লিটল ম্যাগাজিনের চলার পথ নিরন্তর
প্রেমাংশু দাশগুপ্ত
লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজিত ‘লিটল ম্যাগাজিনের আজ কাল’ আলোচনাসভার প্রাণের উত্তাপকে নিরন্তর প্রবল বর্ষাও চুপসে দিতে পারেনি। বেশ কিছু উৎসাহী মানুষের অংশগ্রহণে এবং তাঁদের মূল্যবান মতামতে সভাটা হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়। কেউ বললেন, কর্পোরেট দুনিয়া যখন নিজেদের স্বার্থে অত্যুৎসাহে সাহিত্য সংস্কৃতির ঠিকেদারি নিয়ে ফেলেছে, লিটল ম্যাগাজিন তখন নিজস্ব লড়াইটা জারি রেখেছে কেবলমাত্র প্রাণশক্তিকে সম্বল করে। কর্পোরেট দ্বারা প্রকাশিত পত্র পত্রিকার পিছনে যেমন রয়েছে বিপুল অর্থ তেমনি আছে অগণ্য লেখক এবং পাঠক। আর আছে নির্দিষ্ট একটা দর্শন ও মতবাদ। কর্পোরেটের দেখানো দুনিয়াটার বাইরে অন্য যে আরও একটা জগৎ আছে তারই কথা ক্রমাগত বলে চলেছে লিটল ম্যাগাজিন। কিন্তু বৃত্ত তার পরিসীমিত। লিটল ম্যাগাজিনের কণ্ঠস্বরকে তাই আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে আর একজন বললেন, কলকাতা শহরের বাইরে হয়তো তাঁদের পত্রিকার প্রচার আগের থেকে কিছু কমেছে কিন্তু এখনও তাঁদের ম্যাগাজিন বিক্রির প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি হয় সেখানেই। তাঁর মতে, সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তিই যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণভোমরা তাই ম্যাগাজিনগুলিকে আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে সাংগঠনিক ভাবে। তবেই সম্ভব তার প্রচারকে বাড়ানো। এই কথাতেই উঠে এল এক প্রশ্ন- তাহলে কি সমাজে নতুন চিন্তার চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিজের নিয়মেই নিজেই গড়ে উঠতে পারে না? এই কথা বেয়েই সবাই প্রায় সহমত হলেন, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরস্পরের পরিপূরক মাত্র।
সভায় বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি কম থাকায় এই আশঙ্কাও
কেউ প্রকাশ করলেন, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে
লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আগ্রহ সম্ভবত কম। কিন্তু বিপরীত মত প্রকাশ করে একজন বলেন, ব্যাপারটা
এতটা হতাশাজনক
নয়। তিনি কিন্তু বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অল্পবয়সীদের যথেষ্ট সংখ্যায়
দেখেছেন। তাঁর মতে পাঠক আছেন, কিন্তু আমরা তাঁদের কাছে
পৌঁছতে পারছি না। এর পরে তাই যথারীতি সামনে এসে গেল বিপণন নিয়ে
ম্যাগাজিনগুলির সমস্যার কথা। প্রস্তাব এল, পরে শুধুমাত্র বিপণন নিয়ে আমরা
একদিন আলোচনা করতে পারি। কেউ বললেন, পুঁজির বিরুদ্ধে কথা শুধু নয়, পাল্টা কাজও
আমাদের মতো করে করতে হবে স্কুলে কলেজে প্রচারের মাধ্যমে। সেখানে আমরা লিটল
ম্যাগাজিন নিয়ে পৌঁছে যেতে পারি। কৃষক সমাজের কাছেও পারলে আমাদের যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের
বাইরে এবং বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের চাহিদা কিন্তু আছে বলে মনে করেন অনেকে।
তাঁদের কাছে পত্রিকা নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হবে।
রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসাটাও ছিল এই আলোচনায় অবশ্যম্ভাবী।
ভোগবাদের বিপুল প্রচারের আয়োজন যে হয়ে চলেছে আমাদের চারপাশে তার মোকাবিলার জন্য
আধুনিক প্রযুক্তিকেও সফল ভাবে ব্যবহার করতে হবে, যেমনটা হয়েছে
আধুনিক বিশ্বে সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করাও
একটা আন্দোলন, এটা সভার সবাই মনে করেন। তাই আন্দোলনের প্রচলিত হাতিয়ারগুলিকেও
আমাদের প্রয়োগ করতে হবে। কেউ কেউ বলেন, কর্পোরেট
দুনিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বা মাদারা টেরেসার সংস্থাকে অর্থ দান করে, যারা কিছু
সামাজিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক চিন্তার বিপরীত কিছুকে সে
অস্বীকারই শুধু করে না, তাকে সবরকম ভাবে
নিরুৎসাহিত করে। সভায় উপস্থিত দুজন তাদের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে জানালেন,
রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করা লিটল ম্যাগাজিনগুলির সঙ্গে সমস্ত রকম সম্পর্ক ছেদের
শর্তে কেমন ভাবে কর্পোরেট জগৎ তাঁদের টোপ দিয়েছিল
উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের। লড়াইটা তাই সহজ নয়। কিন্ত অসম্ভবও নয়। অপ্রথাগত বিষয় নিয়ে
চিন্তাভাবনা করা পত্রিকা বা লেখকদের নিয়ে ছুৎমার্গ এখনকার
মতো আগেও ছিল। কিন্তু তা অন্য ধারার লেখক বা পত্রিকা কোনটারই চলার পথকে বন্ধ করতে
পারেনি। ইতিহাসের এই ধারাকে মেনেই লিটল ম্যাগাজিন এগিয়ে চলবে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ
আর সংগ্রামে একাত্মতা। এরই প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেওয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হল ২৫শে জুলাই’এর দুই ঘণ্টা
ব্যাপী কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মোড়ে ঘোষ কেবিনের
উপরের ঘরের আলোচনা।