Pages

Tuesday, 24 October 2017

ডেঙ্গি নেই মানে ডেঙ্গি নেই!!

শতং বদ মা লিখ
অরুণাভ বিশ্বাস


— তাকে তুমি যে নামেই ডাক সে নেই এই বাংলায়। কি নাম তার জানতে চেও না।
— কোথায় থাকতে পারে?
— এই ধর ৩৫°উ অক্ষাংশ থেকে ৩৫°দ অক্ষাংশের মধ‍্যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ফিট উচ্চতার মধ‍্যে।
— আমাদের রাজ‍্যের সবটাই তো প্রায় তাই।
— তো? বলছি না সে নেই। আমি বলছি নেই, মানে সে নেই।
— আরে বাবা, কে সে বলবে তো।
— তার অনেক নাম। দাস ব‍্যবসার রমরমার যুগে সে যখন সুদূর আফ্রিকা থেকে দাসবাহিত হয়ে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে এসে পৌঁছল তখন সেখানকার বাসিন্দারা আফ্রিকার সোয়াহিলি উপজাতির ভাষা ধার করে তার নাম দিয়েছিল ডিঙ্গা (Ka-dinga pepo ~ দুষ্ট আত্মা দ্বারা সৃষ্ট রোগ)। তারপর তো ১৮২৮এর পর থেকে সাহেবদের দেখাদেখি আমরা একে ডেঙ্গু নামে ডাকতে শিখলাম। কিছুদিন হল এটাও জেনে ফেলেছি ঠিক নাম নাকি ডেঙ্গি। ওদিকে আবার সেই ১৭৮০ সালের ফিলাডেলফিয়ার মড়কের উপর ১৭৮৯ সালের এক রিপোর্টে মার্কিন সাহেব Benjamin Rush রসিকতা করে তার নাম রাখলেন হাড়-ভাঙ্গা জ্বর (break-bone fever)। এ নামটা এখনও চলে।
— বাপ্‌ রে, নাম শুনেই ভয় পাচ্ছি, পালাই।
— আরে পালাবে কোথায়? ঐ যে বললাম ৩৫°উ থেকে ৩৫°দ অক্ষাংশের বাইরে পালাতে পারলে যাও।
— কেন বল দেখি?
— আরে এটাও জানো না! সেই ১৯০৫ সালে T L Bancroft প্রমাণ করেছিলেন Aedes aegypti  বা স্ত্রী-এডিশ মশার কামড়ে এই রোগ ছড়ায় আর এই মশা পৃথিবীর মধ‍্যে প্রধানত ক্রান্তীয় বিষুবীয় অঞ্চলেই দেখা যায়।
— যা বলছেন তাতে তো এ রাজ‍্যে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব খুব অস্বাভাবিক কিছু নয়।
— একদম তা নয় হে বাচাল ছোকরা। আমাদের রাজ‍্যে এডিশ মশা নেই কারণ আমাদের রাজ‍্য সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ ফিটের বেশি উঁচুতে হিমালয়ের কোলে ৩৫°উ অক্ষাংশের উত্তরে এবং ৩৫°দ অক্ষাংশের দক্ষিণে অবস্থান করে। তাই ডেঙ্গিটা এ রাজ‍্যে হবেটা কী করে শুনি?
ডেঙ্গির বাহক এডিশ ইজিপ্টাই মশা


এডিশ ইজিপ্টাই মশার পৃথিবী ব‍্যাপী বিচরণ ক্ষেত্র

সুধী পাঠক এতদূর পড়ে নিশ্চয়ই আমার ভূগোলের তথ‍্যজ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। আসলে আপনাদের‌ ঝটকা দেওয়াটা আমার উদ্দেশ‍্য নয়। কিন্তু যখন দেখি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যে অবশ‍্যম্ভাবী সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ‍্য জেনেও রাজ‍্যের স্বাস্থ্য দফতর হাত গুটিয়ে বসেছিল তখন বিশ্বাস করুন নিজের‌ই ঝটকা লেগে যায়। ব‍্যাপারটা তথ‍্য দিয়েই বোঝানো যাক। তথ‍্য নিছক তথ‍্য তো নয়!

গত ২ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জে পি নাড্ডা বিবৃতি দিয়েছিলেন যে ঐদিন পর্যন্ত ২০১৭ সালে সারা দেশে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ‍্যা ১৮৭০০র বেশি, যার মধ‍্যে কেরালা (৯১০৪) তামিলনাড়ু (৪১৭৪) এবং কর্ণাটক (১৯৪৫) শীর্ষ তিনটি রাজ‍্য। অন‍্যদিকে তুলনায় কম আক্রান্ত গুজরাট (৬১৬), অন্ধ্রপ্রদেশ (৬০৬) এবং পশ্চিমবঙ্গ (৪৬৯)। স্বয়ং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর এই বয়ান হয়তো এরাজ‍্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তাদের আত্মতুষ্টি এনে দিয়েছিল এবং তাঁরা ভূগোলের ক্লাস নাইনের জ্ঞান বিস্মৃত হয়েছিলেন। যার নিদারুণ ফল ভুগতে হল এ রাজ‍্যবাসীকে এবং কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সরকারি ওয়েবসাইট ঘোষণা করে বসল ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের ডেঙ্গি আক্রান্তের মোট সংখ‍্যার বিচারে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সারিতেই অবস্থান করছে -- মোট ২৭৮৭৯ জন রুগীর ৫৬৩৯ জন‌ই এরাজ‍্যের। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, এই দুই মাসের মধ‍্যেই এ রাজ‍্যে এমন কী ঘটে গেল যে পরিসংখ্যানের এই লাফ। একটু ঠাহর করলেই বোঝা যাবে জুলাইয়ের একেবারে শুরুতেই যে পরিসংখ‍্যান দেখানো হয়েছিল তখন যে রাজ‍্যগুলি ডেঙ্গিতে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল (কেরালা তামিলনাড়ু কর্ণাটক) সে সব রাজ‍্যে দঃ-পঃ মৌসুমী বায়ু আগে সক্রিয় হয় এবং বর্ষা আগে আসে। তাই ঐ রাজ‍্যগুলিতে ডেঙ্গির প্রকোপ আগে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরে দঃ-পঃ মৌসুমী বায়ু এ রাজ‍্যেও সক্রিয় হলে এখানেও ডেঙ্গির বাড়াবাড়ি হয়েছে। কিন্তু ভূগোলের এই সামান‍্য জ্ঞান যখন জানাই ছিল তাহলে প্রশ্ন উঠবে প্রধানত মরসুমী এই রোগ ঠেকাতে রাজ‍্যের পুরসভাগুলি ও জনস্বাস্থ‍্য দফতর আগাম সাবধানতা নেয়নি কেন? জনস্বাস্থ্য ক্ষেত্রে এই আগাম সাবধানতা এবং সেই সাথে আক্রান্ত রুগীর চিকিৎসা নিয়ে কোনো রকম আগাম চিন্তাভাবনা বা পরিকাঠামো নির্মাণ কোনোটাতেই যে রাজ‍্য সরকার আগ্ৰহ দেখায়নি সেই অভিযোগ সহজে এড়ানোর উপায় নেই। কারণ আবার সেই পরিসংখ‍্যান। পূর্বোক্ত ঐ ওয়েবসাইটটিতে আর‌ও একটি তথ‍্য দেওয়া হয়েছিল। গত ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত এই বছরে এদেশে ডেঙ্গিতে মৃত ৬০ জনের মধ‍্যে এ রাজ‍্যর‌ই ২৩ জন এবং তা ভারতের সবকটি রাজ‍্যের মধ‍্যে সর্বাধিক। অন‍্যদিকে ঐ এক‌ই সময়ে কেরালা ও ওড়িশায় মৃতের সংখ‍্যা মাত্র ৯ করে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ডেঙ্গি মোকাবিলায় এ রাজ‍্যের আম‌ও গেছে ছালাও গেছে। যে পশ্চিমবঙ্গ জুলাইয়ের শুরুতে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ‍্যার বিচারে কেরালার ১৯গুণের‌ও কম ছিল, সেই পশ্চিমবঙ্গ‌ই দুমাসের মাথায় শুধু ডেঙ্গিতে আক্রান্তের বিচারে প্রথম সারিতেই নয় মৃতের বিচারেও কেরালার সাড়ে ৬ গুণ এগিয়ে দেশের মধ‍্যে সেরা হয়ে বসে আছে। জুলাইয়ের শুরুতে আক্রান্তের বিচারে প্রথমে থেকেও কেরালা আগস্টের শেষে মৃত‍্যুহারকে কমাতে পেরেছে। পশ্চিমবঙ্গ কোনোটাই কমাতে পারে নি। অথচ এই দুমাসে কেরালায় কম বৃষ্টিপাত হয়েছে বা চারিদিকে কম জল জমা হয়েছে এমন তো আর নয়! অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মশা নিধন ও নিকাশি সংস্কার করে রোগের প্রকোপ কমানো এবং চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে আক্রান্ত রুগীর মৃত‍্যুহারকে কমানো কোনোটাই এ রাজ‍্যের সরকার সময়মতো যে করে উঠতে পারেনি তা বেআব্রু হয়ে গেছে। এমনকি যেহেতু মহামারীর আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবকে সরকার স্বীকার করে নেয়নি সেহেতু ডেঙ্গি প্রতিরোধে সচেতনতা প্রসারের কাজ‌ও এ রাজ‍্যে বিশেষ চোখে পড়ছে না। তাই সরকারি অবহেলার সাথে জনসাধারণ ইচ্ছামতো ওষুধ কিনে খেয়ে, পুরোপুরি সুস্থ হ‌ওয়ার আগে কাজে বেরিয়ে এবং জমা জল রোধে নাগরিক কর্তব‍্য সম্পর্কে পুরোপুরি বিস্মৃত হয়ে পরিস্থিতি আর‌ও জটিল করে তুলছে। কিন্তু তাতে কী? ডেঙ্গি রুগীর বা ডেঙ্গিতে মৃতের ক্রমবর্ধমান সংখ‍্যা নিয়ন্ত্রণ করার অন‍্য উপায় রাজ‍্য সরকারের জানা আছে।

উপায়টি খুবই সহজ — যাকে বলে আক্ষরিক অর্থে সংখ‍্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা। অত‌এব যত পার ডেঙ্গির প্রকোপ কম করে দেখাও। তাই প্রবীণ চিকিৎসকদের অনেকের‌ই অভিযোগ বেসরকারি প‍্যাথোলজিকাল ল‍্যাবরেটরিগুলিকে ভয় দেখানো হচ্ছে মেডিকেল রিপোর্টে যাতে ডেঙ্গি না লেখে, ডাক্তাররাও ডেথ সার্টিফিকেটে ডেঙ্গি লিখতে ভয় পাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের বাঁচার উপায় হল FUO — এটি কল্পবিজ্ঞানের UFO (unidentified flying object) বা উড়ন্ত চাকীর অক্ষর বিভ্রাট নয়। এটি হল Fever of Unknown Origin যাতে আক্রান্ত একজন রুগী হলেন UFU (Unidentified Fever Unit)। এই FUO হল আমাদের বহু দিনের চেনা 'অজানা জ্বর'। কত চেনা অথচ নামেই অজানা! ১৯৬১ সালে Petersdorf এবং Beeson প্রবর্তিত এই পরিভাষাটিকে এ রাজ‍্যের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন স্বাস্থ্য অধিকর্তারা অধস্তন ডাক্তারদের সেই বাম আমল থেকেই পাখি পড়ানো মতো আয়ত্ত করিয়ে আসছেন। কিন্তু হায়, পরিবর্তনের পরেও সেই ট্র‍্যাডিশন আজ‌ও চলছে! ইদানিং আবার FUO না লিখে গালভরা মেডিকেল টার্ম লেখার চল হয়েছে। কিছু তো পরিবর্তন হল! কাজেই সংবাদপত্রের পাতায় অনেক কিছুই পড়া গেলেও, শোকার্ত বাবা-মার হাহাকার শুনতে পেলেও, অসহায় ডাক্তারদের আফশোস দেখলেও, হে সুধী পাঠক, শতং বদ ডেঙ্গি মা লিখ। লিখলেই তা পরিসংখ‍্যান। আর ডেঙ্গির পরিসংখ‍্যান এ রাজ‍্যে ৩১শে আগস্টের ঐ টনক নড়ানো পরিসংখ্যানের পর থেকে কার্যত নিষিদ্ধ। তাই নিষিদ্ধ ব‍্যাপারে আমি আর কথা বাড়ালাম না। গদ‍্যকারের যদি দশ পাতা লাগে, পদ‍্যকারের লাগে দশ লাইন — এই আপ্তবাক‍্য মাথায় করে ডাক্তার তীর্থঙ্কর ভট্টাচার্যের অনবদ‍্য ছড়াটি তুলে দিয়ে ক্ষান্ত হলাম।


।ডে...।

অজানা রোগে ভুগছে শহর, গঞ্জ গাঁ ও পরগণা,
হাসপাতালে বেড়েছে ভিড় না হোক ধরো চারগুনা।
টেস্ট করালেই ডাক্তারেরা চমকে বলেন ‘পজিটিভ!’
কোন সে রোগের প্রশ্ন হলেই মাথা নাড়েন, কাটেন জিভ।
চেপে ধরলে চাপা গলায় বলেন ‘সওয়াল নোকরি কা,
নাম বলাতে বারন আছে, দোহাই অনুচক্রিকার।
বরঞ্চ নিন রিকুইজিশান, ব্লাড ব্যাঙ্কে যান ছুটে,
রোগ গিয়েছে অনেক গভীর, টান পড়েছে প্লেটলেটে।'
চমকে বলি 'ওমা সেকি, তার মানে তো এটাই ডে...।'
অমনি শুনি ধমক আসে, ‘অ্যাই ব্যাটা তুই বলার কে?’
ঘুরেই দেখি দাঁড়িয়ে আছেন পাড়ার কিছু বোম্বেটে
(তফাত এঁরা করতে পারেন প্লেটলেটে আর কাটলেটে)
আমার কাছে এসে বলেন '‘ডে’ বলেছিস ওটাই ব্যাস।
আগ বাড়িয়ে ধরে নেওয়া , বড্ড তোদের বদভ্যাস!
পজিটিভ তো কি হয়েছে, ওটা হলেই সব নাকি?
এসব শুধু ল্যাবরটারির মিথ্যে কথা আর ফাঁকি।
‘ডে’ দিয়ে শুরু কোনো অসুখ নিষিদ্ধ এই রাজ্যতে,
এত করে বোঝাই তোদের, আনিস না তা গ্রাহ্যতে!'
আমি বলি করজোরে , ‘এসব জটিল ডাক্তারি,
আপনারা কোন কেতাব পড়ে পেলেন এত খোঁজ তারই?’
বোম্বেটেরা ধমকে বলেন ‘ডাক্তারি আর জটিল কই?
সাতখানা দিন সময় দিলে ইচ্ছে যেটা তা শিখবই।
প্লেটলেট তোর যতই লাগুক , পজিটিভ হোক আই জি এম,
নামটি বলার করবে সাহস নেই রে কারো সে এলেম।’
আমি বলি ‘শিক্ষে পেলেম, এবার করুন অনুমতি,
প্রিয়জনের হালত খারাপ, ব্যাঙ্কে ছুটি দ্রুতগতি।’
ওরা বলেন , ‘যা ছোট গিয়ে , একটা কথাই মাথায় রেখে,
জ্বরজ্বালাতে এ রাজ্যতে ভুলেও যেন বলিস না ‘ডে...' !’

আর্যতীর্থ