতি এই সদিচ্ছা নৈব নৈব চ। গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হোক বা সরকারি সুপার স্পেসালিটি্ হাসপাতাল, স্বাস্থ্যর প্রতি সরকারি অবহেলা দৃশ্যমান। সরকারি হাসপাতালে 'কল্যাণময় মানসিকতা' এতটাই প্রবল যে মানুষ ও সারমেয় ফারাকের সারটুকু নেই। সরকারি হাসপাতালের সারমর্ম হল- চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব, হাসপাতালে শয্যার অভাব, মেঝেতে ঠাঁই মিললেও অন্য রোগ সংক্রমণের ভয়। এইসবের সঙ্গে উপরি হল প্রাণ নিয়ে সরকারি হাসপাতালের চৌহাদ্দি থেকে বেরিয়ে আসা।

সম্প্রতি বিভিন্ন রিপোর্টে প্রকাশিত পরিসংখ্যান তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, ভারতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ২০১২ সালে ১.৩৪ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। ২০১০ সালে যা ছিল ১.০৪ শতাংশ। এ ক্ষেএে স্রেফ পরিসংখ্যান থেকেই ছবিটা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। অপরাপর দেশগুলির তুলনায় ভারতের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল বেহাল। ভারতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যয় ব্রাজিল, রাশিয়া, চিন, দক্ষিন আফ্রিকার তুলনায় কম।
Country
Total Health Exp(% of GDP)
Pub.Health Exp.(% of total health Exp)
Pub.Health Exp.(% of total GDP)
Brazil
9.3
46.4
4.32
Russia
6.3
61
3.84
India
4.05
33
1.34
China
5.4
56
3.02
South africa
8.8
47.9
4.22









(World bank Statistic for 2012)

সমসাময়িক কালে স্বাস্থ্য বলয়ের মধ্যে বাণিজ্যিক মানসিকতা আরও প্রকট হয়েছে। আগে যে ছিল না তা নয়। বেসরকারি হাসপাতাল চিরাচরিত চরিত্র স্বভাবে দামের হাঁক ছেড়েছে, সরকারি হাসপাতালগুলো প্যাথোলজিক্যাল্ সেন্টারগুলির এজেন্টদের অবাধ বিচরণ ক্ষেএ হয়ে উঠেছে। এর নেপথ্যে কাজ করছে আর্থিক সুযোগসুবিধা। সরকারি হাসপাতালের পরিকাঠামোর মধ্যেও বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রবেশ করেছে।

অ্যাপলো হাসপাতাল ১৯৮৩ সালে ১৫০টি শয্যা নিয়ে হাসপাতাল পরিষেবা শুরু করলেও ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৮,৩১৩টি শয্যা হয়েছে। আবার ম্যাক্স হাসাপাতালে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই শয্যা সংখ্যা পৌঁছেছে প্রায় দুই হাজারে। বেসরকারি হাসপাতালের পরিষেবা পরিধির বৃদ্ধি ঘটলেও চিকিৎসার নামে সংকীর্ণ ব্যবসায়িক অভিসন্ধি কাজ করে - এক প্রকার টাকা দিয়ে রোগী কিনে নেয় প্রাইভেট হাসপাতালগুলি

বৃহত্তর বাজার ব্যবস্থায় টিকে থাকতে প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন ‘মার্কেট স্ট্র্যাটেজি’ অবলম্বন করে। প্রাইভেট হাসপাতলগুলি স্রেফ নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধির তাগিদে এক ধরনের নয়া স্কিম্ বাজারে এনেছে যার পোশাকি নাম ‘কাট্ প্র্যাকটিস্’। অর্থাৎ, রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতালে রেফার করলে তার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধে পাবেন ডাক্তারবাবুরা।

ভারতের প্রাইভেট হাসপাতালে শহুরে অঞ্চলে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত ৪০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা হত, ২০০৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৬২ শতাংশে। গ্রাম্য ক্ষেত্রের পরিসংখ্যানটি ১৯৮৬ সালের ৪০ শতাংশ থেকে ২০০৪ সালে ৫৮ শতাংশ পৌঁছে গেছে। IBEF 2015’র রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে যেখানে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে সরকারি অংশীদারিত্ব ১৯ শতাংশ সেখানে প্রাইভেট অংশীদারিত্ব ৮১ শতাংশ। এই রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৪’র পর প্রাইভেট হাসপাতালের ‘মার্কেট’ ৫৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছবে।

প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান বাজারে নিজের প্রতিপত্তির প্রসার ঘটাতে ভিন্ন ভিন্ন ‘মার্কেট স্ট্র্যাটিজি’ অবলম্বন করে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলি স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে বাণিজ্যিক কৌশলকে নিপুণভাবে ব্যবহার করছে। এই স্ট্র্যাটেজির অন্যতম ভিওি হল - ডাক্তারবাবুরা ‘কাট্ প্র্যাকটিস্’ স্কীম অনুযায়ী রোগীকে রেফার করবেন প্রাইভেট হাসপাতালে। যেমন, গত বছরের মাঝামাঝি KOKILABEN DHIRUBHAI AMBANI HOSPITAL (KDAH) ‘কাট্ প্র্যাকটিস্’ স্কিম তৈরি করে এবং ‘Elite Forum for Doctors’ গঠিত হয় যারা ‘কাট্ প্র্যাকটিস্’ স্কিম অনুযায়ী যে ডাক্তারা রোগী রেফার করছেন তাঁদের আর্থিক সুবিধে দেওয়ার ব্যবস্থা করে কিন্তু ডাক্তারা তাদের নৈতিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ‘হিপ্পোক্রেটিক ওথ্’ ভুলে কীভাবে এ কাজ করেন? এখানেও দক্ষ বাণিজ্যিক মস্তিস্ক ব্যবহৃত হয়েছে - তুলনায় ছোট হাসপাতাল ও ডিসপেনসারিতে প্র্যাকটিস্ করা ডাক্তারদের ব্যবহার করা হয় পেশেন্ট তুলতে। সেই সঙ্গে আর্থিক লেনদেনের অংকটাও মন্দ না - বছরে ৪০টি রোগী ভর্তির বিনিময়ে ১ লক্ষ টাকা, ৫০টি রোগীর বিনিময়ে ১.৫ লক্ষ টাকা আর ৭৫টি রোগীর জন্য ২.৫ লক্ষ টাকা। প্রেসক্রিপসনেও ডাক্তারা সেইসব ঔষুধের নাম বেশি লেখেন যেগুলির কোম্পানি থেকে তারা বেশি সুবিধে পান

British Medical Journal’এ জনৈক চিকিৎসক ভারতে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, ভারতীয় ডাক্তার এবং স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলি ‘অনৈতিকতার বৃত্তে’ অবস্থান করছে। অর্থ ও অন্য সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে রোগী রেফার করা ডাক্তারদের ‘সততা’কে কালিমালিপ্ত করেছে তাদের উপর মানুষের প্রত্যয়ের অবনমন হয়েছে।

নয়া উদারবাদী ও মুক্ত বাজার ব্যবস্থা দেশের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রটিকে একটি মুক্ত বাণিজ্য ক্ষেএে পরিণত করেছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার যে ‘বাজারিকরণ’ ঘটেছে তা চিকিৎসা শাস্ত্রের নৈতিকতা বিরোধী তো বটেই, এর সামাজিক বৈধতাও আজ প্রশ্নের মুখে। একদল অর্থপিপাসু পেশাদার চিকিৎসার নীতিশাস্ত্রকে অধঃপতনে পাঠিয়ে একটি অর্থ লোলুপ স্বাস্থ্য পরিষেবার বাজার গড়ে তুলেছে।

স্বাস্থ্যের উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে রাষ্ট্র ব্যর্থ কী না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক কিছু নয়। রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার নেপথ্যে অনীহা থাকতে পারে কারণ তাতে প্রাইভেট হাসপাতালগুলির মুনাফা বৃদ্ধির পথ সুগম হয়। যে কোনও ক্ষেএে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার অর্থ কম খরচে পরিষেবা পাওয়া আর যা আমাদের মতো দেশে আবশ্যিক কিন্তু তেমনটি হলে প্রাইভেট হাসপাতালগুলির ব্যবসা লাটে উঠবে।

‘কাট্ প্র্যাকটিস্’র মতো বেআইনি স্কিমের বিরুদ্ধেও রাষ্ট্র নীরব থাকে। MAHARASTRA MEDICAL COUNCIL মারফত BRIHANMUMBAI MUNICIPAL CORPORATION (BMC)’কে KDAH’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বললে প্রত্যুক্তিতে BMC জানায় লাইসেন্স দেওয়ার অধিকার তাদের থাকলেও মিউনিসিপ্যাল নিয়মে হাসপাতালের এই ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য তারা ব্যবস্থা নিতে অক্ষম।

Support for Advocacy and Training to Health Initiatives (SATHI) ডাক্তারদের মধ্যে গবেষণা করে তাদের প্রকাশিত গবেষণা রিপোর্টে দেখিয়েছে প্রাইভেট হাসপাতালে কীভাবে ডাক্তারদের কর্পোরেট কোম্পানির মতো ‘টার্গেট’ দেওয়া হয়। নির্দিষ্ট সংখ্যক সার্জারি বা রোগীকে বেশি দিন হাসপাতালে আটকে রাখা - সবটাই হাসপাতালের মুনাফা বৃদ্ধির তাগিদে।

স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেএটিতে সরকারি সদিচ্ছা একান্ত কাম্য, তাতে প্রাইভেট হাসপাতালের পরিষেবার নামে অর্থনৈতিক স্বার্থ কমবে। কিন্তু অনুশীলন ও তত্ত্বের মধ্যে ফারাক বিদ্যমান। সাধারণ মানুষের পক্ষে চিকিৎসকের পরামর্শ এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া ঝুকিঁর কাজ, কোনও মুমূর্ষু রোগীর বাড়ির লোকের পক্ষে ডাক্তারের রেফার্ উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। পূর্বেকার ‘ডাক্তার কাকারা’ পরিবারের একজন সদস্য হয়ে উঠতেন, রাত দুপুরে ইমারজেন্সি কেসে পাড়ার ‘ডাক্তার কাকুরা’ ছিলেন, পেশেন্ট আর ডাক্তারের গণ্ডি ছাড়িয়ে অনাত্মীয় থেকে আত্মীয় হয়ে ওঠা। কিন্তু আজকের দিনে সেই হৃদ্যতাপূর্ণ সহোদর সম্পর্কের এই অনুপস্থিতি সামাজিক অবক্ষয়কে আরও পরিস্ফুট করেছে।

References:
 1 .EPW July 25th, 2015 ‘Business of Hospitals’
2. EPW July 18th, 2015 ‘Murky waters of Medical Practice in India’
3. Pal, Somita www.dnaindia.com/ “BMC says it can’t act against Ambani hospital for cut practice”
4. Times of India 8th March, 2015 and Ananda Bazar Patrika.



No comments:

Post a Comment