Pages

Sunday, 28 April 2024

নাগরিকত্বের টোপ

জুমলাবাজি ও দখলদারির রাজনীতি

শিবশংকর পাল



মনোবিজ্ঞানের অন্যতম বিদ্যায়তনিক পাঠবস্তু হল সমাজ মনোবিজ্ঞান। মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক চার্লস স্টেনগার তাঁর অন্যতম গ্রন্থ 'সোশ্যাল সাইকোলজি প্রিন্সিপলস'-এ সমাজের মানসিক বিন্যাসের উপর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছেন। এই গবেষণার জন্য আমেরিকার সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির চার্টার ফেলো নির্বাচিত হন তিনি। তাঁর তত্ত্ব বিশ্ব জুড়ে মান্যতা পেয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন, সমাজের মনকে নানাভাবে গড়েপিটে নেওয়া যায়, ভেঙেচুরে দেওয়া যায় পছন্দমাফিক। 

বৃহত্তর সমাজের গভীরতর প্রদেশে কোনও সত্যি/মিথ্যে ধারণা গড়ে তুলতে এতদিন সাধারণত দু' ভাবে প্রচেষ্টা চালানো হত: ১) তীব্র দেশপ্রেমের নামে উগ্র রাষ্ট্রপ্রেমের জন্ম দেওয়া ও ২) ক্রমাগত অনৃতভাষণের সাহায্যে 'সফেদ ঝুট'কে ‘নিছক’ সত্যে পরিণত করা। এর ধ্রপদি ব্যবহার একদা হিটলার করেছিলেন। এখনও এই অস্ত্রের বহুল প্রয়োগ আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের দেশে।

সম্প্রতি ভারতবর্ষের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলির প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োগ স্পষ্টভাবে চোখে পড়বে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন বহু কারণে জাতীয় স্তরে অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল। বিজেপির হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের প্রধান বাধা ছিল পশ্চিমবঙ্গ এবং এখনও এই বাধা তাদের দুশ্চিন্তার কারণ। ভারতের যে অংশকে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা আর্যাবর্ত বা গো-বলয় অথবা হিন্দিবলয় হিসেবে গণ্য করে থাকেন সেখানকার 'লোক'-এর মানসিকতা প্রায় বিজেপির অনুকূল। ‘হিন্দু খতরে মে হ্যাঁয়’ আর তার কারণ ‘মুসলমানদের বাড়বৃদ্ধি’— এই সোশ্যাল সাইকি দিয়ে গুজরাত দাঙ্গা করে ২০১৪-য় ‘মোদী-শাহের’ গোদিয়ান হওয়া এবং অতঃপর ক্রমাগত ‘হিন্দুত্ব’কে সারজল দিয়ে চাষ করে তার ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা অধিকাংশতই সফল। পশ্চিমবঙ্গেও তাঁরা নানা নামে সংগঠন গড়ে প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন বহুকাল, সেই বাম আমল থেকেই। বাঙালির মেধা-মনন ও দ্রোহাত্মক বাম মনোভাব সেই প্রচারের একটা বড় বাধা ছিল এতদিন। বাংলার মাটিতে প্রেম-কবিতা-দ্রোহ-বিপ্লব-- এই সংস্কৃতিকে সমূলে উৎপাটন করতে না পারলে হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে, ‘মোদী-শাহ’ এটা ভালো করেই জানেন। তাই মোদীর মুখে তীব্র ঘৃণাভাষণ; নির্বাচন কমিশন ‘স্নেহান্ধ’ ধৃতরাষ্ট্র। আরএসএস ও তার ভাবপোষ্য বিশ্বস্ত দল বিজেপি বুঝেছে হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের এটাই তাদের শেষ সুযোগ। 

কেন্দ্রীয় সরকারে একক দল হিসেবে বিজেপি তৃতীয়বার নিরঙ্কুশ সাংখ্যাগরিষ্ঠ না হলে তাদের একশো বছরের ‘সংগ্রাম’-এর জলাঞ্জলি হবে। বিফলে যাবে রামমন্দির নির্মাণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ ও এনআরসি করার খাতা। তাই দরকার 'অব কি বার চারশ পার' করার  শপথপূরণ। বিগত পাঁচ বছরে বিপুল গরিষ্ঠতার বাহানায় করোনার মতো অতিমারীর ‘সুযোগ’ নিয়ে তারা একের পর এক এমন সব বিল পাশ করিয়েছে, যার সাহায্যে একদিকে দেশের যাবতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রগুলি সহ সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ কতিপয় পুঁজিপতিদের হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে, শ্রম আইনে শ্রমিকের অধিকার বিপুলভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে। কৃষি ও শিক্ষার দায় সরকারের কাঁধ থেকে নামিয়ে দেওয়ার ফিকির আজ আর গোপন নেই।  সেই সঙ্গে আরও অধিক মুনাফার জন্য প্রয়োজন সস্তা মজুর; তাই প্রায় রাতারাতি অতি তৎপরতার সঙ্গে এনআরসি আনার চেষ্টা  চলছে। অন্যদিকে দাদন দেওয়ার টোপ দিয়ে কৃষিকে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল নতুন কৃষি আইন। শ্রমকোড আইনে এমন বদল আনা হয়েছে যে, মজুরদের অবস্থান মে-দিবসের আগের জমানায় পৌঁছে গিয়েছে। এবং সর্বোপরি নাগরিকত্ব আইনের সংশোধন করা হয়েছে। এগুলি মূলত একই উদ্দেশ্যের 'ক্রোনোলজি'। 

কথা হল, এই আইনগুলি এত কর্কশ ও তীব্রভাবে জনবিরোধী যে, এর একটাও বিজেপির দলীয় ইশতাহারে ঘোষণা না করে গ্যাসের দামে একশো টাকা ছাড়ের মতো কিছু আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে; যার অধিকাংশই তৃণমূলের ইশতেহার থেকে ফেলু ছাত্রের মতো টুকে নেওয়া। বিজেপি খুব ভালো করেই জানে, পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলি (বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ) জিততে হলে যা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে হিন্দু ভোটের সত্তর থেকে আশি শতাংশের উপর। এই সত্তর-আশির মধ্যে একটা বড় অংশ তফশিলি জাতি উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ; বাংলায় এঁদের অধিকাংশ মতুয়া, নমঃশূদ্র, রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এঁদের আবার সকলেই ৭১-পূর্ব ও পরে ভারতে এসেছেন। দীর্ঘকাল ভারতে বাস করে রেশন কার্ড থেকে আধার ও ভোটের পরিচয় পত্র প্রায় সবই অর্জিত হয়েছে। অনেকেই সরকারি চাকরিবাকরি করছেন। বছর বছর নানা কিসিমের ভোটে নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন। তারপরেও নাগরিকত্বের জন্য এঁদের এক অংশের হীনম্মন্য আবদার আর সেই বাঞ্ছা মেটানোর জন্য অমিত শাহের প্রতিশ্রুতি বিলোনো দেখে চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্বগুলোর কথা মনে পড়বেই।  

বাংলা জেতার জন্য মোদী-শাহ্‌ কেন্দ্রীয় সরকারের সব কাজ ফেলে প্রায় গোটা ক্যাবিনেট নিয়ে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছিলেন গত বিধানসভা নির্বাচনে। এবার বোধহয় তাঁরা জনসংযোগের তোয়াক্কা করবেন না। বরং পাগলা কুকুরের মতো সরাসরি ইডি-সিবিআই-আইটি-আদালত লেলিয়ে দিয়ে কাজ সারবেন। ঝাড়খণ্ড ও দিল্লীর মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করে জেলে পুরে এবং কংগ্রেসের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে প্রায় বিরোধী শূন্য ময়দান প্রস্তুত। বাংলায়ও ইডি-সিবিআই লেলিয়ে দেওয়া চলছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এখনও চার্জশিট দিতে না পারায় উচ্চ আদালতের বকুনিও চলছে। এদিকে হাইকোর্ট পাঁচ হাজারের দুর্নীতির জন্য প্রায় ছাব্বিশ হাজারের চাকরি খেয়ে ভোটের ময়দানে বিজেপির পক্ষে একটা ‘সোর মাচানো’ বল তৃণমূলের কোর্টে ঠেলে দিয়েছে। এর পাশাপাশি নিয়ম করে প্রায় প্রতিটি সভায় বিজেপির সব স্তরের নেতানেত্রী ক্রমাগত চরম মিথ্যে ও ঘৃণ্য ভাষণ দিয়ে চলেছেন। অমিত শাহ আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, একজনও 'ঘুসপেটিয়া'কে (বাঙালিকে এঁরা উইপোকা বলেই মনে করেন) ভারতে থাকতে দেওয়া হবে না। সিএএ আইন পাশের চার বছর পর লোকসভা ভোটের আগে এর নিয়মকানুন প্রকাশিত হয়েছে। এবার সমস্ত মতুয়া ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। এই সংবাদে উক্ত সম্প্রদায়ের অনেকেই উদ্বাহু হয়ে ধেই ধেই নাচছেন। 

তাঁরা কি ভেবে দেখেছেন, নাগরিকত্ব যদি দিতেই হয় তবে নিঃশর্তে নয় কেন? অন্য দেশের আক্রান্ত মুসলমানরা সেই তালিকায় কেন থাকবে না? নাগরিকত্ব দানের আইনটি তা হলে সংবিধান বিরোধী নয় কি? এই আইনটি কি আদৌ সকলে খুঁটিয়ে পড়েছেন? একবার আবেদন করলেই তিনি ঘোষিতভাবে বে-নাগরিক হয়ে যাবেন জেনেও আবেদন করবেন? অন্য দেশে ধর্মীয় কারণে আক্রান্ত হওয়ার বা সেই দেশের নাগরিকত্বের কোনও তমসুক বা কাগজপত্র আপনার আছে তো? 'ঘুসপেটিয়া' বলতে অমিত শাহ্‌ কাদের বোঝাচ্ছেন? হিন্দুদের, নাকি মুসলমানদের? মুক্তিযুদ্ধের পরে ওপার বাংলা থেকে আসা মুসলমানদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। ওপার থেকে আসা ৯৮ শতাংশই হিন্দু। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ‘ঘুসপেটিয়া’ বলে হিন্দুদেরই অপমান করছেন না? মতুয়ারা কেন সেই অপমান সহ্য করছেন? দেশভাগের জন্য মূলত দায়ী স্বাধীনতা পূর্বকালের নেতৃবৃন্দ, বিশেষত জনসংঘের জনক শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। তাঁর কৃতকর্মের দায় কেন মতুয়ারা নেবেন? প্রায় সকল মতুয়াই বিগত নির্বাচনগুলিতে অংশ নিয়ে নাগরিকের দায়িত্ব পালন করেছেন; পাশাপাশি রেশন ও নানা সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নাগরিকত্ব পাকা করেছেন। যদি তাঁরা নাগরিক না-ই হন তাহলে তাঁদের দেওয়া ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য উভয় সরকারই কি অবৈধ হয়ে যায় না? সেই ‘অবৈধ’ সরকারের ফরমান কেন একজন স্বাধীন নাগরিক মানবেন? 

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যে মুহূর্তে সরকারি পোর্টালে বা ‘গোলাপি কাগজে’ কেউ লিখিত আবেদন জানাবেন সেই মুহূর্তে সিএএ অনুযায়ী তাঁর নাগরিকত্ব ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে। তাঁর যাবতীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও চাকরি-ব্যবসা ‘সিজ’ করা হবে। এবং তাঁকে লিখিত প্রমাণ দিতে হবে যে, তিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশের পুলিশ কি আজ কোনও মতুয়াকে উক্ত মর্মে জেনারেল ডায়েরি বা এফআইআর করতে দেবে? যদি দেয়ও তবু আপনার মামলার নিষ্পত্তি হতে হতে এক দশক থেকে দেড় দশক কেটে যাবে। ঐ সময় আপনি জেলে বা ডিটেনশন ক্যাম্পে অন্তরীণ থাকবেন। সিএএ-তে কোনও নিঃশর্ত নাগরিকতা দেওয়ার কথা নেই। ইতিপূর্বে যে ৩২ হাজার জন আবেদনকারী উপরোক্ত বয়ানে ভারতের নাগরিক হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন, তার সঙ্গে মতুয়া-নমঃশূদ্রদের কোনও সম্পর্ক নেই। সিএএ আসলে খুড়োর কলের একটি গাজর। যা কোনওদিন মতুয়াদের নাগালে আসবে না। 

এই পর্যন্ত পড়ে হয়তো আমরা সবাই ভাবছি, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি এত বড় ‘ঢপ’ দিতে পারেন? এ যে দিন-দহারে সমুদ্রসমান মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। মনে রাখুন, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' বলে 'বন্ড-ই-ভারত'-এর চুরিবিদ্যা ও তোলাবাজি কিন্তু এই দুই হুজুরেরই মগজপ্রসূত যা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত। এইখানে চার্লস স্টেনগার-কে স্মরণ করব। তিনি জানিয়েছেন, যে-প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা প্রায় অসম্ভব সেই প্রতিশ্রুতি বারবার দিলে সাধারণের মনে একটা ইতিবাচক আগ্রহ তৈরি হয়। এই মনোভাব আরও গভীর হয় গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের উদ্দেশে পুনঃপ্রচারিত হলে। খেয়াল করে দেখুন, চার্লস স্টেনগার-এর তত্ত্ব অনুযায়ী বিজেপি পাকিস্তানকে আমাদের কল্পিত শত্রু বানিয়ে রেখেছে, মাঝে মাঝে কিছু জওয়ানকে ‘বলি’ দিয়ে সীমান্তে যুদ্ধজিগির জাগিয়ে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, হিন্দুদের বিকাশের পথে প্রধান বাধা হিসেবে মুসলমানদের প্রতিপক্ষও বানিয়ে ছেড়েছে। ইতিহাস থেকে 'হাপিস' করে দেওয়া হয়েছে একটা গোটা মোগল যুগ। 

সরকারি তথ্য পরিসংখ্যানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তাঁরা দিনের পর দিন প্রচার করে চলেছেন, মুসলমানদের  চারটে পাঁচটা করে বিয়ে; চোদ্দ-পনেরোটা করে কাচ্চাবাচ্চা। আগামী দশ-বিশ বছরেই 'ওরা' নাকি ভারতের দখল নিয়ে নেবে। ১৪ শতাংশ ৮৬ শতাংশকে এইভাবে নাকি গিলে নেবে। বিজেপি-আরএসএস এবং এদের আইটি সেল নিরন্তর এই মিথ্যা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে সারা ভারত জুড়ে সংখ্যালঘু মানুষ জঘন্য হিংসার শিকার হচ্ছেন। এবং বিজেপির দলীয় উদ্যোগে তা সামাজিক মান্যতা পাচ্ছে। সংখ্যালঘু এলাকায় চলেছে হাড়হিম ত্রাসের রাজত্ব। ভোটের এই হিংসাত্মক আবহে অমিত শাহের মিথ্যা প্রচারের ফাঁদে পা দিয়ে মতুয়ারা বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন অসমের হাতেগরম অভিজ্ঞতার কথা। বিজেপিকে ভোট দিয়ে মতুয়ারা যদি জেতান, তবে সবার আগে কিন্তু তাঁরাই ডিটেনশন ক্যাম্পে যাবেন। মাকড়সার জাল যত সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত হোক না কেন, খাদ্য সংগ্রহই তার একমাত্র উদ্দেশ্য। কয়েক লক্ষ মতুয়া বাঙালিকে বসিয়ে খাওয়ানোর জন্য অসমে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হয়নি। জেনে রাখুন, সিএএ আম্বানি-আদানিদের সস্তার মজুর সাপ্লাই দেওয়ার জন্য একটি ছলনাজাল মাত্র।


Friday, 26 April 2024

সততা সততই ত্যাজ্য!

যখন বিচারের এক চোখে ঠুলি

মালবিকা মিত্র



সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ সকলের থাকে না। আবার কারও কারও থাকে। আমার দিদিমা বিদ্রূপ করে বলতেন, এত সূক্ষ্ম যে 'আছে নাকি নাই হেইয়াই বোঝা যায় না'। কথাটা উঠল, নির্বাচন কমিশন পশ্চিমবাংলার স্বঘোষিত দাপুটে বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষকে কিছুদিন আগে 'সেন্সর' করায় ও তাঁকে 'নজরবন্দী' রাখায়। কমিশনের এই ঘোষণাকে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দিলীপ ঘোষ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন এই বলে যে, 'মেসোমশাইকে' নালিশ করেছে, 'মেসোমশাই' ব্যবস্থা নিয়েছে। এরপরেও দিলীপবাবু নির্বিকার ভাবে তুড়ি মারা ভঙ্গিতে অনর্গল কুকথা বলে চলেছেন। 

এদিকে প্রাক-নির্বাচনী পরিস্থিতিতে রামনবমীর সশস্ত্র মিছিল সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণ হতে পারে- এই আবেদনকে বিবেচনা করে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, দুশো জনের বেশি রামনবমীর জমায়েত করা যাবে না; আর সশস্ত্র জমায়েত কখনই নয়। কী আশ্চর্যের ব্যাপার, উত্তরবঙ্গে সভা করতে এসে মোদীজী স্বয়ং বলে গেলেন, এবারের রামনবমী হবে অনেক বেশি জাঁকজমক ও ধূমধাম করে, কারণ, এই বছর রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছে। দিলীপ ঘোষ সংবাদমাধ্যমকে সরাসরি বললেন, মানুষের আবেগ বলে কথা, পঞ্চাশ হাজার মানুষের জমায়েত হবে; যা হয় আমি দেখে নেব, আমি দিলীপ ঘোষ, সেই মিছিলে থাকব। অক্ষম অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র (নির্বাচন কমিশন) এসব কিছুই শোনেন না, দেখেন না। হাওড়ায়, বীরভূমে সশস্ত্র মিছিলের ছবি দেখলাম টিভি'তে। প্রায় সর্বত্রই সশস্ত্র মিছিল, দুশোর অনেক বেশি জমায়েত, ডিজে বাজিয়ে নৃত্য, প্ররোচনামূলক শ্লোগান ও অন্য ধর্মের প্রার্থনা-গৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হামলা অথবা কটূক্তি। মুর্শিদাবাদের বেলডাঙ্গা অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘর্ষও হল- তা নিয়ে এখন নির্বাচন কমিশনের তরফে সিআইডি তদন্তের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। তো, এই যে ব্যাপক ভাবে আদালত অবমাননা হল, তার বিরুদ্ধে আদালত কি কোনও ব্যবস্থা নিল? ভো-কাট্টা! এত সূক্ষ্ম মান-অপমান বোধ যে বোঝাই গেল না। 

২০১৯ সালে ভোটের প্রাক্কালে নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ অন্তত পাঁচটি ক্ষেত্রে আদর্শ আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন বলে মনে করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার অশোক লাভোস। এরপর আর এমন দৃঢ়তা চোখে পড়েনি। যদিও কমিশনের বাকি দুই সদস্য তাঁর সঙ্গে সহমত পোষণ করেননি। প্রাতিষ্ঠানিক গোপনীয়তার যুক্তিতে লাভোসের বক্তব্য প্রকাশ করা হয়নি। যে ইন্দিরা গান্ধী এবং তাঁর শাসনকাল নিয়ে এত নিন্দামন্দ, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহন সিনহা সেই ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন। দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকি তাঁর নির্বাচন খারিজ করে দেওয়া হয়। অভিযোগ ছিল, প্রশাসনকে কাজে লাগানো ও সরকারি অর্থ খরচ এবং দলীয় কাজে সরকারি আধিকারিকদের ব্যবহার। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের একজন আধিকারিক ছিলেন যশপাল কাপুর। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী এজেন্ট হওয়ার আগেই ওই পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনী জনসভায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণের আগে তাঁর ইস্তফাপত্র আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়নি। এই কারণে ইন্দিরা গান্ধী অপরাধী ঘোষিত হয়ে ছয় বছরের জন্য নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নির্বাসিত হন। 

এইসব আইন কিছুই লুপ্ত হয়নি। আজও আছে। কিন্তু সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকরের বক্তব্যটি খুবই প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ভালো সংবিধান খারাপ সংবিধান বলে কিছু হয় না, সংবিধানটা কাদের হাতে রয়েছে সেটাই আসল কথা। অর্থাৎ, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কলঙ্কিত শাসনেও বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন যে দৃঢ়তায় শিরদাঁড়া সোজা রাখার ক্ষমতা দেখিয়েছিল, আজ সেই ক্ষমতাটুকু বুঝি উধাও। হবে নাই বা কেন, বিজেপি'র বড় থেকে চুনোপুটি নেতা সকলেই বুঝে গেছেন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, সিবিআই, ইডি এসব আসলে প্রহসন। বিজেপি নেতাদের কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা এদের নেই। একজন বিজেপির নেতা যদি রাজভবনে দাঁড়িয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে পারে, 'আমাদের রাজ্যপাল, আমাদের কেন্দ্রীয় বাহিনী, আমাদের কেন্দ্রীয় এজেন্সি, দেখি কীভাবে এরা সরকার চালায়!', এই বলার মধ্য দিয়ে কর্মীদের মনে রাষ্ট্রের এই স্তম্ভগুলিকে উপেক্ষা ও অবজ্ঞা করতে শেখানো হয়। রঞ্জন গগৈ যে ভাবে হাতে গরম পুরস্কার লাভ করে তৃপ্ত থাকেন, একজন বিজেপি কর্মীর কাছে তখন সমগ্র বিচার ব্যবস্থার ভাবমূর্তি ভেঙে পড়ে। 

চেয়ারে থাকাকালীন হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় যে সমস্ত কথাবার্তা বলেছেন, এমনকি তাঁর একটি রায়কে সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত রাখার পর প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলেন 'সুপ্রিম কোর্ট যুগ যুগ জিও'। এসব কথার পর সেই বিচারপতি ঠিক লোকসভা নির্বাচনের মুখে নিজ পদে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির প্রার্থী হলেন। এবার বলুন দেখি, তাঁর কোন কোন রায়গুলি 'নিরপেক্ষ' বা ন্যায়ের পক্ষে ছিল আর কোনগুলি তাঁর দলের রাজনৈতিক সুবিধা করে দেওয়ার জন্য? তদুপরি, তমলুক সহ সারা পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি কর্মীদের কাছে হাইকোর্টের বিচারপতিদের ভাবমূর্তিটা কী দাঁড়ালো? দুশো টাকা নিয়ে মিছিলে যাওয়া বিজেপি কর্মী, অথবা দু' হাজার টাকা নিয়ে ভোট দিতে যাওয়া বিজেপি কর্মীর চোখে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বা রঞ্জন গগৈ তাঁদের সমকক্ষ হয়ে পড়ে। বাড়তি মর্যাদা লুপ্ত হয়। 

শুধু তো এখানেই শেষ নয়, অশোক লোভাস শিরদাঁড়া সোজা রাখার জন্য কী কী মূল্য চুকালেন, সেটাও মনে করে দেখুন। স্ত্রী নাভেল, পুত্র আবির, ভগিনী শকুন্তলা প্রত্যেকের ওপর চলেছে এজেন্সির পীড়ন ও হয়রানি। এ প্রসঙ্গে অশোক লোভাসের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য-- এমন প্রত্যাশা ঠিক নয় যে, যাদের বিরোধিতা করা হচ্ছে, তারা নম্রভাবে বিরুদ্ধতার উত্থান মেনে নেবে। তারাও প্রত্যাঘাত করবে। সততার মূল্য দিয়ে পেতে হয় একাকিত্বের যন্ত্রণা বোধ ও প্রকাশ্য বিচ্ছিন্নতা। বন্ধু বা শত্রু- উভয়ের কাছে সততা ত্যাজ্য।

সততার পথে প্রাপ্ত ২০১৬ সালের রাজ্য শিক্ষা দফতরের প্যানেলের প্রায় ২০,০০০ শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মীদের চাকরি (দোষী ও নির্দোষ আলাদা না করতে পারার অপারগতায়) যখন আদালতের এক ভয়ঙ্কর রায়ে বাতিল হয়ে গেল, তখন এই বাচনটিই তো আরেকবার সাব্যস্ত হয় যে, সততা সততই ত্যাজ্য। কারণ, ন্যায় দণ্ড হাতে আদালতই যখন দোষী আর নির্দোষকে আলাদা করতে পারে না, তখন নির্দোষদের নির্বিচার দণ্ড দিতে তাদের হাত বা কলম কাঁপবেই বা কেন! অথচ, কত আদিখ্যেতা করে বলা হয়, দশজন দোষী যদি পার পেয়েও যায়, তবুও যেন একজন নির্দোষ সাজা না পায়। 

কিন্তু বিপদ আরও গভীর ও নির্মম। যখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিচারব্যবস্থা সাঁট করে চলে, তখন তাকে আর বিচারব্যবস্থা বলা যায় না! এক সামগ্রিক ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থায় তা পর্যবসিত হয়। বিরোধী দলনেতা গত সপ্তাহের শুক্রবার বললেন, আগামী সপ্তাহে একটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত থাকুন যা শাসক দলকে তছনছ করে দেবে; এ সপ্তাহের ঠিক সোমবারই আদালতের রায়ে ২৫,৭৫৩ জনের চাকরি বেমালুম লোপাট হয়ে গেল। আবার বিজেপি'র এক এমএলএ দু' দিন আগে জোর ঘোষণা দিয়েছেন যে খুব শিগগির ৫৯,০০০ প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি যাবে। সেই ঘোষণাকে সমর্থন করে বিরোধী দলনেতাও তালি মেরে বলেছেন, আগামী সপ্তাহেই তা হবে। যুক্তিগ্রাহ্য মনে প্রশ্ন উঠছে, রায়গুলি আসলে কে লিখছে?

এ কি এক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে মারার, কর্মহীন করার এক নৃশংস অভিসন্ধিমূলক যুদ্ধ? বাংলাকে ভাতে ও কাজে মারতে পারলে তবেই দেশ জুড়ে ফ্যাসিবাদ সম্ভব হতে পারে! এ কথা কিছুটা ঘুরিয়ে অমিত শাহ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর এইভাবে বলেছিলেন যে, তাঁদের 'ভারত জয়' এখনও সম্পূর্ণ হয়নি এবং তা সেদিনই হবে যেদিন তাঁরা বাংলাকে জয় করতে পারবেন। মনে রাখবেন, যাঁদের চাকরি গেল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু ছিলেন 'অন্ধভক্ত', তবুও তাঁরা রেহাই পাননি!

 

Sunday, 21 April 2024

সোনার হরিণ চাই!

বদলে যাওয়া 'সোনা'র অর্থনীতি

পার্থ হালদার



কিছুদিন যাবৎই নিয়মিত যে খবরটা চোখে পড়ছে বা কানে আসছে তা হল, সোনা বা রূপোর দামের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। যাদের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে বা কোনও অনুষ্ঠান আছে, তাদের প্রায় মাথায় হাত; অন্যদিকে, যাদের বাড়ির সিন্দুকে বা ব্যাঙ্কের লকারে স্বর্ণালঙ্কার মজুত আছে, তারা বেশ উল্লসিত। আবার অনেকেই ভাবছেন, এখন যদি সোনার অলঙ্কারে বিনিয়োগ করি তাহলে কতটা লাভ বা লোকসানের সম্ভাবনা? 

প্রশ্ন হল, হঠাৎ সোনা-রূপোর দামের এই দ্রুত উত্থানের কারণ কী? তা বুঝতে হলে আমাদের কয়েক বছর পিছিয়ে যেতে হবে সেই করোনার সময়ে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্টের ফেডারেল রিজার্ভ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক গুন বেশি ডলার ছাপিয়ে তাদের নিজেদের ও অন্যান্য দেশে জোগান দিতে থাকে, যার পোশাকি নাম Quantitative Easing বা QE। ফলে, করোনার পরবর্তীকালে এক অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতির সম্মুখীন হয় আমেরিকা সহ গোটা পৃথিবী। এই মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে বাঁচবার জন্য করোনার পরবর্তী বছরগুলিতে আমেরিকার ফেডারাল রিজার্ভ ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক (ভারতের ক্ষেত্রে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক) সুদের হার বৃদ্ধি করতে থাকে; অর্থনীতির ভাষায় যাকে বলে 'Tightening'। এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্টের মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে মাথা নামাতে শুরু করে। আমাদের দেশেও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে পাইকারি মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা স্বস্তি দিলেও মাথা তুলে আছে খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি এবং এই অবস্থায় আমেরিকা সহ সমস্ত দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক সুদের হার আর বৃদ্ধি করছে না, বরং আগামী এক বছরে তা কমানোর কথা ঘোষণা করেছে; যার দরুণ বিকল্প রাস্তায় অধিক উপার্জনের জন্য পৃথিবীব্যাপী সোনা এবং রূপোতে বিনিয়োগ শুরু হয়ে যায়, আর তা থেকেই এই দৌড়ের সূত্রপাত।

অনেকেই বলবেন, শেয়ার বাজারও তো রোজই নতুন উচ্চতায় পৌঁছচ্ছে, অতএব, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলেই তো হয়! কিন্তু ভালোভাবে লক্ষ করলে অনেকেই বুঝতে পারছেন যে, বহু মিডক্যাপ ও স্মলক্যাপ শেয়ার কিন্তু পূর্বের উচ্চতা থেকে বেশ নিচে নেমে গেছে। তাছাড়া, বর্তমান আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেল পিছু ৯০ ডলারের উপর পৌছে যাওয়ায় ভারতের মতো দেশে মুদ্রাস্ফীতি কমার এই মুহূর্তে কোনও লক্ষণ নেই। তাই, শেয়ার বাজারের ভিত কতটা মজবুত তা বলা মুশকিল; সামান্য একটু উত্থানের পর তা বারবার নিচে নেমে আসছে। এই অবস্থায় তুলনামূলক বিচারে সোনা বা রূপোতে বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত স্বস্তিদায়ক ও লাভজনক বলে বিনিয়োগকারীরা মনে করছেন।

সোনা বা রূপোতে বিনিয়োগ বলতেই আপামর বাঙালির চোখের সামনে জুয়েলারি দোকানের ছবি ভেসে ওঠে এবং সোনা কেনা মানেই স্বর্ণালঙ্কার, এরকম একটি প্রচলিত ধারণা আছে। কিন্তু এর বাইরেও জগৎ আছে। সেই বিকল্প রাস্তাটি হল: (১) গোল্ড বন্ড ও (২) গোল্ড ইটিএফ। 

গোল্ড বন্ড যা ভারত সরকারের অনুমতিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দ্বারা জারি করা হয় এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সরকারি ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক এবং স্টক হোল্ডিং কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া'র মাধ্যমে তা বিনিয়োগকারীদের কাছে পৌঁছে যায়। এই বন্ডের দাম সোনার বাজার দরের উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ, বন্ডে বিনিয়োগের সময়ে প্রতি গ্রাম সোনার বাজার দর ও ম্যাচিওরিটির সময় সোনার বাজার দরের যা তফাত তা বিনিয়োগকারী মোট বিনিয়োগকৃত পুঁজির সঙ্গে পেয়ে থাকেন। ম্যাচুওরিটির সময়ে লাভের উপর কোনও কর দিতে হয় না। 

অপর যে ব্যবস্থাটি-- গোল্ড বা সিলভার ইটি ক্রয়-- ভারতবর্ষে বিএসই বা এনএসই এই দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ-এর ব্রোকারদের মাধ্যমে এখানে বিনিয়োগ করা যায়। এর জন্য ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট থাকা জরুরি। এই ব্যবস্থাটি সাধারণ ভাবে কোনও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির দ্বারা পরিচালিত হয়। যেমন, এসবিআই অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট, নিপ্পন ইন্ডিয়া অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি। এর প্রতিটি ইউনিট সোনা এবং রূপোর প্রতি গ্রামের দাম ওঠানামার ওপর প্রায় সমানভাবে নির্ভর করে। এর সুবিধা হল, অত্যন্ত অল্প পুঁজি থাকলেও এতে বিনিয়োগ করা সম্ভব (এমনকি ১০০ টাকাও)। দ্বিতীয়ত, সোনা বা রূপো রাখার জন্য আলাদা কোনও সুরক্ষিত স্থানের দরকার পড়ে না এবং যে কোনও সময়ে তা বাজারে বিক্রি করে পুঁজি এবং লাভ ফেরত নেওয়া যায়।

সাধারণ জুয়েলারি দোকান থেকে সোনার গহনা কেনার থেকে এই বিকল্প ব্যবস্থা দুটি বেশ আলাদা। কারণ, জুয়েলারি দোকানে গেলে অতিথি অভ্যর্থনা, কফি অথবা কোল্ড-ড্রিংক্স এসব পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু গহনা বিক্রির সময় মজুরি, জিএসটি এবং অন্যান্য বহু খরচ বাবদ প্রায় ২০ থেকে ২৫ শতাংশ টাকা গচ্ছা যায়। অর্থাৎ, গহনা কেনার পর সোনার দাম ২৫ শতাংশ বেড়ে গেলেও বিনিয়োগকারীর হাতে প্রায় কিছুই আসে না। অবশ্য, গোল্ড বন্ড ও গোল্ড ইটিএফ'এর ক্ষেত্রে ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য এবং তার বাৎসরিক ফি হিসাবে কিছু টাকা দিতে হয়। কিন্তু সে অর্থের পরিমাণ খুবই কম। এই ব্যবস্থায় সোনা বা রূপো কেনার সময় তার বিশুদ্ধতা নিয়ে মাথাব্যথারও কোনও কারণ নেই এবং এর লাভের উপর আয়কর সাধারণ ক্যাপিটাল ট্যাক্সের মতোই। তাছাড়া বিনিয়োগকৃত পুঁজির সামান্য অংশও দরকারে বিক্রি করে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। কিন্তু স্বর্ণালঙ্কারের ক্ষেত্রে এরকম কিছু করা যায় না।

বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে, মুদ্রাস্ফীতির ভূত সারা পৃথিবীময় ছুটে বেড়াচ্ছে। ভারতও তার ব্যতিক্রম নয়। তার হাত থেকে নিস্তারের লক্ষ্যে যদি আরও কিছুদিন সুদ কমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ব্যাহত হতে  বাধ্য। তাই সরাসরি শেয়ার বাজারে সামান্য একটু উত্থান হলেই আবার তা কারেকশন'এর সম্মুখীন হচ্ছে। অন্যদিকে, ইজরায়েল ও ইরানের মধ্যে নতুন করে যুদ্ধের সম্ভাবনার মধ্যে অপরিশোধিত তেলের দাম বেশ উর্ধ্বমুখি, তাই পৃথিবীর যে দেশগুলি তেল আমদানির উপর নির্ভরশীল তাদের অর্থনীতিতে যে বিপুল চাপ পড়বে তা বলাই বাহুল্য। 

সেই কারণেই যারা অধিক অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছেন বা করবেন বলে ভাবছেন তারা আলাদা কোনও ঝক্কি ছাড়াই সোনা-রূপোর বাজারে বিনিয়োগ করে নিজেদের ঝুঁকি কম করতে পারেন। তাই অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে বোঝার সঙ্গে সঙ্গে আজ শেয়ার ও সোনা-রূপো বাজারের অর্থনীতিকেও সম্যক ভাবে বুঝতে হবে। দুনিয়া জুড়ে অর্থের চলমানতায় যে দুরন্ত গতি ও বিচিত্র ধারা এসেছে, প্রযুক্তি বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্মিলনে তার যে বিভিন্ন রূপ ও অবয়ব, তাকে বুঝতে ও যুঝতে হলে উদীয়মান নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতিকে রীতিমতো রপ্ত করতে হবে। 

পৃথিবী যে আগের মতো আর নেই, তা বলাই বাহুল্য। চোখকান খোলা রাখা এবং প্রয়োজনে নতুন চিন্তার কাণ্ডারী ও পেশাদার পরামর্শদাতাদের কথা শোনাও জরুরি। 


Saturday, 20 April 2024

শিল্পীকৃত বই

একাধারে বই ও শিল্পবস্তু

তন্ময় সাঁতরা



দৃশ্যকলা চর্চা ও সৃজনের অঙ্গনে শিল্পীকৃত বইয়ের (artist’s book) একটি বিশেষ স্থান রয়েছে। এই বই মূলত শিল্পী নিজেই বানায়, যা প্রদর্শিত হয় শিল্পবস্তু (art object) হিসেবে। বই বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, তার মতো এও লেখক (এ ক্ষেত্রে শিল্পী) ও পাঠকের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। তবুও এর কিছু বিশেষত্ব আছে যা একে কিছুটা আলাদা করে চেনায়। এর মধ্যে হাতে লেখা অংশ কিংবা ছাপা অক্ষর (text), রেখাচিত্র, রঙিন চিত্রিত অংশ, ছাপাই ছবি, কোলাজ— এরকম বহু কিছু থাকতে পারে। সে-হিসেবে এটি ইউনিক বা অনন্য এবং কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া এর দ্বিতীয় বা একাধিক কপি থাকে না। তাই শিল্পীকৃত বই তথাকথিত বইয়ের সীমা তো অতিক্রম করেই; তাছাড়াও দৃশ্যতা ও আঙ্গিকের ক্ষেত্রে এর প্রসারের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।




যদিও ‘বই’ বলা হচ্ছে, তবুও শিল্পীকৃত বই অনেক ক্ষেত্রেই বইয়ের আকারেই কেবল সীমাবদ্ধ থাকে না। তাই এর রূপ বা আকার কখনও স্ক্রোল পেইন্টিং-এর মতো, কখনও জাপানি পাখা বা অ্যাকর্ডিয়নের মতো, কখনও বা কিছুটা ভাস্কর্য-সুলভ হয়ে উঠতে পারে। কখনও বা এর পৃষ্ঠাগুলি বাঁধাই না করে একটি বাক্সের মধ্যে রেখে দেওয়া হল দর্শক বা পাঠকের জন্য। এই ধরনের বেশির ভাগ বই হাতে নিয়ে পড়ার জন্য নয়। হয়তো টেবিল বা অন্য কিছুর উপর রাখা থাকল। কখনও বা দর্শক বা পাঠক এই  শিল্পবস্তুটির চারদিকে ঘুরে ঘুরে এর লেখাগুলি পড়েন। এখন এও নিশ্চয় খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে যে শিল্পীকৃত বইয়ের উপকরণ কেবল মাত্র কাগজ হবে না। কাপড়, প্লাস্টিক, ধাতব পাত, কাঠ, প্লাইউড, চামড়া—এমন অনেক কিছুই এই শিল্পবস্তু তৈরিতে ব্যবহৃত হতে পারে। 



প্রকাশ-ভঙ্গি, বিষয় ও শৈল্পিক প্রয়োজন অনুযায়ী মাধ্যম নির্বাচন করে নেন শিল্পী। এই প্রকার বই নির্মাণে তাই শিল্পীর থাকে অবাধ স্বাধীনতা। আর তাই প্রভূত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে তিনি পৌঁছেও যেতে পারেন তাঁর কাঙ্ক্ষিত শৈলী ও নির্মাণের ভাষাতে। কোনও কোনও শিল্পী পুরনো ও পরিত্যক্ত বইকে শিল্পবস্তুতে রূপান্তরিত করতে ভালবাসেন। শিল্পীকৃত বইয়ের এও একটি প্রকার। সেখানে বইটি নব কলেবর লাভ করে এবং পুনরাবিষ্কৃত হওয়ার সুযোগ পায়। কখনও কখনও আলোর ব্যবহার করেও এই প্রকার শিল্পবস্তুর দৃশ্যতায় আরেকটি মাত্রা যোগ করা হয়ে থাকে। ওয়াটারমার্ক বা কাগজের অন্তর্নিহিত স্তরের কিছু অংশ তাতে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে।



শিল্পীকৃত বইয়ের উৎস খুঁজতে গেলে আমাদের চলে যেতে হয় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রসিদ্ধ কবি ও শিল্পী উইলিয়াম ব্লেকের কাছে। তাঁর ‘Songs of Innocence and of Experience’ বইটির পাতাগুলি ভরে উঠেছিল তাঁরই লেখা কবিতা, আঁকা ছবি, এনগ্রেভিং ইত্যাদির অনবদ্য সমাহারে। এই সৃজনে তাঁর সাহিত্যকর্ম ও শিল্পকর্ম একীভূত হয়েছিল। তাই বিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে শিল্পীদের মধ্যে এই আর্ট ফর্মটির প্রতি আগ্রহ বর্ধিত হওয়ার ব্যাপারে বিগত শতকের শিল্পী-কবি উইলিয়াম ব্লেকের অগ্রণী ভূমিকা অসীম। এই ধরনের বই প্রকাশনার ক্ষেত্রেও শিল্পী (বা লেখক) পেয়ে যান এক অভূতপূর্ব স্বাধীনতার স্বাদ— বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনিই প্রকাশক ও পরিবেশক। শিল্পীমহলে এর জনপ্রিয়তার প্রসারের কারণ হিসেবে এও এক গুরুত্বপূর্ণ দিক। 

এ কথা সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এই ধরনের সৃজন ও নির্মাণের জন্য একসঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের দক্ষতার প্রয়োজন। তাই কখনও একাধিক ব্যক্তির সহযোগিতায় তা হয়ে উঠতে পারে কোলাবোরেটিভ। তবে এ কথা বলা চলে না যে, শিল্পকলায় শিক্ষা-প্রাপ্ত পেশাদার শিল্পী বা নকশাকাররাই কেবল এই আর্ট ফর্মটির সৃজনের সঙ্গে যুক্ত। সংবেদনশীল মন এবং সৃজনের আগ্রহও কাউকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে অনেক দূর পথ। ইউরোপ, আমেরিকা ও সুদূর প্রাচ্যের অনেক দেশেই এর চর্চার প্রসার ও জনপ্রিয়তা দেখা গেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। এমন কি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পঠন-পাঠনেও স্থান পেয়েছে শিল্পীকৃত বই। তেমন অনেক দেশের কিছু প্রকাশনা সংস্থারও যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা গেছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা ও সচেতনতার অভাবে এ দেশে এর প্রসার, প্রচার ও চর্চা সীমিত থেকে গিয়েছে। তাই এ দেশের হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পীই এই আর্ট ফর্মটিকে তাঁদের অন্যতম প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই মাধ্যমটির বিশেষত্ব এবং সম্ভাবনাই তাঁদের এই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। 



কখনও সখনও শিল্পীকৃত বইয়ের একাধিক কপি তৈরির কথা ভাবা হয়ে থাকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে লিমিটেড এডিশন। আর প্রায়শই সেগুলি দেখতে হুবহু এক হয় না। সেই কারণে তথাকথিত বইয়ের তুলনায় এর অর্থমূল্য অনেক বেশি হয়। আর্ট গ্যালারি বা কয়েকজন শিল্পকলার সংগ্রাহক ছাড়া কজনই বা আমাদের দেশে এর কদর করেন বা সংগ্রহ করার জন্য এগিয়ে আসেন?

এই আর্ট ফর্মটি সম্পর্কে বর্তমান প্রবন্ধকারের অল্প-স্বল্প কিছু ধারণা ও সৃজনের বাসনা থাকলেও কিছুদিন আগে পর্যন্ত হাতেকলমে কিছুই করা হয়ে ওঠেনি। কিছু বছর যাবৎ ডায়েরির পাতাগুলিকে লেখায় আঁকায় ভরিয়ে তোলার প্রয়াস ছাড়া তা বেশি দূর প্রসারিত হতে পারেনি। এ হেন সময়ে হায়দরাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলা বিভাগে জার্মান শিল্পী ক্যাথেরিনা হোলস্টেইন-স্টুর্মের কর্মশালার আয়োজন খুবই উপযোগী ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। কর্মশালার বিষয় ছিল: শিল্পীকৃত বই (Book Art, Artist’s Book)। ২০২৩-এ প্রথমবার। দ্বিতীয়বারের সপ্তাহব্যাপী কর্মশালা হয়ে গেল এ বছরের (২০২৪) মার্চে।




এটি বর্তমানে আমার কর্মস্থল। এই কর্মশালায় অতিথি শিল্পীর সঙ্গে কোঅর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতে গিয়ে এ বিষয়ে অনেক কিছু জানা গেল। এই আর্ট ফর্মটির কিছু পরিমাণ ইতিহাস এবং সমকালে এর চর্চার নানান বৈচিত্রের দিকগুলি সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু জানার সুযোগ হল। শেখা গেল কাগজ ভাঁজ করার কিছু অভিনব পদ্ধতি আর বই বাঁধাইয়ের কয়েকটি প্রাথমিক টেকনিকও। ছাত্রছাত্রীরা উদ্যমের সঙ্গে হাতেকলমে কাজ করল। সৃজনের সেই পরিবেশ আমাকেও হাতেনাতে কাজ করায় উৎসাহিত করল। তৈরি হল প্রচুর বই। নানা রঙের, নানা ঢঙের। শিল্পকলা বিভাগের প্রাঙ্গণে দু’-দিনের প্রদর্শনীর আয়জনও হল। সেখানে দেখা গেল নানান প্রকার শিল্পীকৃত বইয়ের সম্ভার।



বিষয় হিসেবে উঠে এল মানচিত্র, প্রকৃতি, স্থাপত্য, জীবনযাপন, মানবজীবনে প্রযুক্তির প্রভাব এবং মনোজগতের বিচিত্র দিকগুলি। মাধ্যম হিসেবে কাগজের পাশাপাশি কেউ বেছে নিয়েছে কাপড়, কেউ ধাতব পাত, কেউ প্রাকৃতিক উপাদান—যেমন গাছের শুকনো পাতা, ফুল, শাখা-প্রশাখা। কেউ বা ‘ফাউন্ড অবজেক্ট’ বেছে নিয়েছে। আকার-আকৃতি এবং আঙ্গিকেও দেখা গেল বৈচিত্র্য ও বিস্তারের বিভিন্ন প্রয়াস।  



যে কোনও বইয়ের বিষয়, অন্তর্গত গুণ ও সমৃদ্ধি ছাড়াও একটা আঙ্গিকের দিক থাকে। সামগ্রিক দৃশ্যতা— যেমন প্রচ্ছদ, অক্ষর বিন্যাস, ভেতরের অলংকরণ বা গ্রাফিক্স, অনেক কিছুই তার মধ্যে পড়ে। কোনও কোনও পাঠক বা গুণগ্রাহীর কাছে এই দিকগুলিও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পীকৃত বই এই বিশেষ দিকটির সুপ্রসারণ ও বিস্তার ঘটায়, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। শিল্পীকৃত বই একাধারে বই এবং শিল্পবস্তু। এর পঠিত হওয়ার সম্ভাবনাগুলিও বহুধা বিস্তৃত। সে কারণে এ দেশেও এর চর্চা, সৃজনের সুযোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার বিশেষ প্রয়োজন। আরেকটি কথা, ই-লাইব্রেরি, ই-বুক আর অনলাইন ভার্সানের এই যুগে বইয়ের পাতার স্পর্শ ও গন্ধ যখন সুদূর স্মৃতির মতোই ম্রিয়মান, তখন বইয়ের এমন সুমধুর উদ্‌যাপন বড়ই তৃপ্তির, আনন্দের। 

কৃতজ্ঞতা:

১) ক্যাথেরিনা হোলস্টেইন-স্টুর্ম; 

২) অনুপম চক্রবর্তী, ‘বুক আর্ট’, ১৭৭৮ গ্রন্থচর্চা, ভলিউম-১।


Sunday, 14 April 2024

বাংলা ভাষা যখন দুয়োরানি

বাংলা শিক্ষার হাল-হকিকত

প্রজ্ঞা পারমিতা



বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা ধরনের হা-হুতাশ সরিয়ে রেখে, যারা ভাষাটা শিখছে তাদের মধ্যে কিছু কাজ করে যদি সামান্যতম পরিবর্তনও আনা যায়, সেই তাগিদ থেকে আমরা স্কুলে স্কুলে বাংলা বানান প্রতিযোগিতার আয়োজন করা শুরু করি ২০২২ সাল থেকে। বিগত তিন বছর ধরে সেই কাজ করতে করতে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিশেষত বাংলা শিক্ষার মান নিয়ে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি তা জানানোর উদ্দেশ্যেই আজ লিখতে বসা। যদিও আমরা কী করেছি তার ঢক্কানিনাদ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, কিন্তু বাংলা ভাষা শেখা ও শেখানোর যে বাস্তব ছবিটা পেয়েছি, তা কী করে সম্ভব হল, সে সম্পর্কে প্রথমে একটু লিখতেই হবে; অন্যথায় পূর্বোক্ত ‘আমরা’ কথাটাও স্পষ্ট হবে না। 

বাংলা নিয়ে বানান প্রতিযোগিতার এই ভাবনাটি সুমন গাঙ্গু্লি মহাশয়ের। তিনি ও আমি ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব’ নামে একটি দল পরিচালনা করি যার উদ্দেশ্য বাংলা ভাষা চর্চা। এই গোষ্ঠীর নামেই আমরা প্রতিযোগিতাটি করি যার নাম দিয়েছি ‘বানানবাজি’, সহজ ভাষায় যার অর্থ বানানের বাজি। এখন কথা হল, বানান প্রতিযোগিতা– এই শব্দবন্ধ উচ্চারিত হওয়া মাত্র নিশ্চিত সবার মনে ‘স্পেলিং বি’ এই শব্দ দুটোই ঘাই মারে। অথবা মনে পড়তেও পারে রিচার্ড গিয়র ও জুলিয়েট বিনোশে অভিনীত ‘বি সিজন’ ছবিটির কথা, যে ছবি পৌঁছে দেয় শব্দ ও অক্ষরের অমেয় রহস্যময়তার কাছে। কিন্তু যদি বলি বাংলা বানান প্রতিযোগিতা, তবে মগজের লিঙ্ক-লিস্ট বেমালুম ঘাবড়ে যায়। আসলে দুয়োরানি বাংলা ভাষার তেমন কিছু নেই যে! এই ছবিটা বদলাতে চাইছিলাম আমরা। লক্ষ্য ছিল বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা আবেগময় সচেতনতা সৃষ্টি ও শুদ্ধ বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা। এই লক্ষ্য হয়তো অনেকের অতিউচ্চাশী মনে হবে। কিন্তু বাংলা ভাষার কাছে দায়বদ্ধতা থেকেই যাবতীয় দ্বিধা-সংশয় নস্যাৎ করে সেই ভাবনাকে বাস্তব রূপ দিতে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমরা। আমি দেখেছি, কী অবলীলায় একজন সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিধারী বাঙালি ‘স্বর্গ’ এবং ‘সর্গ’-- এই দুটো বানানের প্রভেদ না করে প্রবন্ধ লিখে ফেলেন। আমি নিশ্চিত তিনি ‘night’ এবং ‘knight’ বানান দুটি যে আলাদা তা যত্ন নিয়ে খেয়াল রাখেন। কিন্তু বাংলার বেলায় সেই দায় নেই কেন? এত তাচ্ছিল্যই বা কেন? সুতরাং, 'catch them young'।

এ কথা সত্যি যে বাংলা বানান নিয়ে সমস্যা আছে। নতুন বানান বিধি, পুরনো বানান, কাগজে কাগজে প্রচলিত ইচ্ছেমতো বানান– এইসব নিয়ে সে এক ঘোর অবস্থা। কিন্তু যারা বাংলা শিখতে শুরু করেছে তাদের তো একটাই এবং সঠিকটা শিখে নিতে সাহায্য করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলা ভাষা তার কাছে একটু যত্ন দাবি করে। আমরা সেই ভাবেই সাজাই আমাদের প্রতিযোগিতা। মধ্য শিক্ষা পর্ষদের বাংলা পাঠক্রম আধুনিক বানান বিধি অনুসরণ করে। আমরা সাধারণত অষ্টম, নবম এবং দশম শ্রেণিতেই এই প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে থাকি এবং তাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঠ্যবই থেকেই শব্দ বাছাই করি। তাদের যত দূর পড়ানো হয়েছে খোঁজ নিয়ে সেই অংশ থেকেই বানান ধরা হয়। অর্থাৎ, তাদের শক্ত বা অজানা শব্দ ধরে ভড়কে না দিয়ে, যা শিখছে সেটাই কতটা শিখেছে তা একটা আনন্দানুষ্ঠানের মোড়কে বুঝতে পারার সুযোগ তৈরি করা।  

এই প্রতিযোগিতাটি হয় দুটি পর্যায়ে, যার দ্বারা ছাত্রছাত্রীদের লেখার দক্ষতা ও শুদ্ধ বানান সম্পর্কে জ্ঞান এই দুটো বিষয়েরই আন্দাজ পাই আমরা। প্রথমত একটি ছোট অনুচ্ছেদ থেকে শ্রুতিলিখন দিয়ে সবচেয়ে কম বানান ভুলের উপর ভিত্তি করে প্রতিযোগী বেছে নেওয়া হয়। তারপর দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রত্যেককে দশটি করে বানান জিজ্ঞাসা করা হয়। এভাবে সেই স্কুলের পঠনপাঠন সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এবং এই পদ্ধতিতে ক্রমাগত কাজ করতে করতে বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার যে ছবিটা ধীরে ধীরে বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমাদের কাছে তারই আভাস দেওয়ার চেষ্টা করছি বর্তমান লেখায়।

আমরা সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি তিন ধরনের স্কুলেই কাজ করেছি, ইংরেজি ও বাংলা দুটি মাধ্যমেই। কলকাতা ও মফসসলের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে কিন্তু বিস্তর ফারাক, সে ছাত্র সংখ্যা বা শিক্ষার মান যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা যাক। কলকাতার সরকারি ও আধা-সরকারি বাংলা মাধ্যম স্কুলের ছবি অত্যন্ত হতাশাজনক, অবশ্যই হাতে গোনা কয়েকটি বাদ দিয়ে। ছাত্রছাত্রী সংখ্যা অতি অল্প এবং ক্রমাগত নিম্নগামী। পড়াশোনার মান কল্পনাতীত রকমের খারাপ। অবশ্যই প্রতি ক্লাসে একজন বা দুই জন ভালো ছাত্র বা ছাত্রী আমরা পেয়ে যাই, কিন্তু তাতে সামগ্রিক চিত্রে কিছু হেরফের হয় না। অধিকাংশ স্কুলে ৭০ শতাংশ ছাত্রকে একটি ছোট্ট অনুচ্ছেদ লিখতে গিয়ে ৩০ থেকে ৩৫টি বানান ভুল করতে দেখেছি। অতি সাধারণ বানানও ভুল করা দেখে বোঝা যায় যে তারা উচ্চারণ বুঝে বানান করে লিখতেও শেখেনি। বহু খাতা পড়ে ওঠা দুষ্কর বলে বাতিলও করতে হয়। প্রথমেই জানিয়েছি যে আমরা তাদের পাঠ্যবই থেকেই শ্রুতিলিখন দিয়ে থাকি এবং অবশ্যই সেই সময় ক্লাসে যত দূর পড়ানো হয়েছে তা থেকেই। এবং আমরা যে আসছি তা আগে থেকেই তারা জানে। তবুও এ হেন ভুল দেখে নানা ধরনের প্রশ্ন জাগে মনে যার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। 

দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বানান ধরি তাদের। এই পর্যায়ে যেহেতু সবচেয়ে ভালো ছাত্র বা ছাত্রীকে আমরা তুলে নিয়েছি, তাই দশটির মধ্যে দশটি বানান ঠিক করেছে এমন বহু ক্ষেত্রেই দেখেছি। কিন্তু কোথাও আবার আরও হতাশাজনক অবস্থা পেয়েছি। বেশ কয়েকটি স্কুলের ছাত্রীদের যথাযথ বর্ণপরিচয় হয়নি। তারা আঙুল দিয়ে বাতাসে লিখে অক্ষর বোঝাচ্ছে। এ-কার উ-কার ইত্যাদিও আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। তাদের যুক্তাক্ষর পরিচয় নেই। কোন অক্ষরের সঙ্গে কোন অক্ষর জুড়ে সেই যুক্তাক্ষরটি তৈরি হয়েছে সে ধারণা ভাসা ভাসা। এই ভয়াবহ ছবিটা পেয়েছি বেশিরভাগ সিক স্কুলে বা হাবে। এখানেই একটা প্রশ্ন আসতে বাধ্য। সিক স্কুলগুলোতে কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত শক্তিশালী। একটি স্কুলে যদি ১৬৩ জন ছাত্রী হয় এবং ১০ জন শিক্ষিকা তবে তো অতি অল্প সংখ্যক ছেলেমেয়েকে পড়াতে হয় এবং ব্যক্তিগত খেয়াল রাখা আরও সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। শ্রুতিলিখন দিতে গিয়ে দেখেছি ৯ জন ছাত্রী একটি ক্লাসে, কিন্তু নবম শ্রেণির ছাত্রী অতি সাধারণ বানান করে উঠতে পারা তো দূর, অক্ষরের নাম উচ্চারণ করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে কি শিক্ষকরা দায় এড়াতে পারেন?! তাঁদের পড়ানোর আগ্রহ নিয়েও কি সংশয় জাগা স্বাভাবিক নয়।

প্রথমত এটা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে নামী দামী হাতে গোনা কয়েকটি স্কুল ছাড়া আজ বেশিরভাগ বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়তে আসে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলি থেকে। এবং তাদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। একটি ছেলের নাম বাপি দাস। এতেই স্পষ্ট যে একটা ভালো নাম রাখাও বিলাসিতা তাদের পরিবারে। তাহলে এটাও বোঝা যায় যে তার বাড়িতে পড়ায় ভুল ধরানোর মতো কেউ নেই। সে যেটুকু শিখবে স্কুল থেকেই, সে ক্ষেত্রে স্কুলের  দায় আরও বেড়ে যায় না কি? অথচ আমরা একটি স্কুলে ক্লাস টেনের ছাত্রকে তার নামের বানান লিখতে দেখলাম 'দিপায়ন' দাস। প্রশ্ন করে জেনেছি, প্রথম শ্রেণি থেকে দশম পর্যন্ত দশ বছর সে ওই স্কুলেই পড়েছে। তবু কেউ তার বাংলা নামের ভুলটুকু শুধরে দেয়নি। আজকাল নানা খাতে সরকারি সাহায্য পাওয়ার কার্ডে নাম তোলাতে হয়। সে দোহাই দিয়েও ভুল রেখে দেওয়া অযৌক্তিক, কারণ, ভোটার কার্ড থেকে আধার কার্ড সবই শোধরানো যায়। এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট বাংলা শিক্ষিকাকে করায় উত্তর পেয়েছিলাম, 'আজকাল তো কোথাও বাংলায় নাম লিখতে হয় না, পরীক্ষার খাতায়ও ইংরেজিতে নাম লেখাই দস্তুর। তাই জানাই যায় না যে বাংলায় তারা কোন বানান লেখে।' স্তম্ভিত হতেও ভুলে গিয়েছিলাম এই জবাব পেয়ে। ছাত্রছাত্রীদের বিষয় ভিত্তিক একটি খাতা থাকার চল কি আজ আর নেই! বাংলা খাতায়ও কি তারা ইংরেজিতে নাম লিখে থাকে?!

চিরকালই কিছু স্কুল সাধারণ হত, কিছু স্কুল নামকরা হত-- স্কুলের পড়াশোনার মান ও ছাত্রছাত্রীদের মানের উপর ভিত্তি করে। আমাদের অনেকের বাবা মায়েরাই হয়তো সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু এত ভয়াবহ পড়াশোনার মান কী আগেও ছিল? আলোচনা করে দেখেছি, সম্ভবত না। আমি কিন্তু কলকাতার বাংলা মাধ্যম সরকারি বা আধা-সরকারি স্কুলের কথাই বলছি, অবশ্যই কিছু নামী স্কুলের কথা বাদ রাখছি। 

আরও কিছু অদ্ভুত সত্যের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। কলকাতার বেশ কিছু অঞ্চলের স্কুলে আমরা একশো শতাংশ মুসলমান ছাত্র বা ছাত্রী পেয়েছি। একটা ভালো দিক যে তারা মাদ্রাসায় পড়াশোনা না করে মূল স্রোতের স্কুলে পড়াশোনা করছে। কিন্তু তারা অনেকেই হিন্দিভাষী। বোঝা যায় অন্য সুবিধা গ্রহণে অপারগ হয়েই তারা বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ছে। এই স্কুলগুলিতে আগে থেকেই আমাদের জানিয়ে রাখা হয় যে এরা বাংলা পারে না, কারণ, এরা সবাই অবাঙালি। আশ্চর্যের বিষয়, আমরাও তো অ-ইংরেজ হয়েই A B C D শিখতে পেরেছি। সেখানে একটি নবম শ্রেণির ছাত্রীর অক্ষর পরিচয় না থাকাটা কি তার অবাঙালি হওয়াকে দায়ী করা যায়? অবশ্যই পাশ ফেল তুলে দেওয়া জাতীয় নানা সরকারি সিদ্ধান্ত শিক্ষার অবনমন ঘটিয়েছে। অনতি অতীতের কোভিড একটি ব্যাচকে দুর্বল করে দিয়েছে নিশ্চিত। কিন্তু তারপরেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যায়। পাশ ফেল উঠে যাওয়ায় ঠিকঠাক শেখানোর প্রয়োজনটাও কি উঠে যায়?! তাহলে নৈহাটি বা বহরমপুরের স্কুলে অন্যরকম ছবি কেন দেখলাম! এমন কি শহরতলির স্কুলেও। সে সব স্কুল তো চিরকালীন স্বাভাবিক ছবিই আঁকলো– কিছু অমনোযোগী, কিছু সাধারণ এবং বেশ কিছু ভালো ছাত্রছাত্রী পেয়েছি যাদের নিয়ে অসাধারণ সুন্দর কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা ভাষা ছুঁয়ে। 

এতক্ষণের আলোচনা ছিল বাংলা মাধ্যম নিয়ে। ইংরেজি মাধ্যম বেসরকারি স্কুলে পড়াশোনার মান অতিউচ্চ, কিন্তু বাংলা ভাষা সেখানেও দুয়োরানী। বেশিরভাগ বাংলায় নামটুকুও লিখতে শেখেনি। মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবর্গ পরিবারের প্রদীপগুলি এই সব স্কুলেই জ্বলছে। কিন্তু চ্যাটার্জি, ঘোষ বা গুহদের ছেলেমেয়েদের অনেকেই বাংলায় নাম লিখতেই শেখেনি। এটাই আজকের বাস্তব চিত্র।

আরও জানতে, বাংলা বানানবাজি নিয়ে এই দৃশ্য-নিবন্ধটি দেখতে পারেন:

https://www.youtube.com/watch?v=6mAH6P3e0bo&t=7s


Thursday, 4 April 2024

বেকারত্বের রহস্য!

অধিকাংশ মানুষের নিয়মিত কাজ না থাকাটাই ভবিতব্য?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

সম্প্রতি, ইন্টারন্যাশনল লেবর অর্গানাইজেশন (আইএলও) প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪’ নানা দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বেকারি বাড়ছে, আয় কমছে- এই প্রবণতাটি প্রতিবেদনটির মূল অক্ষ হলেও এর মধ্যে যে একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ধারা প্রবাহিত, তাকে বুঝতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের দিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

এ কথা আগে বহুবার বলেছি, অর্থনীতি ও যাপন ক্ষেত্রের সর্বস্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমতার প্রয়োগে আপামর বিশ্বে এতাবৎকালের রাজনৈতিক অর্থনীতিতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তা থেকে আমাদের দেশের অর্থনীতিও বাদ থাকেনি। যেমন, আইএলও’র প্রতিবেদন জানাচ্ছে, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের অনুপাত ১২ থেকে ১৪ শতাংশে স্থির থাকলেও নির্মাণ ও পরিষেবা ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানে বৃদ্ধি হয়েছে-- কৃষি থেকে শ্রম শেষোক্ত এই দুটি ক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু কোভিডের পর এই চিত্র সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, অ-কৃষি ক্ষেত্র থেকে কৃষি ক্ষেত্রে শ্রম স্থানান্তকরণের উলটো প্রক্রিয়াই এখন চরম বাস্তব। স্বভাবতই, কৃষির ওপর এ এক ভয়ঙ্কর চাপ। কারণ আর কিছুই নয়, নির্মাণ ও পরিষেবা ক্ষেত্রে, বিশেষত পরিষেবা ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগের ফলে মনুষ্য শ্রমের চাহিদা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। সেই বাড়তি শ্রম ফিরে আসছে কৃষিতে। শুধু তাই নয়, ২০১৮ সালের পর থেকে স্থায়ী কর্মসংস্থানও ক্রমেই কমতে থেকেছে; পরন্তু, ২০১৯ সালের পর কর্মসংস্থানের যেটুকু বৃদ্ধি দেখা গেছে তার দুই-তৃতীয়াংশই ঘটেছে হয় স্বনির্ভর ক্ষেত্রে নয়তো বা মিলেছে বিনা মজুরিতে গৃহশ্রমের মহিলাদের পরিসরে। অর্থাৎ, কাজের বহু রসদ আছে, অফুরন্ত কাজের সুযোগও আছে, কিন্তু চাকরি নেই। কারণ, উৎপাদন প্রক্রিয়াটাই সার্বিক ভাবে হয়ে পড়েছে পুঁজি-নিবিড় ও প্রযুক্তি-নির্ভর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসে বিষয়টিকে আরও ত্বরান্ত্বিত করেছে।  

বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনে চাকরির বাজার একপ্রকার অনিশ্চিত। শুধু তাইই নয়, ডিগ্রি-প্রাপ্ত অথবা উচ্চশিক্ষায় পাশ দেওয়া কর্মপ্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা আরও কম। কারণ, দক্ষতা-নির্ভর উচ্চশিক্ষিত-পাশদের এতদিনের বরাদ্দ কাজগুলি যন্ত্র এখন অনায়াসে আরও নিপুণ ও নিখুঁত উপায়ে দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করতে সক্ষম। জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জমানায় prompt লিখে দিলেই কেল্লা ফতে! যন্ত্র নিমেষের মধ্যে নির্ধারিত কাজটি করে দেবে। ‘ডেভিন’ নামে এমন এক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবস্থা এসে গেছে যে, সফটওয়ারের বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত সে সমস্ত কাজ সমাধা করতে পারে। উপরন্তু, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ‘Agentic Workflows’ এখন থেকে মানুষের মতোই ধাপে ধাপে সৃজনশীল ও উদ্ভাবনের কাজগুলি করবে; যেমন, একটি কাজের প্রথমে খসড়া তৈরি করা, রাফ ওয়ার্ক, প্যাচ ওয়ার্ক মারফত তাকে আরও যথাযথ ও উপযুক্ত করে তোলা-- এইভাবেই যন্ত্রও এখন মানুষের কায়দাতেই প্রয়োজনীয় বিবিধ স্তরীয় বিন্যাসের মধ্য দিয়ে কাজগুলিকে সম্পন্ন করবে আরও অধিক উৎপাদনশীল ফলের জন্য। তফাত হল, যন্ত্রের কাজ হবে অত্যন্ত দ্রুততা ও নিপুণতার সঙ্গে, সর্বোপরি ত্রুটিহীন। তার মানে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ব্যবস্থাপনা মানুষের দক্ষতাকে প্রতিস্থাপন করে তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-পাশ ডিগ্রিধারীদের অকেজো ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেবে। বরং, পরিশ্রমসাধ্য কায়িক কাজের প্রতুলতা এখনও কিছুকাল অদক্ষ ও কায়িক শ্রমিকের চাহিদাকে ধরে রাখবে। তার ইঙ্গিত উল্লিখিত প্রতিবেদনেও আছে। বলছে, আমাদের দেশে এখনও ৮২ শতাংশ মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন এবং ৯০ শতাংশ মানুষ অনিয়মিত ভাবে নিয়োজিত। তথ্য এও বলছে, ২০২২ সালে যেখানে নিরক্ষর যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল ৩.৪ শতাংশ, সেখানে স্নাতকদের মধ্যে তা ছিল ২৯.১ শতাংশ যা নিরক্ষর-বেকারি থেকে ৯ গুন বেশি। যেহেতু, দক্ষতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষার অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক, আর এই দক্ষ কাজগুলিকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ব্যবস্থাপনা শুরু থেকে শেষ অবধি সম্পন্ন করতে পারদর্শী, তাই ‘উচ্চশিক্ষিত’দের মধ্যে বেকারির হার আরও বাড়বে। কারণ, ‘ভাল ও স্থায়ী’ চাকরির আশায় উচ্চশিক্ষায় ভর্তির হার ইদানীং কমে এলেও পাশের হারের বিচারে এখনও তা সংখ্যাগত ভাবে বেশি।

ফলে, একদিকে বেকারির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে কর্মরত মানুষের মজুরি বা আয় কমছে। সংগঠিত ক্ষেত্রে নিত্য ছাঁটাই ব্যতিরেকেও মজুরি বা আয় কমছে, অসংগঠিত বা অদক্ষ কাজের এলাকাগুলিতে কাজের জোগান থাকলেও মজুরি ক্রমশই কমছে। আইএলও প্রতিবেদনের তথ্য দেখাচ্ছে, আমাদের দেশে অদক্ষ ও অনিয়মিত কৃষি শ্রমিকদের ৬২ শতাংশ ও নির্মাণ শ্রমিকদের ৭০ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি পান না।

এইরকম পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই জনকল্যাণের রাজনীতি আজ প্রধান ভূমিকায় অবতীর্ণ। কারণ, প্রথমত, নগদ হস্তান্তরের মাধ্যমে (যেমন ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্প) পরিবারের প্রকৃত আয়কে কিছুটা বর্ধিত করলে সার্বিক গড় মজুরির পতনকে আপাতত সামাল দেওয়া যায়; দ্বিতীয়ত, নানান পরিষেবাকে বিনামূল্যে অথবা অর্ধমূল্যে প্রদান করতে পারলেও তা প্রকৃত আয়কে কিছুটা বাড়ায়! যেমন, ২০০ ইউনিট অবধি যদি বিদ্যুৎ বিনামূল্য পাওয়া যায়, অথবা, উন্নত বিদ্যালয়-শিক্ষা ও স্বাস্থ্য যদি সত্যি সত্যিই একেবারে বিনাপয়সায় মেলে, তাহলে তা যে প্রকৃত আয়কে বাড়ানোর পক্ষে সহায়ক, তা বলাই বাহুল্য। হয়তো, আগামী দিনে এই প্রবণতাই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’এর এক সর্বতো ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়াবে। যে মোদি সরকার কিছুদিন আগেও এই ধরনের জনকল্যাণমূলক অভিসারকে ‘রেউড়ি’ বলে গাল পেড়েছিল, আজ তারাও ‘মোদি কা গ্যারান্টি’ নামে এইগুলিকেই ফেরি করছে। কোনও কোনও দল, যেমন আরজেডি বলতে শুরু করেছে, তারা বিহারে ক্ষমতায় এলে ব্যাপক ভাবে সরকারি চাকরি দেবে। হয়তো অন্য দলগুলিও অচিরেই একই কথা বলবে। কারণ, সরকারি দফতরে কাজের চেয়ে লোক-নিয়োগের পাল্লা ভারী হলেও এই ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতে পারে এই অভিসন্ধিতেই যে, কাজ নেই তো কী হয়েছে, মাসের শেষে মাইনে তো আছে— অন্য ভাষায় যা হয়তো বা, অথবা নিশ্চিত ভাবেই ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ বলেও পরিগণিত হতে পারে!

কিন্তু রাজকোষে এত অর্থের জোগান দেবে কে? বলাই বাহুল্য, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এমন এক ব্যবস্থাকেই সাব্যস্ত করে লাগাম ধরেছে যেখানে মনুষ্য শ্রমের সমস্ত ভার সে বহন করতে সক্ষম; ফলে, এআই চালিত উৎপাদন ও পরিষেবায় কোনও খামতি থাকার কথা নয়, বরং, আরও নিখুঁত ও নিপুণ হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দেখাও যাচ্ছে তা! অতএব, উদ্বৃত্ত আহরণের প্রক্রিয়াটিও অটুট রইল। সখেদে, রাজকোষে কর আদায়ও হয়তো আরও নিপাট হল। বুঝতে হবে, এ সময়ে কতিপয় পেশাদারকে বাদ দিলে যন্ত্রই স্বয়ম্ভু!

তাহলে অধিকাংশ মানুষের কি আর কাজ থাকবে না? ঠিকই, বাধ্যত মজুরি-দাসত্ব হয়তো আর থাকবে না। যখন শিল্প বিপ্লবের পর ইংল্যান্ডে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে জোয়ার আসে তখন কারখানায় কাজ করার জন্য মজুর পাওয়া যেত না। গ্রাম থেকে তুলে এনে, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরেদের গ্রেফতার করে কারখানায় ঢুকিয়ে দেওয়া হত। কারণ, সেই অসহনীয় মজুরি-দাসত্বে কেউ স্বইচ্ছায় আবদ্ধ হতে চাইত না। পরে সেই রীতিই অভ্যাসে, প্রচারে ও আইনের চমকানিতে সর্বজনমান্য হয়েছে। ওষ্ঠাগত প্রাণে গত দু’ শতকে চাকরির নামে মানুষ এই মজুরি-দাসত্বকেই বহন করেছে। এর ভয়াবহ অভিঘাত ও চরম বিপন্নতা আমরা বারবার প্রত্যক্ষও করেছি। মার্কস এই মজুরি-দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তবুও এই চক্র চলেছে, কারণ, মানুষের আর অন্য উপায় ছিল না।

কিন্তু যন্ত্রের অভূতপূর্ব উত্তরণে আজ যখন এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির সম্ভাবনা প্রবল তখন ‘কর্মসংস্থান’ প্রদানের রাজনীতির নামে এই বদ্ধ অবস্থায় বন্দী রাখার প্রয়াস কেন? মানুষের জন্য ‘মজুরির বিনিময়ে অধিকাংশ কর্মই’ তো আর থাকছে না! যা মৃতপ্রায় তা নিয়ে এত মড়াকান্না কীসের? অভ্যাসের টান? বিপ্রতীপে, ঘরে বসে অথবা লোক-দেখানো সরকারি কর্মস্থলে গিয়ে মাস শেষে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ গোছের জুটে গেলে মানুষ তো এক অর্থে আংশিক মুক্তি লাভ করবে, নিজের পছন্দের কাজে মনোনিবেশ করতে পারবে। সে তো ভাল কথা। কিন্তু মৌলিক ব্যবস্থাপনাটি যেহেতু অর্থ বৈষম্যের সমস্ত উপাদান নিয়ে এখনও ‘পুঁজিবাদ’ই থাকছে, তাই এর বিবর্তন ও অভিঘাতগুলি বাস্তবে কেমনতর হবে তা এখনও কিঞ্চিৎ অনিশ্চিত! সম্মুখ পানে আরও খানিক এগোনো যাক না হয়! আওয়াজ উঠুক, 'ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম' চালু করো।

 

Tuesday, 2 April 2024

বঙ্গে লড়াই ত্রিমুখি?

জোট না হওয়াই যখন 'ইন্ডিয়া'র পক্ষে লাভ

কল্যাণ সেনগুপ্ত



ত্রিমুখি লড়াই হলে সাধারণত যে কেন্দ্রে যার সাংগঠনিক ক্ষমতা বেশি, তার জয়ের সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু ব্যতিক্রমের সম্ভাবনাও আছে সীমিত ক্ষেত্রে, তবে নিশ্চিত গোপনীয়তা রক্ষা করে। এ রাজ্যে সে সম্ভাবনা আছে শুধুই সিপিএম, কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে, যেখানে তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষমতা প্রশ্নাতীতভাবে অনেক বেশি। 

আবার উল্টো সম্ভাবনাও আছে। যথা, যেখানে তৃণমূল অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং তাদের বিরোধী দু' পক্ষের মধ্যে গোপন বোঝাপড়া করে জয়ের সম্ভাবনাময় আসনগুলো যদি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া যায়, ফলে তিন দলেরই প্রধান শত্রু তৃণমূল সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু এমন সম্ভাবনায় সবচেয়ে বড় বাধা হল জাতীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতা এবং ভোট শতাংশে সিপিএম ও কংগ্রেসের সাংগঠনিক অস্তিত্ব প্রমাণের দায়। কারণ, ২০১৯'র ভোটে বিজেপির হঠাৎই ১৮টি আসন প্রাপ্তি ও সিপিএম-কংগ্রেসের ভোট শতাংশে অভাবনীয় ধস নামা দু' দলেরই নেতৃত্বের মুখ পুড়িয়েছে, বিশেষভাবে সিপিএমের। ফলে, এবার তাদের দিক থেকে প্রাধান্য পাওয়া উচিত সাংগঠনিক জমি পুনরুদ্ধারের বিষয়টি। তার সঙ্গে আর একটি ব্যাপারও মাথায় রাখা উচিত- বহরমপুর ও মুর্শিদাবাদ আসন দুটি জয়লাভে এবার দু' দলেরই মুখ্য নেতা অধীর চৌধুরী ও মহঃ সেলিমের পক্ষে পরিস্থিতি কিন্তু বেশ খানিকটা সম্ভাবনাময়।

জাতীয় ক্ষেত্রে জোট 'ইন্ডিয়া' প্রথম দিকে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি করলেও পরবর্তীকালে তা খানিকটা হতাশায় পর্যবসিত হয় কংগ্রেস নেতৃত্বের খামখেয়ালিপনা ও দলীয় স্বার্থবাদী চিন্তায়। অপরদিকে, মোদী তাঁর ভাবনার রূপায়ণে রামমন্দির সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালাতে শুরু করেন এবং এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সমর্থ হন যে, দেশের আপামর জনসাধারণের মধ্যে খানিকটা বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়, মোদীর জয় সুনিশ্চিত ও তিনিই তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরতে চলেছেন। এমতাবস্থায়, জোট ইন্ডিয়ার অন্যতম পুরোধা নীতিশ কুমার নিজের প্রধানমন্ত্রী হবার সাধ পূরণ হবে না বুঝতে পেরে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি'টি রক্ষায় অধিক মনোযোগী হয়ে সম্ভবত শেষবারের মতো পাল্টি খেয়ে মোদীর শরণাগত হলেন এবং আশ্বাস দিলেন, ভবিষ্যতে আর কোনও এদিক-ওদিক করবেন না। শুনে মুচকি হাসি চাপতে পারলেন না মোদীও। এরপর জোট ইন্ডিয়াকে দুর্বল করতে ও নিজের শিবিরকে শক্তিশালী করতে চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখলেন না মোদী-শাহ জুটি। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব নির্বিকার, জোটের বৈঠক ডাকার কোনওরকম প্রয়োজনীয়তাই বোধ করল না তারা। ব্যস্ত রইল 'ন্যায় যাত্রা' নিয়ে। এই যাত্রার সময়জ্ঞান নিয়ে নানা মুখরোচক গল্প বাজারে চালু হল। যেমন, এক ছাত্রের যেই পরীক্ষার দিন ঘোষিত হয়েছে অমনি সে দ্রুত এক জিমে গিয়ে ভর্তি হল, কারণ সে শুনেছিল আগে স্বাস্থ্যরক্ষা জরুরি। জোটের বৈঠক ডাকায় কংগ্রেস নেতৃত্বের অনীহার বিষয়টি সত্যিই চূড়ান্ত রহস্যজনক। যৌথ উদ্যোগে পাটনা ও দিল্লির সভায় মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া কি জমিনি বাস্তবতার ইঙ্গিত করছে না? যৌথ প্রতিবাদ ও প্রচার শুরু করতে পারলে মোদীর পরাজয় যে সুনিশ্চিত, তা অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস।

এ রাজ্যের চিত্রটি অতএব বেশ জটিল। জাতীয় ক্ষেত্রে জোট ইন্ডিয়ার শরিক কংগ্রেস, তৃণমূল ও বাম তথা সিপিএম সবাই। এমনকি জোটের নামকরণেও মমতার প্রস্তাবই গৃহীত হয়। ফলে, মোদী শিবিরে প্রচণ্ড অস্বস্তি ও বিরোধ দেখা দেয়। এমনকি সরকারি অনুষ্ঠানেও প্রথম দিকে দিশেহারা হয়ে শাসকের তরফে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত ব্যবহারের ছেলেমানুষী লক্ষ করা যায়। পরে ধীরে ধীরে মোদীর সম্বিত ফেরে ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এখন বিজেপি নেতৃত্ব ব্যঙ্গ করে বলে 'ইন্ডি জোট'। অর্থাৎ, জোটের নামকরণে যে প্রবল অস্বস্তি মোদী শিবিরে পরিলক্ষিত হয়, তা নিঃসন্দেহে নামকরণে সাফল্যেরই পরিচায়ক।

এ রাজ্যে জোট গঠনের আলোচনার শুরুতেই সিপিএম জানিয়ে দেয়, এ রাজ্যে তাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গে জোট গঠন সম্ভব নয়, বরং তারা আগ্রহী কংগ্রেস ও আইএসএফের সঙ্গে জোট গড়ায় এবং তারা তৃণমূল, বিজেপি দু' দলের অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে চায়। এরপর রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্বও সাফ জানিয়ে দেয় যে, তৃণমূলের সঙ্গে জোট তারাও চায় না। কিন্তু কংগ্রেসের জাতীয় নেতৃত্ব ক্রমাগত জানাতে থাকে, জোট আলোচনা চলছে ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এখনও। এমনই চরম বিভ্রান্তির মধ্যে ফয়সালার জন্য তৃণমূল সময় বেঁধে দেয় ৩১ জানুয়ারি। সময় পেরিয়ে যায়, কোনওরকম সদর্থক পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয় কংগ্রেস। অবশেষে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে তৃণমূল সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে যে তারা ৪২টি আসনেই প্রার্থী দেবে অর্থাৎ জোটের সম্ভাবনায় ইতি ঘটে। তৃণমূলের এই সিদ্ধান্তের ফলে সিপিএম দলে খুশির হাওয়া বয়ে যায়। নিশ্চিন্ত হন অধীরও। 

এ রাজ্যে জোট হওয়া বা না হওয়ায় দু'রকমেরই সুবিধা বা অসুবিধে আছে।  প্রথমত, এ রাজ্যে জোট হলে কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা নিশ্চয়ই হত কিন্তু অঙ্কের হিসেবে খুব বেশি লাভ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। এখানে জোট বলতে ধরে নিচ্ছি শুধুই তৃণমূল ও কংগ্রেসের জোট, সিপিএম ব্যতিরেকেই। কারণ, সিপিএম অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল যে, কোনও অবস্থাতেই তৃণমূলের সঙ্গে কোনও জোট নয়। যেমনটা কেরলে কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও জোট নয়। এ রাজ্যে যেমন সিপিএম তৃণমূল'কে বিজেপির দোসর বলে থাকে, ঠিক তেমনই কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বলে থাকে। সম্প্রতি কেরলের মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের মুখ থেকেও কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অভিযোগ শোনা গেল বিজেপির সঙ্গে গোপন আঁতাতের। ভোটের লড়াইয়ে এসব অভিযোগ গুরুত্বহীন। তবে অঙ্কের হিসেব মাথায় রাখতেই হয়। এ রাজ্যে জোট হলেও কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকদের ভোট আদৌ তৃণমূলের পক্ষে পড়ত কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে এবং অনুরূপ ভাবনা পারস্পরিক তিক্ততায় সর্বত্রই থাকার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, জোটের যথেষ্ট সদর্থক পরিবেশ এ রাজ্যে ছিল না।

এ রাজ্যের ভোট এখন মোটামুটি ভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত- তৃণমূল বনাম বিজেপি। তবে তৃতীয় পক্ষ আছে, যদিও বেশ কিছুটা পিছিয়ে, যেমন, সিপিএম ও কংগ্রেস। বাস্তব পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, এ রাজ্যে ভোটের অঙ্কে জোট হওয়ার চেয়ে না হওয়াটাই হয়তো তৃণমূল তথা জোট ইন্ডিয়া'র পক্ষে অধিক লাভজনক হতে চলেছে। ২০১৯'র ভোটে- সিপিএম ও কংগ্রেস- এই দু' দলেরই ভোট শতাংশ প্রচুর ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছিল। এখন দেখার, সেই হারানো ভোট কতখানি ফিরে আসে। বাস্তবতা হল, এই দু' দলের ভোট যদি গড়ে ১২-১৪ শতাংশ বাড়ে তবে বিজেপির আসন প্রাপ্তিতে যথেষ্ট ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার আসন সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত।