Pages

Sunday, 31 May 2020

কৃষিকাজের মূল্য অসীম

'আবাদ করলে ফলত সোনা'
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

লক্ষ লক্ষ মানুষ হাঁটছেন। রেল লাইন ধরে, হাইওয়ে পেরিয়ে, বাচ্চা কোলে, পিঠে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে, সাইকেলে, ট্রেনে, বাসে, যে যেখানে যেভাবে পারছেন, সে ভাবে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে। জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি নিয়ে। মরছেনও। পথে ঘাটে দুর্ঘটনায় অনাহারে অপুষ্টিতে অসুস্থতায় কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। তবুও তাঁরা হাঁটছেন, বা ফিরে চলেছেন ‘শ্রমিক স্পেশাল’এ তাঁদের অলীক শিকড়ের টানে। সেখানে যে নিশ্চিদ্র নিশ্চয়তা আছে, তা তো নয়। তবুও তারা জীবন বাজী রেখে ফিরে চলেছেন। সকলে বলছেন, এঁরা পরিযায়ী শ্রমিক, এঁরা মরীয়া হয়ে ঘরে ফিরছেন। কীসের এত তাগিদ? কোথায় এত ভয়? নাকি কাজ হারানো, অভুক্ত দশায় তাদের আর কোনও উপায়ন্তর নেই? এঁরা কারা? এঁদের নিয়ে তো আগে সেভাবে কখনও আলোচনা হয়নি। বরং, এই ধরনের মানুষজনদের খুব সহজেই দাগিয়ে দেওয়ার এক খেয়াল আছে- এঁরা কামচোর, সর্বনাশা, ঝামেলাবাজ, নেশাড়ু। দেখা যাচ্ছে, এঁদের সংখ্যা কোটি কোটি। হঠাৎ যেন অদৃশ্য কোনও গর্ত থেকে পিলপিল করে সহস্র পিঁপড়েদের মতো বেরিয়ে আসা। কোথায় ছিলেন এঁরা?

চকিতে এমন দেখে আপনি ভয় পেলেও, এঁরা ছিলেন। এঁরা ছিলেন আপনার দৃষ্টির অগোচরে আপনার বাড়িতে, নানাবিধ অফিসে, চলার পথে দৃশ্যমান অট্টালিকা বা হাইওয়ে নির্মাণে, রাস্তা-ফুটপাত জুড়ে পসরা নিয়ে বসে, কারখানার যন্ত্রের সামনে, রাস্তা সাফাইয়ে অথবা এমন কিছু কাজে যেখানে এঁদের ছাড়া চলত না। কায়িক, পরিশ্রমসাধ্য, গায়ে গতরে কাজগুলি করার জন্যই এদের ডাক। যে কাজের মজুরি যেখানে আপেক্ষিক ভাবে বেশি সেখানেই তাদের জড়ো হওয়া। খুব কষ্টেসৃষ্টে থেকে, যতটা সম্ভব কাজ তুলে, প্রাপ্ত মজুরির কিছুটা নিজের জন্য রেখে বাকীটা দেশের সংসারে পাঠিয়ে খানিক হিল্লে ফেরানোই এঁদের অন্যতম প্রেরণা। প্রবহমান থাকলেও এতদিন কেউ পরোয়া করেনি- এই দৈনন্দিন যাপনে কতটা অসহায়ত্ব, কতটা পিষ্ট হওয়া ছিল। কোভিড১৯’এর তাণ্ডবে যখন কাজকর্ম শিকেয় উঠল তখনই বোঝা গেল উপরের আপাত শান্ত জীবন প্রবাহের গভীর তলদেশে কী নিদারুণ আগ্নেয়গিরি সুপ্ত হয়ে আছে। তা যেন নিমেষে বিস্ফোরণের তালে উদ্গীরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল দেশের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত। আর রেখে গেল কিছু অমূল্য প্রশ্নাবলী ও নতুন দিকনির্দেশ। আমরা সবিস্ময়ে দেখলাম, তাঁরা হাঁটতে শুরু করেছেন। কাঁখে শিশু, হাতে লোটাকম্বল নিয়ে।

এ হাঁটা বা এখন কাতারে কাতারে ট্রেনে ফেরা তাঁদের পশ্চাদপসরণ নয়। তাঁরা মুক্ত হয়ে ফিরে চলেছেন নিজ বাসভূমে। বহুকাল আর ফিরবেন না বলে। অনেকটা অগস্ত্য মুনির যাত্রার মতো। বলা ভালো, ধসে পড়া অর্থনীতির সম্ভাব্য ‘পুনর্জাগরণ’কে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে তাঁরা ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় নির্মাণ করতে ফিরে চলেছেন। এ তাঁদের মিলিত চেতনা। এই চৈতন্য তাঁদের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে বহু কাল ধরে। শুধু অপেক্ষা ছিল উপযুক্ত সময়ের। রাজনৈতিক অর্থনীতির সেই কাল সমাগত। সে কালকে তাঁরা পড়ে ফেলেছেন। তাই দুটি বাড়তি মজুরির আশায় গ্রাম ও সংসার ছেড়ে তাঁদের পরভূমে পরাধীন হয়ে নিকৃষ্টতর ভাবে বেঁচে থাকার খোয়াবের মিথ্যাচারকে তাঁরা অবশেষে পরিত্যাগ করেছেন। এই মিথ্যাচারের পিছনে দৌড়নোর জন্য তাঁদের যে জমে ওঠা ক্ষতি ও ক্ষতের পরিমাণ, তার আঘাত তাঁদের সচকিত করেছে। কোভিড১৯ ছিল এই ক্ষতি ও ক্ষতের এক উপচার মাত্র। বলা ভাল, এক অনুঘটক।

কিন্তু যে পানে তাঁরা চলেছেন সেখানে কি নিশ্চিতি আছে? দুটি কাজ ও দু’ মুঠো কি তাঁদের আয়াসসাধ্য? এঁদের অধিকাংশই তো কৃষি পরিবার থেকে ছিটকে আসা তরুণের স্বপ্ন। তাহলে কি আবার প্রত্যাবর্তন সেই কৃষির বলয়েই? পরিবর্তিত দুনিয়া ও কোভিড-উত্তর সময় এই প্রশ্নকেই নতুন করে অনুধাবন করতে চাইছে। কারণ, অন্তত আমাদের দেশে কোভিডের এই ভয়ঙ্করতম তাণ্ডবেও যে ক্ষেত্রটি এখনও নির্মল দাঁড়িয়ে আছে তা কৃষি। কৃষিকে কোভিড ততটা ঘায়েল করতে পারেনি। কারণ, কৃষিকাজে মনুষ্য শরীরের ঘনিষ্টতা তত নিবিড় নয় এবং স্থানীয় পর্যায়েই তার কার্যনির্বাহ।

ইতিমধ্যে প্রকাশিত সরকারি তথ্য থেকেও দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে ২০১৮-১৯ সালে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিষেবা শিল্পে যেখানে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৫.৭ ও ৬.১ শতাংশ তা ২০১৯-২০ সালে এসে নেমে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে .০৩ ও ১.৩ শতাংশে, উল্লেখ্য, ২০১৯-২০ সালের জানুয়ারি-মার্চ’এর শেষ ত্রৈমাসিকে ম্যানুফ্যাকচারিং’এর ক্ষেত্রে তা -১.৪ শতাংশে। অথচ, কৃষির ক্ষেত্রে ছবিটি অন্যরকম। ২০১৮-১৯ সালে যেখানে কৃষির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ২.৪ শতাংশ, তা ২০১৯-২০ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশে ও জানুয়ারি-মার্চের শেষ ত্রৈমাসিকে ৫.৯ শতাংশে। খবরে এও প্রকাশ, এবারের রবিশস্যও যথেষ্ট ভাল হয়েছে। অতএব, যারা দূর-দূরান্ত থেকে ঘরে ফিরে আসছেন, কৃষি ক্ষেত্র অন্তত তাদের একটা বড় অংশকে যে সামাল দিতে সক্ষম, তা তার আর্থিক সবলতা থেকেই স্পষ্ট। কিন্তু এই চাপকে ধরে রাখা ও তার ভবিষ্যৎ বিকাশের পথটিই আসল পরীক্ষা।

এ কথা বারবার অনেকে বলেছেন, আমাদের দেশে কৃষিকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং, শিল্প বিকাশের স্বার্থে কৃষিপণ্যের মূল্যকে সব সময়েই অতিরিক্ত নিম্নমুখি করে রাখা ও কৃষি উৎপাদকদের (বিশেষত ছোট ও প্রান্তিক যারা) মোটবাহী পশু হিসেবে দেখা হয়েছে যাদের কাজ হল অতি স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্যের জোগান দেওয়া যাতে শিল্পে অতি মুনাফার তাগিদে মজুরি খরচকে যতটা সম্ভব কম রাখা যায়। গত ৭০ বছর আমাদের দেশে কৃষি ক্ষেত্র নিজেকে অভুক্ত রেখে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলিকে পুষ্টি জুগিয়ে গেছে। অথচ, কৃষিপ্রধান এ দেশে কৃষি ক্ষেত্র থেকেই যথেষ্ট আয় ও কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিশেষ করে, কৃষিভিত্তিক ও কৃষি সহায়ক শিল্পের যে বিপুল সম্ভাবনা ও রসদ ছিল তাকে প্রকারান্তরে অবহেলা করে শুকিয়ে মারা হয়েছে।

কালের অবগাহনে আজ কোভিড পরিস্থিতিতে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলির দুরবস্থায় কৃষির সামনে আবারও নতুন করে সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। এর জন্য প্রথম প্রয়োজন কৃষকের আত্মসম্মান পুনরুদ্ধার। কৃষি কাজ কোনও পরিত্যক্ত, ‘চাষাড়ে’, মোটা বুদ্ধির হেয় কর্ম নয়- তা অত্যন্ত উন্নত, শিল্পগুণসম্পন্ন, সৃজনশীল এক ক্রমউন্নত আত্মনির্ভর কর্মধারা। কৃষককে সম্মান ও তাঁর কাজের স্বীকৃতির মধ্যেই অর্থনীতির আগামী দিন, অন্তত আমাদের দেশে, বহু সম্ভাবনার আকর নিয়ে সুপ্ত হয়ে আছে। পরিযায়ী শ্রমিকদের যে বেপরোয়া ঘরে ফেরার তাগিদ তা এই পুনঃঅবলোকন থেকে যে দুটি বাড়তি পয়সার জন্য পরবাসে যে নিকৃষ্টতম দীর্ঘস্থায়ী যাপন, তাকে পরিত্যাগ করে নিজ পরিসরে নিজ শক্তিকে পুনঃআবিষ্কার করা। হয়তো নিকট ভবিষ্যতে এই শ্রমিকদের জন্য হাহাকারে শিল্পগুলি ছটফট করবে। ইতিমধ্যেই গুজরাতে কচ ও অন্যান্য এলাকায় লবণ কারখানাগুলিতে সোরগোল পড়ে গেছে ও মালিকেরা জোড় হস্তে চলে যাওয়া শ্রমিকদের কাছে প্রার্থনা করে বলছে যে ফিরে এলে তারা দ্বিগুন মজুরি দেবে ও থাকাখাওয়ার বন্দোবস্তও করা হবে। কথায় আছে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।

অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান- বেঁচে থাকার এই তিন ন্যূনতম প্রয়োজনে অন্ন হল এমন এক উপাদান যা ছাড়া মানুষ কোনওভাবেই বেঁচে থাকতে পারে না। তাই, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডাটা অ্যানালিটিকস’এর যতই দাপট সারা বিশ্বকে এক নতুন আঙ্গিক ও যাপন অভিমুখে নিয়ে চলুক না কেন, কৃষিকে কখনই সে বাতিল করতে পারে না। কিন্তু কৃষি আজকের নতুন পরিসরে কীভাবে যুঝবে তা নিজেকেই আত্মমূল্যায়ন করে জাহির করতে হবে। প্রশ্নটা সব সময়েই ছিল, কৃষি ও কৃষক কতটা নিজ মূল্যকে বুঝে ও যুঝে উঠতে পারে। কোভিড১৯ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাকে বাধ্যত বাস্তবায়িত করে এ দেশে এই ক্ষেত্রে এক নতুন বাঁক নির্মাণ করেছে। সেই সুযোগকে ঠিকঠাক উশুল করতে কৃষি ও কৃষক সমাজ কতটা প্রস্তুত, তাই এখন দেখার।

‘মন রে কৃষি কাজ জান নাএমন মানব-জমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা।’ এ আসলে চৈতন্যের আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত।      

Friday, 29 May 2020

এক যুদ্ধক্ষেত্র

চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতা
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়

সিনেমা এক যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। প্রেম, সংঘাত, ঘৃণা, বন্ধুত্ব, হিংস্রতা, মৃত্যু... এক কথায় আবেগ। আর এই আবেগ থেকেই বিচ্ছিন্নতা। ফেদেরিকো ফেলিনি, আন্তোনিওনি, আ্যালা রেঁনে এইসব পরিচালকদের ছবিতে প্রেমের পরাজয় সন্ধান করা যায়। তিনজনই বুর্জোয়া সমাজে আবেগের মূল্য ধসে যাওয়া ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। ফেলিনির 'লা দোলছে ভিটা'য় বুর্জোয়া অধঃপতনের সাধারণ একটি দৃষ্টিই আমরা লক্ষ করি। আন্তোনিওনির 'লা স্ত্রাদা' ছবিতে দরদি প্রেম, সংযোগের ব্যর্থতা বিষয়ে এক ভিন্ন রূপ। আন্তনিওনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করেন বুর্জোয়া সমাজের শূন্যতা, 'ইল গ্রীডো' ছবিতে শ্রমিকশ্রেণির পারিপার্শ্বিকতা। একজন কাজের লোক মরীয়া হয়ে মানবিক সম্পর্ক সন্ধান করছেন। আলডো-র আত্মহত্যা ও ইরমার কান্না, যখন সে দেখছে আলডো ঝাঁপ দিচ্ছে- এই দৃশ্য আধুনিক চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতা বিষয়ক একটি শক্তিশালী ইমেজ। আলডো-র মৃত্যু খুব সহজভাবেই ছিল একটা প্রয়োজন। এটাই অনিবার্য উপসংহার, বোধের বাইরে চলে যাওয়া। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা ইরমাকে যখন সে বিদায় জানাচ্ছে তা শুধু ইরমাকে নয়, জানাচ্ছে নিজেকেও; সে নিজের কাছ থেকে, পরিবেশ-গোষ্ঠী-গ্রাম- গোটা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে । 

পরের তিনটি ছবিতে বিচ্ছিন্নতার বিষয় আরও পরিমার্জিত সূক্ষ্ম এবং আরও বিশদ ও গভীর। মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার গুরুত্ব ব্যক্তিগত পরাজয়ের চেয়ে বেশি। বোধে শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে যায় আরও। 'লাভেন্তুরা' শূন্য দ্বীপের নির্জনতায় মানবিক একাকীত্বের নাটক, শহর আমাদের চারপাশে যে স্থাপত্যের কারাগার তৈরি করে তারই পটভূমিতে 'লা নত্তে' নিজেরই কারাগারে বদ্ধ মানুষের নাটক। আন্তোনিওনি একবার চিত্রকর মার্ক রোথকো-র স্টুডিওতে গিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, আপনার আঁকা ছবি আমার ক্যামেরায় তোলা ছবির মতো,  about nothing। আপনার মনে পড়ে, apart from the experiences of subjects there is nothing, nothing, nothing and nothingness। অপরাহ্ণ থেকে নির্ঘুম রাত্রি, নির্ঘুম রাত থেকে ধূসর ভোরের দিকে চলে যায় 'লা নত্তে'। যন্ত্রণা, দ্বন্দ্ব, পীড়নের এক দীর্ঘ প্রতিকৃতি।

এরকম প্রচুর ছবি নিয়ে বিচ্ছিন্নতার আলোচনা করা যায়।  

আন্তোনিওনির আরেকটি ছবি 'প্যাসেঞ্জার'। Passenger is a film within a film-এর অন্তর্গত প্রতিবিম্ব । অপরিচিত সব উদ্দেশ্যের সন্ধানে চলেছে লক। একজন মৃত মানুষকে তার নিজের নামটা দিয়ে দেয় লক। যেন সে নিজের সম্পর্কে একটা মৃত-সত্যকে আবিষ্কার করেছে। এক জীবনে নিজেকে দুবার আবিষ্কার করা যায় না‌, প্রথম অস্তিত্ব থেকে নিতে হয় নির্বাসন। দ্বিতীয় অস্তিত্ব খুঁজে বার করা যায়, কিন্তু সেখানেও মুক্তি নেই। কী আর করা যাবে, তাই বিচ্ছিন্ন হতেই হবে। লক যদি রবার্টসন হয়ে যায়, রবার্টসনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন হতেই হবে, লক রবার্টসন হয়েও বাঁচতে পারে না, বিচ্ছিন্নতা এই-ই। আসলে বুর্জোয়া সভ্যতার অন্যতম প্রধান নান্দনিক উপাদান বিচ্ছিন্নতা, বিমূর্তায়ন ও মায়া। ফলে, চলচ্চিত্রে বিচ্ছিন্নতার শুধু মাত্রাগত নয় ঘাতগত গুরুত্বও আছে।

বড়াই!

হংস মধ্যে বক
অমৃতা ঘোষাল

বৃষ্টি। আহঃ। আরাম। আহঃ। ঘুম। আহঃ। মসৃণ নরম বিছানা। আহঃ। ঘরে বসে বেতন। আহঃ। আবাসনের সিকিউরিটি গার্ডের কাশির শব্দ। ঘুম ভেঙ্গে গেল। লোকে কাশে কেন এত রোমান্টিক ঝড়বৃষ্টির রাতে! খোলা জানলার থেকে এক ঝলক বৃষ্টির দমক পায়ে ঠাণ্ডার উষ্ণ স্রোত বইয়ে দিল। বিছানা থেকে উঠে এক পেগ হুইস্কি বানিয়ে জানলায় দাঁড়িয়ে ঝড়-বৃষ্টির চাঞ্চল্য দেখে ভাবলেন, কাল একটা কিছু করতেই হবে। বেশ কিছু দগদগে ফেসবুক পোস্ট করে ইতিমধ্যেই বেশ পপুলার হচ্ছেন। এবার একটু বড় রকমের কিছু চাই। গত দু' মাসের স্যালারি ভালোই জমেছে। ঝড়বৃষ্টি কমলে এবার একটা কিছু করবেনই। হোয়াটস্যাপ খুলেই জাস্ট প্ল্যানিং হয়ে গেল। বান্ধবী আর পাড়ার দুটো গায়ে হাওয়া লাগানো বেকার ছেলে। পরশুই নিজের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়বেন একটু গরিব গরিব এলাকায়। ঝড়ের ঝাপটা বাড়ছে, জানলা বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।

পরশু চাল, ডাল, সয়াবিন, তেল, আলু, বিস্কুট, মাস্ক আর সাবান ইত্যাদি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সকাল সকাল। আর সঙ্গে তো সবচেয়ে অপরিহার্য উপাদান অর্থাৎ আপনার ডিএসএলআর ক্যামেরা রয়েছেই। সঙ্গে মুখে মাস্ক হাতে গ্লাভস পরিহিতা সুন্দরী বান্ধবী, আর ওই পাড়ার লাল্টু পল্টু। স্টিয়ারিং আপনার হাতে। গন্তব্য আপনার ঘরের পরিচারিকা যে জলমগ্ন এলাকায় এখন আছেন, তারই কেন্দ্রে। সেখানে একটু শুকনো জায়গায় থামলেন, কারণ খিচুড়ি রেঁধে দেওয়ারও একটা প্ল্যান আছে। প্যান্ট গুটিয়ে জল পেরিয়ে পরিচারিকার ঘর খুঁজে তার হাতে কিছু টাকা দিয়ে এদিক ওদিক ছবি তুলতে শুরু করলেন। খিচুড়ি রাঁধবে লাল্টুরা। বান্ধবী ব্যস্ত মাস্ক সরিয়ে সেলফি তুলতে। একটু উদাস ভঙ্গিতে দেখলেন একটা কচি বউ খামোকাই আপনাকে দেখে মাথায় ঘোমটা দিয়ে নাক মুখ ঢাকল। এরা মাস্ক ফাস্কের ধার ধারে না। কচি তাই আঁটোসাঁটো বাঁধন। খিচুড়ির গন্ধে মিশেল ঘটল অন্য ধোঁয়ার। দেখলেন অদূরেই বান্ধবী মাস্ক সরিয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে। তার ঠোঁটের ওপর হালকা রোম বুঝিয়ে দিচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার শপিং মলের অভিজাত সালোঁ এখনও খোলেনি। মিশ্র গন্ধ উপভোগ করতে করতে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন আজ রাতটা বান্ধবীর রাজারহাটের ফ্ল্যাটেই কাটাবেন।

লাল্টু খিচুড়ি প্যাক করে বিলিয়ে দিচ্ছে। পল্টু অনেককে চাল, ডাল, তেল, আলু আর সয়াবিনের প্যাকেট ধরিয়ে দিচ্ছে। তবে মাস্ক, সাবান সকলের জন্যে। ছবিগুলো তুললেন অনেক এঙ্গেল থেকে। একটু কায়দা করে তুলতে হবে পঙ্গু বৃদ্ধ আর রোগা শিশুদের ছবি। ভাবলেন ছবিগুলোয় ধূসর রংটাকে একটু ঘষে বেশ একটা সুররিয়াল গন্ধ ছড়িয়ে দেবেন। গ্রে স্কেল পিকচার আপলোড=স্কোপ অফ সফিস্টিকেশনও অর্জন। প্রায় এক লাখি স্যালারি থেকে আপনার খসল আড়াই হাজার, বান্ধবী একটু কম স্যালারি পেলেও পাঁচ হাজার খসিয়েছে। ফেরার সময় ব্ল্যাকে একটা ভদকা কিনলেন। ওটাকে অনেকে দেশি মালের ক্যাটাগরিতেই রাখে। তাই একটু শ্রেণিচ্যুত হলেন। মধ্যরাতে নেশাতুর হয়ে বান্ধবীর নাভির রিংটায় জিভ বোলাতে বোলাতে হঠাৎ আতঙ্কিত হলেন। ধাতুতেও তো করোনার ভাইরাস জেগে থাকে! ব্যাস, বাকিটুকু রূপকথা!

গল্পটার মোদ্দা কথা হল- আত্মরতি। যেভাবেই হোক, নিজেকে মহৎ প্রমাণ করতে হবে। ছবির দৌড়ে নিজেকে সেরা দেখাতেই হবে। তাই কাউকে সাহায্য করারও কিছু একটা ডকুমেন্ট সযত্নে মেলে ধরতে হবে। ছবির সঙ্গে কখনও বা সেঁটে দিতে হবে কোনও বিখ্যাত কবির জ্বালাময়ী পংক্তি। দুটো রসকে একসঙ্গে মেশাতে হবে-- করুণ আর বীভৎস। অন্যের মনে যত 'চুক চুক' আর 'ওরে বাবা' জাগিয়ে তুলতে পারবেন, ততই আপনার সন্তুষ্টি বাড়বে। আবার আপনার কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বীও জুটে যাবে। আয়নার গোলকধাঁধায় ঢুকলে ঠিক যেমন হয়, তেমনটাই ঘটতে থাকবে নিরবচ্ছিন্ন প্রবাহে। তবে এই গোলকধাঁধার দুটো মুখই আটকানো। তাই নিজেকে আপাতত নার্সিসাস ভাবুন। নেমেসিস ঠিক আপনাকে খুঁজে নেবে।

Sunday, 24 May 2020

বই আলোচনা

বর্তমান প্রজন্মের কাছেও অনন্য আকর্ষণ
সঞ্চারী ভাদুড়ী
 
সম্প্রতি অনিন্দ্য ভট্টাচার্যের 'আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি' বইটি পড়ে আমি যারপরনাই বিস্মিত ও অভিভূত হলাম। সুদীর্ঘ কাল ধরে আধুনিক বাংলা গদ্যের, বিশেষত বাংলা প্রবন্ধের ছক ভাঙ্গার এক অনলস প্রচেষ্টা তিনি করে চলেছেন। সেই বিষয়ে তাঁর সাফল্য প্রশ্নাতীত। ইতিপূর্বে তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে 'ইত্যবসরে' পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। তাঁর লেখা যখনই পড়েছি অত্যন্ত সমৃদ্ধ হয়েছি। বাংলা ভাষার আকর্ষণ কতটা বহুমুখী হতে পারে, তা তাঁর স্বাদু গদ্যশৈলীই প্রমাণ করে। সাম্প্রতিক কালের প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আর এক অভিনব সংযোজন হল এই 'আশায় বাঁচে চাষা' বইটি। প্রচলিত কথাকে অপূর্ব প্রতিশব্দে প্রতিস্থাপন করে ঝকঝকে স্মার্ট ও নির্মেদ গদ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আর একটি অসামান্য উপহার দিলেন তিনি আমাদের। বইটি কেন আমাকে বিস্মিত ও অভিভূত করল তা বলি...

যে বিষয়টি তিনি নির্বাচন করেছেন তা অত্যন্ত জটিল অথচ অতি প্রয়োজনীয়। তা নিয়ে বাংলা ভাষায়ও যে এমন চিত্তাকর্ষক, উপাদেয় ও  তথ্যসমৃদ্ধ বই লেখা যায় তা তিনি প্রমাণ করে ছাড়লেন। এর আগে বরেণ্য অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত বা অশোক মিত্ররা বাংলা ভাষায় অর্থনীতির যে অসামান্য লেখনিগুলি আমাদের সামনে রেখে গেছেন, তাঁদের কথা সসম্মানে মনে রেখেই বলছি, দীর্ঘকাল ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলায় আধুনিক প্রজন্মের চাহিদা মিটিয়ে অর্থনীতির দুরূহ বিষয়গুলি নিয়ে এমনভাবে চর্চা বোধহয় এর আগে কেউ করেননি।

অর্থনীতির প্রতিটি কোন্দরে লুকিয়ে থাকা রাজনীতি, সামাজিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তার বিশ্লেষণ, তিনি ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। এমন একটি গুরুগম্ভীর বিষয় লিখতে গিয়ে যে এমন রসিকতাও করা যায় এটাও আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতা। বইটা পড়তে গিয়ে দেখতে পাই একটা চমক ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই আর একটা উপস্থিত, যা কোনও গোয়েন্দা গল্পের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। একুশ শতকের রাজনীতির অর্থনৈতিক বীক্ষণ তিনি যথার্থভাবেই তুলে ধরেছেন।

আরও চমকে উঠলাম এটা দেখে যে, আধুনিক ভার্চুয়াল অর্থনীতির আকাশে কৃত্রিম চাঁদও থাকছে। বর্তমান প্রজন্ম, যাদের মধ্যে সিংহভাগই যারা ভার্চুয়াল পৃথিবীর অধিবাসী, যান্ত্রিক উপায়ে মননচর্চায় আসক্ত এবং বই পড়ায় অনাগ্রহী, তাদের কাছেও বইটি এক অনন্য আকর্ষণ এনে দিয়েছে। তাদের জীবনচর্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত এই বইটি বাংলা বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়াতে কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছে। বাংলা ও বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে এটা বেশ আশার কথা।

ভবিষ্যৎ অর্থনীতির দিশা ঠিক কোন দিকে? এই দিশাহীন যান্ত্রিক ও ভোগসর্বস্ব পৃথিবীর চোখে তিনি আঙ্গুল দিয়ে সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন। চরম পুঁজিবাদের কদর্য কুটিল আবর্তের পাশাপাশি চলতে থাকা মানব কল্যাণী মোহিনী রূপ এবং তারও অন্তরালে লুকিয়ে থাকা যে দূষিতান্তকরণ, তা তিনি অত্যন্ত সুচারু বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন।

এর থেকে উত্তরণের পথের কথাও চমৎকার ভাবে এসেছে বইটির শেষে। সব ইজমের উর্ধ্বে সার কথা হল এই যে, ব্যক্তি মানসের আধ্যাত্মিক ও বৌদ্ধিক স্তরের উত্তরণ ঘটাতে হবে। মনুষ্যত্বের সেই বিকাশ ও উন্মোচনই যুগে যুগে প্রমাণ করে এসেছে যে বহু সহস্রাব্দের বিকশিত পরম্পরায় ও নিরন্তর প্রচেষ্টায়  গড়ে ওঠা মনুষ্য সম্পদ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কোলে বেড়ে ওঠা ভার্চুয়াল অর্থনীতির করাল গ্রাসে এভাবে শেষ হয়ে যেতে পারে না। সে যন্ত্র যতই উন্নত, উচ্চগুণমান সম্পন্ন ও শক্তিশালী হোক না কেন তা মনুষ্য সম্পদ ও মনুষ্যত্বের বিকল্প হতে পারে না। আর এখানেই তিনি  সঠিকভাবে সেই অমোঘ প্রশ্নটি তুলেছেন যে, ঠিক কোথায় ও কেন বারবার আমাদের শ্রীঅরবিন্দ, গান্ধীজী বা কার্ল মার্কসকে ফিরে দেখার ও পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজন আছে।

Friday, 22 May 2020

উমফুন!

বিবর্ধিত ঘূর্ণিঝড়
ইন্দিরা বন্দ্যোপাধ্যায়
সাধারণত গ্রীষ্মে ও শরতের শুরুতে উষ্ণ ক্রান্তীয় সমুদ্রে সৃষ্ট ঘূর্ণাবর্ত স্থলভাগে প্রবেশ করে। সুবিস্তৃত উষ্ণ সমুদ্রপৃষ্ঠে বাষ্পীভবনের ফলে বায়ুতে মুক্ত লীনতাপ ঘূর্ণাবর্তের শক্তি যোগায়। সম্প্রতি 'আমফান' নামক ঘূর্ণিঝড়টিও এমন এক ক্রান্তীয় ঘূর্ণাবর্ত যার উৎপত্তিস্থল বঙ্গোপসাগর।

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, যে মহাসাগরে ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয় তার অববাহিকায় থাকা দেশগুলি আগে থেকেই ঝড়ের নামের তালিকা তৈরি রাখে। সেই অনুযায়ী ২০০৪ সালেই বর্তমানের বিধ্বংসী 'আমফান' ঝড়টির নামকরণ করে থাইল্যান্ড। 'আমফান' শব্দটির অর্থ আকাশ।

কোনও ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ সদা সর্বতো পরিবর্তনশীল হলেও বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট আমফানের গতিপথ এগিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দীঘা, উড়িষ্যার পারাদীপ ও বাংলাদেশের হাতিয়ার দিকে। বুধবার ২০ মে বিকেলের পর থেকে আমফান পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা, হাওড়া, হুগলি এই জেলাগুলিতে তাণ্ডব দেখায়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই এর গতি উত্তরবঙ্গের দিকে এগিয়ে যায়।

প্রতি বছর একটা বা দুটো ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের জন্য কোনও নতুন ঘটনা নয়। কিছুদিন আগেই ফণী, বুলবুল প্রভৃতি ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দেখেছে উপকূলীয় এলাকার মানুষ। তবে আয়লার ভয়ঙ্করতার ছবি ভুলতে না ভুলতেই সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন সন্দেশখালি, হিঙ্গলগঞ্জ, যোগেশগঞ্জের অধিবাসীরা আবার আমফানের করাল রূপ দেখল। এই আমফান স্থলভাগে ১৩০ কিমি বেগে প্রবাহিত হয়ে যাত্রাপথে লণ্ডভণ্ড করেছে জনজীবন। যদিও সতর্কতামূলক প্রচারের জন্য জনগণ যথেষ্ট সচেতন ছিল।

এখন প্রশ্ন তো আসেই, কেন সম্প্রতি ঘন ঘন এমন ঘূর্ণিঝড়ের দাপট। এখানে কাঠগড়ায় অবশ্যই এক শ্রেণির ক্ষমতাশালী মানুষের অবিবেচকতা এবং অপরিমেয় লোভ। তথাকথিত উন্নয়নের জোয়ারে ক্রমশ বেড়েছে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ যার ফলস্বরূপ বিশ্ব উষ্ণায়ন। এই বিশ্ব উষ্ণায়নের জেরেই সমুদ্রের জলতলের উচ্চতা যেমন বাড়ে তেমন বাড়ে জলের উষ্ণতা। ক্রান্তীয় মণ্ডলে সমুদ্রগুলিতে এই উষ্ণ জলই ঘূর্ণাবর্তের ক্ষেত্রে শক্তি যোগায়। তাই জলের তাপমাত্রা যত বেড়েছে তাতে ঘূর্ণাবর্তের কেন্দ্রের গতি কমেছে ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সমুদ্রের উপর অবস্থানে ঘূর্ণাবর্তের নিজস্ব শক্তি ও আর্দ্রতা বেড়েছে যাতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বাড়ে। ফলে, ১৯৭৯ থেকে ২০১৭ এই ৩৯ বছরে ক্রমশ ঘূর্ণিঝড়ের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে ('দ্য গার্ডিয়ান')।

এমনিতেই করোনার প্রকোপ মনুষ্য জীবনের চেনা ছন্দ সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে, তার উপরে আমফানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় অবশ্যই গোদের উপর বিষফোঁড়া হয়ে আমাদের জীবনকে নাস্তানাবুদ করছে নিঃসন্দেহে।

Wednesday, 20 May 2020

দুর্যোগেও যখন অমানবিকতাই প্রকট

কিছু দায় তো আমাদেরও
শতাব্দী দত্ত
কোভিড'এর পরিপ্রেক্ষিতে এই দেশের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা কীভাবে 'শ্রমিক শ্রেণি', অথবা বৃত্তটা আরও বড় করে বললে, সমাজের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া শ্রেণির প্রতি আচরণ করে তা ভেবে দেখার সময় এসেছে। এই প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক কালে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কিছু ঘটনা আমাদের সামনে এসেছে। যেমন, লকডাউন চলাকালীন উপার্জন, পুঁজি, খাদ্য এবং বাসযোগ্য ঘরের অভাবে যখন পরিযায়ী শ্রমিকরা বহু মাইল দূরে নিজের নিজের ঘরে ফিরতে চাইছেন, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তাদের পুলিশের লাঠি, সরকারের অনীহা আর মৃত্যু জুটেছে। কোনও জায়গায় জানা যায়, শ্রমিকরা যখন বাঁচার তাগিদে পথ ধরেছেন রাস্তায়, তাদের পুলিশ দ্বারা নিগৃহীত হতে হয় এবং পরে পণ্য পরিবহনের ট্রাকে বোঝাই করে তোলা হয় তাদের। পণ্যের মতোই তাদেরও নিঃশ্বাসের অধিকার নেই বলে মনে করা হয়েছিল বোধহয়।

এরই পাশাপাশি এমনও ঘটে- যে শ্রমিকরা কোনওমতে নিজের সর্বস্ব আর্থিক সম্বল একত্রিত করে নিজের রাজ্যে ফিরতে গাড়ি ভাড়া করেছিলেন, তাদের লকডাউনের নিয়মরক্ষার অজুহাতে নিঃস্ব অবস্থায় পরিবারসুদ্ধ গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও বা শোনা যায়, শ্রমিকদের ঘরের ফেরার জন্য যে বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়, সেই ব্যবস্থারই অঙ্গ হিসাবে শ্রমিকদের ইংরেজিতে ফর্ম ফিল-আপ করে আনতে বলা হয়। হয়তো সরকারের ধারণা হয়েছিল, ইংরেজি শিক্ষার দায় শ্রমিকদের নিজেদেরই। তেমনই বাড়ি ফেরার হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুর ঘটনার দায় তাঁদের নিজেদেরই বলে মনে করিয়ে দেয় আমাদের দেশের বিচারব্যবস্থা। এরই সাথে, অর্থনীতিকে 'চাঙ্গা' করতে অঙ্গীকারবদ্ধ কিছু রাজ্যের সরকার অস্থায়ীভাবে দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রম আইন রদ করার পথে হেঁটেছে। এতে এটাই মনে হয়েছে যে, সরকারের কাছে শ্রমিকদের সর্বোচ্চ শ্রম সময়ের সীমা, ন্যূনতম মজুরির সীমা এবং আরও কিছু মৌলিক অধিকার রক্ষা দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। বলাই বাহুল্য, এইসব ভিত্তিহীন সরকারি সিদ্ধান্ত মানুষ ও অর্থনীতির মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটিয়ে মানুষকেই হারিয়ে দেয়। ফলত, নাগরিক দ্বারা নির্বাচিত সরকারের দ্বারা নাগরিক তথা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলিও খর্ব হতে থাকে। 

আরেকটু পিছিয়ে এসে কিছু চোখ সওয়া ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক। লকডাউন ঘোষণা করার পর প্রথম দিকের কয়েক দিনে আমাদের অনেকেরই মোবাইল ফোনের পর্দায় অথবা খবরের চ্যানেলগুলোতে দেশের নানা প্রান্তের কিছু ভিডিও ক্লিপ দেখতে পাচ্ছিলাম। কীভাবে নানা প্রান্তের পুলিশ লকডাউন নিয়মভঙ্গকারীদের অভিনব পদ্ধতিতে শাস্তি দিচ্ছে তা আমাদের স্তব্ধ মধ্যবিত্ত দিনযাপনে কৌতুক ও বিনোদনের সাময়িক উৎস হয়ে উঠেছিল। যেমন, কোথাও দেখা গেল কোনও নিয়মভঙ্গকারীকে পুলিশ জনসমক্ষে কান ধরে ওঠবোস করাচ্ছে, কোথাও কোনও একজনকে রাস্তায় হামাগুড়ি দিতে বলা হচ্ছে, আর লাঠিপেটা আজকাল আরও সাধারণ শাস্তির পর্যায় পড়ে। অসম্মানের দ্বারা শাস্তিপ্রাপ্তরা খুব স্বাভাবিকভাবেই দর্শকদের হাসির খোরাক হয়েছিলেন। এখানে নিয়মভঙ্গকারীদের নিয়মের পথে ফেরানোর মহৎ উদ্দেশ্যের পাশাপাশি শাস্তিপ্রাপ্তদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই চোখে পড়েছিল। আর তা হল, অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ব্যক্তিদেরই শাস্তির নিশানা করা। ভিডিও ক্লিপগুলিতে এই শাস্তিদানের সময়ই পাশ দিয়ে চার-চাকা বা দু-চাকায় অন্যান্য ব্যক্তিদেরও যেতে দেখা গেলেও তাঁদের এই অসম্মানের পরিণতি হতে হয়নি। আরও দেখা গেল, কোনও এক জায়গায় পরিযায়ী শ্রমিকের দলকে জীবাণুমুক্ত করার উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাঁদের উপর রাসায়নিক (সোডিয়াম হাইপোক্লোরাইট) স্প্রে করলেন। অথচ, এই তরল মানবদেহের সংস্পর্শে এলে শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ার চরম সম্ভাবনা থাকে। অর্থনৈতিক মাপকাঠিতে উচ্চশ্রেণিকে আর্থিক সৌভাগ্যের কারণে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়নি। নাগরিক বা মানবাধিকার বারবার সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের দ্বারা নির্ধারিত হতে দেখা গেছে, যা কোভিড-১৯ আরও বড় আকারে দৃশ্যমান করেছে।

শুধুমাত্র গত কয়েক সপ্তাহের লকডাউনের সময়ে 'পরিযায়ী শ্রমিক'দের অবস্থান দেখেই এই শ্রেণির আয়তন সম্বন্ধে আমরা ইতিমধ্যেই আংশিক ভাবে হলেও অবহিত হয়েছি। আবার এই শ্রমিকরা সমাজের বৃহত্তর অর্থনৈতিক অনগ্রসর মানুষের অন্যতম অংশ। সুষ্ঠু নাগরিক জীবনধারা বজায় রাখতে অর্থনীতির মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত এই সব মানুষের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। অথচ, অর্থনীতি ও সমাজব্যবস্থায় ভূমিকার দিক থেকে এবং জনসংখ্যার গুরুভাগ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা জাতীয় আয়ের একটি অতি ক্ষুদ্রভাগের অধিকারী। তবু দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় ভোটদানের নিরিখে সমাজের এই অংশই সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তা মাথায় রেখে উপরোক্ত ঘটনাগুলি পরপর সাজালে সমাজের এই অংশের প্রতি সরকারি প্রতিনিধি বা সরকারের যে আচরণগত অসঙ্গতি ও বৈষম্যমূলক চরিত্র প্রকাশ পায় তা সুস্থ গণতন্ত্রের লক্ষণ নয়।

এই সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার অসংখ্য অসুখের সূত্রপাত হয়তো আরও গভীরে যার সংক্রমণ বহুদিন ধরে সমাজ বয়ে চলেছে। গণতান্ত্রিক সরকার কোথাও গিয়ে সমাজেরই প্রতিফলন, তাই, সামাজিক আচরণের প্রতিও সচেতন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এখানে কথ্য ভাষার একটা বড় ভূমিকা। দরিদ্র সমাজের প্রতি সম্বোধনের ভাষা তথাকথিত সম্মাননীয় সমাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় না। সামাজিক মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ভাষায় ঘটে। আবার আশ্চর্য ভাবে, বহু 'শিক্ষিত', 'রুচিশীল' পরিবারে অর্থের বিনিময়ে শ্রম দিতে আসেন যারা তাঁদের খাবার বা জল দেওয়ার ক্ষেত্রে পৃথক পাত্র ব্যবহৃত হতে দেখা যায় অথবা বাড়ির শৌখিন বসার জায়গায় হয়তো তাঁদের বসার অধিকার অনেক সময়েই থাকে না বা তাঁরা নিজেরাও বসতে কুণ্ঠা বোধ করেন। আমরা হয়তো এই কুণ্ঠার কারণ ভেবে দেখি না সব সময়। এমন আরও হাজারও ছোট বড় অসঙ্গতি আমাদের রোজকার জীবনে ঘটে চলে। শ্রম, দক্ষতা বা কর্মের বিনিময়ে উপার্জনের জন্য ধার্য 'সম্মান'এর মাপকাঠি হয়ে ওঠে উপার্জনের পরিমাণ অথবা উপার্জনকারীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান। আচরণগত বৈষম্য দেখা যায় 'উন্নত', 'শিক্ষিত' মানুষের মহানুভবতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও। প্রিয়জনকে উপহার দান, সংগঠনকে অর্থ সাহায্য এবং ভিখারিকে ভিক্ষা দানের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য প্রকটভাবে দেখা যায় প্রায়শই। অথচ, এই তিন ক্ষেত্রেই অর্থের প্রবাহ একতরফা এবং অর্থপ্রদানকারী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছায় হয়ে থাকে। দরিদ্র ব্যক্তিকে অর্থ বা দ্রব্য দানের সময় বহু ক্ষেত্রেই সহমর্মিতার চাইতেও দানের গর্ব, আত্মসন্তোষ এবং প্রদর্শনের মোহ বড় হয়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা তার সম্মানের মৌলিক অধিকার লাভ অথবা তার প্রতি সরকারের দায়বদ্ধতার নির্ধারক হতে পারে না।

তাই, এই কোভিড-পরবর্তী দুনিয়ায় আবারও আমাদের আত্মসমালোচনা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। আমাদের সামনে যে অস্বস্তিকর চিত্রগুলো বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রকট হয়ে উঠেছে, তার দায় সরকার ও প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজ ও ব্যক্তিরও।

Tuesday, 19 May 2020

খোয়াব দেখি অন্তরে

মানুষের ন্যূনতম চাহিদা তো মেটাতে হবে!
অরিন্দম সিংহ
করোনার আবহে  সোশ্যাল মিডিয়া ও অন্যান্য গণ মাধ্যমে অনবরত একটা কথাই বলা হয়ে চলেছে। করোনা অতিক্রান্ত সময়ে পৃথিবীটা এমন থাকবে না, বদলে যাবে আমাদের যাপিত জীবনের দিনলিপি। সামাজিক দূরত্বের স্থায়ী চিহ্ন গেঁথে যাবে আমাদের প্রাত্যহিকতায়। লকডাউনের পরবর্তী সময়ে সমাজ-অর্থনীতির আমূল বদলের সঙ্গে সমঝোতা করে এগোতে হবে আমাদের।

এ বিশ্ব অনেক মহামারী দেখেছে। কিন্তু এমন ত্রস্ত আতঙ্কের সময় বোধহয় দেখেনি। এক অতি ক্ষুদ্র জীবের এমন সর্বাত্মক, সর্বগ্রাসী ধ্বংসাত্মক মারণলীলার কাছে দাম্ভিক মানুষ এমনভাবে কখনও বোধহয় অসহায় আত্মসমর্পণ করেনি। এখানেই এই প্যানডেমিক ইউনিক।

কিন্তু, বদলে যাওয়া জীবনের ছবিটা কীভাবে কল্পনা করা যাবে? অর্থনীতিবিদ থেকে সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই আন্দাজ দেবার চেষ্টা করছেন বটে, কিন্তু এই পুঁজিবাদের চেহারায় তা কেমন বদল হবে তার স্থির চিত্র আঁকা যেমন অসাধ্যপ্রায়, তেমনি কেউ কেউ অত্যন্ত সঠিকভাবেই হয়তো বলার চেষ্টা করছেন ইতিউতি যে, পুঁজির ক্রম সঞ্চারমানতা আর নির্বাধ লাভ আর সীমাহীন লোভ পুঁজিবাদেরই ক্রিয়াশীলতার ধরন-ধারণকেই বদলে নেবে। ডিজিটাল পেপারলেস ইকনমির দিকে আরও বেশি বেশি করে ঝুঁকবে তার আপন অস্তিত্ব ও সঙ্কটকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে।

হয়তো ঠিক। হয়তো কেন, ঠিকই। কিন্তু, বদল কি আসবে সেই ক্ষুৎকাতর, অস্বাস্থ্যে অশিক্ষায় দিন কাটানো হতভাগ্য মানুষদের জীবনে, যেখানে গণতন্ত্র, সাম্য, স্বাধীনতা ইত্যাকার শব্দ দূরতম নক্ষত্রের মতোই অচেনা ও অধরা? প্রতিবেশে গড়ে ওঠা সামাজিক দূরত্বের ধারণা অন্তত তাঁদের জীবনে কোনও নতুন তাৎপর্য নিয়ে হাজির হবে না।

গ্রাম ভারতে, এমনকি এই ‘প্রগতিশীল’ পশ্চিমবঙ্গেও, জাত ব্যবস্থার মধ্যবর্তিতায় সামাজিক দূরত্বের রকমফের এখনও গেঁড়ে বসে আছে। এখনও জাতের নামে বজ্জাতি করে চলা কায়েমী স্বার্থের মানুষরা, যারা বদলে যাওয়া অর্থনীতির ধারক ও বাহক এবং নিশ্চিতরূপেই এর দোসর হবে, তারা জাতব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখে নবায়িত পুঁজিবাদের অস্তিত্বের যাথার্থ্য প্রমাণে সচেষ্ট থাকবে। আদিবাসী জনগণের অরণ্যের অধিকার, আর যা ন্যূনতম অধিকার জীবন ধারণের, তা পরিবর্তিত আর্থ- সামাজিক পরিস্থিতিতে বদলে যাবে- এমন ভাবনা অতি বড় স্বপ্নের সওদাগরও ভাবতে পারবেন না। হ্যাঁ, পরিবেশের অপরিবর্তনযোগ্য ক্ষতি সাধনের পরও। বদলে যাওয়া অর্থনীতির যারা চালক তারাও একদিকে হাই-টেক রোবটিক্স ইকনমিক্সের জয়ডঙ্কা বাজাবেন তুমুল চিৎকারে আর অন্যদিকে হয়তো দলিত মানুষজন প্রান্তিকতা থেকে আরও প্রান্তিকতায় সরে যাবেন। মিলিয়ে যেতে থাকবে তাঁদের কণ্ঠস্বর, যদি বা কখনও ক্কচিৎ ওঠে তা। ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের বাস্তবায়নের পথে তাঁরা হাঁটবেন কি না তা যেমন দেখার তেমনই দেখার প্রাথমিক স্বাস্থ্যে, শিক্ষায় সার্বজনীন অধিকারের প্রতি মনোযোগী হবেন কী না। করোনার আক্রমণ দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের বিব্রতকর অপরিণামদর্শী অপ্রস্তুত ভাব।

রাজনীতিশাস্ত্রে একটা কথা আছে, রাষ্ট্র যতক্ষণ না বৈধতার সঙ্কটের সম্মুখীন হয় ততক্ষণ সে তার বিচিত্র প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দৃশ্য বা অদৃশ্য কার্যাবলী দিয়ে নিজের টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জন করে এবং রেজিলিয়েন্স বাড়াতে সচেষ্ট থাকে। কিন্তু, সত্যিই যদি অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষের মধ্যে সংক্ষোভের সৃষ্টি হয় ক্রমাগত বঞ্চিত হতে হতে, তখন কোন বটিকার উদ্ভাবন করবে এই রাষ্ট্র, সেই দেখার। না, বিপ্লব বা বিদ্রোহ অত্যাসন্ন এমন ভাবালুতার অবকাশ রাখছি না। কিন্তু এই যে পরিবর্তিত অর্থনীতিতে কোটি কোটি মানুষের কাজ হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে তাতে এই বিপুল সংখ্যক নতুন করে কর্মহীন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই বা কোন পথে সামাল দেবে রাষ্ট্র? আকিল বিল্গ্রামীর মতো দার্শনিক করোনা-পূর্ব ভারতের ধর্ম-দ্বন্দ্ব দীর্ণ জীর্ণ শীর্ণ কাপুরুষ সমাজ-দেহ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। বলেছেন, আন্দোলন শূন্যতাই (ওঁর ভাষায়, movement vacuum) এখনকার সমস্যা।

এই ফাঁক পূরণে কারা এগিয়ে আসবে ? সিভিল সোসাইটির কমিটেড মানুষ না মার্কসবাদী বিপ্লবীরা? তরল পরিস্থিতিতে কোনও অনুমানই চলে না। তবুও, লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকেদের, যাঁদের অধিকাংশই  অদক্ষ কিন্তু অপরিহার্য দেশের বিবিধ কর্ম-পরিকল্পনায়, রাষ্ট্রের সীমাহীন ঔদাসীন্য আর অসংবেদনশীলতা কী প্রমাণ করে না যে রাষ্ট্রের কাছে এক গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষ বাতিলের তালিকায়? এ ব্যাপারে মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের ভূমিকা বেশ হতাশাব্যঞ্জক। এমন আশঙ্কা কী খুব অমূলক যে, বদলে যাওয়া সময়ে সমাজ-অর্থনীতিতে এঁদের দুর্দশাই ঘনিয়ে তুলবে না মহা সংকট যা হতে পারে সার্বিক এবং সার্বত্রিক? পরিতাপ এই যে, এই ঘনীভূত সংকটের থেকে জন্ম নেওয়া  অমানবিক সমাজ-রাষ্ট্র ব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের শতধা বিভক্ত হতশ্রী চেহারা পূর্বকথিত আন্দোলন শূন্যতা পুরণে তেমন সক্রিয় ভুমিকা নিতে পারবে বলে আদৌ মনে হয় না। নয়া উদারবাদী ভাবনায়  বেসরকারিকরনের সর্বরোগহর বটিকার কেরামতি স্পষ্টতই বড় প্রশ্নের মুখে। বিশেষ করে, করোনার মোকাবিলা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়ে পড়েছে। জনস্বাস্থ্যকে অবহেলা করে, তার পরিকাঠামো তৈরি না করে, কেবল আয়েসি জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই বেসরকারি হাতে তুলে দেবার পরিকল্পনার মস্ত গলদ আজ দ্গদগে ক্ষতচিহ্নের মতো সকলকে ব্যঙ্গ করছে না? আয়ুষ্মান ভারতের মতো ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্টও যে আদতে বেসরকারি কর্পোরেট স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীদের পকেট ভর্তি করার সুনিপুণ কৌশল, তা আর গোপন নেই। গরিবগুর্বোদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃকপাত পর্যন্ত করার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার বাহাদুর।

করোনার আক্রমণ যে শিক্ষা দিয়ে গেল বা আগামী বছর কয়েক মাঝে মধ্যেই সর্ববিশারদ রাজনীতি কারবারী তথা বেত্তাদের সবক শেখাবে তাতে এখন অন্তত বিশেষজ্ঞরাও নিঃসন্দেহ। এই শিক্ষা কী বদল আনবে স্বাস্থ্যনীতিতে? যে 'বাদ দেওয়া'র খেলা অহরহ চলছে, তাতে রাতারাতি ভোলবদলের কোনও সম্ভাবনা নেই। জনবাদী রাজনীতির ইডিয়মে কিঞ্চিৎ পরিবর্তন যদি বা আসে, পুঁজির লক্ষ্য কিন্তু মুনাফা বাড়ানোর মধ্যেই স্থির থাকার কথা। এর অন্যথা হলে বুঝতে হবে, পুঁজিবাদ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই একটু আধটু কল্যাণমুখী প্রকল্পের দিকে ঝুঁকছে। সাম্প্রতিকে কুড়ি লক্ষ কোটি টাকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করা হল তা দেশের জিডিপি-র ১০ শতাংশ বলে দাবি করা হয়েছে। কম কথা নয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হল যে এই করোনা আবহেও, যেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দৈন্য নগ্ন হয়ে পড়েছে সেখানেও এই ক্ষেত্রে এক পয়সাও বরাদ্দ নেই। যে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পিপিই কেনা হল তার সামান্যতম সদিচ্ছাও এখানে প্রকাশিত হলে সরকারের আন্তরিকতার প্রমাণ আমরা পেতে পারতাম। কিন্তু তা বোধহয় হবারই নয়। জনস্বাস্থ্য সরকারের কাছে কখনই অগ্রাধিকার পায়নি, আগামীতেও পাবে এর কোনও নিশ্চয়তা নেই। অথচ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বেসরকারি অংশগ্রহণ যথেষ্টই বেশি। কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনও হাসপাতালই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামিল হয়নি। সরকার বা রাষ্ট্রও তেমন জোরাজুরি করেনি ওদের যুদ্ধে সামিল হতে।

তাই, বদল যদি সত্যিই দেখতে হয় আমাদের জীবনযাপনের ধরন-ধারণে বা আমাদের প্রাত্যহিকতায়, তবে রাষ্ট্রকে কেবল পুঁজির লালন পালনেই ব্যস্ত থাকলে চলবে না বা কর্পোরেটদের অগ্রাধিকারকেই রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হিসেবে দেখলে চলবে না, অগণিত মানুষের  ন্যূনতম চাহিদার কথাও মাথায় রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, বর্তমান আর্থিক বিপর্যয় সামাল দিতেও চাই এক নীরোগ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী কর্মঠ মানব সম্পদ। কেবল দক্ষ ও অতি দক্ষ শ্রমিক আমাদের মতো অর্থনীতির একমাত্র চালিকাশক্তি হতে পারে না, বিপুল সংখ্যক তথাকথিত অদক্ষ শ্রমিকরাই কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রাণশক্তি। এই সরল সত্য বোঝার জন্য অর্থনীতিবিদ হবার কোনও প্রয়োজন নেই।

Monday, 18 May 2020

থেকে যাবে সংক্রমণের ভয়!

সংক্রমণের ডায়রি
শ্রেয়া ঘোষ


(১)
একটা বন্ধ ঘর ঘরে একজন মানুষ ডাঁই করে রাখা জিনিসপত্র কিছু খাদ্য সামগ্রী বা নিত্য প্রয়োজনীয় সে সব দিকে কিন্তু মন নাই মানুষটির সকাল থেকে বারে বারে বন্ধ জানলার কাচের শার্সি দিয়ে আসা আলো মাপে অন্ধকার হয়ে যায় খিদে পায় যখন, বুঝতে পারে একটা দিন শেষ হল তখনই একটা রঙিন চক খড়ি দিয়ে দেওয়ালে একটা দাগ কাটে চার দিনে চারটে দাগ আর পাঁচ দিনের দিন চারটে দাগের ওপর দিয়ে একটা ঢ্যাড়া এরকম টা হওয়া মানে এক মাস তখন পরের লাইনে চলে যেতে হয় এত কিছুর দরকার হত না ঘড়িটা বিগড়েছিল ব্যাটারি লাগালেই হয়তো চলত অথবা কলকব্জায় কিছু মেরামতি আর করা হল না মোবাইলে সময় দেখা চলত কিন্তু কতদিন? মোবাইলের ব্যাটারিও তো মৃত্যুঞ্জয় নয়

আর চকখড়ি? কটা আছে? গুনতে বসে মানুষটা কাজ পায় চারটে গোটাগুটি আর সাত আটটা ছোট ছোট তারপর? হতে পারে সব কিছু আগের মতো মোবাইল, ঘড়ি আবার সব চলতে শুরু করল কিন্তু নাও হতে পারে সে ক্ষেত্রে বিকল্প কোনও উপায় তৈরি রাখতে হবে পাশের ছোট ঘরটা গুদাম মতো খুঁজলে ওখানে কয়লার টুকরো বা পুরনো মোম রঙের বাক্স পাওয়া যেতে পারে তবে এখনই খুঁজতে শুরু করবে না তার চেয়ে আশাটা জিইয়ে রাখা অধিক জরুরি আর সেই আশাটুকু ধরে রেখে মানুষটা আজ থেকে আর একটা কাজ শুরু করে যাবৎ কাটা দাগগুলো, যারা এখন ছয় সাতটা সমান্তরাল সারিতে বোকার মতো দাঁড়িয়ে, ন্যাড়া ন্যাড়া, তাদের পাশ দিয়ে ত্যারচা দাগ কেটে ডালপালা আঁকে শুকনো ডালে পাতা সাজায়, কুঁড়ি, ফুল তিরিশটা গাছকে ফুলে পাতায় ভরিয়ে বহুদিন পর যেন ক্লান্ত বোধ করে

খেলাটাকে ধরে রাখে পরদিন, তার পর দিনওগাছের তলার সারির দাগগুলোতে জুড়ে দেয় হাত পাএকা মানুষের পাশে ক্রমশ অনেকপোশাক পরায় তাদের কোনওদিনপোশাকের হেরফেরে নারী বা পুরুষমুখে মুখে মাস্কবাচ্চা, বুড়ো, মাঝবয়সিসারি দিয়ে মানুষ বা সাজানো গাছপালা দেখে ওর মনে পড়ে কিছুএকটা ক্লাস ঘরবেঞ্চ, বাচ্চা, ব্ল্যাক বোর্ডচকের স্টিকগুলো কোথা থেকে এল সেই প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে যায় অতঃপরমনে পড়ে যায় সকালের ভাতে ভাত, প্রেসার কুকারের হুইশিলস্নান-খাওয়া, তৈরি হয়ে রিক্সায় স্টেশনভীড়, ভীড়স্কুলের প্রেয়ার লাইনে সারি দেওয়া ঘেঁষাঘেঁষি বাচ্চা ঠেলাঠেলি, চিৎকারমানুষটার আঙুলের ডগা শিরশির করেশীত করেকেন কে জানে চোখ উপচে নোনা জল গড়ায় গাল বেয়েপাগলের মতো গুনতে শুরু করে লাইনের সংখ্যাগুনতে গিয়ে দেখে কতকগুলো মানুষ, ছবির মানুষ কেমন ঝাপসাকাছাকাছি মানুষজনের মাঝে মাঝে ফাঁকখাঁ খাঁ শূন্যতা


()
অনেকদিন পর আলমারি খুলে একটা শাড়ি বের করে ন্যাপথালিনের গন্ধ কড়া হয়ে বসে গেছে শাড়ির ভাঁজে ভাঁজেবাজারের ব্যাগ নেয় হাতে টাকা-পয়সা র‌্যাশন কার্ড, কী ভেবে আরেকটা পরিচয় পত্র উঁচু হিলের চটিটায় পা ঢুকিয়েও সরিয়ে নেয় পা-ঢাকা ওয়াকিং শু-টাই বেছে নেয়আর একটা কিছু... ভুল হচ্ছে  কোথাওবেরিয়ে পড়ে ল্যাচ টেনে দরজা বন্ধ করেই দেখে আর একজন কেউ, ওরই মতো একটা ব্যাগ হাতেমুখে মাস্ক অভ্যেসটা তৈরি হয়নিদোনামোনা করে শেষ অবধি আবার দরজা খুলে ঘরে ঢুকে, আলমারি খুলে এক গোছা মাস্ক থেকে একটা বেছে নেয়হাল্কা নীলটা নিয়েও আবার রেখে দিয়ে কালো কুচকুচেটাই পরে নেয়আয়নার সামনে একটুক্ষণকিন্তু আয়না তো ধরে রাখবে না ওর এই অদ্ভুত ছবিমোবাইলে ক্যামেরা অন করে নিজেই নিজের ছবি তোলেএই প্রথমছবিটা একেবারে পছন্দ হয় না ওরএরকমই কি ? নাকি হাত কেঁপে গেল? শুনশান রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় পথে লোকজন নেইবাড়ি ঘর স্পন্দনহীনজানলা বন্ধ, দরজা বন্ধ বাড়িগুলোও মানুষের মতো একলা আর বিচ্ছিন্ন হওয়ার পাঠ সম্পূর্ণ করেছেগাছগুলো সবুজগত রাতের ঝড়ে গাছ থেকে খসে পড়া আমগুলো থেঁতলে পড়ে আছে মাটিতেএকলা শালিক খুঁটে  খাচ্ছে কিছুওষুধের দোকানের সামনে গোল গোল গণ্ডির একটাতে দাঁড়িয়ে পড়ে ।  দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখেএকজন বেরিয়ে আসে দোকান থেকেচোখাচোখি হয় ওর সঙ্গেলোকটার চোখ কেমন উপোসিওকে দেখে যেন জ্বলে ওঠেফুটপাথের লাইনে তখন একালোকটা দু' পা এগিয়ে থ্যাক করে থুতু ফেলে রাস্তায় ভয় পায়বেশ কিছুদিন পর পুরনো ভয়টা ফিরে আসেলোকটার মুখনিঃসৃত লালারস থেকে কোটি কোটি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে কিছু বলতে চায়চিৎকার করে লোকটাকে সতর্ক করতে চায়অথচ ওর স্বরযন্ত্র বরাবরের মতো অসহযোগিতা করে তাড়াতাড়ি দোকানের মধ্যে ঢুকতে যায়দোকানি হাতের ইশারায় নিষেধ করেনিরুপায় অপেক্ষাকালে আক্রান্ত হয় অচেনা পুরুষের নিক্ষিপ্ত জীবাণু দ্বারা- কোভিড ১৯ বা ত্রাস

()
ওর মন কেমন করছিল ঘরের জন্যওর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল ছোট ঘরটা ছেড়ে যাবার কালেছোট্ট  ঘরটা যে ওর নিজের ছিল না ভুলেই গিয়েছিলসাতাশ বছর ধরে এক কামরায় যাপনছোট, ভীষণ ছোট ছিল ঘরখানাএকটা দেড়া চৌকি, ওপরে পুরনো সুজনিদু' এক জায়গায় তাপ্পি মারাহোটেলের ঘরের বাতিল চাদরতা নিয়ে কোনও মাথাব্যথা ছিল নাসাতাশ বছর আগের সেই লাথি ঝাঁটার দিনগুলো আস্তে আস্তে নেই হয়ে গিয়েছিল এই ঘরটা পেয়েআস্ত ঘরও নয় কিছুরান্নাঘরের এক দিকে দেওয়াল তুলে, স্লাইডিং দরজা লাগিয়ে আলাদা খুপরি একটাতবু  হোটেল শুদ্ধু লোক জানে ওটা মাসির ঘরগাদাগাদি তক্তাপোশ, আলমারি, বাক্স, টেবিল পাখা, কুলুঙ্গিতে ঠাকুরের পট, ক্যালেন্ডারদড়ির আলনায় ঝোলানো শাড়ি, ম্যাক্সি, পেটিকোটআর কী লাগে একটা ঘরকে সম্পূর্ণ করতে?

মার্চের মাঝামাঝি থেকে হোটেল ফাঁকা হতে শুরু করলকাকা, মানে ম্যানেজার বললেন ভালো বুঝছি না মাসিস্বপন, আশিস তর্ক জুড়ে দিলনতুন গেস্ট না এলেই বা নিউ লজের কি? তো আর ভুইঁফোড় উত্তরা কি মেজদির লজের মতো নয়মাসকাবারি পার্মিন লোকেদের ভাড়ার টাকাতেই দু-তিন মাস চলে যাবেগেল না১০৪, ১১৬, ৩১২, ২১০ সব এক এক করে খালি হতে লাগলট্রেন বন্ধ, ফ্লাইট বন্ধওরা বোকার মতো ভেবেছিল আটকে পড়ে যাবে পার্মিন গেস্টগুলো জন, জন করে বারো হাজার-চোদ্দ হাজার টাকায় প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে বাক্স গুছিয়ে চলে গেলমালিকের ফোন এলজ্যোতিষের টোটো ডেকে জিনিসপত্র গুছিয়ে কাকাও শ্রীপুরে ভাগ্নের বাড়ি চলে গেলমালিক এসে চাবি পত্র বুঝে নিয়ে যাবার আগে ওকে বলে গেল, মাসি তোমার ভাতিজির ঘর আছে না করিমগঞ্জওখানেই না হয় একটু ব্যবস্থা করে নাওএক পয়সা ইনকাম নেই, বেতনের টাকা কোথা থেকে দিই বল তোতার ওপর তুমি একা মেয়েছেলেসাবধানে কাটিয়ে দাও কটা দিনকাঁচাকান্তি মা দয়া করলে ফের না হয়.... পরশু আমার কিছু মাল নিয়ে যাচ্ছে একটা গাড়ি ওদিকেপারমিট  করিয়েছিভাগ্নি জামাইকে বলে রেখ মেন বাস স্ট্যাণ্ড থেকে এসে তোমাকে নিয়ে যেতে

দুটো রাত আর ঘুম আসেনি। তার মানে খবরের কাগজের ছবির পরিযায়ী শ্রমিক না কি, তাই ছিল ও? জানতো না তো
স্বপন, আশিস, সিকিওরিটির গোবিন্দ- সকলের মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। 

- আজ তোমারে জবাব দিল, কাল না হলে পরশু আমাদেরও তাড়াবেব্যাগ, বাক্স, প্লাস্টিকের থলি গুছিয়ে নিয়ে ভোর রাত্তিরে ওরা পথে নামলকোথায় যাবে? করিমগঞ্জ, জিরিবামশেষ অবধি কোথাও পৌঁছবে না ওরা
 
দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে  বন্দীদশাআমাদের শ্বাস আটকে আসবেবদ্ধ ঘরে থাকতে থাকতে আমাদের চোখে ছানি পড়বেগায়ে ছত্রাকের বাসা বাতাসশূন্য এক অন্ধ কুঠুরিতে শুধু ভয়টুকু জাপটে ধরে বেঁচে থাকাভয় থেকে অবিশ্বাসঅবিশ্বাস থেকে ঘৃণাআলো আর সহ্য হবে নাআরশোলা বা চামচিকে যেমনআলো থেকে পালিয়ে যাব অন্ধকারেভালোবাসা সহ্য হবে নাপালিয়ে যাব সন্দেহের অন্ধকূপেসংক্রমণ চলে যাবে একদিন। কিন্তু থেকে যাবে সংক্রমণের ভয় বাকি জীবনের ওপর থাবা বসিয়েমুক্তি নেই আর